স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৬

0
1414

স্বপ্ন চূড়ার আহবান
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৬

১১.
মিনিট পাঁচেক আগে পায়রার জ্ঞান ফিরেছে। মুখের একটা পাশ ব্যান্ডেজ করা। অজ্ঞান হয়ে ছিলো বিধায় ঠিকঠাক ভাবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। গায়ে হালকা আকাশী রঙের একটা ঢোলা জামা। মাথার ভেতরটা ভোঁতা যন্ত্রণায় রগ টনটন করছে৷ এক হাত ভর করে উঠে বসলো সে। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন ডক্টর আয়মান সোহরাব। মধ্যবয়স্ক ডাক্তারকে দেখে পায়রা নিজের পোশাক ঠিক আছে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ডক্টর আয়মান পায়রাকে দেখতেই মৃদু হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন-
‘ এখন কেমন লাগছে মামণী?’

পায়রা মাথা নাড়িয়ে ভালো লাগছে বললো৷ ডক্টর আয়মান চেয়ার টেনে বসলো। পায়রা এদিক ওদিক তাকিয়ে তাঁরাকে খোঁজার চেষ্টা করলো। না পেয়ে ডক্টরকে প্রশ্ন করলো -‘বুবু কই? ‘

ডক্টরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্স বললেন –
‘তোমার বড় বোন কাল রাতেই চলে গেছেন৷ তবে, তোমার নামে একটা চিঠি দিয়েছেন ‘
বলেই নিজের ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে পায়রার হাতে দিয়ে দিলো৷ পায়রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তাঁরা বুবু কেনো তাকে রেখে গেলো! আর তাকে দেখতে মা বাবা কেউ এলো না কেন? বাবা না হয় শহরে কাজ করে বিধায় আসেনি কিন্তু মা! আর চিঠি কীসের! অসংখ্য প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে পায়রার। ডান হাতে চিঠি নিয়ে খুলতে নিয়েও কী মনে করে খুললো না সে৷ ডক্টর আয়মান বললেন –

‘শোনো পায়রা, এতদিন তুমি সাধারণ একটা মেয়ে ছিলে। কিন্তু এখন তোমার জীবন পাল্টে গেছে, অনেকেই তোমাকে তুচ্ছ করে ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করবে। শুধু তুমি ভাঙবে না। মনে রাখবে, জীবনটা তোমার নিজের, তাই সবার প্রথমে নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিবে’

পায়রা কথাটা বুঝতে পারলো না কারণ এসিডে যে মুখের অর্ধেক পুড়ে গেছে তা সে জানে না। কারণ ইনজেকশনের জন্য কোনো ব্যাথাও টের পাওয়া যাচ্ছে না। পায়রা জিজ্ঞেস করলো –
‘মানে! আমার জীবন পাল্টাইবো ক্যান? ‘

ডক্টর আয়মান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন-
‘পায়রা, তোমার মুখে কেউ এসিড ছুড়ে দিয়েছে। যার ফলে মুখের অর্ধেকটা পুড়ে গেছে। চোখ মুখ ঠিক আছে বলে তুমি বুঝতে পারছো না ‘

পায়রা আঁতকে উঠলো ভয়ে৷ কান্না দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো৷ এবার সে উপলব্ধি করলো মুখের অর্ধেকটা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। হাত দিয়ে ধরতে নিলেই ডক্টর আয়মান বললেন –
‘হাত দিওনা মামনী, কিছুক্ষণ আগেই ওয়াশ করে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। এখন হাত দিলে জ্বলতে পারে।’

পায়রা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ডা. আয়মান বুঝতে পারলেন পায়রার মন। প্রতিটি এসিড ভিক্টিমের এই করুণ আর্তনাদ সে প্রতিনিয়ত শুনে। কিছুই করার থাকে না। কোনো কোনো মানুষ পশুর চেয়েও অধম হয়। মন মানসিকতা ঠিক কতোটা নিচুস্তরের হলে কেউ একটা মানুষের পুরো জীবনটা ধ্বংস করে দেয়!
পায়রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো-

‘ডাক্তার কাকা, আমারে কী অনেক খারাপ দেহাইতাসে?’

ডক্টর আয়মান কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু হেসে বললো –

‘ জানো মামণী, চাঁদ খুব সুন্দর, এতটাই সুন্দর যে এটার দাগটা কারো চোখে লাগে না। মানুষের আসল পরিচয় তার ভেতরের আলো। আলো যত বেশি হবে অন্ধকার তত বেশি হারবে ‘

পায়রা নিজেকে শান্ত করে চোখ মুছে হেলান দিয়ে রইলো। ডক্টর আয়মান বললেন –
‘ কাল তোমার ডিসচার্জ হবে। এখন রেস্ট নাও। কিছু লাগলে এই নার্স খালাকে জানাবে ‘

পায়রাকে তারপরের দিনই ডিসচার্জ করা হলো। কেউ আসেনি বিধায় ডক্টর আয়মান নিজের গাড়ি দিয়ে দুইজন নার্স দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিলো। গাড়ি থেকে নেমে নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো পায়রা, কিন্তু মনের ভেতরে খচখচ করছে কিছু একটা। সবকিছু কেমন যেনো শান্ত হয়ে আছে৷ ঘরের ভেতরে পা রাখতেই দেখলো মা ফ্লোরে শুয়ে কাঁদছে আর বাবা পাশে বসে কপাল চাপাচ্ছেন। পায়রার দুই নয়ন শুধু তার বুবুকে খুঁজে চলেছে৷ দুই পা এগিয়ে আলতো স্বরে বললো-
‘আম্মা! বুবু কই? ‘

১২.

বিভা কাঁদতে কাঁদতে হুঁশ হারিয়ে বসেছিলেন। পায়রার দিকে এখনো ভালো করে তাকাননি। পায়রার হাতটা টেনে আহাজারি করে বললেন –
‘ পায়রারে! সব শেষ হয়ে গেলোরে! আমাগো সব শেষ। তাঁরা আর নাইরে, আর নাই ‘

পায়রার বুক ধকধক করছে। সবাই এভাবে কাঁদছে কেনো তার মাথায় ঢুকছে না৷ পায়রা মায়ের কাধের ঝাকিয়ে বললো-
‘এসব কী কও আম্মা!’

পায়রার বাবা ইবাদত বললেন –
‘হ্যারে মা, কাল রাতে নাকি তাঁরা মা বিষ খাইয়া আত্মহত্যা করসে। বিয়ার আসরে বিয়া ভাঙসে দেইখাই আজ এমন হইলো। বারবার আমি তাঁরার মারে কইসি এহন বিয়া দিওনা, আমার কথা শুনে নাই!’

পায়রার চোখ ফেটে পানির ফোয়ারা বইতে শুরু হলো। কাঁপা গলায় বললো –
‘তাঁরা বুবু ঠিক আছে। কাইল আমারে ধইরা হাসপাতালে নিয়া গেলো। কিসু হয় নাই আমার বুবুর ‘

হাসপাতালের কথা শুনে বিভার মনে পড়লো কালকে সন্ধ্যার দুর্ঘটনার কথা৷ মুখ তুলে তাকাতেই চমকে চিৎকার করে উঠলো সে৷ সবাই চিৎকারের জন্য পায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলো। গ্রামের এতো সুন্দর মেয়ের এই পরিণতি যেনো কেউ বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা। মহিলারা সবাই মুখে আঁচল ছি ছি করে উঠলো। একজন বুড়ী মহিলা মুখ ফিরিয়ে বললো-‘আমাগো গেরামে কার নজর লাগলো আল্লাহয় জানে! তাঁরা আত্মহত্যা করলো, তুষাররে কে জানি কোপাইয়া মাইরা লাইলো, আর এহন এই সুন্দরী মাইয়ার মুখ পুঁইড়া গেলো। বড় মাইয়া কালা আসিলো দেইখা কত দেরি কইরা বিয়া হইলো আর এহন এই পোড়ামুখী মাইয়া কেডা নিবো!’

পায়রা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। কীভাবে পারে এরা এমন একটা সময়ে বিয়ের কথা চিন্তা করতে! তাঁরা বুবু কী এদের কটু কথা সহ্য করতে পারবেনা বলেই আত্মহত্যা করলো!
এরই মাঝে বিভা খলবল করে এগিয়ে এলো। পায়রার চুলের মুঠি ধরে বললো-
‘হারামজাদি! এই পোড়া মুখ নিয়ে বাড়ি এলি ক্যা? মরতে পারলি না? ‘
কিছুটা থেমে রাগে ফসফস করতে করতে বললেন –
‘ ঐ মাইয়া তো কাইল ঠিকই কইসিলো! তোর নাগরই মনে হয় এই কাম করসে। নাইলে কেডা করবো এমন। বল কার লগে পীরিত জমাইসিলি? ‘

পায়রা হতবাক হয়ে গেছে। এই ধরনের ব্যবহার পাওয়ার কথা সে কল্পনাও করেনি। মা যে কখনো তাকে এসব বলেনি, তাঁরা বুবুকে মাঝে মধ্যে এইসব বলতো গায়ের রংয়ের কারণে। তাহলে, এত আদর যত্ন বুঝি তার সৌন্দর্যের জন্য ছিলো! মুহুর্তেই সবটা পানির মতোন স্বচ্ছ হয়ে এলো তার। মুখে এক তাচ্ছিল্য হাসি ফুটিয়ে বিভাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিলো। বিভা তাল সামলিয়ে কড়া চোখে তাকালেন। পায়রা রাগী মুখে বললো-
‘আম্মা! আমারে তুমি তাঁরা বুবু ভাইবো না যে আমি মার খাইয়া চুপচাপ বইসা থাকুম৷ আমারও মুখ আসে ‘

বিভা ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে বললেন –
‘আমার পেট থিকা বাইর হইয়া আমার মুখের উপর কথা কস! বঠি দিয়া টুকরা কইরা দিমু এই পোড়া মুখ’

পায়রার বাবা বিভাকে সরিয়ে ধমকে বললেন –
‘কী শুরু করসো তুমি! এক মাইয়া মরসে শান্তি হয় নাই তোমার? ‘

বিভা রক্তচোখে বললেন –
‘তুমি কোনো কথা বলবানা তাঁরার বাপ। এই মাইয়ারে এহনই এই ভিটা ছাড়তে হইবো। আমার মান সম্মান সব শেষ কইরা ছাড়বো, একজন মইরা আমারে উদ্ধার করসে এহন ইনি পোড়া মুখ নিয়া আইসে ‘

ইবাদত কিছু বলার আগেই পায়রার হাত টেনে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো বিভা। পায়রা শক্ত পায়ে নেমে এলো একবার বাড়িটা দেখে নিলো। বুবু আর তার ছোটবেলার কতশত স্মৃতি জমে আছে এখানে। আর কোনো কিছুর জন্য তার কষ্ট হচ্ছে না। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে তাঁরা বুবুর জন্য। কিছুটা সামনে যেতেই উঠানের শেষের দিকে একটা নতুন
ভেজা কবর দেখতে পেলো পায়রা। দৌড়ে এসে বসে পড়লো জায়গাটায়, ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। মুখ চেপে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কবরের উপর নিজের মাথাটা রেখে মিনিটখানেক বসে রইলো। এভাবেই তো কয়দিন আগে তার বুবুর কোলে মাথা রাখতো সে আর বুবু মমতাভরা হাতে গল্প শুনিয়ে চুলে বিলি কেটে দিতো! উঠে বসে জামার ছোট পকেট থেকে চিঠিটা বের করলো পায়রা। কাঁপা হাতে তিন ভাজের চিঠিটা খুলতেই দেখলো, গুটিগুটি অক্ষরে লেখা –

জগতের মায়াতরে এসেছিলাম এ ভবে,
আলো-ছায়ার গোলকধাঁধায় আজও একইপথে।
মায়ার মোহনজাল ভেঙে যাচ্ছি আমি সবে,
আকাশের বুকে তাঁরা হয়ে সুখ খুঁজে পেতে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here