স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৩৩

0
812

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৩৩

নিমিষেই মুখটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো পায়রার।
অভিমানী গলায় বললো –

‘সুন্দর সাহেব! ‘

নীলাংশ ফিক করে হেঁসে ফেললো। যেতে যেতে অন্য রকম বললো-

‘তুমি সবার কাছে অনেক বড় হলেও, আমার কাছে আমার পিচ্চিই থাকবে। একমাত্র আদুরে পিচ্চি। ‘

_________________

ফিল্টারের বাটন চাপতেই গড়গড় করে পানি নেমে আসলো। অর্ধেক গ্লাস ভর্তি হতেই বাটন অফ করে ঝুঁকে পানিটা হাতে নিয়ে পান করলো পায়রা। বাসায় এখন তেমন কেউ নেই। ছোট চাচী তো বেশির ভাগ সময় ঘরেই বিশ্রাম করেন। রায়ানা মাঝে মাঝে বই পড়ে আর মোবাইল চালিয়ে সময় কাটায়। তানজিমা
নিজের এক বান্ধবীর বাড়িতে গিয়েছে বিকেলের দিকে
। রাত হওয়ার আগে আর আসবে না। অপূর্ব কোচিং-
এ গেছে। আসতে এক দেড় ঘন্টা লাগবে। আয়মান সাহেব তো হসপিটালেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটান। রোগী নিয়েই তাঁর দিনরাত্রী পার হয়ে যায়।
নীলাংশ ভার্সিটির কিছু কাজে এক টিচারের সঙ্গে কথা বলতে গেছে। এখন বাজে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। বলতে গেলে পায়রা একাই। পানি পান করে মুখ মুছে নিজের ঘরে যেতে উদ্যত হলো, সেসময় কলিং বেল বাজালো।
পায়রা ভাবলো হয়তো নীলাংশ এসেছে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো প্রসন্ন লাজুক হাসি। হাতের মুঠোয় ওড়নার কোণাটা চেপে ধরে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো সে। দরজা খুলতেই বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেলো।
একটি যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পায়রা অবশ্য চেনে মেয়েটাকে। চার তলায় থাকে মেয়েটা। নাম আশরীন।
বয়স আঠারো উনিশ হবে। পায়রার খুব বেশি বড় না।
কয়দিন আগেই রায়ানার সাথে দেখা করতে এসেছিলো। কথা সেটা নয়, মেয়েটা একটু বেশি কথা বলে। কারো সাথে মিশতে বেশিক্ষণ সময় লাগেনা। এক্ষেত্রে পায়রা ব্যাতিক্রম। সেও চঞ্চল, মিশুক কিন্তু হঠাৎ করেই অপরিচিত কারো সাথে নয়। প্রথমে মানুষের ব্যবহার পরখ করে নেয়। তারপর যদি মনে হয় ভালো তবেই সে কথাবার্তা চালিয়ে যায়।

পায়রা বিস্ময় সামলে সামান্য হাসলো। চোখের ইশারায় ভেতরে আসতে বললো। মেয়েটা হাসিমুখেই আসলো। দুম করে সোফায় বসলো আবার দুম করে দাঁড়িয়ে গেলো। পায়রা দরজা লাগিয়ে হা করে তাকিয়ে কান্ডকারখানা দেখছে। মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেনো! পায়রা কাছে এসে বললো-

‘কী হয়েছে আপু? ‘

আশরীন এদিক সেদিক তাকাতাকি করে চটপটে গলায় বললো –

‘বাসায় কেউ নেই? ‘

‘আছে, ছোট চাচী ঘরে ঘুমাচ্ছে। রায়াবু তাঁর কোনো এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে। ‘

‘ওহ আচ্ছা৷ ‘

পায়রা স্মিত হেঁসে পাশে বসলো। বয়সে সে নিজে ছোট হলেও মেয়েটাকে তাঁর ছোট মনে হচ্ছে। সবাই তো আর তাঁর মতো কম বয়সেই মা বাবা থেকে আলাদা হয়ে যায় না তাই হয়ত বড় হয়েও আহ্লাদী ভাবটা রয়ে গেছে। হাসে পায়রা আপনমনে। মনে মনে দোয়া করে ‘আমার মতো কারো জীবন থেকে রঙ হারিয়ে না যাক। ‘ আশরীন হঠাৎ বললো-

‘তুমি এমন কেনো বলো তো?আমি মেহমান হয়ে তোমাদের বাসায় আসলাম, তুমি এক কাপ কফির অফারও করলে না!’

পায়রা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলো। আশরীন জানেনা
যে পায়রা এই বাড়ির মেয়ে না। সেদিন রায়ানা তাকে
আশরীনের সামনে কাজিন বলে পরিচয় দিয়েছে। সাথে এটাও বলেছে যে পায়রা পড়াশোনা করার জন্য এখানে চলে এসেছে। নাহলে, অন্য কিছু বললে হয়তো সন্দেহ করতো। পায়রা এই বাড়ির সদস্যগুলোকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু এ বাড়ির সবাই তো আর তাঁকে ভালোবাসে না, যেমন তানজিমা। তিনি পায়রাকে বলে দিয়েছেন যেনো রান্নাঘরে না যায়। তানজিমা বাড়ি না থাকলে আগ বাড়িয়ে পাকনামিও না করে। পায়রা তাই কিছু রান্না করলেও রূপসাকে অথবা বড় কারো অনুমতি নিয়ে নেয়। এখন যেহেতু তানজিমা নেই তাই কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রান্নাঘরে যেতে নেয়৷ আশরীন তৎক্ষনাৎ বলে-

‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?রাগ করলে নাকি?আমি মজা করছিলাম। ‘

‘একদম না আপু, সত্যিই তুমি এলে আর আমি কিছু দিচ্ছি না খারাপ দেখায়। তুমি বসো আমি দুই কাপ কফি বানিয়ে আনছি। ‘

‘তাহলে, আমি একটু ঘুরে আসি। ‘

পায়রা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকালো। আশরীন থতমত খেয়ে গেলো যেনো। হাসার চেষ্টা করে বললো –

‘মানে, তুমি তো রান্নাঘরে যাচ্ছো আমি বোর হয়ে যাবো
তাই ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করি বরং। ‘

পায়রা মাথা ঝাকিয়ে বললো-

‘ঠিক আছে আপু। ‘

কফি বানানো শেষ হতেই কাপে ঢেলে টেবিলে রাখলো পায়রা। ভাবলো আশরীনকে ডেকে নিয়ে আসবে। কিন্তু তাঁর আগেই আশরীন এদিকে এসে পড়লো। পায়রা কফির কাপটা দিতেই আশরীন বললো-

‘পায়রা, আমার না শরীর খারাপ লাগছে। কফি খেলে মনে হয় আরও খারাপ লাগবে। আমি যাই হ্যা?তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না। কষ্ট করে কফি বানালে আমি খেতে পারলাম না। আরেক দিন এসে খাবো। তুমি আমার বাসায় যেও৷ ‘

এক নিঃশ্বাসে কথা বলেই দ্রুত পদে বেরিয়ে গেলো আশরীন ৷ যেমন ঝড়ের বেগে আসলো তেমন ভাবেই বের হলো। মাঝখানে পায়রা হতবাক হয়ে রয়ে গেলো।
কফির কাপটা রেখে একবার নিজের ঘরের দিকে তাকালো। দরজাটা চাপানো ছিলো। এখন একদম খুলে দেওয়া। তাহলে কী আশরীন তার ঘরে গেছিলো?
কিন্তু কেনো?

___________________

ঢুলুঢুলু হয়ে উচ্চস্বরে পড়ছে পায়রা। মাঝে মাঝে নীলাংশকে বিরবির করে বকছে। দশটা থেকে তার সামনে বসে একমনে পড়াচ্ছে। এখন বাজে একটা দশ।
এতক্ষণ কোনো মানুষ পড়ায়! সুন্দর সাহেবের মাথার সবগুলো তার ছিঁড়ে গেছে। পড়তে পড়তে নিজে পাগল হয়েছে। এখন তাঁর পিছে লেগেছে কোমর বেঁধে। হায়রে কপাল, অনেক শখ ছিলো না? নীলাংশকে মন ভরে দেখবে। আহা! জন্মের স্বাদ ঘুচিয়ে দিয়েছে নীলাংশ। বসে বসে আরামসে পড়তে পড়তে নীলাংশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। নীলাংশ দুই তিন বার গম্ভীর কন্ঠে বলেছে-

‘বইয়ে মনোযোগ দাও পিচ্চি। ‘

পায়রা লজ্জা পেয়ে ঠিকই সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের পাতায় তাকাতো। কিন্তু আবারও বই থেকে নীলাংশকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে একধ্যাণে তাকিয়ে থাকে। তাই নীলাংশ কিছুক্ষণ পরই তাঁকে বলে দিয়েছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে৷ এবারও যদি মনোযোগ না দেয় তাহলে বেত নিয়ে আসবে। পায়রা পড়ছে কম বকছে বেশি। ঐ যে, আপনজনদের সঙ্গে পায়রা প্রচুর খোলা। তাঁর চঞ্চলতা এদেরকেই দেখায়। ঘড়ির কাটা দুইয়ের কোঠায় পৌঁছাতেই ঢংঢং আওয়াজ করে জানান দিলো রাত অনেক হচ্ছে। পায়রা আর পারলো চোখ খোলা রাখতে। ক্লান্ত শরীরে ফ্লোরের কারপেটেই শুয়ে পড়লো। হাই তুলে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো-

‘সুন্দর সাহেব, আজ আর না! আমি ঘুমা…’

ঘুমের রেশ এতোই যে সম্পূর্ণ কথাটি শেষ হওয়ার আগেই তা নিদ্রাদেশে তলিয়ে গেলো। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নীলাংশ উঠে দাঁড়ালো। একদমই বিনা দ্বিধায় দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে নিলো তুলোর মতো নরম দেহ। পায়রা ঘুমের ঘোরেই মাথাটা গুঁজে রাখলো বুকে। নীলাংশ নিঃশব্দে হেঁটে পায়রার রুমের বিছানায় শুইয়ে দিলো। এলোমেলো চুল গুছিয়ে গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে দিয়ে ভীষণ যত্নে ব্ল্যাঙ্কেটটা গায়ে টেনে দিলো ৷ উজ্জ্বল ল্যাম্প দুটো নিভিয়ে ড্রিম লাইট অন করে দিলো। সবশেষে হাঁটু মুড়ে বসে পায়রার দুই ভ্রুর মাঝে ছোট চুমু এঁকে দিয়ে হাতটা মুঠোয় নিয়ে নিজের গালে চেপে বললো-

‘আমার একটা তুমির খুব প্রয়োজন পিচ্চি। দ্রুত বড় হয়ে যাও। তোমার সুন্দর সাহেব তাঁর পিচ্চির জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে থাকবে। ‘

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here