স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। পর্ব-৩

0
1989

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

এলাকার টং দোকানে চায়ের কাপে আড্ডা জমে উঠেছে। একটি কাঠের বেঞ্চে বসে অনিক আর জাওয়াদ খোশগল্পে মত্ত। অনিকের হাতে চায়ে কাপ। জাওয়াদের হাতে সিগারেট। সিগারেটের নেশা আছে তার। দিনে দুই প্যাকেট বেনসন না হলে চলেই না। অফিস থেকে অনিকের এলাকা হয়ে ফিরে সে। মাঝে যাত্রাবিরতি নিয়ে টং বসে। অনিককে ডেকে সুখ, দুঃখের ঝুলি খুলে বসে দুই বন্ধু। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। ঘড়ির কাটায় রাত দশটা। ওদের আড্ডাকালীন সময়টা ঘন্টা পেরুলো । কথা বলার মাঝে থেমে গেল জাওয়াদ। টং দোকান সংলগ্ন রাস্তা ধরে হাটছেন নাজমুল সাহেব। জাওয়াদ বন্ধুকে ইশারা করল,
‘ইনাকে সেদিন রাফার বাসায় দেখেছিলাম।’

অনিক চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে সামনে তাকাল। ভদ্রলোককে পরখ করে বলল,

‘ইনিই নাজমুল আংকেল। তোর বাবুনীর বাপ। ‘

গ্রীষ্মঋতুতে বৃষ্টিকন্যার আগমনটা একবারেই বিনা সঙ্কেতে হয়। চাঞ্চল্যে মাখা মুক্তোফোটার দেখা মেলে দৈবাৎ। হুটহাট এসে সবার কপালে বিস্ময়ের রেখা ছাটানো যেন তার প্রধান কর্তব্য। বলা নেই, কওয়া নেই। আকস্মিক মেঘ চিরে মুক্তোফোটা নামল। ছন্দে আনন্দে আকাশ বেয়ে পড়ল জমিনে। বৃষ্টির বেগ প্রবল, সাথে যোগ হয়েছে শিলা। বাতাসের বেগে টং দোকান উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আড্ডার ইতি টেনে অনিক চায়ের কাপ আর টাকা দোকানির হাতে তুলে দিয়ে ছুটল সামনের দিকে। একবার পিছু ফিরে ডাকল,
‘এদিকে আয়। ওখানে থাকলে ভিজে যাবি।’

জাওয়াদ অনুসরণ করল বন্ধুকে। কয়েক কদম এগুতেই একটা ফার্মেসি পড়ল। যার সামনের দিকটায় সিড়ির বহর। বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণের জন্য মাথা গুজার যথেষ্ট জায়গা আছে। দুই বন্ধু গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিল। খানিক বাদে সেখানে উপস্থিত হলে নাজমুল সাহেব। জাওয়াদ নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে বন্ধুকে নিঁচুস্বরে বলল,
‘ভদ্রলোকের সাথে তো তোর পরিচয় আছে। কথা বল।’

ইঙ্গিতটা কোনদিকে বুঝতে অসুবিধা হলো না অনিকের। সে ভ্রু কুঁচকাল। বিস্ময় ভরা চাহনিতে জিজ্ঞেস করল,
‘ তোর মাথা থেকে এখনো মেয়েটার ভূত নামেনি!’

তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না জাওয়াদ। নিঃশব্দে সিগারেটে টান দিল। আকস্মিক বিরক্তভরে বলল,
‘এই মেয়ে মাথা কিনে নিয়েছে আমার। গত এক সপ্তাহ অপ্রাণ চেষ্টা করেছি ভুলে যাওয়ার। যত যাই হোক, দ্বিতীয়বার বাবুনি পোষার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু পারলাম কই? তার রূপের ঝিলিক এসে চোখে বিধছে বারবার। মাথা, মন কোনোটা থেকে সরছে না। বিরক্ত লাগছে। কী করি বলতো?’

হিসহিসিয়ে নিজের উপর বিরক্তি ঝাড়ল জাওয়াদ। অনিক ঠোঁট চেপে হাসল। কৌতুকের স্বরে বলল,
‘ বিয়ে কর, বাবুনি পোষ। বাবু পয়দা কর। আমাকে বছর বছর পাঞ্জাবি উপহার দিবি। করার থাকলে এই কাজগুলোই আছে। ‘

জাওয়াদ তীক্ষ্ম চোখে তাকাল বন্ধুর দিকে। অনিক হেসে বলল,
‘আমি তোর শ্বশুরের সাথে কথা বলছি। দাঁড়া।’

জাওয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাজমুল সাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল অনিক। জাওয়াদ পথচারীর মতো উঠে নাজমুল সাহেবের পিছু গিয়ে দাঁড়াল। এমন ভান করল যেন অনিককে সে চিনে না। অনিক বিনম্র স্বরে সালাম দিল। নাজমুল সাহেব প্রসন্ন হেসে উত্তর দিলেন। হেসে বললেন,
‘তুমি ও আটকা পড়েছিলে না কি!’

‘ওই আর কি। তা আপনি এ সময় কোথা থেকে ফিরছেন?’

কৌতুহলী জানতে চাইল অনিক। নাজমুল সাহেব বললেন,
‘ বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। ফিরতে দেরি হয়ে গেল।’

এরপর কী বলা যায়? কথা খুঁজে পেল না অনিক। আগ বাড়িয়ে মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করাটা কেমন দেখাবে? তা ছাড়া এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার মতো পরিচয় কিংবা অধিকার নেই তার। কথা খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে। ফোন বাজল নাজমুল সাহেবের। পকেট থেকে ফোন বের করে সামনে আনলেন। চোখ বুলালেন। ‘Rafa’ নামটা জ্বলজ্বল করছে ফোনের পর্দায়। নাজমুল সাহেব মৃদু হাসলেন। অনিক এক পলক ফোনের দিকে তাকিয়ে তড়িৎ ঘাড় ঘুরাল। জাওয়াদের দৃষ্টি নাজমুল সাহেবের ফোনে আবদ্ধ। চোখে মুখে কৌতুহল। নাম্বারটা রপ্ত করেছে নিশ্চিত। এই ছেলের স্মৃতিশক্তি প্রবল। অনিক হাসল কেবল। চোখ ফেরাল। সচেতন হয়ে কান পাতল নাজমুল সাহেবের কথায়।
‘হ্যালো রাফা?’

রাফা কী বলল শুনা গেল না। নাজমুল সাহেব বলে গেলেন থেমে থেমে,
‘ না বাসায় পৌঁছাতে পারিনি। বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি। এই তো বাসার কাছেই ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তোর জোরাজোরির পরও ছাতা নিয়ে বের না হয়ে সত্যি ভুল করেছি। তোর কথা শোনা উচিত ছিল।’

কথার মাঝে আকস্মিক হেসে উঠলেন নাজমুল সাহেব। হেসে বললেন,
‘ ফাইজার জায়গাটা তোর হলে ভালো হতো। সারাক্ষণ বাসায় থেকে আমাকে ঠিক করতে পারতি। তুই বরং কাল চলে আয়। আর যাস না ও বাসায়। তোকে ছাড়া বাসাটা খালি খালি লাগে। মনে পড়ে তোর কথা। আর শুন, ফরিদা কাঁদছে তোর জন্য। ফোন দিয়ে কথা বলিস। আচ্ছা ছাড়ছি। আল্লাহ হাফেজ।’

ফোন রাখলেন নাজমুল সাহেব। প্রসন্ন হাসলেন। আবেগী সুরে অনিকের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ কিছু কিছু মানুষকে সারাজীবন পাশে রাখার নিয়ম থাকা উচিত। অন্তত আত্মিক শান্তির জন্য।’

‘রাফা কে, আপনার মেয়ে?’ প্রশ্নটা করা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে অনিকের।

নাজমুল সাহেব হাসলেন,
‘বলতে পারো। ওকে আমার মেয়ে বলতেই ভালো লাগে । আপন আপন লাগে। ‘

অনিক গোলকধাঁধায় পড়ল যেন।
‘আপনার মেয়ে নয়?’
‘ আমার ভাগ্য এতটাও ভালো নয়।’ আফসোসের সুরে বলল নাজমুল সাহেব।

অনিক ভ্রু কুঁচকাল। নাজমুল সাহেবের কথার মারপ্যাঁচ বোধগম্য হচ্ছে না ওর। চোখে মুখে উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে রইল,
‘ বুঝতে পারছি না আংকেল। ‘

‘ কিছু সম্পর্ক থাকে রক্তের। আর কিছু সম্পর্ক থাকে আত্মার। আত্মার সম্পর্কে জন্ম না দিয়েও বাবা হওয়া যায়, মেয়ে মানা যায়। তেমন একটা সম্পর্ক আমাদের। আমার দুই মেয়ে, ফাইজা ফাবিহা। রাফা আমার বোনের মেয়ে। অথচ আমার কাছে অতি আপন রাফা। ‘ শান্ত স্বরে বেশ রহস্য করে বললেন নাজমুল সাহেব।

তার এই শান্ত কথায় অশান্ত হলো জাওয়াদের মন। নাজমুল সাহেবের দুই মেয়ে না হলে মেয়েটা বাবুনি ধরণের হওয়ার শঙ্কাটা গেল বিলীন হয়ে। হতে পারে মেয়েটা ওর মনের মতো কেউ। পিছিয়ে রাখা পা টা এগিয়ে গেল। চোখ মুখ থেকে বিরক্তি স্বরে গিয়ে বিস্ময় দেখা গেল। বিস্ময়ে মিশে একাকার হলো খুশির রেখা। জাওয়াদ হাসল, হাসল ওর চোখ। অনিক তড়িৎ ঘাড় ঘুরাল। বন্ধুর উৎফুল্ল মুখ দেখে সেও প্রসন্ন হাসল। বলল,
‘আসোলেই, আমাদের জীবনে থাকে এমন কিছু আত্মার আত্মীয়।’

নাজমুল সাহেব উৎফুল্ল হয়ে বললেন,
‘ রাফা ওয়ান্ডার গার্ল। ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললে ওকে আত্মায় স্থান দেয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায়, যে কারো পক্ষে। এত সুন্দর ব্যক্তিত্বের মানুষ আমি দুটো দেখিনি। সবে বিশ পেরুল, এই ছোট্টো জীবনটাকে কী সুন্দর গুছিয়ে নিয়েছে। দেখলে অবাক লাগে। তোমার আন্টির ভীষণ আফসোস তার কেন একটা ছেলে নেই, থাকলে রাফাকে বিয়ে করিয়ে দেখে দিত। ‘ প্রাণবন্ত হাসলেন নাজমুল সাহেব।

মানুষ যাকে পছন্দ করে, তার গল্প করতে পছন্দ করে। নাজমুল সাহেবের পছন্দের মানুষ রাফা। রাফার প্রসঙ্গ এলে তিনি আগ বাড়িয়ে কত কথা বলে পেলেন। শান্তি পান। এই যে এখন বলে দিলেন, চিন্তা ও করলেন না তার এই কথা গুলো বিপরীত পক্ষের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে। বা অবিবাহিত পুরুষের সামনে ভাগ্নির গুনগান করা উচিত হচ্ছে কি-না।

জাওয়াদের হাসিটা চওড়া হলো। চোখ মুখ আনন্দে চিকচিক করছে। খুশিতে আত্মহারা সে। অনিক আবার পিছু ফিরল। জাওয়াদের আনন্দটা পরখ করল। পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নিচু স্বরে বলল,
‘ আউট অব ডেঞ্জার। ট্রিট কবে দিবি?’

জাওয়াদের হাতে সিগারেগ। জ্বলজ্বল করছে। সে স্থবির দাঁড়িয়ে আছে। সে বন্ধুর দিকে তাকাল। আকস্মিক জড়িয়ে ধরল,
‘তুই উকিল বাবা হ আগে।’

অনিক বন্ধুকে ছাড়িয়ে গম্ভীরমুখে বলল,

‘তুই কি সিরিয়াস? অনেক মেয়ে এসেছে তোর জীবনে। কারো উপর বেশিদিন অনুভূতি টিকিয়ে রাখতে পারিস নি। অনুভূতিহীন হয়ে গেছিস। এবার পারবি? প্রেম তো হবে না, বিয়েই করতে হবে। সারাজীবনের প্রশ্ন। বিয়ে কোন ছেলে খেলা নয়। একজনের উপর এক অনুভূতি নিয়ে জীবন পার করতে হবে , পারবি? ভেবে চিন্তে বল।’

জাওয়াদ উত্তর দিতে সময় নিল না,
‘ আমি এতটা আকর্ষণ কারো প্রতি অনুভব করতে পারিনি। এতটা অনুভূতিপ্রবল হইনি কখনো। এই অনুভূতি কাটবে না সহজে। আমি ভেবেচিন্তে বলছি, রাফাকে আমার জীবনে আনতে চাই। সারাজীবনের জন্য।’

অনিকের মুখের গম্ভীরতা কাটল না,
‘ আংকেলের সাথে কথা বলে যতটুকু জানতে পারলাম, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়ে। ওকে কষ্ট দেয়া উচিত হবে না। তুই আরও ভাব। নিজেকে ঠিক কর। আমাকে নিশ্চয়তা দিবি, যে তুই সব ছেড়ে একজনে মত্ত হবি। কারো দিকে নজর দিবি না। তাহলে আমি উকিল বাবা হবো। নয়তো একটা জীবন নষ্ট করার কোন চেষ্টাই করব না আমি। ‘

জাওয়াদ আশ্বাস দিল,
‘বিশ্বাস কর আমি পারব। তুই আমাকে চিনিস, আমি যা বলি তাই করি।’

‘আমি তোকে চিনি বলেই দ্বিধায় আছি। একটা জীবনের প্রশ্ন, আমি এভাবে হেলায় নিতে পারিনা। তুই আরও ভাব। সময় নে। তারপর আমাকে জানা। আমি নিজে আগাব এ ব্যাপারে। এটা প্রেম নয়, এটা বিয়ে। প্রেমটা দু’দিনের, বিয়েটা সারাজীবনের। প্রশ্নটা আবেগের নয়, প্রশ্নটা জীবনের, প্রশ্নটা বিবেকের। বি সিরিয়াস দোস্ত! ‘

অনিকের স্বর নরম হলো। জাওয়াদ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘আমি সিরিয়াস। এত সিরিয়াস আগে কখনো হইনি। বিশ্বাস রাখ আমার উপর! ‘

বন্ধু বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারবে কি-না যথেষ্ট সন্দেহ অনিকের। কারণ এই বন্ধুকে রগে রগে চেনা তার।
বাস্তবিক অর্থে, এতটা সিরিয়াস জাওয়াদকে কোন রিলেশনশিপে দেখা যায়নি। কাউকে পেতে এত উৎকন্ঠা, এতটা খুশিও হয়নি সে।
কিন্তু এই লক্ষণ কতক্ষণ স্থায়ী হবে অনিকের জানা নেই। তার মন কোন নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। নিশ্চয়তা বোধহয় জাওয়াদের মন ও দিতে পারবে না। কারণ জাওয়াদের মন জানে, সে তার অনুভূতি কতটা পরিবর্তনশীল।
রূপে মজে দুইদিন বাদে রূপের আকর্ষণ শেষ হয়ে গেলে, বলবে এক ঘেয়ামি এসে গেছে। আর ভালো লাগছে না। তার কত প্রেম এভাবে ঝরে গেছে। অনিকের ভাবনা, তার কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে হাজারবার ভাবতে হবে। হুটহাট বন্ধুর কথায় মজে গিয়ে একটা জীবনকে নষ্টের পথে ধাবিত করা যাবে না।

অনিক বন্ধু কাধ চাপড়াল,
‘সময় নে আরও। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। উকিলদের পাত্র পাত্রী সম্পর্কে খোঁজ নিতে হয়। তারপর উকিলের যদি মনে হয়, হ্যাঁ এই পাত্রীর সাথে পাত্রকে মানাব, দুজনে সারাজীবন সুখে-শান্তিতে কাটাতে পারবে। তবে বিয়ের দিকে আগায়। আমাকে একনিষ্ঠভাবে উকিল হতে দে। জীবনের প্রথম ঘটকালি করব, অভিজ্ঞতা এবং পরিণতি কোনটাই খারাপ হওয়া যাবে না। ‘

বৃষ্টি বেগ কমে গেছে। এখন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে এগারোটা বাজতে চলল। এখন বাসায় না ফিরলেই নয়। নাজমুল সাহেব পা বাড়ালেন। সিড়িতে অনেক মানুষ। অনিককে কোন ফাঁকে দেখে যাওয়ার আগে অনিকের উদ্দেশ্য বললেন,
‘ আমার দেরি হচ্ছে। যাই।’

দুই বন্ধুর আলাপ থেমে গেল। তারা চাইল নাজমুল সাহেবের পানে। তিনি ততক্ষণে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছেন। জাওয়াদের হাতে সিগারেট। টান দিতে মুখের সামনে ধরল। আকস্মিক কী যেন ভেবে থেমে গেল। এক পলক তাকিয়ে পায়ে পিষে ফেলল। ওর গায়ে জড়ানো শার্টের হাতা কনুইয়ে ভাজ করা। বুকের দুটো বোতাম খোলা। কাধে ঝুলানো অফিসিয়াল ব্যাগটা নড়বড়ে। নিজেকে একবার পরখ করল সে। হাতা ঠিক করল, বোতাম লাগাল। ব্যাগের চেইন খুলে ভেতর থেকে ছাতা বের করল। ছাতা মেলে বলল,
‘একমিনিট দাঁড়া, আমি আসছি।’

অনিক সচেতন চোখে ওর কাজ পরখ করছে। জাওয়াদ কী করতে চাইছে দেখতে চাইল ও। কিছু বলল না। জাওয়াদ দ্রুত সামনে এগুলো। পথচারীর মতো নাজমুল সাহেবের পাশ কাটল। আকস্মিক থামল, বৃষ্টিভেজা ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বিনম্র স্বরে সালাম দিল। পরপরই বলল,
‘আংকেল আপনি আমার ছাতাটা নিন। ‘

নাজমুল সাহেব হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন । ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘তুমি কে বাবা? ‘

জাওয়াদ উপচে পড়া ভদ্রতা স্বরে, শরীরে মাখিয়ে বলল,
‘ আমি জাওয়াদ। পথচারী ও বলতে পারেন। ‘

‘কিন্তু তুমি আমাকে ছাতা দিচ্ছ কেন? তুমি কিভাবে যাবে?’

জাওয়াদ নিশ্চিত সিড়িতে ভদ্রলোক ওকে খেয়াল করেনি। তাই বলল,
‘আমার গাড়ি দাঁড় করানো আছে। আমি তো গাড়ি করে যাব। আমার ছাতা লাগবে না। গাড়িতে বসে দেখলাম আপনি ভিজে ভিজে যাচ্ছেন, তাই ভাবলাম ছাতাটা দিলে আপনার উপকার হবে। এই ভেবেই আসা। ‘

নাজমুল সাহেব আগন্তুকের এহেন আচরণে কিছুটা অবাক হলেন। আজ-কালকার সময়ে কত রকম মলম পার্টি বের হয়েছে। মানুষকে কথায় ভুলিয়ে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয়। এই ছেলে এমন কেউ না তো! অন্তর্ভেদী চোখে পরখ করলেন। নাহ দেখতে তো ভদ্রই মনে হচ্ছে। গলায় ঝুলানো আইডি কার্ড স্পষ্ট জানান দিচ্ছে তার চাকরিজীবী হওয়ার কথা। আচরণ ও বেশ মার্জিত। উদ্দেশ্য ভালোই হবে হয়তো। অনিক নাজমুল সাহেবের মাথায় ধরল ছাতা। উনাকে দ্বিধামুক্ত করতে বলল,

‘ আমার কোন বাজে উদ্দেশ্য নেই আংকেল। আমার বাবা পাশে থাকলে আমি কখনো তাকে ভিজে যেতে দিতাম না। আপনাকে দেখে বাবার কথা মনে পড়ল, তাই এগিয়ে এসেছি। বিশ্বাস করে ছাতা নিন। যদি ছাতায় রাখতে সমস্যা হয় তবে টং দোকানে রেখে দিয়েন। আমি কাল নিয়ে যাব। তবু ও নিন আংকেল!’ নম্রভাবে অনুরোধ করল জাওয়াদ।

এ পর্যায়ে নাজমুল সাহেবের চোখে মুগ্ধতা ভর করল। কী চমৎকার ব্যবহার ছেলেটার! এমন সহানুভূতিশীল ছেলে আজকাল মেলা ভার। দ্বিধা কাটল তার। ছাতা নেয়ার আগে জাওয়াদের পরিচয় জানলেন। তারপর ছাতা নিলেন। জাওয়াদ ছাতা হাতে ধরিয়ে হাটা ধরল। যাওয়ার আগে বিনম্ব স্বরে সালাম দিতে ভুলল না। নাজমুল সাহেবের মনে নিজের জন্য একটা নরম জায়গা করে নিল একটু সময়ে।

নাজমুল সাহেব দৃষ্টির আড়াল হতেই জাওয়াদ হাফ ছাড়ল। অনিকের কাছে গেল। অনিক বলল,
‘কাউকে বশে আনার উপায় শেখার জন্য তোর কাছে আসা উচিত মানুষের। সব জানা তোর! ‘

জাওয়াদ হাতা গুটাতে গুটাতে বলল,
‘ আমার অনেক বছরের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা। কোন খাদ নেই। ভদ্রলোকের চোখে মুগ্ধতা দেখলাম আমার জন্য। হবু মামা শ্বশুরের ভোট কনফার্ম। ‘

অনিক কৌতুকের সুরে বলল,
‘অথচ আমিই জানি, ভদ্রলোক তোকে ভদ্র ভেবে কত বড় বদকাজ করছেন!’
জাওয়াদ প্রতিবাদ করল,
‘এতটাও খারাপ না আমি। শুধু কয়েকটা প্রেম করেছি এই যা। ‘

‘কয়েকটা!’ অবাক হয়ে বলল অনিক। জাওয়াদ ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘দশ-পনেরোটা। ‘ চোরা চোখে চেয়ে বলল জাওয়াদ।

অনিক বলল,
‘ভালো হয়ে যা, ভালো হওয়া ছাড়া বউ পাবি না।’

‘রাফা আসলে সব ছেড়ে দিব। তুই শুধু ব্যবস্থা কর। ভীষণ জ্বালাচ্ছে মেয়েটা। ঘুম টুম ও হচ্ছে না ঠিকমতো। কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না। আজ বস ঝেড়েছেন। শান্তির ঘড়িতে বারোটা বেজে আছে। এই মেয়েটাকে এখন আমার জীবনে আনা বাধ্যতামূলক। আমি বাসায় জানাব শীঘ্রই। তুই এদিকটা ম্যানেজ কর। ‘ অনুরোধ ঝরে পড়ল জাওয়াদের স্বর থেকে ।

অনিকের মনটা দ্বিধার সাগরে ডুবে আছে। ওর উকিল বাবা হওয়া উচিত হবে? কারো অভিশাপের কারণ হবে না তো! তবে তার প্রার্থনা, বন্ধুটা বদলাক। তার এলোমেলো জীবনটা এবার গুছিয়ে যাক। জাওয়াদের মায়ের আফসোসের পাল্লা কমুক এবার।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here