স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। পর্ব-১৩

0
1672

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-১৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

বেলা তখন বারোটা। চারদিকে খা খা রোদ। রোদে পুড়ে ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বন্ধুর বাসায় এসেছে অনিক। গ্র‍্যান্ড ফ্লোরে লিফটের সামনে জাওয়াদের দেখা পেল। জাওয়াদ ওকে দেখে চমকাল,

‘তুই!’

‘হ্যাঁ, কই যাস?’

‘তোর বাসায় যাচ্ছিলাম। ‘ গম্ভীরমুখে জবাব দিল জাওয়াদ।

অনিক ভ্রু কুঁচকাল,
‘ নিজের বাসায় সবাইকে দাওয়াত দিয়ে আমার বাসায় যাচ্ছিস কেন?’

‘বাসায় ভালো লাগছে না। আজাইরা ক্যাচাল।’ ক্ষিপ্ত গলায় বলল জাওয়াদ।

অনিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে খুলে বল তো?’

‘শালা, বিয়ে করলাম শান্তির জন্য। কিন্তু অশান্তিই ছাড়ে না। শ্বশুর বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথে শুরু করেছে অশান্ত। বসার ঘরে যাবে না। ঘরভর্তি মেহমান। সবাই বসে আছে বউ দেখার জন্য। ও যাবে না কারো সামনে। মা রেগে আগুন। আমার সাথে রাগারাগি করছে। ভাবি ওকে জোর করছে যেতে, যাচ্ছেই না। এসব ক্যাচাল দেখেই বাসা ছাড়ছি।’ রাগে গরগর করছে জাওয়াদ। অনিক হতভম্ব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কথা বলল না। তারপর বলল,
‘তুই আন্টিকে কিছু বললি না কেন?’

‘আমি মায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারব না। ‘ কড়া স্বরে বলল জাওয়াদ। অনিক কটাক্ষ করে বলল,
‘ এ অবধি তুই কবে আন্টির পক্ষে ছিলি বলতো? আমার তো মনে পড়ে না কবে তুই আন্টির কথা শুনেছিস? বিয়ের আগে মাকে হাজারটা অনুচিত কথা বলতে পারবে অথচ বিয়ের পর মাকে একটা উচিত কথা বলতে পারবে না! শালা, সমাজটাই পঁচে গেছে। বউ আর মায়ের দ্বন্দ্বের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে স্বামীর। সে চাইলে দুই পক্ষকে বুঝিয়ে সমস্যা সমাধান কর‍তে পারে। অথচ সে এক পক্ষীক হয়ে অন্য পক্ষকে একা ছেড়ে দেয়। তুই ও মায়ের পক্ষ নিয়ে বউকে ছেড়ে পালাচ্ছিস।’

জাওয়াদ কথা এড়াতে বলল,
‘ওর কথা বলবি না, রাগ লাগছে। তোর বাসায় চল। ‘

অনিক আরও রেগে গেল,
‘বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলি। ওকে ছাড়া বাঁচবি না। ওকে লাগবেই। আমাকে দু’দণ্ড শান্তি দিস নি। বিয়ের আগে ভাবির মামা, আমি, ইভেন ভাবি অবধি তার পর্দার ব্যাপারে তোকে বলেছে। তখন তো হাসিমুখে মেনে নিয়েছিস। এখন সমস্যা হচ্ছে কেন? ভাবি শুধুমাত্র তোর জন্য নিজের দুইটা ফ্যামিলি ছেড়ে এসেছে। সব ছেড়ে হাজার স্বপ্ন নিয়ে তোর সাথে শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছে। আর সেই তুই বাড়িতে পা রেখেই হাত ছেড়ে দিলি! শালা তুই না ভাবিরে ভালোবাসতি? এই তোর ভালোবাস!’

জাওয়াদ হতাশ স্বরে বলল, ‘ওটা ভালোবাসা না, মোহ ছিল। রূপের মোহ। যা কেটে গেছে বাস্তবতার ধাক্কায়। এখন ওকে আমার ভালো লাগছে না।’

‘ একটা মেয়ের জীবনের সাথে খেলবি তুই? যদি তাই হয় তবে মনে রাখ আমি তা হতে দিব না। বন্ধু হলে হয়তো দিতাম। কিন্তু আমি উকিল বাবা, তোদের সমস্যা সমাধানের দায় আমার কাধে। বিয়ে যেহেতু করেছিস। ভাবির সব দায়িত্ব তোর, তোকে সব পালন করতে হবে।’ আদেশের সুরে বলল অনিক। জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল,
‘আমি কোন প্যারা নিতে পারব না।’

‘তুই এখন আমার সাথে যাবি, ভাবিকে পুরুষদের সামনে না আসার ব্যবস্থা করবি। ‘ কড়া স্বরে বলল অনিক। জাওয়াদ বের হতে গেল, অনিক টেনে লিফটে উঠাল।

দুজন উঠল ছয়তলায়। ওখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে জাওয়াদের পুরো পরিবার। তিন ছেলে, এক মেয়ে জয়নাল আবেদীনের। মেয়ে জেরিনকে বিয়ে দিয়েছেন। বড়ো ছেলে শাহেদ, তার স্ত্রী কাকন ও এক ছেলে জাহিন। মেঝো ছেলে জাওয়াদ , ছোটো ছেলে জিশান, মায়মুনা সহ সাতজনের পরিবার জয়নাল আবেদীনের। সদস্য খাতায় সদ্য যোগ হওয়া মুশরাফাকে ধরলে হবে আটজন। চাররুমের ফ্ল্যাটটায় আটজন মানুষের বাস।

অনিক বাসায় ডুকে পরিস্থিতি পরখ করল। বসার ঘরে তখনো জাওয়াদের দাদা, নানার দিকের সব পুরুষ মহিলা মুরুব্বিরা বসা, তাড়া দিচ্ছে বউকে আনার। সবার মাঝে বসে আছে নাজমুল সাহেব আর মুশরাফার বাবা মাহবুব সিদ্দিকী।

মায়মুনা, কাকন, জেরিন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জাহিনকে দিয়ে মায়মুনাকে ডেকে পাঠাল। মায়মুনা দেখেই সালাম দিল অনিক। মায়মুনা উত্তর না নিয়ে অভিযোগের ঝুলি খুলে বসলেন,
‘কী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়েছিস আমার ছেলেকে? মেয়েটা তো ভারি বেয়াদব। সামাজিকতা জানে না, মানসম্মানের বালাই নেই। আলখাল্লা পরে এসেছে শ্বশুরবাড়ি। এসে আমার ঘরে ঢুকেছে, গো ধরে বসেছে বসার ঘরে, যাবে না। কারো সাথে দেখা করবে না। এদিকে সবাই বসে আছে বউ দেখার জন্য। ‘

উনাকে থামিয়ে অনিক বলল,
‘আন্টি আমি কিন্তু আগেই ভাবির পর্দা সম্পর্কে বলেছিলাম। তখন আপনার আপত্তি ছিল না। আপনি সব মেনে নিয়েছেন। বড়োমুখ করে বলেছেন, যেমন চাইবে তেমন থাকবে। বেপর্দা হবে না।’

মায়মুনা গমগমে উত্তর দিলেন,
‘ছেলে বিয়ে করানোর সময় মা বাবাকে অনেক কথাই বলতে হয়। সব মানতে হবে কথা নেই। তা ছাড়া বাইরের মানুষের সাথে পর্দা করুক, বাধা দিব না। এরা সবাই ঘরের মানুষ, এদের সাথে কিসের পর্দা? শুন, নিজে ঠিক তো দুনিয়া ঠিক। নিজে ঠিক হলে ওসব পর্দা লাগে না। এই মেয়ের নিজের ঠিক নেই, এসেই নাটক শুরু করেছে। এমন মেয়েকে বিয়ে করানো ঠিক হয়নি তোর, আমার ছেলের জীবন শেষ করে দিয়েছিস।’

অনিক কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। চেনা মানুষটা হঠাৎ যেন অচেনা হয়ে উঠল ওর। অনিককে এই বাসার সদস্য ধরা যায়। অবাধ আসা যাওয়া ওর। এই মানুষটাকে সে মায়ের মতো ভালোবাসে, সম্মান করে। কত ভালো জানে! কী সুন্দর তার ব্যবহার! হঠাৎ বদলে গেল কিভাবে? শ্বাশুড়ি হলেই কি বদলে যায় মানুষ? পুত্রবধুকে শুরু থেকে টাইটে না রাখলে পরে মাথায় চড়ে বসবে, এই কথাই বিশ্বাসী সমাজের মানুষ বলেই বদলে নিজেকে ফেলতে হয়? হয়তো-বা।
তিনি কেন ভাবছেন না? আজ মেয়েটা নতুন, তিনি পুরনো, আজ যদি মেয়েটাকে তিনি আগলে নেন, কাল পুরনো হলে মেয়েটা তাকে আগলে নিবে? বৃদ্ধ বয়সে তো পুত্রবধূই কাজে আসবে, এই ভাবনা আসে না কেন? আজ পুত্রবধূ শ্বাশুড়ির অধীনস্থ, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে এই শ্বাশুড়িই হবে বউয়ের অধীনস্থ। আজ যদি বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘চিন্তা করো না, আমি সামলে নিব। কেউ কিছু বলতে পারবে না তোমায়। ‘
তাহলে শ্বাশুড়ির বৃদ্ধ বয়সে সে যখন বিছানায় পড়বে, বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলবে তখন পুত্রবধূই আজকের দিন স্মরণে এনে বলবে, ‘মা, আপনার কিছু হবে না। আমি আল্লাহর কাছে আপনার হয়াত চেয়েছি, আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে দিবেন। ‘
আজ আপনি তাকে পর করলে, কাল সেই আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিবে। এই ধারণা জন্মায় না কেন শ্বাশুড়িদের মাঝে?

অনিক চাপা শ্বাস ফেলল। সমাধানের পথ খুঁজল। খানিক ভেবে বলল,
‘ বসার ঘরে ভাবির বাবা, মামা বসে আছেন। আপনারা কিন্তু আগেই কথা দিয়েছেন। এখন ভাবিকে জোর করে নিলে, তারা ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখবে না। প্রতিবাদ করলে সবার সামনে আপনাদের সম্মানহানি হবে। অযথা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। তাই বলি কী আন্টি, একটা কাজ করুন। ‘

‘কী কাজ? ‘ সমাধানের নিমিত্তে জিজ্ঞেস করলেন মায়মুনা। অনিক বলল,
‘ভাবি আপনার রুমেই থাকুক। মহিলাদের আপনার রুমে নিয়ে আসুন। সেখানেই দেখুক বউ। এতে উনার আপত্তি থাকবে না। ‘

‘ শ্বশুর পক্ষ কী বলবে?’

অনিক বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, ‘লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে। লাঞ্চ দিন টেবিলে। পুরুষরা খেতে বসুক। তখন মহিলাদের রুমে ডাকবেন। খেতে খেতে আমি বলে দিব ব্যাপারটা। যেহেতু আমি উকিল বাবা, তাই এটা আমার দায়িত্ব। ‘

মায়মুনা তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলেন না। খানিক ভাবলেন, মনে ধরল সমাধান। গমগমে গলায় বললেন,
‘আচ্ছা দেখি কী করা যায়। তুই থাক বাসায়, যাবি না। এক মেয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিস, আবার না কী কান্ড বাধায়! ছেলেটাও কেউ বলি হারি, রূপ দেখেই মজে গেল। কিছু যাচাই-বাছাই না করে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেল। এখন রূপ ধুয়ে পানি খাক। নিজের জীবন নিজেই শেষ করল। সব কপাল। ‘

অনিক হাসল কেবল। বিয়ের আগে মুশরাফাকে দেখে এসে ইনিই অনিককে ফোন দিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলেছিলেন, ‘ মেয়ে তো রূপে গুনে একশো তে একশো। এমন মেয়ে হলে আর কিছু লাগবে না। আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে।’

মায়মুনা চলে গেলেন। অনিকের কথামাফিক কাজ করলেন। পুরুষদের ডাইনিং টেবিলে ডেকে মহিলাদের নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। খেতে বসে অনিক মুশরাফার পর্দার কথা বলে দিল। জয়নাল আবেদীন সাহেব ও সায় জানালেন। নাজমুল সাহেব গলা মেলালেন। মাহবুব সাহেব আর জাওয়াদ নির্বিকার খাচ্ছে। অনিক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘কবে মানুষ হবি তুই?’

মহিলামহলের মাঝে বসে আছে মুশরাফা। তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে গল্পের আসর। বয়স্ক মহিলারা ওকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। ও চুপচাপ উত্তর দিচ্ছে। জোহরের আযান দিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো। সে পরখ করে দেখল, উপস্থিত মহলের একজনের মাঝে ও নামাজ পড়ার কোন ভাবাবেগ অনুভূতি নেই। কেউ নামাজ পড়ে না কি! এদের মাঝে কাউকেই চিনে না সে, কাকে বলবে নামাজের কথা? মা, ভাবি, ননাশ কারোর দেখা নেই।
মুশরাফা অপেক্ষায় আছে কখন এখান থেকে মুক্তি পাবে। জেরিন এলো মাঝে একবার। ওকে দেখে মুশরাফা হাফ ছাড়ল। ধীর স্বরে বলল,
‘আপু, আমি জোহরের নামাজ পড়ব। সুযোগ করে দিন।’

জেরিনের কপালে বিরক্তির ভাজ দেখা গেল না। সে হেসে মুশরাফার হাত ধরে বলল,
‘আসো আমার সাথে। ‘

মুশরাফা গেল। জেরিন ওয়াশরুম দেখিয়ে দিল। অযু করে আসার পর দেখল জেরিন জায়নামাজ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই একটা টাওয়াল বাড়িয়ে দিল। রুমে তখন মানুষে ঠাসা। কোণায় একটুখানি জায়গা খালি ছিল। সে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন জেরিনের দুই কাজিন। জেরিন ওদের সরিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে বলল,
‘ লাঞ্চের আগে তোমাকে চেঞ্জ করতে বলতে পারছি না। মা বকবে। এই শাড়ি পরে নামাজ পড়তে পারবে?’

মুশরাফা সায় জানাল। জেরিন বলল, ‘নামাজের হিজাব লাগবে? এনে দিব?’

শাড়ির উপর হিজাব টানানো মুশরাফার। হাতের কবজির উপর অংশ কিছুটা দেখা যাচ্ছে। মুশরাফা বলল,
‘আমি সাথে নিয়ে এসেছি। আমার ব্যাগেই পাবেন।’

ব্যাগটা এই রুমেই ছিল। জেরিন নিজে নিয়ে দিল। হেসে বলল,
‘এবার পড়ো।’

সকালে মায়মুনা আর কাকনের ব্যবহারের পর মুশরাফা এই পরিবার থেকে ভালো আচরণ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল, ওকে সাপোর্ট করার কেউ নেই এই পরিবারে। কিন্তু জেরিনের অমায়িক আচরণ তার ধারণা বদলে দিল। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নিয়ত বাধার আগে হুট করেই জেরিনকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
‘এর বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিক।’

কী সুন্দর দোয়া! জেরিন খুশি হলো। প্রসন্ন হাসল। ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,
‘তুমি নামাজ পড়ো। আমি রান্নাঘরে যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে। কিছু লাগলে বলবে কিন্তু। ‘

জেরিন চলে গেল। মুশরাফা বিড়বিড় করে ‘আলহামদুলিল্লাহ ‘ পড়ল। জেরিন আধুনিক জগতের মেয়ে। নিজে পর্দা করে না। কিন্তু সে পর্দাকে খারাপভাবে দেখে না। তার মতে এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তার নেই। সে পর্দাকে সম্মান করে।

অনেকটা সময় নিয়ে নামাজ পড়ল মুশরাফা। নামাজ শেষে করতেই জেরিন এসে খেতে নিয়ে গেল। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘আপু, আমি গায়রে মাহরমের সামনে যাব না।’

কাকন মুখ বাঁকাল। মায়মুনা রেগে তাকালেন। জেরিন হেসে বলল,
‘ছেলেরা সবাই বসার ঘরে। খাবার ঘরে কেউ আসবে না। চলো, আমি দেখব ব্যাপারটা। ‘

জেরিনের তত্ত্বাবধানে মুশরাফার খাওয়া হলো। খাওয়া শেষে আবার শ্বাশুড়ির ঘরে গিয়ে বসল। মেহমানরা বিদায় নিতে শুরু করেছে। যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে মুশরাফার বাবা, মামাও। মুশরাফা দরজার কাছে গেল। নাজমুল সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় নিলেন। মাহবুব সাহেবের তেমন ইচ্ছে না থাকলেও রুমের ভেতর থাকা মেহমানদের তাকিয়ে থাকতে দেখে কৃত্রিম হেসে বললেন,
‘আসি, ভালো থাকিস।’

মুশরাফা স্মিত হাসল। কতমাস পর বাবা কথা বললেন ওর সাথে! সময়টা মনে পড়ে না। সে ধীর গলায় বলল,
‘কখনো যদি আপনার কথা মনে পড়ে, কথা বলতে ইচ্ছে করে তবে কল দিব, আপনি ধরবেন বাবা?’

মাহবুব সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। তার মাঝে লায়লার মতো অনুভূতি দেখা গেল না। ছোটো করে বললেন, ‘দিস।’

চলে গেলেন তারা। শেষ বিকেলের দিকে মেহমানরাও চলে গেল। বাসায় আটজনই রইল। মাগরিবের আযান হলে জেরিন মুশরাফাকে জাওয়াদের রুমে নিয়ে গেল। জায়নামাজ দিয়ে ফিরে এলো। রুমে চোখ বুলাতেই চক্ষুচড়ক ওর। ফার্নিচার বলতে খাট, ড্রেসিংটেবিল আর ক্লথ কেবিনেট। এক কোণে দুটো বিন ব্যাগ রাখা, একটা সেন্টার টেবিল। গিটার, সাউন্ড বক্স, হেডফোন সেন্টার টেবিলে অ্যাশট্রে। সব যেন চোখে বাজছিল। মনে হচ্ছে অচেনা দুনিয়ায় এসেছে সে। লোকটার জীবনটা বাজে অভ্যাসে ঘিরে আছে। চেঞ্জ করে জায়নামাজ হাতে নিয়ে বিপাকে পড়ল, দেয়ালে দেয়ালে জাওয়াদের, বিভিন্ন জীবজন্তুর ছবি টাঙানো। এখানে তো নামাজ হবে না। ঘরে জীবজন্তুর ছবি থাকলে ফেরেশতা আসে না।

মুশরাফা পুরো ঘর দেখে বারান্দায় গেল, বেশ বড়োসড়ো বারান্দা। খালি একবারে, কিচ্ছু নেই। আলো নিভিয়ে অন্ধকারে বারান্দায় নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ক্লান্তিতে চোখ বুঝে আসছে। জেরিন এসে নাস্তার জন্য ডেকে গেল। নিশ্চিত করল, বাসায় পুরুষরা কেউ নেই।

নাস্তা করতে গিয়ে দেখা হলো জয়নাল আবেদীনের সাথে। তিনি সবে বাইরে থেকে ফিরেছেন। মুশরাফা উনাকে দেখে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম বাবা। ‘

বিয়ের পর উনার সাথে কথা হয়নি, এটাই প্রথম। তার বিনয়ের সাথে সালাম শুনে জায়নাল সাহেব প্রসন্ন হাসলেন। সালামের উত্তর নিলেন হাসিমুখে,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’

পরপরই বললেন, ‘এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো মা?’
মুশরাফা সেই ক্ষণে ধরতে পারল, এই পরিবারে তার শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা এক থেকে দুই এ নেমেছে। সে হেসে বলল,
‘না বাবা। কোন সমস্যা হচ্ছে না।’
‘ এখন থেকে এটাই কিন্তু তোমার ঘর। নিজের মতোই থাকো। ‘
জয়নাল সাহেবের কন্ঠে উপচে পড়া কোমলতা। মুশরাফা হেসে সায় জানাল। তিনি স্বভাবগতভাবে বলে ফেললেন,
‘অপদার্থটা কি আছে ঘরে?’

মুশরাফা বুঝল না। ভ্রু কুঁচকাল, ‘কে বাবা!’
জেরিন এসে হেসে বলল, ‘জাওয়াদের কথা বলছে বাবা। ও নেই। বন্ধুদের সাথে বাইরে গেছে। ‘

জয়নাল সাহেব চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘ওকে একটু মসজিদে পাঠানোর চেষ্টা করো।’

মুশরাফা এবারও সায় জানাল। জয়নাল সাহেব গিয়ে বসার ঘরে বসলেন। নাস্তা করে ঘরে এলো মুশরাফা। খানিক বাদেই জাওয়াদ এলো। ওকে দেখে মুশরাফা হাসিমুখে আলতো স্বরে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’

সকাল থেকে ঘটা এতসব ঘটনার পর ও মেয়েটা হাসছে! ওকে সালাম দিচ্ছে! অবাক হলো জাওয়াদ। এই মেয়ে কিসের তৈরি! উত্তর নিল না ও। হেটে গিয়ে বিন ব্যাগে বসল। বন্ধুদের কথা মাথায় ঘুরছে। আজ ওর কলেজের বন্ধুরা এসেছিল। মুশরাফা যখন সামনে যাচ্ছিল না, তখন বন্ধু সাদাফ বলল,
‘কিরে বেটা, বিয়ে দাওয়াত দিলি না, এখন আবার বউকে লুকিয়ে রেখেছি। কাহিনি কি? ডাক ভাবিরে, পরিচিত হই?’

জাওয়াদ লজ্জায় পড়ল। কী বলবে এবার? অনিকই বলল, মুশরাফার পর্দার কথা। তখন একজন কটাক্ষ করে বলল,
‘কী গেঁয়ো বিয়ে করেছিস! এরা কোন সামাজিকতা জানে? রোমান্টিকতা জানে? কিচ্ছু জানে না। তোর সাথে রেস্টুরেন্টে যাবে না, সাজবে না, বের হবে না, ছবি তুলবে না। সবকাজে হারাম হারাম করবে। গেঁয়ো হয়ে থাকবে। তোর মতো ছেলে এমন মেয়ে কিভাবে বিয়ে করল? ইউ ডিজার্ভ বেটার ওয়ান। তোর জন্য কত হাই সোসাইটির মেয়ে পাগল ছিল মনে নেই? শান্তি পাবি না ভাই, ছাইড়া দে।’

কিছু বন্ধু থাকে যারা বন্ধুত্বের নাম করে এসে আগুনে ঘি ঢালতে পারে। আবার কেউ আছে পানি দিয়ে আগুন নেভাতে পারে। জাওয়াদকে চিন্তিত দেখাল। লজ্জিত হলো চোয়াল। অনিক বলল,
‘ ও কিন্তু ভাবিরে ভালোবেসে বিয়ে করছে। সুখটা ওরেই খুঁজে নিতে দে?’

সাদাফ বলল, ‘দেখা যাক এই বিয়ে কদিন টিকে। ছ’মাস ও টিকবে না দেখিস? ইউ ডিজার্ভ বেটার ওয়ান জাওয়াদ। ভুল মানুষের ফাঁদে পড়ছস তুই।’

সত্যিই কি সে মুশরাফাকে ডিজার্ভ করে না? গত দুদিনে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। জাওয়াদের মনে কত প্রশ্ন চলছে? মুশরাফা বলল,
‘শুনুন!’

জাওয়াদ চোখ তুলে তাকাল,
‘কী!’
‘ আপনার ছবি গুলো সরিয়ে নিন, আমি নামাজ পড়তে পারব না।’
জাওয়াদ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকাল,
‘পারব না। বারান্দায় গিয়ে পড়ো।’

মুশরাফা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেবল। এশার নামাজ ও পড়ল বারান্দায়। নামাজ শেষ এসে দেখল, জাওয়াদ কানে হেডফোন গুজে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। গান শুনছে বোধহয়। এদিকে খেয়াল নেই। মুশরাফা বিছানায় বসল। আল্লাহর কাছে দোয়া করল, এই মানুষকে ঠিক করে দিতে।

অভ্যাসগতভাবে জাওয়াদ গান শুনতে শুনতে সিগারেট ধরালো। ধোঁয়া নাকে লাগতেই কেশে উঠল মুশরাফা। জাওয়াদের মনোযোগ নেই এদিকে, সে টের পেল না। একটা সিগারেট শেষ করার পর আরেকটা ধরানোর সময় বিছানার দিকে তাকাতেই মুশরাফাকে কাশতে দেখল।

বিরক্তি,রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা সবকিছুর উর্ধ্বে হলো মানবতা। একটা মানুষের প্রতি মানুষের রাগ থাকতেই পারে তাই বলে সে বিপদে পড়লে না আগানো বা তাকে বিপদে ফেলে দেয়াটা সমীচীন নয়। মুশরাফার জন্য জাওয়াদের মনে তেমন টান না থাকলেও ছোটোবেলা থেকে লালন করে আসা মানবতাবোধ আছে। যার কারণে সে হাজার বিরক্তির পরও মুশরাফাকে শারীরিক কষ্ট দেয়ার কথা ভাবতে পারেনা। ব্যাপারটা অনিচ্ছাকৃত হয়ে গেছে। সে খেয়াল করেনি। জাওয়াদ উঠে বারান্দায় চলে গেল। যেখানে গিয়ে আরেকটা ধরাল। টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। গন্ধটা জানালা বেধ করে রুমে এসে ডুকে পড়েছে। মুশরাফার কাশির মাত্রা বাড়ল। চোখ থেকে পানি বেরুচ্ছে অনবরত। গানের ভলিউম ভেদ করে শব্দটা কানে গেল জাওয়াদের। সে থেমে গেল, গান থামাল। শব্দটা পর্যবেক্ষণ করে দরজায় এসে দাঁড়াল। কাশতে কাশতে মুশরাফার নাক মুখ লাল হয়ে গেছে, দমবন্ধ হয়ে আসার জো।

জাওয়াদ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। হেডফোন খুলে ল্যাপটপ রেখে ওর পাশে বসল। আলতো হাতে স্ত্রীর পিঠ ঢলতে ঢলতে অনুতাপের স্বরে বলল,
‘স্যরি! আগে বলবে তো সিগারেটের ধোঁয়ায় তোমার সমস্যা হয়। আমি খেয়াল করিনি।’

মুশরাফা উত্তর দেয়ার অবস্থায় নেই। কাশি বন্ধ হচ্ছে না। সেন্টার টেবিলের উপরে পানির জগ। জাওয়াদ এক গ্লাস পানি এনে দিল,
‘পানি খাও, কম লাগবে।’

মুশরাফা গ্লাস ধরতে পারছিল না, জাওয়াদ নিজেই ধরেই মুখের কাছে নিল। পানি খেয়ে গ্লাস রেখে এলো। আবার বসল পাশে। ততক্ষণ পাশে বসে রইল, যতক্ষণ না মুশরাফার কাশি থেমেছে। কাশি থামার পরে মুশরাফা বিস্মিত চাহনি দিল কেবল। কষ্ট নিজে দিল, আবার পাশে রইল ও নিজে। এমন করে যদি পর্দা রক্ষায় ওর পাশে থাকতো, তবে ওর চিন্তা করতে হতো না। মুশরাফা হেসে বলল,
‘আপনার মাঝে মানবতাবোধ আছে, একটু মূল্যবোধ হলেই আপনি চমৎকার মানুষ হয়ে যাবেন। ‘

জাওয়াদ উত্তর দিল না। সরে গিয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
‘বেশি বকবক করো না, চোখমুখ মুছে শুয়ে থাকো কিছুক্ষণ। ‘

পরদিন ভোরে মুশরাফা নিজে ও নামাজের জন্য উঠল, ঠেলেঠুলে জাওয়াদকে ও উঠাল। টেনে নিয়ে গেল ওয়াশরুমে। মুখে পানি চিটিয়ে বলল,
‘আমি জান্নাতে গেলে আপনার সাথেই যাবো ইন শা আল্লাহ। অযু করে আসুন।’

ততক্ষণে জাওয়াদের চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেছে। রাগত চাহনি দিল। কাজ হলো না। অযু করিয়ে বের করিয়েই এনেছে। নামাজ পড়তে গিয়ে হলো বিপত্তি। বারান্দায় মশার জন্য থাকা দায়। মুশরাফার হাত পা ঢাকা, মশা খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। কিন্তু হাফহাতা টি-শার্ট পরিধেয় জাওয়াদ পার পেল না কোনভাবেই। সেকেন্ড দশেকে কটা যে কামড়েছে হিসেব নেই। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেল ওর। মুশরাফার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘তুমি মেয়েটা আস্ত একটা বিরক্তি!’

হনহন করে রুমে চলে গেল জাওয়াদ। মুশরাফা ভাবল, ও নামাজ পড়বে না বলে চলে গেছে। স্বামীকে নামাজ না পড়াতে পারার হতাশা ঘিরে ধরল ওকে। মলিন মুখে নামাজে দাঁড়াল। তখনি রুম থেকে ডাক এলো,
‘ মুশরাফা? এদিকে এসো।’
‘কেন? আমি নামাজ পড়িনি তো। নামাজ পড়ে আসছি।’

জাওয়াদ ধমকে উঠল, ‘ এত কথা বলো কেন?আসতে বলছি, আসো। ‘

মুশরাফা রুমে ধীর পায়ে। বারান্দার দরজায় দাঁড়াতেই ওর চক্ষুচড়ক!

চলবে…

আগামীকাল হয়তো গল্প দিতে পারব না। তাই আজ বড়ো করে দিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here