স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৫

0
1513

স্বপ্নচূড়ার আহবান
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৫

৯.
পায়রার চিৎকার শুনে তারা দৌড়ে এলো৷ পায়রার দাপাদাপি দেখে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। হুশ আসতেই বুঝতে পারলো কী ঘটেছে, কলসি ভরা পানি এনে পায়রার উপর ঢালতে থাকলো। ইতিমধ্যে পুরো বাড়ির মানুষ এসে হাজির হয়েছে। তারা আরও পানি এনে ঢাললো৷ চেহেরার ঠিক কেমন ক্ষতি হয়েছে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। পায়রার মা এখনো কিছু বোঝেনি৷ তাই তারাকে বললো-
‘কী হইসে তারা? পায়রা এমন করে ক্যা?’

তারা কাঁদতে কাঁদতে বললো –

‘পায়রার মুখে কে জানি এসিড ঢাইলা দিসে মা!’

বিভা মাথায় হাত দিয়ে নিচে বসে পড়লেন। হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন-
‘বেশি ক্ষতি হয় নাইতো? তাইলে তো মাইয়ার বিয়া দেওন যাইতো না! ‘

তারা ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে তাকালো৷ এতদিন সে ভাবতো গায়ের রং চাপা বলে হয়তো মা তাকে ভালোবাসে না৷ অথচ পায়রার বেলায়ও ঠিক একই কাজ! কী করে পারে এত পাষাণ হতে। বিয়ের জন্যই কী মেয়েদের জন্ম হয়! এই জীবনটায় কী আর কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নেই? তারা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পায়রাকে ওঠালো৷ সাথে সাথে আঁতকে উঠলো, ঠান্ডা পানিতে চোখ মুখের কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু মুখের একপাশের চামড়া ঝলসে গেছে। নিজের সুন্দর এই মুখশ্রীর এমন করুণ দশা কী করে সহ্য করবে তার আদরের পারু!কারো দেখার আগে রুমাল বেধে দিলো৷ বিভা দেখতে নিলে তারা বললো ‘ পরে দেখো’
বিপত্তি সৃষ্টি হলো পাত্রপক্ষ নিয়ে। তাদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বলছে ‘এমনি এমনি তো আর এসিড দেয়নি,নিশ্চয়ই কোনো আকাম কুকাম করেছে! ‘ পাত্রের বড় বোন জোরে জোরে চেচিয়ে বললো -‘ ছোট বইনেরই এমন অবস্থা! না জানি বড় বইনে আরও কত কী করসে! এই বিয়া হইবো না। ‘ বলে মহিলাটি নিজের ছোট ভাইকে বললো-‘দাড়ায় আসোস কেন শরীফ!চল চল বাইতে চল’

বিভা চমকে উঠলেন৷এই বিয়ে ভাংলে তো আর পাত্র পাওয়া যাবে না। এখন কী হবে! পাত্রের বোন নিমার হাত ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন-
‘মাগো! এমন কইরো না। আমার মাইয়ার কী হইবো!’

নিজের হাত ধাক্কা দিয়ে টেনে নিলেন৷ তারার দিকে নাক মুখ কুচকে বললো-
‘সরেন আপনে,নিজের দুশ্চরিত্রা মেয়েরে আমগো গলায় ঝুলায় দিতে চান! এই বিয়া হইবো না। এই শরীফ তুই চল’

ক্যাবলাকান্ত শরীফ কত আশা নিয়ে বসে ছিলো বউ নিয়ে যাবে। অথচ, তার বোন তার আশা ভরসায় জল ঢেলে দিলো৷ মুখ গোমড়া করে বোনের কাছে বললো-
‘বুবু, তুমি না কইলা এইবার আমার বিয়া হইবোই। সুন্দর একখানা বউ পামু!’

নিমা রেগে কটমট করে তাকালো৷ বিয়ের পর জামাই, বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকে সে৷ বোকা ভাই পেয়ে পুরো বাড়িতে রাজ চালায়, তারাকে দেখে নিমি বুঝতে পেরেছিলো চুপচাপ মেয়ে তারা। সারাদিন কাজ করিয়ে খাটিয়ে মারলেও টু শব্দ করবে না। কিন্তু, তিনি ভেবেছিলেন যৌতুক নিয়ে বিয়ে করাবে৷ তা আর হলো না, তার ভাই বোকার মতোন তারাকে দেখে পাগল হয়ে গেলো। যৌতুকের দাবি করার সুযোগ পাননি তিনি। এখন চাইছেন ঝোপ বুঝে কোপ মারতে। এখানে বিয়ে ভাঙলে বড়লোক মেয়ে দেখে বিয়ে করাতে পারবে৷ ভাইকে টানতে টানতে গাড়িতে বসিয়ে সবাই চলে গেলো৷

তাঁরা কাউকে পরোয়া না করে একজন মানুষকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলো। পায়রাকে এডমিট করিয়ে দিলো। পায়রা কিছুক্ষণ পর পরই পা দাপিয়ে কাঁদছে। তাঁরার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ নিজের বোনের এই করুন দশার পেছনে কে তা আর বুঝতে বাকি নেই তার৷ হসপিটালে নিজের জমানো কিছু টাকা জমা দিয়ে দিলো। পাশের দোকান থেকে একটা খাতা কলম কিনে নিয়ে লিখতে বসলো। পুরোটা লেখা শেষ করে একজন নার্সের হাতে ধরিয়ে দিলো। ডাক্তার ব্যাস্ত হাতে চিকিৎসা করছে। অনেক অনুরোধের প্রেক্ষিতে কিছু সময়ের জন্য তারা পায়রার কাছে বসার অনুমতি পেলো। শেষবারের মতোন কানের কাছে ফিসফিস করে বললো -‘ভালো থাকিস পারু, এই দুনিয়া আমার মতোন তারাগো জইন্য না। আমার মতোন তাঁরারা এমনেই হাঁপাতে হাঁপাতে হারাইয়া যায়। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না, তোর সাথে যে এমন করসে তারে শাস্তি দিয়া তবেই যা করার করমু’

উঠে দাড়িয়ে নিশ্চলভাবে হেঁটে চোখখানা মুছে নিয়ে বেরিয়ে গেলো তাঁরা। বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো ডক্টর সোহরাব। বয়স পঞ্চাশের ঘর পেরিয়ে গেছে। তারা খেয়াল করলো। পায়রার দিকে মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে আছে। নিজের মতোন ভাবছে হয়তো৷ তারা ডক্টরকে বললো-
‘কী দেখতাছেন? ‘

ডক্টর সোহরাবের ধ্যান ভাংলো। গলা ঝেড়ে বললো-
‘আসলে, আমার একটা মেয়ে ছিলো। বয়স পাঁচ হতেই মারা যায়। তারপর বড় ছেলেটাকে নিয়েই আজ চব্বিশ বছর কাটালাম। মেয়েটাকে দেখে তেমনই মনে হলো। ‘
কিছুটা থেমে বললেন-
‘ নাম কী ওর?’

তাঁরা বললো-
‘ইসমাত সেহরি পায়রা ‘

‘বেশ সুন্দর নাম। ‘

তাঁরা বাহিরে যেতে নিয়েও একবার ফিরে এলো। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘ ডাক্তার কাকা,আমার পারু ঠিক হইয়া যাইবে তো?’

‘দেখো মা, এসিড খুবই খারাপ জিনিস। একবার লাগলে পুরো জীবন নষ্ট হয়ে যায়। পায়রাকে এখন অনেক স্ট্রাগল করতে হবে। তবে যেহেতু মুখের একপাশ ঝলসে গেছে, সেই ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারি করা যেতে পারে। উন্নত দেশে নিয়ে চিকিৎসা করালে ঠিক হয়ে যাবে। চেহারা হয়তো বদলে যাবে।’

তাঁরা পায়রার কেবিনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো -‘তোকে অনেক পোহাতে হবে পারু, দোয়া দেই তুই বড় হ, অনেক বড় হ’

চোখ মুছে নিয়ে ডাক্তারকে খেয়াল রাখতে বলে বেরিয়ে গেলো তাঁরা। শুয়ে রইলো নির্মল নিষ্পাপ পায়রা। জীবন যুদ্ধের শুরু বোধ হয় এখানেই।

১০.

তাঁরা মুখ হাত ঢেকে নিয়ে তুষারের বাড়ির পেছনে এসে পড়লো। তুষার ভয়ে কাপছে, সেখানে বসে আছে অনেক সময় নিয়ে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারলো, রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো সে। আর এসিডটাও যে পায়রার মুখের উপর লেগেছে। ঠিক করছে, কালই দেশ ছেড়ে বিলেতে পাড়ি জমাবো। এমন সময়ই কে যেনো গলায় এক কোপ বসিয়ে দিলো। হ্যা, তারা-ই এ কাজ করলো৷ নিজের ভালোবাসা আর বোনের সৌন্দর্যের হত্যাকারীকে মৃত্যু দান করে দিলো৷ এই প্রথম ও শেষ বারের মতোন। তুষার সেখানেই মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলো৷ তা দেখে পৈশাচিক শান্তি অনুভব করলো তারা৷ উন্মাদের মতো হাসতে হাসতে চলে গেলো। নিজের বাড়িতে ঢুকে দেখলো বিভা কান্না করে বিলাপ করছে।
বড়লোক ঘরে বিয়ে না দেয়ার আফসোসে পুড়ছে সে। পায়রা কেমন আছে তা বোধ হয় একবারও চিন্তা করেনি সে। তাঁরা তাচ্ছিল্য হেসে নিজের দুয়ার লাগিয়ে দিলো। নিজের শাড়ির আচল থেকে বিষের কৌটা থেকে দুটো বড়ি খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে গোঙাতে গোঙাতে বললো-

অমৃত সুধা পানে করেছি জীবন দান,
বিধি মোরে দিলো লিখে দিলো মৃত্যু সমাধান।
জীবনের হালখাতা অচিরেই ম্লান ,
কে কোথা ধরে রাখে নিভু নিভু প্রাণ?

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here