স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। পর্ব-৫

0
1860

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর-৫)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

রাত দশটা নাগাদ নাজমুল সাহেব এবং ফরিদা পারভীন এসে পৌঁছালেন লায়লার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। ঘন্টা দুয়েক আগে তাদের জুরুরিভাবে ডেকেছেন লায়লা। তার ধারণা নাজমুল সাহেব এবং ফরিদা পারভীন এসে বুঝালে মুশরাফা রাজি হবে। মেয়েটা বাবা মা থেকে তার মা মামীর কথা বেশি শুনে। ভাই ভাবিকে দেখেই অভিযোগের ঝুলি খুলে বসলেন লায়লা। ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেদের দোষ চেপে মুশরাফাকে দোষী করে তুললেন। মান সম্মান হারিয়ে কান্নার ঢং ও করলেন। আকুতি করলেন, তারা দুজন যেন বুঝায় মেয়েটাকে। সময় আছে এখনো, ডিনারে যাওয়া যাবে। ভাই ভাবি বুঝিয়ে শুনিয়ে তৈরি করে আনে যেন।

মুশরাফা ঘন্টা দুয়েক লাগিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। খালি রুম পেয়ে দরজা দিয়েছে। আর খুলে নি। নাজমুল সাহেব, ফরিদা পারভীন দরজায় নক দিলেন। তাদের স্বর শুনে দরজা খুলল মুশরাফা। বিনম্র স্বরে সালাম দিল। তাদের আসার কারণ অজানা নয় ওর। ভেতরে যেতে বলল। নিজে গিয়ে বসল খাটে। ভেতরে প্রবেশ করার ফাঁকে মুশরাফাকে পরখ করতে গিয়ে আঁতকে উঠলেন ফরিদা। পুরো হাতে কালসিটে দাগ, গালটাও ফুলে গেছে। হাটতে পারছেনা ঠিকমতো, খুড়িয়ে হাটছে। ফরিদা দ্রুত গিয়ে বসলেন আদরের ভাগ্নির পাশে। কাঁপা স্বরে বললেন,
‘ কী হয়েছে তোর? কে এমনভাবে মেরেছে তোকে?’

উত্তরটা নাজমুল সাহেবই দিলেন,
‘ এটা লায়লার কাজ। তাই না রাফা?’ নিজের বোনকে বেশ ভালো করে চেনা নাজমুল সাহেবের। মানুষ খুন করার মতো রাগ ওর। রেগে গেলে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়।

মুশরাফা উত্তর দিল না। ওড়নায় হাত ঢাকল। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে মলিন হেসে বলল,
‘ কখন এসেছো তোমরা? কিছু খেয়েছো?’

ফরিদা পারভীন জবাব দিলেন না। মুশরাফার হাতটা আলতো করে তুলে নিলেন। মোটা মোটা স্কেলের দাগ বসে গেছে। বুক কেঁপে উঠল তার, চোখে অশ্রু ভর করল। মানুষ এতটা নির্দয় কীভাবে হতে পারে? তাও একজন মা! এমন মেয়ে ঘরে থাকলে তিনি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মা মনে করতেন, অথচ এরা!
আর ভাবতে পারলেন না, কেঁদে ফেললেন। পরম যত্নে মুশরাফাকে বুকে টেনে নিলেন। মমতাভরে বললেন,
‘খুব ব্যাথা পেয়েছিস তাই না মা?’

মুশরাফা চোখ বন্ধ করল। মৃদু হাসল। সান্ত্বনা স্বরে বলল,
‘চিন্তা করো না। সেরে যাবে। আল্লাহ আছেন তো।’

ফরিদা অবাক হয়ে তাকালেন ভাগ্নির পানে। এত অত্যাচারের পরও পরিবারের প্রতি কোন অভিযোগ নেই মেয়েটার! অন্য কেউ হলে হাউমাউ করে কেঁদেকেটে অভিযোগের ঝুলি খুলে বসত। পরিবারের মেয়েটার উপর এত অত্যাচার করে, কিন্তু কখনো ও কারো কাছে গিয়ে অভিযোগ করেনি। বিচার দেয়নি, মনের কষ্ট তুলে ধরেনি। এত চাপা স্বাভাব কেন মেয়ের?

ফরিদা দুঃখী গলায় বললেন,
‘লায়লা আপা কেন যে এমন করেন বুঝি না! ‘

‘ আমাদের কথা বাদ দাও, তোমাদের কথা বলো। আজ থাকবে?’ স্বাভাবিক স্বর মুশরাফার। যেন কিছু হয়নি।
‘না, চলে যাবে। কাল তোর মামার অফিস আছে।’ মলিন স্বরে উত্তর দিলেন ফরিদা। মুশরাফা বলল,
‘ আজ রাতটা থেকে যাও। ‘

নাজমুল সাহেব পাশে বসে অবাক চোখে ওকে পরখ করছেন। এতটা সহনশীল একটা মানুষ কিভাবে হতে পারে! তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘রেডি হ। ‘

মুশরাফা তাকাল মামার দিকে। তার চোখে বিস্ময়, অবিশ্বাস। সে করণ স্বরে বলল, ‘ সব জেনেও আপনি আমাকে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে বলবেন, মামা!’

নাজমুল সাহেব ভাগ্নির মাথায় হাত বুলিয়ে কাতর চোখে বললেন,
‘ এখনো মামাকে চিনলি না তুই !’

‘তাহলে!’ অবাক স্বর মুশরাফার। নাজমুল সাহেব হেসে বললেন,
‘তোকে নিয়ে যাব আমাদের সাথে । রেস্টুরেন্টে নয়, আমার বাসায়। তোর যত গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র আছে নিয়ে নে। যেন এই নরকে দ্বিতীয়বার না আসা লাগে। ‘

মুশরাফাকে আনন্দিত দেখাল। ফুলো গালে চমৎকার হাসল। পরপরই মলিন স্বরে বলল,
‘মা যেতে দিবে?’
‘সে দায়িত্ব আমার। তুই তোর কাজ কর। ‘

থামলেন নাজমুল সাহেব। স্ত্রীর পানে চেয়ে বললেন,
‘তুমি ওকে তৈরি হতে সাহায্য করো। আমি লায়লার সাথে কথা বলে আসি। ‘

নাজমুল সাহেব চলে গেলেন। বোনকে বললেন, ‘ রাফা রাজি হচ্ছে না। আজ কোন বাহানা দিয়ে পাত্রপক্ষকে ফিরিয়ে দে। আমি রাফাকে আমার বাসায় নিয়ে যাই। বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাব। তারপর পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাব। তাড়াহুড়ো করিস না, হিতে বিপরীত হতে পারে। ‘

হাজার কথা বুঝিয়ে রাজি করালেন বোনকে। নিয়ে গেলেন নিজের বাসায়। সিড়িতে দেখা হয়ে গেল অনিকের সাথে। নাজমুল সাহেব রাফার ব্যাগ নিয়ে আসছেন। ফরিদা পারভীন রাফাকে ধরে ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন।

অনিক নিচে যাচ্ছে কয়েলের জন্য। রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখল কয়েল নেই। যা গরম পড়ছে মশারী দেয়া যাবে না। মশার উপদ্রবে থাকতে না পেরে সাড়ে এগারোটায় নিচে নামছে। সামনের দোকানটা বারোটা অবধি খোলা থাকে। নাজমুল সাহেবকে দেখে সালাম দিল। টুকটাক কথায় জানতে পারল, ভাগ্নিকে নিয়ে বোনের বাসা থেকে ফিরছেন নাজমুল সাহেব। ফরিদার মুখে নিচুস্বরে ‘রাফা’ ডাক শুনা গেল দুই একবার। এটা রাফা! অনিক অবাক হয়ে পরখ করল আপাদমস্তক বোরকা নিকাবে আবৃত মেয়েটাকে।

বাসায় পৌঁছাতেই পরম যত্নে মুশরাফার ঘায়ে মলম লাগিয়ে দিলেন ফরিদা। অভুক্ত ভগ্নিকে হাতে তুলে খাইয়ে দিলেন। ওষুধের বক্স খুলে পেইন কিলার নিয়ে দাঁড়ালেন নাজমুল সাহেব। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘চুপচাপ কিছুক্ষণ ঘুমা, ব্যাথা কম লাগবে। সকালে ডাক্তার কাছে নিয়ে যাব।’

ফরিদা ভাগ্নির কাছে থাকলেন রাতে। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো মাঝরাতে। গোঙানোর আওয়াজে ঘুম ভাঙল ফরিদার। চমকে উঠে মুশরাফার গায়ে হাত দিতেই তার মনে হলো, জলন্ত অগ্নিশিখায় হাত পড়েছে তার। হাত পুড়ে যাবার উপক্রম। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপলেন। ১০৪° জ্বর! চোখে মুখে রাগ ফুটে উঠল তার। বিড়বিড় করে বললেন,
‘অমানুষের দল। ‘

হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন নাজমুল সাহেবের কাছে। ঘুমন্ত স্বামীকে জাগিয়ে খবর জানালেন। নাজমুল সাহেব এসে ভাগ্নির অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন। পুরো শরীর ফুলে একাকার, সাদা চামড়া কালো হয়ে গেছে। ব্যাথায় চটপট করছে মুশরাফা। মুখটা রক্তিম আকার ধারণ করেছে। দিশেহারা দেখাল উনাকে। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না, স্থবির হয়ে বসে রইলেন। নিজেকে ধাতস্থ করলেন মিনিট দুয়েক বাদে ।
সন্তানতূল্য ভাগ্নিকে নির্দ্বিধায় কোলে তুলে বললেন,
‘হাসপাতালে নিতে হবে। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমি আসো।’

দ্রুত কদম বাড়ালেন। ওয়ারড্রব থেকে ওড়না, নিকাব বের করে ফরিদা ছুটলেন পিছু। সিড়িতে গিয়ে মুশরাফার গায়ের উপর ওড়না মেলে বললেন,
‘ মেয়েটা সুস্থ থাকলে কখনো খোলামেলা বাইরে যেত না। অসুস্থ অবস্থায় আমাদের এদিকটা খেয়াল রাখা উচিত। না হয় হুশ হলে কষ্ট পাবে ও। ‘

নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করানো হলো। চিকিৎসা শুরু হলো। নাজমুল সাহেব, ফরিদা গিয়ে নামাজে দাঁড়ালেন। চোখে জ্বল ফেলে ভাগ্নির সুস্থতা কামনা করলেন। অথচ জন্মদাতা মা-বাবার খবরটি নেই। তারা মুশরাফাকে হাতের কাছে পেলে জ্যান্ত পুতে ফেলার মতো আক্রোশে ফেটে পড়ছেন। এই আপদ বিদায় হবে কবে! একটু শান্তি কবে আসবে?

মুশরাফাকে দেখার পরদিন অনিক বন্ধুকে জুরুরি তলব করল। অফিস শেষে টং দোকানে বসল দুজন। চা ওর্ডার দিয়ে বলল,
‘ তুই বায়োডেটা বানিয়েছিস?’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘না। কেন বলতো!’

অনিক কারণ বলল না। আদেশের সুরে বলল,
‘ কালকের মধ্যে আমাকে বায়োডেটা বানিয়ে দিবি।’

‘কী করবি বায়োডেটা দিয়ে?’ চোখে মুখে কৌতুহল ফুটে উঠল জাওয়াদের। চা এসে গেছে। অনিক চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করল,
‘ উকিলরা পাত্রের বায়োডেটা দিয়ে কী করে?’

‘ পাত্রী পক্ষের কাছে পাঠায়। ‘ সরল মনে উত্তর দিল জাওয়াদ। অনিক হাসল,
‘ঠিক তাই।’

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
‘তোর উদ্দেশ্যটা কী বলতো?’

‘ তোকে ভাবির গলায় ঝুলানো। ‘ অনিকের মুখে রহস্যময় হাসি। জাওয়াদ অস্ফুটে উচ্চারণ করল, ‘ভাবি!’ আকস্মিক থেমে গেল। কপালের ভাজ সোজা হলো। বিস্মিত স্বরে বলল,
‘তুই রাজি?’

অনিক চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘আড়ংয়ের পাঞ্জাবির লোভে পড়ে গেছি, শালা। রাজি না হয়ে থাকা গেল না। ‘

কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলো না জাওয়াদের কাছে। সে সন্দিহান হয়ে বলল,
‘হঠাৎ তোর সুমতি হলো কিভাবে!’

অনিক উত্তর দিল না। কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘ কাল বায়োডেটা দিবি। আমি সময় করে নাজমুল আংকেলের সাথে কথা বলব। সরাসরি প্রস্তাব দিব। কটাদিন সাবধানে থাক। এলাকার রাস্তাঘাটে বসে আড্ডা দিবি না, যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানবি না। পাত্রীপক্ষ খোঁজ খবর নিতে গেলে রিপোর্ট খারাপ ফেলে বিয়ের চিন্তা ভুলে যেতে হবে। উকিল বাবার কথা থেকে চোখের দেখাকে বিশ্বাস করবে সহজে। ‘

জাওয়াদ অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। কাল বিকেলে ও জাওয়াদ বন্ধুকে প্রস্তাব দেয়ার ব্যাপারে তাড়া দিয়েছে। অনিকের উত্তর ছিল, আরও কদিন সময় নে, ভাব। নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা কর। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
বিয়ের ব্যাপারে অনিকের নির্বিকতা টের পেয়েছে ও। জাওয়াদকে নিয়ে ওর চোখে ভাসা সন্দেহ স্পষ্ট পরখ করেছে । হঠাৎ একরাতে কী হলো? অনিক হঠাৎ বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে গেল। রাফা থেকে একবারে ভাবিতে নেমে গেল! সমীকরণ মেলাতে পারল না জাওয়াদ। সন্দেহ গেল না স্বর থেকে। সে বলল,
‘তা না হয়, করলাম। কিন্তু তার আগে বল, একদিনে কী এমন হলো যে তুই উকিল বাবা হতে রাজি হয়ে গেলি!’

অনিক কৌতুকের স্বরে বলল,
‘ আড়ংয়ের পাঞ্জাবির লোভে পড়ে গেছি। ভাবলাম, বেশি কিছুতো করতে হবে না, শুধু একটা বিয়ে করাতে হবে। বিনিময়ে যদি বছরে দুটো পাঞ্জাবি পাওয়া যায়, মন্দ হয়না। আমার কতগুলো টাকা বেঁচে যায়। তাছাড়া, ভাবির গলায় তোকে ঝুলিয়ে দিতে পারলে তোর জ্বালাতন থেকে ও মুক্তি পাওয়া যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। ‘

অনিকের ঠোঁটে হাসি। সেই হাসিটা রহস্যময় ঠেকল। এই ছেলের মাথায় চলছেটা কী!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here