স্বপ্ন সাদিয়া_সৃষ্টি পর্বঃ- ১০ (শেষ

স্বপ্ন
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ১০ (শেষ)

— “শুরুটা হয়েছিল ৪ বছর আগেই তবে আমি আমার মতো করে বলি?”

বলেই বৃষ্টিকে আবিরের বরাবর রাখা চেয়ারে বসার জন্য ইশারা করল নিশান্ত। বৃষ্টি ইতস্তত করলেও বসে পড়ল। কারণ নিশান্ত বলেছিল,

— “চিন্তা নেই, তোমার এক্সের সাথে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করাতে আনিনি তোমায়।”

সামনে আবিরের বসে থাকাটা তার কাছে ভালো লাগছে না। যদিও মুখ-হাত-পা বাঁধা, তবুও ভালো লাগছে না তার। নিশান্ত বেশি সময় নিল না। বৃষ্টি বসার সাথে সাথেই নিজের কথাগুলো একের পর এক বলা শুরু করল। বৃষ্টিও সবটা জানার জন্য আবিরকে নিয়ে আর মাথা ঘামাল না।

— “ও প্রান্ত, আমার বন্ধু। পেশায় পুলিশ। ৩ মাস আগে আমার সাথে যোগাযোগ করে নিজের একটা কেস নিয়ে। বেশ কিছু বেআইনি কাজ কেউ একজন বা এক দল লোক সকলের অগোচরে করছে। কাজের ধরণের মধ্যে রয়েছে সাইবার অপরাধসহ আরও অনেক কিছু। উদাহরণ হিসেবে বলব, নকল ফিঙ্গার প্রিন্ট তৈরি করে সেটা নিয়ে নানান অনৈতিক কাজ, বিভিন্ন নতুন হার্ডওয়্যার বদলে পুরনো টা সংযুক্ত করা, হ্যাকিং তো আছেই। এগুলো বেশি করা হত। আর এসব কিছুর মূল কে সেটা খুঁজে বের করা যাচ্ছিল না। কারণ তাদের কাউকেই ধরা যাচ্ছিল না। আমার কথাগুলো সহজ মনে হলেও এর গভীরতা অনেক বেশি। তোমাকে শুধু ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি।

ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েই যদি কিছু বলতে চাই, তাহলে বলব আধুনিক যুগে এর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। একজনের পরিচিতি প্রকাশ পায় এর মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন বেআইনি কাজ যদি ধরো তাহলে দেখবে এসব নকল ফিঙ্গার প্রিন্টের বাজার মূল্য অনেক চড়া। মানুষ নিজের কোন কাজ হাসিল করতে হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক উপায় অবলম্বন না করে শর্টকাট বাছাই করে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন দলিলে স্বাক্ষর লাগলে তো কথাই নেই। একজন ব্যক্তি যদি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একটি স্থাপনা তৈরি করতে চায় কিংবা বিল্ডিং, সেক্ষেত্রে সে কম খরচে পুরো কাজ শেষ করার চেষ্টা করতে। এজন্য সেই বিল্ডিং এর মান ভালো হবে না, সেখানে নানা সমস্যা হতে পারে কিংবা বিল্ডিং ধসের মাধ্যমে অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু মালিক সে কাজ করতে চাইবে না। এই বিল্ডিং তৈরির আগে অনুমতি নেওয়া হয়। সেখানে মালিক পক্ষের স্বাক্ষর থাকে সাথে নকল কিছু দলিল বিল্ডিং সম্পর্কিত। এখানে যদি কোনদিন ওই বিল্ডিং ধস হয়, তাহলে পুলিশ তার পিছনের খবর বের করার চেষ্টা করবে। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে পাবে ওই নকল দলিল, যেখানে নকল ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারবে। এতে করে আসল মালিক পার পেয়ে গেল কারণ স্বাক্ষর হিসেবে নকল ফিঙ্গার প্রিন্ট বা স্বাক্ষর ছিল যেটা তার সাথে ম্যাচ করবে না।

এটা ছিল শুধু একটা ক্ষেত্র। মানুষ রোজ রোজ অগণিত এমন নকল দলিল তৈরি করে, নকল আইডেন্টিটি কার্ড, টাকা সংক্রান্ত কার্ড কিংবা বিভিন্ন লেনদেন সম্পর্কিত কাজ- প্রায় সব ক্ষেত্রে এই নকল ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যবহৃত হয়। এতে দেখা যায় বিভিন্ন খাবারের কোম্পানি ভেজাল মিশ্রিত খাবার বানানোর সুযোগ পায়। আর আজকাল তো সব জিনিসেই ভেজাল, সেটা খাবার হোক বা অন্যকিছু। অনেক সময় দেখা যায় যার কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে স্বাক্ষর করানো হয়, সেই ক্ষেত্রে তার আসল স্বাক্ষর না নিয়ে আরেকটা নকল আঙুল ছাপ দিয়েই কাজ চালায়।

এবার আসি কাজটা করার একটা উপায় নিয়ে। যেটার সাথে আবির জড়িত। শুধু আবির না, আবিরের একটি দল আছে এই কাজ করার জন্য।

আমাকে যখন সবটা জানানো হয়, তখন আমি সেই জায়গা থেকে শুরু করি যেখান থেকেই এই কেসের শুরু। প্রান্তদের দল ওদের একটা কর্মস্থল খুঁজে পেয়েছিল। যদিও তেমন কোন চিহ্ন রেখে যায়নি। তবে ওরা সন্দেহ করেছিল এখানে নকল ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়েই কাজ হয়। বলতে গেলে বৃষ্টি, যেখানে তুমি এখন বসে আছো, সেই বিশাল কক্ষটিই। আমি এখানে আমি আর শুধু এই কয়েকটা চেয়ার আর টেবিল ছাড়া তেমন কিছু পাইনি। তবে দেওয়ালে বিভিন্ন ছাপ কিংবা ফেলে রাখা জিনিসগুলো খুব সাহায্য করে আমাদের বুঝতে যে এটাকে একসময় ল্যাব হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আলমারিও ছিল কিন্তু তাতে কিছু ছিল না তেমন। বাইরের লোকদের কাছ থেকে শোনা যায়, এই বিশাল কক্ষটি বিগত ৬-৭ বছর ধরে বন্ধই পড়ে আছে। মাঝে মাঝে ভার্সিটির কিছু নির্দিষ্ট ছেলে মেয়ে আসে, আবার চলে যায়। তবে সময়টা কেউ বলতে পারেনি। খুব কমই দেখেছে তাদের।

এখানে আসার পর ছড়িয়ে রাখা অল্প কিছু জিনিস, খাবারের প্যাকেট আর বদ্ধ ঘরের পরিবেশের সাথে এখানের অমিল প্রথম ক্লু হিসেবে গণ্য হয়। আর সবচেয়ে বড় ক্লু ছিল এই টেবিলটা। মূলত টেবিলের ড্রয়ারটা। ড্রয়ার থেকে হুমায়ূন আহমেদের “হিমুসমগ্র” বই আর সাথে কিছু হাইলাইটার। এটা আমাদেরকে আবির পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করে। হয়তো হ্যান্ড গ্লাভস পরে কাজ করত, তাই ওদের ফিঙ্গার প্রিন্ট কিংবা অন্য কিছু খুঁজেই পাইনি। তবে যাই হোক, এতে করে আমি আমার হবু বউ পেয়ে গিয়েছি।”

বৃষ্টি নিশান্তের সব কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। মাঝ পথে সকলের সামনে এমন কথা বলায় লজ্জা পেল। চোখ রাঙ্গিয়ে নিশান্তের দিকে তাকিয়ে বুঝাল ইতি-উতি না করে মূল কথায় আসতে। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখল প্রান্ত আর লোক দুটো নিজের হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছে। আর আবির খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে নিশান্তের কথা। নিশান্ত আবিরের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। ওর বাঁকা হাসি দেখে বৃষ্টি অবাক হলেও কিছু বলল না।

— ” আবির, একজন ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র, খুব ব্রিলিয়ান্ট। সাথে তার বন্ধুরাও। শুরু থেকেই পড়াশোনা নিয়ে খুব সিরিয়াস। নতুন কিছু আবিষ্কারের ক্ষেত্রে তার বেশ কৌতূহল, তবে সম্পূর্ণই সেটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।

মানুষের মন কিংবা মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা বহু বছরের। সেই নিয়ে নানা যুক্তি তর্ক ‘গুগল’ থেকেই পাওয়া যায়। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বশ করতে পারে। গ্রামে তো এদেরকে আবার অন্য চোখে দেখা হয়। যাই হোক, আজকাল এই নিয়েও কম কাজ হয় না। দেখা যায় একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে কথার জালে ফাসিয়ে কত কাজ করে নেই। এক কথায় মন নিয়ে খেলা কথা বা মস্তিষ্ক নিয়ে খেলা করা। নিজের নানান কথার মাধ্যমে কারো মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করা। এই কাজটা আবিরের দল খুব ভালো পারতো।

ধরা হোক, আবির কোন এক সময় কারো সাথে বাজি ধরে খুব কঠিন একটি কাজের। একটি বড় প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে কর্মরত কারো ফোন থেকে তথ্য বের করে আনতে হবে। এর আশেপাশে আরও কাজ দিতে পারে, যেমন কাউকে সেই তথ্য দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা কিংবা বড় এমাউন্টের টাকা আদায় করে নেওয়া। তাতে আবির ও তার বন্ধুরা রাজি হয়ে যায়। প্রথমত তার আইডি হ্যাক করে তার সম্পর্কিত অনেক তথ্য বের করে আনে। তারপর বন্ধুদের মাধ্যমে ফোন চুরি করে, কাঁচের কোন জিনিসের উপর আঙুলের ছাপ ও নিয়ে নেয়, কারণ ফোনের লক খুলতে প্রয়োজন। সেখান থেকে প্রক্রিয়া করে নকল আঙুলের ছাপ তৈরি করে, সেটা দিয়ে লক খুলে বিভিন্ন তথ্য বের করে আনে, সেখান থেকে টাকা নিয়েছে কি না সেটা তোমার না জানলেও চলবে।

প্রথমত শুরুর দিকে এমন কাজ বেশ কয়েক বার করায় তারা নিজেদের গুণ ধরতে পারে। এবার শুরু করে নিজেদের ইচ্ছা পূরণ। দেখা যেত কিছু বড়লোক ছেলে মেয়েকে তারা ভালোবাসার জালে ফাসাত। এক কথায় নিজের শিকার বানাত। তারপর তাদের থেকে বিভিন্ন উপায়ে টাকা আদায় করত। কিংবা নিজেদের চাহিদা পূরণ করতেও ছাড়ত না। কিছু কিছু মানুষ সহজে মেনে যেত, আবার কেউ ‘না’ বললে তার মস্তিষ্ক নিয়ে খেলা চলত। ধীরে ধীরে এই কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। তবুও শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর এটা শুধু বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন বেকার যুবকের কাছে পৌঁছায় যেটা বৃহৎ আকার ধারণ করেছে আজ।

এখনকার যুগে অনেক ছেলে মেয়ে আছে, যারা ফ্রি ল্যান্সার হিসেবে কাজ করে। তুমিও আছো বৃষ্টি। অনেকে আবার আইডি হ্যাক সহ নানান কাজ করে। তাদেরকে টাস্ক হিসেবে এসব দেওয়া হয়। দেখা যায় একটা ছেলে কোন গুরুত্বপূর্ণ সাইট হ্যাক করছে, কিন্তু সে আসলে জানেই না যে সে একটা বেআইনি কাজ করছে। নকল ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহের পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে আসল গুলো কয় জায়গায় ব্যবহৃত হয় সেটাই কেউ জানে না।

এই ছিল আবিরের বেআইনি কাজের শুরু আর বিস্তার, সাথে ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করার বিষয়টা। এবার আসি তোমার স্বপ্নের দিকটা। এটা সম্পূর্ণ আবিরের নিজ ইচ্ছায় ছিল।

স্বপ্ন মানুষের একটি মানসিক অবস্থা, যাতে মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় বিভিন্ন কাল্পনিক ঘটনা অবচেতনভাবে অনুভব করে থাকে। গড়ে মানুষ জীবনের ৩৩ শতাংশ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। বিজ্ঞানের মতে একজন মানুষ তার সারা জীবনে গড়ে প্রায় ১০০০০০ বারের মতো স্বপ্ন দেখতে পারেন। এক রাতে ২৪টিরও বেশি। স্বপ্নে ব্যক্তির কাছে নিজের নানারকম আবেগ, তথ্য ও তত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। স্বপ্ন মূলত দর্শন-ইন্দ্রিয়ের কাজ। স্বপ্ন দেখা অনেকটা সিনেমা দেখার মতো। সাধারনত প্রায় ৯০ থেকে ১৮০ মিনিট স্বপ্ন দেখি যেখানে, গড়ে একটি স্বপ্নের স্থায়িত্ব হয় প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট। আবার বলা হয়ে থাকে, আমাদের প্রতিটা স্বপ্নের স্থায়িত্ব মাত্র ৪ সেকেন্ড। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের ঘুমের দুইটি পর্যায় রয়েছে। একটি র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট – আরইএম, অন্যটি নন র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট – নন আরইএম। আরইএম- পর্যায়ে থাকার সময় স্বপ্ন দেখে। এসময় নন অ্যাড্রোনালিন ও অ্যাড্রোনালিন হরমোন বেশি নিঃসরিত হয়। মানুষ যখন উদ্বিগ্ন থাকে তখন সে স্বপ্ন বেশি দেখে। দৈনন্দিন জীবনে ঘটনার তথ্য মানুষের মস্তিষ্কের ‘থ্যালামাস’ নামক অংশে জমা হয়। যখন মানুষ ঘুমায়, তখন এই থ্যালামাস বন্ধ বা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। স্বপ্ন যখন দেখি তখন এই থ্যালামাস বন্ধ থাকে আর আরইএম পর্যায়ে থাকার সময় থ্যালামাস দোলনার মত দুলতে থাকে। ফলে ছিন্ন ছিন্ন ঘটনাপ্রবাহ আমরা স্বপ্নে দেখি।”

কারো হাই তোলার শব্দে নিশান্তের কথায় আবার ব্রেক লাগে। সে সামনে তাকিয়ে দেখল প্রান্ত ঘুমিয়ে পড়বে এমন অবস্থা। বৃষ্টি বলল,

— “আপনি আবার জ্ঞান দেওয়া শুরু করেছেন? আমরা জানি না ঠিক আছে, কিন্তু এমন কঠিন কঠিন কথা কি না বললে ভালো হয় না?”

নিশান্ত খেয়াল করল, সে সত্যিই আবার বেশি ব্যাখ্যার দিকে চলে যাচ্ছে। তাই সরি বলে আবার শুরু করল।

— “আবির প্রথমত তোমাকে প্রপোজ করেছিল বাজি ধরে। তুমি ছিলে বাস্তববাদী মেয়ে। স্বাভাবিক কাজে যারা ইমোশনাল হয়ে পড়ে, তাদের কাতারে তুমি পড় না। বলতে গেলে আবেগে গা ভাসাও না। তাই তোমাকে প্রপোজ করে রিজেকশন পাওয়া গিয়েছে সব সময়। এই চ্যালেঞ্জ ও আবির নিয়ে নেয়। যেহেতু আবির মস্তিষ্ক আর মন নিয়ে খেলতে পারতো ভালো তাই সে তোমাকে তার প্রতি দুর্বল করার চেষ্টা করে শুরুতে। তারপরও যখন সফল হয় না, তখন তোমার মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। একটা সময় তুমি ওর নিয়ন্ত্রণে চলেও আসো আর একসেপ্ট করে নেও। আবির জিতে যায় বাজি। আর তোমরা তোমাদের রিলেশন কন্টিনিউ করে যাও, যদিও তেমন কিছুই করোনি।

তুমি বলেছিলে তুমি খারাপ স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলে আবিরের সাথে রিলেশন হওয়ার ৫-৬ মাস পর থেকে। মনে করে দেখ তো, তার কয়েক দিন আগেই তুমি আবিরকে ‘হিমুসমগ্র’ উপহার দিয়েছিলে। সেই বই এর শুরুর পৃষ্ঠায় লেখা ছিল – From: Rafiya Sultana Bristy & To: ❤❤ তাই তো? সাথে ব্রাকেটে তারিখ। ওই লাল লাল হার্ট দেখলে আমার এখনো যে কি পরিমাণে রাগ হয়!

সেই বই থেকে আমি আমি হাইলাইটার দিয়ে দাগানো লাইনগুলো মিলিয়ে দেখি। বই ও পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু হয়তো এইটা বইও হাতে গ্লাভস পরে পড়ত। বই এ বেশির ভাগ লাইন দাগানো ছিল হিমুর বাবার এক্সপেরিমেন্ট করার বিষয়গুলোতে। সেখান থেকে জানতে পারলাম আসামি এক্সপেরিমেন্টের দিকে বেশি কৌতূহলী। এখানে থাকা জুতার ছাপ আর আকার দিয়ে মানুষের সংখ্যাও হিসাব করেছিলাম। তারপর চলে যাই তোমাদের বাড়ি। তোমাকে বার বার জিজ্ঞেস করি। কারণ আমার মনে হচ্ছিল তুমি জেনে থাকলেও থাকতে পারো আর তোমার ওই অস্বাভাবিক আচরণগুলো। তোমার এক্স আবির সম্পর্কে জানার পর তার পিছনে নিজে লেগে পড়ি আর সময়ের সাথে সাথে সবটা বের করে ফেলি। সিম্পল।

তবে এর মধ্যে তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম, তাই বাকিটা সময় তোমার সমস্যা সম্পর্কে জানতে উঠে পড়ে লাগি।”

এই পর্যায়ে এসে প্রান্ত বলে ওঠে,

— “তার মানে এসব তুই আগে থেকেই জানতি?”

— “হ্যাঁ, বাট তোকে জানাইনি। জানালে যে তোদের ভাবীকে পটানোর টাইম পেতাম না।”

— “কবে থেকে জানিস?”

— “আমি তো শুরুতেই ধরে ফেলেছিলাম। বলতেও যাচ্ছিলাম। কিন্তু তখন তুই আমার কথা শোনার আগে আমাকে বৃষ্টির ছবি দেখালি। তাই আমি মতামত বদলে ফেললাম আর এখানে চলে আসলাম। যদিও গেস করেছিলাম, তবে তাতে কিছু ভুল ছিল না। উল্টো আরও নতুন কিছু জানতে পেরেছি।”

— “তোর জন্য আমি আরও আগেই প্রমোশনটা মিস করে ফেললাম।”

— “ভাবি তো পেলি, কান্না করিস না। আর বৃষ্টি, তোমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা হলো-

ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব মতে স্বপ্ন মূলত মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষা এবং আবেগের বহিঃপ্রকাশ। মানুষ জাগ্রত অবস্থায় যে আবেগগুলো লালন করে তা ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্ন রূপে আসে। আবিরের তোমার পিছনে পড়ে থাকার জন্য শুরুতে ভালো স্বপ্ন দেখতে। কিন্তু আবিরের ইচ্ছা জাগল অন্যকিছুর। নতুন আবিষ্কার হিসেবে তোমাকে বানাল তার পুতুল। তুমি যেহেতু আবিরের কথা শোনা শুরু করেছিলে, নিজের ইচ্ছায় নয়, আবিরের নিয়ন্ত্রণের জন্য ওকে সব কথায় হ্যাঁ বলে দিতে, আবির তোমার উপর তাই সহজেই এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে। আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি তাহলে আবির মানুষের স্বপ্নের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আনতে চেয়েছিল।

দেখা যায় ঘুমন্ত মানুষের উপরও একটি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ আনা যায়। আবির প্রথমে তোমাকে এমন ড্রাগ দেওয়া শুরু করে যাতে তুমি ঘোরের মধ্যে কিঙ্গা ঘুমের মধ্যেই চলে যাও। তারপর কথার মাধ্যমে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। মূলত কথা বলার সময় তুমি ওর কথার জালে হারিয়ে যেতে তাই বুঝতেই পারতে না আবির কিভাবে তোমাকে ড্রাগ দিত। একসময় ঘুমিয়েও পড়তে। দেখবে, ইনসোমনিয়া কিঙ্গা অনিদ্রার রোগীদের ক্ষেত্রে নানার উপায় অবলম্বন করা হয়ে থাকে। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, তবে সেই উপায়ের ক্ষেত্রে একটা মানুষকে চোখ বন্ধ করতে বলে তার ঘুমের উপযোগী পরিবেশ শুধু কথার মাধ্যমে তৈরি করত। তাকে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে বলা হত, এক পর্যায়ে রোগী ঘুমিয়েও যায়। সেরকম স্বপ্নে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করেছে আবির।

কম্পিউটারে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেই মানুষের মুখ তৈরি করা যায়। আসল মানুষের সঙ্গে সহজে এসব চেহারার পার্থক্য করা না গেলেও এমন চেহারার কোনো মানুষের অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। এদের ছবি তোমাকে দেখানো হত অফিসে। সেগুলো তোমরা গেমসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে। সেটা দেখতে দেখতে একসময় স্বপ্নেও তাদের দেখা শুরু করো। কারণ বলা হয়ে থাকে আমরা স্বপ্নে জাগ্রত অবস্থা এক ঝলক দেখা মানুষগুলোকেও দেখতে পারি। যদিও তাদের ভুলে যাই, কিন্তু স্বপ্নে দেখতে পাই। আবিরের সাথে রোজ রাতে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গেলেও স্বপ্ন দেখার পর্যায়ে আবির কথার মাধ্যমে তোমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রণ করত। আবিরের গবেষণা চলতে থাকে।

একসময় আবির চেষ্টা করে তোমাকে আসল কোন ঘটনা স্বপ্নে ঘটনা ঘটার আগেই দেখিয়ে দেওয়ার। সেই হিসাবে একজন সৎ পুলিশ অফিসারকে শিকার বানায়। অবশ্য উনি আবিরদের বেআইনি কাজের হদিশ পেয়েছিলেন। তাই আর কি, প্রথমে অফিসে তার ছবি তুর্যয় এর মাধ্যমে তোমাকে বার বার দেখায়। তারপর স্বপ্নে প্রয়োগের চেষ্টা চালায় আর সফল হয়। তারপর বাস্তব জীবনে তাকে সেভাবেই হত্যা করে। আর আবিরকে নিয়ে সেইদিন দেখা স্বপ্নটাও আবিরের একপেরিমেন্টের অংশ ছিল। সেজন্যই মৌটুসিকে বিয়ে করেছে আর আর হিমুর বাবার থেকে অনুপ্রানিত হয়ে তোমার উপর নিজের পরীক্ষা করেছে।

দ্যাটস ইট।”

নিশান্তের কথা শেষ হতেই বৃষ্টি একটা ঘোর থেকে বে রহয়ে আসে যেন। এই চার বছর যে সে কারো পুতুল হিসেবে ছিল এটাই মানতে কষ্ট হচ্ছে। এই জন্যই আবিরের বিয়ের পরেও সে নিজের অনুভূতি নিয়ে দোটানায় ছিল। নিজের আসল স্বত্ত্বাকে খুঁজে পেত না বলে মনে হত। কান্না করা উচিত কি না সেটা বুঝতে পারতো না। সবটা হজম করতে সময় প্রয়োজন। তাই সে সেখান থেকে উঠে চলে যায়। নিশান্ত বৃষ্টির অবস্থা দেখে তার পিছনে হাঁটা ধরলে পিছন থেকে প্রান্ত বলে ওঠে,

— “যা, বাকিটা আমি সামলে নিচ্ছি। বিয়ের দাওয়াত দিতে ভুলিস না। আমার জন্যই ফাইনালি বিয়ে করতে পারছিস যেহেতু।”

নিশান্ত হেসে সেখান থেকে চলে যায়।

_____

সবটা পরিষ্কার হওয়ার পর নিজেকে সবচেয়ে বোকা মনে হয় বৃষ্টির। সেই সময় বাড়ি ফিরে খালি গেমস খেলা ছাড়া একটা কাজও করেনি সে। যদি মাথা একটু ঠাণ্ডা করা যায়!

সারাদিন ঘর থেকে বৃষ্টি বের হচ্ছে না খালি গেমস খেলছে দেখে নিশান্ত বৃষ্টিকে টেনেই ছাদে নিয়ে গেল। আকাশের রং লাল হতে শুরু করেছে। নীল-লাল-সাদা রং লুকোচুরি খেলছে আকাশে। মৃদুমন্দ বাতাসে এক চরম নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। রেলিঙের কাছে দাঁড়ালে নিচে গলিতে ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে দেখা যাবে। বৃষ্টিকে দেখে মনে হচ্ছে এক বিশাল ঝড় হয়ে যাওয়ার পরের নীরবতা তার মধ্যে রয়েছে এখন। হুট করেই আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশান্ত বলতে শুরু করল,

— “আমি আসলে তোমার বাবার বন্ধুর ছেলে না। সত্য কথা বলতে গেলে আমার তো বাবাই নেই। মাও নেই। আর না আছে পরিবার। তোমার বাবার কাছাকাছি থাকতে তার এক বন্ধুর তথ্য নিতে হয়েছিল আমাকে। এর বেশি কিছু না।”

বৃষ্টি অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। এতক্ষনের চিন্তা সরে গেল মন থেকে। নিশান্তের করা কাজগুলো এক এক করে মনে পড়তে থাকল। আবিরের সামনে বলা কথাগুলো মনে পড়ল। বৃষ্টির জন্য এ বাড়িতে আসা! মাঝে মাঝে অভিমান করে নিশান্তের বলা কথাগুলো মনে পড়ল। সবটা যেন মিলে গেল কিভাবে। বৃষ্টির ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠল। এক চিলতে হাসি। সে নিশান্তের দিকে তাকাল না। আজ খুব করে ছেলেটা টানছে তাকে/ এতদিন দোটানায় ছিল। কিন্তু আবিরের প্রতি তার কোন অনুভূতি নেই বুঝ হওয়ার পর আজ কোন বাঁধা কাজ করছে না তার মধ্যে। নিশান্তের বলা প্রতিটা কথা মনে গভীর ভাবে দাগ কেটেছে অনেক আগেই। কিন্তু “প্লে-বয়” উপাধি দেওয়া ছেলেটার সকল কাজ আজ তার সত্য মনে হচ্ছে। নিশান্ত সত্যিই তাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলত!

শব্দ করে হেসে পাশ থেকেই নিশান্তকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরল। নিশান্তও হেসে ফেলল।

🍁🍁🍁🍁🍁

নিশান্ত আর বৃষ্টির বিয়ের দু বছর হয়ে গিয়েছে। সেদিন বৃষ্টির সম্মতি পাওয়ার পর আর সময় নষ্ট করেনি নিশান্ত। সরাসরি বাবাকে সবটা জানিয়ে দেয়। তারপর ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হয়।

সকালে,

ঘুম ভাঙতেই নিশান্ত চোখ আধ বোজা রেখেই পাশে হাত রাখল। জায়গাটা ফাঁকা। বুঝতে পারল বৃষ্টি উঠে পড়েছে। এখন হয়তো খাবার তৈরি করতে লেগে পড়েছে। চোখের রোদের আলো পড়ছে না গাছের কারণে। এই জায়গায় বাসা নেওয়ায় নিজেকে বেশ করে ধন্যবাদ দিল নিশান্ত। শুরুর দিকে বৃষ্টি নিশান্তের ঘুম ভাঙাতে ঘরের পর্দা সরিয়ে দিল। তাই পরের বার বাসা বদলানোর সময় গাছপালা দেখেই বাসা নিয়েছে। এখানে থাকতে হনে কয়েক মাস বোধ হয়। এর আগেও বেশ কয়েক বার বাসা বদলানো হয়েছে নিশান্তের কাজের জন্য। আবার বদলিয়েছে। নিশান্ত আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।

ঘুম আসতে না আসতেই বৃষ্টি খোঁচানো শুরু করে দিল। তাই সোজা হয়ে শুয়ে ঘুমুঘুমু কণ্ঠে জ্বালাতে মানা করল। বৃষ্টি তাকাল জানালার দিকে। গাছের কারণে রোদ ঘরে আসছে না বলেইএ তো কষ্ট করতে হচ্ছে তার। সে বলল,

— “এবার না উঠলে কিন্তু গাছের ডাল গুলো কেটে দেব।”

— “ভালোবাসি বউ। এবার একটু ঘুমাতে দেও তো আমার কিউট, সুইট বউ এক খান। গুলুমুলু।”

ঘুমের মধ্যে নিশান্ত কি বলছে সেটা সে নিজেও জানে না। বৃষ্টি দেরি না করে পিঠের উপর কিল বসিয়ে দিল। নিশান্ত চিৎকার করে উঠে বসল,

— “পুলিশ পুলিশ বাঁচাও। আমাকে মারছে।”

তারপর বৃষ্টি জোরে শব্দ করে হেসে ফেলল।

— “আজও ইচ্ছা করে এমন করেছেন তাই না? যেন আমাকে সকালেই হাসাতে পারেন।”

— “শুধু শুধু আমাকে মারলে বউ। আমি ব্যাথা পাই না?”

— “না।”

— “ভালো কথা। আমাদের আবা বাড়ি বদলানো লাগবে। এখানে কাজটার জন্য মনে হচ্ছে অন্য শহরে যেতে হবে।”

— “না, আমার গেমসের সব কিছুর সেট আপ আমি এই জায়গা ধরে করেছি। আপনি একা চলে যান। আমি যাব না।”

— “তা কি করে হয়?”

— “কিন্তু আমার গেমস? বানাতেই পারলাম না ঠিক করে আপনার জন্য।”

— “খাগড়াছড়ির টিকেট বাতিল করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।”

— “আই লাভ ইউ বর।”

— “আই লাভ ইউ ২, ৩, ৪, অনেক গুলা বউ।”

।সমাপ্ত।

[এতদিন পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। বিদায়]

আগের পর্বঃ-
https://www.facebook.com/106145991733793/posts/136361828712209

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here