স্বপ্ন
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০৫
রাতে খাবার খাওয়ার জন্য সবাই জড়ো হয়েছিল ডাইনিং টেবিলে। কিন্তু তখনও কোন কথা হয়নি বৃষ্টি-নিশান্তের মাঝে। শুধু আড়চোখে বৃষ্টি বার কয়েক তাকিয়ে পরোখ করে নিয়েছিল নিশান্তকে। নিশান্তের বলা ব্যাখ্যামূলক কথা তাকে ভাবাচ্ছে। অকারণে এতো যুক্তি দেখানোর কোন মানে হয় না। দেখা যাবে কিসব ব্যাখ্যা বলে কখন তার পেট থেকে সত্য কথা বের করে আনে। বৃষ্টি টেরও পাবে না। এজন্য সাবধানে থাকা জরুরি।
“লোকটা কি কাজ করে?”
ভাবালো বৃষ্টিকে, তবে সেটা শুধু কয়েক মুহূর্তের জন্যই।
আবার নিজের খাওয়ার দিকে মন দেয় সে। যা করার, করুক। সেই নিয়ে ভাবলে চলবে না। অফিস থেকে আজ ফেরার সময় আকিবের কাছে শুনেছে, তাদের কোম্পানি আবার নতুন গেমসের নামে অন্য একটা গেম হুবুহু নকল করতে চলেছে। এতে কোম্পানির শুধু মান সম্মান-ই যাবে। অবশ্য এই নিয়ে মাথা ব্যথা করার কোন কারণ নেই বৃষ্টির। সে করেও না। তার ইচ্ছা একটা নতুন গেম বানানোর। শুধু অভিজ্ঞতার জন্য অফিসে চাকরি করতে হচ্ছে। অফিসের কাজগুলো যথারীতি করে সেখানে অর্জিত অর্থ অন্য কাজে লাগায় সে। বাবা জীবনেও ওই টাকায় বাড়ির কিছু করতে দিতে রাজি হননি। শুরুর দিকে তিনিও বৃষ্টির কাজ নিয়ে বিরূপ মত পোষণ করেছিলেন, কিন্তু বৃষ্টির জেদের কাছে হার মানেন। বৃষ্টির মায়ের মতো বৃষ্টির বাবারও ইচ্ছা বৃষ্টি যেন ডাক্তার হোক, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তারাও বৃষ্টিকে জোর করেননি এ বিষয়ে। যার জন্য বৃষ্টি নিজের ইচ্ছা পূরণ করতে পারছে কোন বাঁধা ছাড়াই। যদিও জানা নেই, এতো দিনের পরিশ্রমের ফল কোনোদিন পাওয়া হবে কি না। কিন্তু চেষ্টা তো করেছি- এই কথাটা মনকে শান্তি দিবে। মাঝে বেশ অনেকটা সময় নিজের লক্ষ্য থেকে দূরে ছিল। আবিরের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এই কয়দিন নিজেকে আটকে রেখে এই কাজটা আবার শুরু করেছে। উন্নতির হার খুবই কম, তবুও হাল ছাড়েনি বৃষ্টি।
খেতে খেতে আবার আড়চোখে নিশান্তকে দেখে নিল সে। ছেলেটা খাবারের দিকেই সম্পূর্ণ মন দিয়ে রেখেছে। বসার ধরণ থেকে শুরু করে প্রতিটা কাজ নজর কাড়ার মতো। সোজা হয়ে বসে সেই যে খাওয়া শুরু করেছে, আর নড়েনি সে। বৃষ্টি নিজের দিকে তাকাল একবার। খেতে খেতে কখন যে চেয়ারেই পা মুড়ে বসেছে তার ঠিক নেই। কিন্তু শুরুতে স্বাভাবিক ভাবেই বসেছিল। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের পাশেই রাখা ছোট চামচটা ফেলে দিল আস্তে করে। তারপর সেটা নিতে মাথা নিচু করে বাকিদের দেখল। তার ভাই এর পা সবচেয়ে বেশি নড়ছে, তবে তার নিজের থেকে কম। বাবা স্বাভাবিক তবে নিশান্ত অতিরিক্ত মাত্রায় স্বাভাবিক। আর কোন কিছুর মাত্রা অতিরিক্ত কথাটায় ঠেকলে সেই বিষয়টা সাধারণ মানুষের কাছে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য হয় না। বৃষ্টি চামচটা তুলে আবার আগের জায়গায় রেখে খাওয়া শুরু করল। নিশান্তের দিক থেকে চাইলেও চোখ ফেরাতে পারল না। বারবার আড়চোখে দেখেই গেল তাকে। তারপর আবার কি মনে করে নিজের দিকে তাকাতেই দেখল, পা মুড়ে বসার পরও পা দুটো নাড়িয়েই চলেছে সে নিজে। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করল এই প্রথম তার। এখানে সবচেয়ে বেশি চঞ্চল কি সে নিজেই?
নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করল,
“আমি চঞ্চল না, মশাগুলোর কামড় থেকে বাচতেই পা নাড়াচ্ছি। টুরু সান্ত্বনা।”
নিশান্ত বৃষ্টির দিকে তাকালে স্বাভাবিক ভাবেই তাকাচ্ছে। মূলত বৃষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করছে। আর নিজের মাথায় থাকা বৃষ্টির ছবির সাথে মেলানোর চেষ্টা করছে। কিছুতেই মেলাতে পারল না সে। তার সামনে বসা মানুষটা আদৌ বৃষ্টি বলে মনে হচ্ছে না তার কাছে। “অকারণে লাফিয়ে বেড়ানো পোকা” বা “অকারণে উড়ে বেড়ানো তেলাপোকা” বলে মনে হচ্ছে। একটা মানুষ এতোটা কিভাবে নড়তে পারে, তাও খাওয়ার সময় সেটা ভাবনার বিষয়। সে যখন বাড়িতে আসলো, তখনও কি শান্তভাবে বসে ছিল। এটা কি সেই বৃষ্টি? একটা মানুষের হুটহাত পরিবর্তন নিশান্তকে ভাবাচ্ছে। এসেছিল বৃষ্টিকে জানতে, কিন্তু এবার তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে সে। এতো অল্পতেই উত্তেজিত হওয়া স্বভাব নয় তার। তবুও শুধু এই মেয়েটার ব্যাপারেই তার মধ্যে একটু বেশিই উত্তেজনা কাজ করছে।
।
।
সকাল হতেই রোজকার রুটিন। খাবার সেরে কাপড় বদলে অফিসের জন্য ছুটে যাওয়া। অফিস দূরে হলেও রিকশা দিয়েই যাওয়া আসা করে। মাঝে মাঝে হেঁটে যায় অর্ধেক পথ। তবে সব সময় না। যখনই মনে হয় ওজন একটু বেড়ে যাচ্ছে, তখনই হাঁটা আরম্ভ করে। আর নাহলে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটালেও তার মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে না। তবে আজ দেখা গিয়েছে ভিন্ন দৃশ্য। খাবার শেষে বাড়ি থেকে নামা পর্যন্ত সবটা ঠিক থাকলেও সামনে একটা রিকশায় নিশান্তকে বসে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। অকারণে রিকশা দাঁড় করিয়ে রাখার কারণ বুঝতে না পেরে নিজের পথে হাঁটা শুরু করে। আর একটু সামনে থেকে রিকশায় উঠে পড়বে। এমনিই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বার বার জানান দিচ্ছে- এই ছেলেটার থেকে দূরে থাকার জন্য। সুবিধার ঠেকছে না তার কাছে।
কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই বৃষ্টিকে আটকাল নিশান্ত।
— “শোনো বৃষ্টি, দাঁড়াও।”
বৃষ্টি থেমে গেল সাথে সাথেই। নিশান্ত নামল না রিকশা থেকে। উল্টো তাকেই নিজের কাছে আসতে বলল সে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অমান্য করতে পারল না তার কথাটা। ফিরে আসলো সেখানে। নিশান্ত এক মুখ হাসি নিয়ে বলল,
— “রিকশায় উঠে পড়। দেরি করো না।”
বৃষ্টি অবুঝের মতো চেয়ে রইল শুধু। মাঝ রাস্তায় হুট করে কেউ রিকশায় উঠতে বললে কি করা উচিত সেটা ভাবতে সময় নিল কিছুটা। মানুষটা অপরিচিত হলে মুখের উপর না বলে দিত। কিন্তু পরিচিত হওয়ায় মুখের উপর ‘না’ বলার সময় কথায় একটু বাড়িয়ে কমিয়ে বলতে হবে কি না সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই চোখ গেল সামনের দিকে। আবির পরম যত্নে মৌটুসির শাড়ির আঁচল গাড়িতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সেদিকে অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবার পিছনে রিকশায় বসা নিশান্তের দিকে তাকাল। নিশান্ত ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে বৃষ্টির হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠে বসার তাড়া দিল। বৃষ্টি তাই করল যা তাকে বলা হলো। কিন্তু চোখ আবার সামনে চলে গেল। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে দুজনকে একসাথে, হয়তো! গাড়ি চলে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকার পর আবার ধ্যান ভাঙল তার। পাশে নিশান্ত এসে ততক্ষণে বসে পড়েছে। একটু সরে বসতে গিয়ে খেয়াল করল হুড তুলে দেওয়া। তাই চাইলেও নড়তে পারল না। সে নিশান্তের দিকেই তাকিয়ে রইল। যেন তাকে চোখে চোখেই এই প্রশ্ন করছে- “তখন এত তাড়া দেওয়ার কারণ কি ছিল? সে কে তাকে নিয়ে উপহাস করতে চাইছিল?” বৃষ্টির চোখ দেখে নিশান্ত প্রথম প্রশ্ন সহজেই আন্দাজ করতে পারল। কিন্তু তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দেখে আবার ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। বৃষ্টির মনে নিশান্তকে নিয়ে প্রতিকূল চিন্তার উদয় ঘটেছে সেতা বুঝতে অসুবিধা হল না তার। তবে একটা কাজ করতে এসে তার বিপরীত ফলাফল পাওয়ায় হতাশ হলো একটু। বৃষ্টির কাছাকাছি আস্তে গিয়ে উল্টো নিজের সম্পর্কে নেগেটিভ মন্তব্যের সৃষ্টি করেছে সে। অজান্তেই মুখটা ছোট হয়ে এলো তার। হোক পরিচিতি দুদিনের, কিন্তু এমন ভাবনা আশা করে নি বৃষ্টির কাছ থেকে।
অত্যন্ত গোপনে নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার আগেই দীর্ঘশ্বাস লুকালো নিশান্ত। তারপর নিজের আসল কাজে মন দিল। নিরবতা কাটিয়ে কথা বলার জন্য পাশে তাকাতেই দেখল, বৃষ্টি ততক্ষণে তার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছে। চোখ বন্ধ করে প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগের চেষ্টা করছে সে। মুখে রিকশার হুডের সামনের খোলা অংশ থেকে রোদ এসে পড়ছে ঠোঁটে। ঠোঁটের কম্পন অনুভব করতে পেরে চোখের দিকে তাকাল। পাপড়ি আধভেজা। আবার মুখ ভেজে নি চোখের জলে। যেন কান্না করবে কি করবে না সেটা নিয়েও দ্বিধায় ভুগছে বৃষ্টি। নিশান্ত অবাক হলো। সাধারণত মেয়েরা হয় শক্ত হয়ে নিজের কান্না সামলায় নাহয় নরম হয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। কিন্তু কান্না নিয়ে কাউকে দ্বিধাবোধ করতে প্রথম দেখছে সে। আবিরের গাড়ির কথা মনে পড়তেই আবার সেই অজানা রাগটা জেঁকে ধরল তাকে। তবে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে আবার নিরবতা ভাঙায় মন দিল।
— “জিজ্ঞেস করলে না, আমি কেন রিকশায় ওঠালাম তোমায়?”
— “না।”
— “কেন? যদি আমি তোমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাই?”
— “ইচ্ছা করছে না। ভালো লাগছে না।”
— “আবার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব?”
— “দরকার নেই। এমনিই অনেকদিন ধরে অফিস যাওয়া হয়নি। এখন বাদ দেওয়া যাবে না।”
— “আচ্ছা।”
তারপর আবার নিস্তব্ধতা। অপ্রাসঙ্গিক কথা শুরু করাই হয়তো উচিত হবে ভেবে জানা থাকা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল নিশান্ত,
— “তুমি কি করো?”
— “আমার জানামতে বাবার এতক্ষণে আপনি জানতে না চাইলেও বলে দিয়েছে কথাটা। আবার জিজ্ঞেস করলেন?”
— “এমনিই কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
— “কেন? আবার ফ্লার্ট করবেন?’
— “ধরে নিতে পারো তাই।”
— অদ্ভুত মানুষ আপনি।”
— “সেটাও বলতে পারো। তবে আজ থেকে তোমাকে নিয়ে যাওয়া আসা আমি করব।”
— “কি? আপনি কি এজন্য আমাদের বাড়ি এসেছেন?”
— “না, আমার কাজেই এসেছিলাম। হোটেলে থাকা সমস্যা হচ্ছিল বলে আংকেল বললেন এখানে থাকতে। মানা করিনি। তবে তোমাকে আনা নেওয়ার ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। আমার কাজ শুরু থেকে শেষ হওয়ার সময়টা মিলে যায় বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
— “তো আপনি কি করেন?”
— “এই তো, মানুষদের রিকশায় করে গন্তব্যে পৌঁছে দেই।”
— “মজা করবেন না, সত্যি বলুন।”
— “তোমাকে দেখতে আজ সুন্দর লাগছে।”
অসময়ে হঠাৎ বলা কথায় না চাইতেও মুখে লালাভ আভা চলে আসলো বৃষ্টির। নিশান্তের কণ্ঠে কিছু একটা ছিল, যেটা না চাইতেও বৃষ্টিকে লজ্জা পেতে বাধ্য করেছে। আর জানার ইচ্ছা থাকলেও সামনে আরও প্রশ্ন করার জন্য কথা বের হলো না মুখ থেকে। গলা পর্যন্ত এসে সেখানেই আটকে থেকে ধীরে ধীরে যেন হারিয়ে যেতে থাকল কথাগুলো। সে জানে, নিশান্ত ইচ্ছা করেই এমন কথা বলেছে। হয়তো এই কথা নিয়ে সে সিরিয়াসও নয়। হয়তো কাজের প্রসঙ্গ এড়াতেও চাইতে পারে। কিন্তু এতো জানার ভেতরেও প্রশ্ন করে উঠতে পারল না। ওই যে, কথা গলা পর্যন্ত এসে হারিয়ে যেতে থাকল। মুখ থেকে লালাভ আভা সরল না। উল্টো বৃষ্টিকে আরও লজ্জায় ফেলতে নিশান্ত ধীম কণ্ঠে বলে উঠল যেন,
— “সত্যিই দারুন লাগছে তোমাকে।”
বৃষ্টি নিশান্তের দিকে চাইল। সত্যিই কথাটা বলেছে নাকি এটা তার আরেক কল্পনা সেটা নিশ্চিত হতে। কিন্তু দেখল, নিশান্ত অন্যদিকে চেয়ে রয়েছে। হয়তো এতক্ষণ করা সবটুকুই কল্পনা। অবশ্য নানা স্বপ্নে ডুবে থাকা বৃষ্টি, নতুন গেম তৈরি করতে সব সময় কল্পনায় ডুবে থাকতে থাকতে কখন যে আসল ঘটনার সম্মুখীন হয় আর কখন কল্পনার – সেটা আলাদা করতে ব্যর্থ হয় প্রতিবার। তাই চুপ করে বসে রইল সে। কিছুক্ষণ আগের কথোপকথনকে নিছক কল্পনা ভেবে সামনে তাকাল। ট্রাফিকে জ্যামে আটকে গিয়েছে তারা। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
তবে কল্পনা ভেবে আগের ঘটনাকে উড়িয়ে দেওয়া বৃষ্টি জানতেই পারল না তার পাশে বসে থাকা নিশান্ত বহুদিন পর অনেকটা সময় ধরে মুখ ঘুরিয়েই মুচকি হেসেছে। শুধুমাত্র তাকে লজ্জিত হতে দেখে, গরমের পাশাপাশি লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসতে দেখে। বেচারা নিশান্তও হয়তো লজ্জা পেল আজ! অনেকদিন পর কিংবা হয়তো প্রথমবার!
চলবে।
আগের পর্বঃ-
https://www.facebook.com/106145991733793/posts/134878265527232