স্বয়ম্বরা (২য় পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি
২
হতভম্ব বলতে যা বোঝায়, এই মুহুর্তে আমার অবস্থা সেটাই। সত্যি বলতে কি আমি বুঝে উঠতে পারলাম না, উত্তরে কি বলব। এমন না যে আমি খুব লাজুক টাইপের কিংবা আনএক্সপেক্টেড কোন সিচুয়েশানের মুখোমুখি আগে হইনি, বাট আজকের অবস্থা আগের সব অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও আন্দাজ করেছিলাম, কিডন্যাপড হয়েছি, তারপরও… কিডন্যাপারের এমন ইন্ট্রোডাকশান? সত্যিই, বিয়ান্ড এক্সপেকটেশান।
আর এভাবে স্বীকারোক্তি শুনে, মিথ্যে বলব না, আসলেই কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হাত বাড়িয়ে ওর বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে কেমন যন্ত্রচালিত পুতুলের মত কফির মগটা নিলাম। এমন সময় ছেলেটাই আবার বলল
— ওটাতে কিছু মেশানো নেই। নির্ভয়ে খেতে পারেন।
ঘটনার আকস্মিকতা থেকে আমি তখনও বেরিয়ে আসতে পারিনি। মগ হাতে নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু সেটায় চুমুক দিইনি। স্বাভাবিক যে হতে পারছি না, তা আসলে দুটো কারণে। প্রথমটা তো বললামই, দ্যা গাই ইজ ডেঞ্জারাসলি হ্যান্ডসাম। এমন সুদর্শন একটা ছেলে আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। এক বাক্যে যদি ডিস্ক্রাইব করতে বলেন তাহলে বলব, সিনেমায় নায়ক হবার মত।
আর বেশ ভুষা? অ্যাটিচুড? অসাম। সব কিছুতেই একটা ক্লাস আছে। ওর চাহনিতে কোন হ্যাংলাপনা নেই। সুন্দরী হওয়ার কারণে যে ড্যাবড্যাবে দৃষ্টির মুখোমুখি সারাজীবন হয়েছি, এ দৃষ্টি তেমন না। তাকানোর ভেতরে একটা ভদ্রতা আছে। এমন একটা ছেলে আমাকে কিডন্যাপ করেছে? কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটার কারণে স্বাভাবিক হতে সময় লাগছিল, সেটা হচ্ছে, ওর সাবলীলতা। ওর চাল চলনে মনেই হচ্ছে না ও কিডন্যাপিংয়ের মত জঘন্য একটা কাজ করেছে। নিজের কিডন্যাপার পরিচয় এমনভাবে দিচ্ছে, যেন হি ইজ প্রাউড অফ হিজ জব। কোন অনুশোচনা নেই।
— আপনি চাইলে ওখানে থেকে আমি এক চুমুক খেয়ে দেখাতে পারি।
ততোক্ষণে আমি অনেকটাই সামলে নিয়েছি। আমার আমিতে ফিরে আসলাম। এবার চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে উত্তর দিলাম
— আর আমি আপনার এঁটো খাব?
ছেলেটা স্মিত হেসে কিচেনে ফিরে গেল। এরপরে একটা চামচ নিয়ে বেরিয়ে এল। মতলবটা আঁচ করলেও কিছু বললাম না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। সোজাসুজি আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মগে সেটা ডুবিয়ে দিল। এক চামচ কফি তুলে নিজের মুখে দিল। কফির স্বাদ পছন্দ হয়েছে এমন ভাবে ঘাড়টা কাত করল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— সন্দেহ দূর হল?
জীবনে অনেক অবাক করা ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি, তবে এটা অভুতপূর্ব। সিনেমা টিনেমায় যেমন দেখায়, মুখে কাপড়, কোন থামের সাথে হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, মানেই কিডন্যাপ। কিংবা বলা যায় কিডন্যাপ বলতে এমন একটা দৃশ্য দেখতে অভ্যস্থ আমরা। অথচ চোখের সামনে যা দেখছি, তা পুরো উল্টো। এমন অমিল টাইপের কিডন্যাপ্যার জন্যই বোধহয়, কিডন্যাপড অবস্থাটাকে ঠিক অনুভব করতে পারছি না।
একটা ব্যাপার অবশ্য না বললেই না। ফিল করলাম, আমার ভয় লাগছে না। কেন, বলতে পারব না। এমন ভদ্র আচরণ পাওয়ার পরেও কি আমার ভয় পাওয়া উচিৎ? এনিওয়ে, এই মুহূর্তে আমার অবস্থাটা, শুধু ‘ভয় পাচ্ছি না’ বললে পুরোটা বলা হবে না। যে অনুভুতিটা হচ্ছে, তাকে বলা যায় আগ্রহ। সাথে বোধহয় কিছুটা রোমাঞ্চ। তবে এক্সাইটেডের চেয়ে একটু কম।
ঘটনার আকষ্মিকতা থেকে ততোক্ষণে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছি। এবার ছেলেটার দিকে স্বাভাবিকভাবেই তাকালাম। আই মিন, মাইনাস মুগ্ধতা। কি যেন নাম বলেছিল? মনে পড়ছে না। তারপরও কথা বলতে শুরু করলাম
— দেখুন মিস্টার…
— আসিফ
ছেলেটার দিকে এবার যে দৃষ্টিতে তাকালাম, সেটায় বোধহয় কিছুটা কমপ্লিমেন্ট ছিল। রিয়েলি স্মার্ট গাই। তবে এবার অবাক ভাব থেকে দ্রুতই নিজেকে বের করে আনতে পারলাম। বললাম
— ইয়েস। মিস্টার আসিফ। জানতে পারি, হোয়ায় অ্যাম আই হেয়ার?
ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বলল
— বসুন।
নিজের অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে গেল। এখনও ব্যাটার কোন অনুশোচনা নেই। মাথায় জেমস বণ্ড আবার জেগে উঠল। কি এমন কারণ হতে পারে যেখানে কিডন্যাপ এতো গর্বভরে কেউ স্বীকার করতে পারে? জেমস বণ্ড চুপ। কাজ করছে না। উনিও মনে হচ্ছে হতভম্ব। তবে আমি এবার একটু কম অবাক হলাম। ইন্সটিংক্ট বলছে, এটাই ওর স্টাইল।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারটায় বসলাম। খুব শান্তভাবে কফিতে চুমুক দিলাম। খারাপ বানায়নি। নিজের অজান্তেই ব্যাপারটা স্বীকার করে ফেললাম। বললাম
— সুন্দর হয়েছে।
ছেলেটা বসতে বসতে উত্তর দিল
— থ্যাঙ্কস।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কেমন যেন একটা সহজ ভাব চলে এসেছে আমার মধ্যে। মনে হল, কিডন্যাপার হলেও অভদ্র টাইপ না। মানে সিনেমায় যেমন দেখায়, লোলুপ দৃষ্টি, বিচ্ছিরী হাসি, তেমন টাইপের ভিলেন এ লোক না। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। ‘কেন?’
ওর সাবলীলতার কারণেই হোক আর ব্যাটার চেহারার কারণেই হোক, এবার অনেক সাবলীলভাবেই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলাম
— কিডন্যাপটা কেন করেছেন? টাকা?
ছেলেটা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। কফির মগে চুমুক দিল। সিপ টা গলা দিয়ে নামার সময়টা নিল। এরপরে বেশ শান্ত স্বরেই বলল
— ইয়েস, টাকা।
কেন যেন একটা ধাক্কা লাগল। মনে হল অন্য কারণ বললে… হোয়াটস রং উইথ মি? হচ্ছে কি আমার ভেতরে? নিজেকে সংযত করা জরুরী। মুখ গম্ভীর করে জানতে চাইলাম
— কত চাই আপনার?
ছেলেটা এবার একটু অবাক হল মনে হল। আমাকে বোঝাবার ভঙ্গিতে বলতে লাগল
— আপনি ভুল বুঝছেন। কাজটা টাকার জন্য করছি, বাট নট র্যানসাম।
এবার বেশ অবাক হলাম। র্যানসাম না, মানে কি? পাজল সলভ করার মুডে আমি আর নেই। ব্যাপারটা তাই সোজাসুজিই জানতে চাইলাম।
— র্যানসাম না মানে?
ছেলেটা কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল। থেমে গেল। এরপরে কিছু একটা মনে পড়েছে এমনভাবে বলল
— আজকের মেনু, রাইস, ডাল, আলুভর্তা আর চিকেন। আপত্তি নেই তো?
এমন সময় এধরনের অপ্রয়োজনীয় কথা শুনলে কার না মেজাজ খারাপ হয়। আমারও মেজাজ গরম হতে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম। কথাটা খুব অপ্রয়োজনীয় না, তবে এই মুহুর্তে কথাটা বলা খুব দরকারীও ছিল না। আর এমন প্রশ্ন করে আমাকে রাগিয়ে দেয়া ওর উদ্দেশ্য হলে, সেটায় ওকে সাকসেসফুল হতে দেয়া যাবে না। নিজেকে তাই সামলে নিয়ে বললাম
— না নেই।
— ওকে দেন। আধঘন্টা পরে সার্ভ করছি।
নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত করে ঠান্ডা গলায় বললাম
— আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছি।
ব্যাপারটা হঠাৎ মনে পড়ল এমন ভাব করে ছেলেটা উত্তর দিল
— ও হ্যা। কি যেন জানতে চাইছিলেন?
ইচ্ছে করে রাগাচ্ছে আমাকে। ফাঁদে পা দিলাম না। শান্তভাবেই প্রশ্নটা আবার করলাম
— র্যানসাম না কেন?
প্রশ্নটা শেষ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। রিয়াকশান অ্যানালাইসিস করছি। বোঝার চেষ্টা করছি, আমাকে কনফিউজ করতে চাইছে? না ইচ্ছে করে আমাকে বিরক্ত করতে চাইছে? শব্দের হেরফের করে বিরক্ত করাই ওর ইচ্ছে।
ঠিক করলাম রাগব না। অপেক্ষা করে থাকলাম। ব্যাটার উত্তর দেয়ার নাম নেই। খানিকক্ষণ সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল কেবল। মনে হচ্ছে এখনই উত্তর দেবে। ধৈর্য হারিয়ে ফেললাম। প্রশ্নটা তাই আবার করলাম
— ইয়েস। র্যানসামের জন্য না, তো কেন কিডন্যাপ করেছেন?
ছেলেটা কফির মগে চুমুক দিল। মনে হল গুছিয়ে নিচ্ছে। এরপরে আমার দিকে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে আমি তখনও অপেক্ষা করে আছি। মন বলছে উত্তর দেবে। বাট আই ওয়াজ রং। হঠাৎ আমার মগের দিকে ইঙ্গিত করে বলল
— কফিটা শেষ হওয়ার পরে বলি?
এবার সত্যিই রেগে গেলাম। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে হিসহিস করে বললাম
— আপনি কি ইচ্ছে করে আমাকে বিরক্ত করার জন্য এসব আবোল তাবোল বকছেন?
ছেলেটা মিষ্টি একটা স্মাইল দিল। মিথ্যা বলব না, যেকোন মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি স্থির চোখে তাকিয়ে আছি। এবার ছেলেটা আমার দিকে তাকাল। চোখে চোখ রেখে বলল
— রাগলে আপনাকে সুন্দর দেখায়।
কেমন লাগে বলেন? আমি টেনশানে অস্থির, আর এই ব্যাটার এখন রোমান্টিক ডায়ালগ মারার শখ চেপেছে। যাই হোক, ব্যাটার স্টাইল বুঝে গেছি। মাঝে মাঝে বিরক্ত করা আর মাঝে মাঝে ফ্লার্ট। শান্ত স্বরেই প্রশ্নটা করলাম
— আর উই ইন অ্যা ডেট?
আবার সেই স্মাইল। এরপরে মাথা দুদিকে নেড়ে না সুচক ইঙ্গিত করল। আর রাগছি না ডিয়ার। তোমার স্টাইল আমি বুঝে গেছি। এবার আমি সুন্দর একটা স্মাইল দিলাম। বললাম
— দেখুন, যদি উত্তরটা দিতে না চান সেটাও বলুন। তাতেও হবে।
ছেলেটা আমার দিকে এবার বেশ খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ঠিক প্রশ্নকর্তার দিকে তাকানো দৃষ্টি না। প্রেমিকের মুগ্ধ দৃষ্টি। ব্যাটা ইম্প্রেসড হচ্ছে নাকি? আপত্তি নেই। পরে ইউজ করা যাবে। ডোন্ট মিসআন্ডারস্ট্যান্ড মি। বাকী সব সুন্দরী মেয়ের মত, এমন মুগ্ধ দৃষ্টি জীবনে বহু দেখেছি। আর এসব ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিতেও শিখেছি। ব্রেন এখন সুন্দর কাজ করছে। বেচারা এখন ফ্লার্টিং প্রথম স্টেজে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম
— বলবেন না, এই তো?
ছেলেটা এবার খানিকটা ভাবল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল
— দেখুন, আমাদের প্রফেশানে, আমরা কিছু এথিকস মেনে চলি।
— লাইক?
— লাইক, কে কাজ দিয়েছে, কি কাজ দিয়েছে, কত রেট, অ্যাডভান্স কত দেবে এটসেটরা, আমরা ডিসক্লোজ করি না।
কথাগুলো মনযোগ দিয়েই শুনলাম। নিজের অজান্তেই ছেলেটার দিক থেকে নজর সরিয়ে কখন যেন নীচের দিকে তাকিয়েছিলাম। ঝড়ের বেগে মাথায় জেমস বন্ড কাজ শুরু করে দিয়েছে। একটা তথ্য দিয়েছে। কেউ একজন এদেরকে কাজটা দিয়েছে। মানে, এরা আসল পার্টি না। সেই লোকটা তাহলে কে? আর সে কি চায়?
ছেলেটার দিকে আবার তাকালাম। বোঝার চেষ্টা করলাম, আর কিছু বলবে কি না। মনে হচ্ছে, বলবে না। তা ও চেষ্টা করলাম
— আমার বাবার কোন বিজনেস রাইভাল?
আবার সেই স্মাইল। মানে উত্তর দেবে না। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে ব্যাপারটা মেনে নিলাম। ছেলেটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হাতটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। ইশারায় বোঝাল কাপটা চাইছে। আমারও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কাপটা ওর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম
— বলবেন না, এই তো?
কাপটা আমার হাত থেকে নিতে নিতে উত্তর দিল
— না। এটা বলার পারমিশান আছে। আই মিন, যিনি কাজটা দিয়েছেন, তিনি এটাও জানিয়েছেন, আমি যেন আপনাকে উনার নামটা জানাই।
মাথা ওপর নীচে করে বোঝালাম, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। ভেবেছিলাম এবার নামটা বলবে। কিন্তু বলল না, বরং কাপদুটো নিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। অপেক্ষা করব? না আবার জানতে চাইব? ছেলেটার মুখে আর কোন শব্দ নেই। এগিয়ে যাচ্ছে কিচেনের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে গলার আওয়াজটা একটু উঁচু করে বললাম
— তা কি নাম আপনার মনিবের?
ছেলেটা কিচেনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখান থেকে ঘাড় না ঘুরিয়েই উত্তর দিল
— আমাদের ভাষায় একে মনিব বলে না, বলে ক্লায়েন্ট।
কথাটা বলে কিচেনের ভেতরে ঢুকে গেল। মনিব বলায় মনে হচ্ছে আত্মসম্মানে লেগেছে। নিজের অজান্তেই ঠোঁটে বাঁকা একটা হাসি এসে গিয়েছিল। এমন সময় কিচেন থেকে উঁচু গলায় উত্তর দিল
— ভদ্রলোকের নাম ইশতিয়াক চৌধুরী।
চলবে
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/anyaprokash/posts/1307854613062896