“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৪০
বিছানা দাপিয়ে মেয়েটা হুপরে পড়ে কাঁদল। ক্ষণকাল নিজের মাথার চুল নিজেই ছিড়লো। বুক চাপাড়ালো।
হৃদয়ের লাল রক্তক্ষরণে পাগলের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। ফ্লোরেই! চেয়ার টেনে বসার শক্তি কোথায়!
শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সীমানাহীন আকাশটার দিকে। আকাশ জুড়ে কত সুন্দর মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে!
রঙ বেরঙের। তাঁর জীবনটা ধীরে ধীরে এমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে কেনো? জীবনের কোনো চাওয়া পাওয়াই কেনো যেনো তাঁর পূর্ণতা পায়না। মাঝে মাঝে মনে হয়
সে যদি নির্মল শান্ত নদীকেও চায়, তাহলে তাও উত্তাল হয়ে তাঁর উপর আছড়ে পড়বে। তীব্র প্রবল স্রোতের সঙ্গে মিশে অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। আর কত নাটক করে যাওয়া সম্ভব!
‘আশরীন,এই আশরীন খেতে আয়।’
ডাইনিং রুম থেকে মায়ের জোড়ালো কন্ঠ শুনতে পেয়ে চোখ মুখ মুছে আয়নার সামনে দাঁড়ালো আশরীন। চোখ ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। মায়ের সামনে দাঁড়ালেই সব বুঝে যাবে। বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে নিলো। চুল রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেণীগাঁথন করে বের হলো। মুখে বিরাট হাসি। এই হাসি দিয়েই তো সবার চোখকে বোকা বানায় সে। নিজেকে লুকিয়ে রাখার এ যে এক বিরাট অস্ত্র। যে কেউ তাকে দেখলে ভাবে, আহা!মেয়েটা কত সুখী। কিন্তু আসলেই কী সে সুখী? এক গাল হাসির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা এক সিন্ধু বিষাদ কেউ কী দেখতে পায়? ডাইনিং টেবিলে বাবা বসে পেপার পড়ছেন। মা কোমড়ে আঁচল গুঁজে মেলামাইনের প্লেটে ভাত বাড়ছেন। হাসিফুটিয়েই বসলো আশরীন। মা, সোহানা রহমান মেয়েকে প্লেট এগিয়ে দিতেই আঁতকে উঠলেন। মেয়ের মুখটা উঁচু করে বললেন –
‘তোর চোখ এমন রক্তলাল বর্ণ হয়েছে কেনো আশু?’
আশরীন মনে মনে ঘাবড়ে গেলেও বাহিরে যথাসম্ভব স্থির হয়ে বললো-
‘গোসলের সময় শ্যাম্পু চোখে চলে গিয়েছিলো তো তাই। ‘
‘আহা!দেখেশুনে দিতে পারিসনা!’
‘খেয়াল করিনি মামণী। ‘
‘আচ্ছা খেয়ে নে। ‘
ভাত মাখাতে মাখাতে আশরীন বললো-
‘মামণী.. ‘
স্বরটা খুব করুণ শোনালো। সোহানা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
‘কী হয়েছে মা? ‘
‘আজ একটু বড় কবরস্থানটায় নিয়ে চলো না! ‘
আশরীনের বাবা নিউজপেপারটা পাশে রেখে বললেন -‘ভাত খেয়ে নে, নিয়ে যাবো৷ ‘
থেমে বললেন-‘ মায়ের কথা মনে পড়ছে?’
আশরীন ঘোলা চোখে মাথা নাড়লো। কয়েক লোকমা কোনোভাবে খেয়ে রুমে ঢুকলো। যখন আশরীনের বয়স পাঁচ বছর তখন তাঁর মা সুমনা হায়দার, ও বাবা জামান হায়দার কার এক্সিডেন্টে মারা যান। তারপর থেকে আশরীন তার নিঃসন্তান বড়খালার মেয়ের রূপেই বড় হয়েছে। মা বাবার কোনো অভাব পায়নি এইখানে। বরং আদর ভালোবাসা বেশিই পেয়েছে। কিন্তু, মাঝে মাঝে কিছু একটা শূন্যতা অনুভূত হয়। নিজেকে নিজেই দোষারোপ করে, তাঁর অতিরিক্ত ভালোবাসাগুলো কেনো তাঁর ভাগ্যে জোটেনা!
গ্যারাজ থেকে বাইকের হর্ণের তীব্র আওয়াজে চোখ হেঁসে উঠলো আশরীনের। দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। শত শত অপমান ধুলোয় উড়িয়ে তাঁর মন চাইলো আরও একবার বেহায়া হতে। যদি মানুষটা তাঁকে একটু জায়গা দেয়!খুবই স্বল্প! যেটুকু অনুবেক্ষণ
যন্ত্র দিয়ে দেখা যায় ঠিক ততটুকু!
স্বপ্নীল নিজের মাথার হেলমেট খুলে বাইকের উপর ঝুলিয়ে রাখলো। আয়নার দিকে তাকিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে চুলগুলো ঠিক করে ফ্ল্যাটের চাবির একগুচ্ছ রিংটা তর্জনীতে ঘুরিয়ে উপরে উঠলো। কী একটা মনে করে চার তলার বারান্দায় তাকালো। বিরক্তির পারদ তড়তড় করে বেড়ে গেলো। এই মেয়েটা ফ্ল্যাটটা কেনার পর থেকেই এমন উদ্ভট যত আচরণ করে। তখন সবেমাত্র মেয়েটা চৌদ্দ পনেরো বছর বয়স। স্বপ্নীল ঘুম ঘুম চোখে বাইক পরিষ্কার করছিলো। দুই বেণী করা স্কুল পড়ুয়া মেয়েটা দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো। স্বপ্নীল তো অতশত ভাবেনি। সে যেতে যেতে শুধু হায় হেলো বলেছিলো। কে জানতো! তারপর থেকে মেয়েটা রোজ গ্যারাজে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রথম প্রথম খুব একটা পাত্তা দেয়নি সে। কিন্তু এক বছর যেতেই বুঝতে পারলো মেয়েটা তাঁর জন্য পাগলের মতো করছে। বাহির থেকে আসলেই হর্ণের আওয়াজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে একগাল হেঁসে তাকিয়ে থাকতো। স্বপ্নীলের মনে পড়ে, সাত আট দিন আগে সকল দ্বিধা কাটিয়ে আশরীন তাঁকে ছাদে প্রপোজ করে মনের কথা জানিয়ে ছিলো। স্বপ্নীলের কোনো অনুভূতি কাজ করেনি। তাঁর মন সাগর তো ডুবে আছে অন্য নারীর তরে। সেখানে ডুবে বাড়িঘর বানিয়ে সেঁটে আছে। আর কাউকে দেখার ফুরসত কই! স্বপ্নীল খুব কড়া চোখে তাকিয়ে বলে দিয়েছিলো-
‘জেগে স্বপ্ন দেখা বাদ দাও। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। ‘
বাঁধ ভাঙা অশ্রুপাতে তলিয়ে গেছিলো আশরীন। সদ্য কৈশোর থেকে নবযৌবন অব্ধি সে এই স্বপ্নের পেছনেই ছুটছে। দিনরাত এক করে একেই ভালোবেসেছে। এক নিমিষেই গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো স্বপ্নচূড়া!
তবুও নিজেকে সামলে বলেছিলো-
‘কে সে? ‘
‘আমার অন্তর্নিহিত অনুভূতির অধিকারিণী। স্বচ্ছ মিষ্টি নির্মল। তাঁর বাস ঠিক আমার দরজার পাশে। ‘
ছলাৎ করে আঁতকে উঠলো আশরীন। তবে কী,এটা রায়ানা! এই মেয়েই তো স্বপ্নীলের বাসার পাশে থাকে। আনমনে নানান চিন্তা করে দৌড়ে নিচে গেছিলো। সোজা স্বপ্নীলের পাশের বাসায় কলিং বেল বাজিয়ে ফেললো। দরজা খুলে বের হলো কিশোরী মেয়ে। একগাদা অস্থিরতা নিয়ে আশরীন ছলেবলে চেষ্টা করছিলো কীভাবে স্বপ্নীলের পাশের রুমটা দেখবে। এপাশে ওপাশে মিলিয়ে তো অনেক গুলো রুম। দুই তিনটা রুম ঘুরে দেখলো। পায়রার রুমের পাশেই তাঁর স্বপ্নপুরুষের ঘর। যে ঘরের রাণী হয়ে সে থাকার স্বপ্ন দেখছিলো সে ঘরের রাজা তো অন্য কোন পথচেয়ে বসে!
সবটা পানির মতোন পরিষ্কার হয় তাঁর কাছে। আশরীন তারপরও বহুকষ্টে পায়রাকে এটা ওটা বুঝিয়ে চলে এসেছিলো। সেদিনের পরের একটা রাত কাটছে নির্ঘুম হয়ে। চোখের নোনাজলে বালিশ ভিজেছে। কিন্তু ঘুম আর চোখে ধরা দেয়নি। আর সুখ! সে তো কর্পূরের মতো উড়ে গেছে। স্বপ্ন পুরুষের সঙ্গে সকল স্বপ্নও ভেঙে গেছে।
স্বপ্নীল বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে। আশরীন সেদিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো। গালবেয়ে অজস্র অশ্রু ঝড়িয়ে বললো-
‘স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে, কিন্তু স্বপ্নচূড়ায় নাম কী আর সবাই লেখাতে পারে! ‘
চলবে-
(বিরক্ত হতে পারেন এই ভেবে, যে পায়রা নীলাংশ নেই কেনো? আসলে, প্রতিটা পর্বেই তারা থাকবেনা। অনেকেই জিজ্ঞেস করছিলেন, স্বপ্নীল সহ আরও কিছু চরিত্রের গুরুত্ব কী? প্রতিটা চরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ। হতে পারে, প্রতিটি চরিত্রকে প্রতিদিন দেখতে পাবেন না।
গল্পের প্রয়োজনেই সবগুলো চরিত্র আসবে। কখনো কাঁদাবে তো হাসাবে৷ হ্যাপি রিডিং। গল্প নিয়ে দুই লাইন মন্তব্য করে যাবেন। )