স্বয়ম্বরা (৭ম পর্ব) রাজিয়া সুলতানা জেনি

স্বয়ম্বরা (৭ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি


সারাটা রাত ছটফট করে কাটল। বই পড়ার চেষ্টা করলাম। লাভ হল না। গানের কালেকশানও খারাপ না। দুএকটা শুনলাম। মন বসছে না। একটু আগের কথোপকথনের প্রতিটা শব্দ এখনও কানে বাজছে। ফোনটা যখন আমার হাতে দিল, তখন ফিল করলাম বুকের ঢিপঢিপ বেড়ে গেছে। অদ্ভুত এক সাসপেন্স অনুভব করলাম। এই গল্পের নায়ক বা ভিলেন, যা ই বলি, তার সাথে প্রথমবের মত আলাপ করতে যাচ্ছি। ফোন হাতে নিয়ে কিছুটা সময় নিলাম। নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত করে আলাপ শুরু করলাম
— হ্যালো
— বলুন।
কিভাবে কথা শুরু করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করেই শুরু করলাম
–আমি অরিন।
–জানি। কিছু বলবেন?
— জ্বি।
এরপরে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে কথাগুলো বলতে শুরু করলাম
–আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় না, দিস ইজ নট দ্যা রাইট ওয়ে টু ম্যারি অ্যা ওমেন?
— রাইট ওয়েতে তো এগিয়েছিলাম, বাট…
কথাটা শেষ করল না। সম্ভবতঃ ইচ্ছে করেই। চুপ করে যাওয়ার ভেতরে কি অঘোষিত একটা হুমকি ছিল? না সিচুয়েশানটা শুধু ডেস্ক্রাইব করল? গলার আওয়াজ শুনে বোঝার চেষ্টা করলাম। ঠিক ক্লিয়ার হলাম হলাম না। বললাম
— সো ইউ ডিসাইডেড টু কিল মি।
— অনলি ইফ ইউ সে ‘নো’।
মনের কোণে বোধহয় ক্ষীণ একটা আশা কাজ করছিল, ‘আই হ্যাভ টু কিল ইউ’ কথাটা আসিফের নিজের হুমকি। ইশতিয়াক চৌধুরীর আইডিয়া না। সেটা ভেঙ্গে গেল। বুঝে গেলাম, এই লোক আসলেই একটা সাইকো। ভেবেছিলাম কিছুটা আলাপ করে মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করব, সেটা নষ্ট হয়ে গেল। আর কাজটার ন্যায় অন্যায় নিয়ে তর্ক করার মানসিকতা অবশিষ্ট নেই। বেশ ধীরে ধীরে স্পস্ট করে তাই উত্তর দিলাম।
— বিয়েতে আমি মত দিয়ে দিয়েছি। আমাকে কি এখন ছেড়ে দেয়া যায়?
— না, মত যেটা দিয়েছেন সেটা ওখান থেকে ছাড়া পাবার জন্য।
ইজি গেস। যে মেয়েকে একজন ছেলে বিয়ে করবে বলে কিডন্যাপ করেছে, তার মিনিমাম আত্মসম্মান থাকলে, এই বিয়েতে মত যে দিয়ে না, সেটা একটা ইজি গেস। তার মানে ‘বিয়েতে রাজী’ বললেও এখান থেকে মুক্তি মিলছে না। তাহলে এই ব্যাটা চাচ্ছে কি আসলে? কথাটা স্পষ্ট করেই জানতে চাইলাম।
— দেন… আমি ছাড়া পাব কবে?
— তিন তারিখ সকালে ওখানে একটা মাইক্রো যাবে। ওটাতে করে ওখান থেকে আপনি পার্লারে যাবেন, ইফ ইউ উইশ। সেখান থেকে, অর ইফ ইউ উইশ সোজাসুজি, কাজী অফিসে। ওখানে বিয়ে হবে এরপরে কমিউনিটি সেন্টারে আমাদের রিসেপশান হবে। আপনার এবং আমার তরফের সব গেস্ট ওখানে থাকবেন। আমরা সবার আশীর্বাদ নেব।
কথাগুলো বলার ভেতরে কিছু একটা ছিল। বুঝলাম, হি ইজ সিরিয়াস। প্রতিটা কথাই এই লোক বিশ্বাস করে এবং ভেরি মাচ কনফিডেন্ট যে এমনটাই ঘটবে। এই ইডিওটের সাথে তর্ক করার কোন মানে হয় না। তারপরও শেষবারের মত ট্রাই করলাম। বললাম
— ডোন্ট ইউ থিঙ্ক, ইউ আর মেকিং অ্যা বিগ মিসটেক?
— নো।
নাহ, এই ব্যাটা শুধু সাইকো না, মেয়েদের সম্পর্কে উদ্ভট কোন আইডিয়া নিয়ে চলে। শেষ একটা চেষ্টা করলাম। বললাম
— আপনার কি ধারণা, এই বিয়েতে আপনি সুখী হবেন?
— ইয়েস।

আর কথা বলে লাভ নেই। যা বোঝার, বুঝে গেলাম। একজন ম্যানিয়াকের সাথে ডিল করছি। জনমের মত শিক্ষা দেয়ার যে প্ল্যানটা করেছিলাম, তা বাদ দিতে হচ্ছে। বিয়েতে রাজী না হলে মেরে ফেলার যে হুমকি দিয়েছিল, সেটা করা এর জন্য আসলেই অসম্ভব কিছু না। এ আদৌ আমার সাথে জীবন কাটাবার জন্য বিয়ে করতে চাইছে কিনা সন্দেহ। হি জাস্ট ওয়ান্টস টু সেটল দ্যা স্কোর। রিজেক্টের রিভেঞ্জ। টিপিক্যাল বাংলা সিনেমার ভিলেনের অ্যাপ্রোচ।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। ঘুম ভাঙ্গল দরজায় মোলায়েম একটা নক শুনে। উঠে বসলাম। পোষাক অবিন্যস্ত ছিল দেখে দরজার কাছে গিয়ে বললাম
— টেন মিনিটস
— ওকে।
ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত ফ্রেস হয়ে নিলাম। নতুন একটা পোষাক পড়ে পরিপাটি হয়ে বেরোলাম। ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখি টেবিল রেডি। যথারীতি আমার ফেভারেট মেনু। সাথে কিলার স্মাইলসহ মি হ্যান্ডসাম।
গতরাতের কথোপকথনটা তখনও মন থেকে সরে যায়নি। কিছুটা ভয় কাজ করলেও মাথা ঠান্ডা রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এমন সময় কথাটা জানাল আসিফ।
— আপনার বাবা সকালে নাস্তা সেরে ফেলেছেন। এরপরে আপনার ফুপুকে নিয়ে বিয়ের মার্কেটিংয়ে বেরিয়েছেন।
এবার অবাক হলাম না। বুঝলাম, ভয়েস সিন্থেসাইজারের কাজ। বাবাকে ফোনে আমার কন্ঠ জানিয়ে দিয়েছে, বিয়ের মার্কেটিং করে রাখবার জন্য। হয়তো এটাও জানিয়েছে, ইশতিয়াককে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই। গলার স্বর স্বাভাবিক রেখেই জানতে চাইলাম
— আপনার ক্লায়েন্ট কি এখন দেশে?
— জ্বী।
— দেখা হতে পারে?
ছেলেটা খানিকটা প্রশ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকাল। এরপরে বলল
— এব্যাপারে কোন নির্দেশনা নেই। আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
আর কথা না বাড়িয়ে স্যান্ডউইচে কামড় দিলাম। ভাল বানিয়েছে। না তাকালেও বুঝতে পারছি, ছেলেটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলা দরকার। গতরাতের আলোচনাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম
— এই কটা দিন কিভাবে কাটবে?
— ভিডিও গেম আছে, টিভি আছে, কিছু ফিল্ম আছে আর বই
রাগ করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু থেমে গেলাম। এই বন্দী দশাতে আসলেই তেমন কিছু অ্যারেঞ্জ করা সম্ভব না। ইন্টারনেট মনে হয় না অ্যালাউ করবে। সো, টিভি, ফিল্ম আর বই দিয়েই সময় কাটাতে হবে। কথা না বাড়িয়ে খাবারে মনযোগ দিলাম। এমন সময় হ্যান্ডসামের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা স্মাইল দিল। এরপরে ফোনটা রিসিভ করল। ফোনটা নিয়ে নিজের রুমের দিকে যাবার জন্য উঠছিল। আমি বলে উঠলাম
— আপনার ক্লায়েন্ট?
উঠতে গিয়েও উঠল না। মাউথ পিসে হাত রেখে আমার দিকে তাকাল। বলল
— জ্বি
— ক্যান আই টক?
খানিকটা ভাবল। এরপরে মিঃ হ্যান্ডসাম ফোনটা এগিয়ে দিল। এবার গলার স্বর যতটা সম্ভব মোলায়েম করে শুরু করলাম
— হ্যালো। আমি
— বলুন
— আপনার কি মনে হয় না, আপনার প্ল্যানে একটা বড় ফল্ট আছে।
— বিয়ের দিন আমি মত পাল্টে ফেলতে পারেন, এই তো?
অবাক হলাম। ব্যাটা ম্যানিয়াক হলেও বুদ্ধিমান। উত্তর দিলাম
— ইয়েস।
— না। সেটা নিয়ে আমি চিন্তিত না।
— জানতে পারি, কেন?
— কারণ এই কয়দিনে আপনি আমার প্রেমে পড়ে যাবেন।
ব্যাটা বলে কি? প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম। নিজেকে সংবরন করলাম। বললাম
— আর ইউ ম্যাড?
— নো। দ্যাট ওয়াজ দ্যা ডিল। আসিফের উইল মেক ইউ লাভ মি।
কথাটা শুনে উত্তর দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। এই লোক বলে কি? ঝট করে আসিফের দিকে তাকালাম। সেই কিলিং স্মাইল ঠোঁটে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে এসব? মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গান পয়েন্টে বিয়ে করা যেতে পারে, রেপ করা যেতে পারে, বাট প্রেম? কাউকে প্রেমে পড়ানো যায়? উইল মেক মি লাভ হিম, মাই ফুট।
সিদ্ধান্ত নিলাম, ইশতিয়াকের সাথে আর কোন আলাপ করব না। যা করার আমাকে একাই করতে হবে। কথা শেষ হয়ে গেছে এমন ভাব করে ফোনটা হ্যান্ডসামের দিকে এগিয়ে দিলাম।
— কথা হয়ে গেছে।
হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিল ছেলেটা। এরপরে ‘হ্যাঁ’ ‘নো প্রব্লেম’ টাইপ কিছু আলাপ সেরে ফোন রেখে দিল। এরপরে টেবিলে বসতে বসতে বলল
— তো? আজকের প্ল্যান?
আড়চোখে ছেলেটার দিকে তাকালাম। কথা বলার মুড নেই। কথাটা স্পস্ট করেই বললাম
— ক্যান ইউ লিভ মি অ্যালোন?
মাথা ওপর নীচ করে সম্মতি জানাল। এরপরে থালাগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়াল। একবার ভাবলাম বাধা দিব। দিলাম না। টেবিল ছেড়ে উঠলাম। আসিফ হয়তো ভাবল আমি কিচেনে যেতে চাইছি। তাই জানাল
— আমি করে দেব। আপনি টিভি দেখুন।
ওকে হেল্প করার ইচ্ছে এমনিতেও ছিল না। শুধু নোড করে লিভিং রুমে গিয়ে একটা সোফায় বসলাম। একটু আগেও ‘কিছু একটা করার’ যে প্ল্যানগুলো মাথায় নাড়াচাড়া করছিলাম, সেগুলোর সবটাই বাতিল করলাম। বুঝতে পারছি, একটা না, দুটো ম্যানিয়াকের পাল্লায় পড়েছি। জোর করে আমাকে বিয়ে করা এর উদ্দেশ্য না। এই ছয়দিনে আসিফ উইল মেক মি ফল ইন লাভ উইথ ইশতিয়াক। হাও ক্যান হি? রিয়েলি পাজলড ফিল করছি। এদের সত্যিকারের প্ল্যান কি?
টিভি ছেড়েছি, কিন্তু দেখছি না। এমন সময় আসিফ সেখানে এসে পাশের সোফাটায় বসল। বলল
— হঠাৎ মুড চেঞ্জ?
চোখ তুলে তাকালাম। মুখটা খানিকটা গম্ভীর। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। ইতস্ততঃ করছে। আমিই তাই জানতে চাইলাম
— কিছু বলবেন?
— ইয়েস।
— বলুন
— আপনি কেন এমন পাগলামী করছেন? আজ হোক কাল হোক, বিয়ে তো আপনাকে করতেই হবে। ছেলেটাও তো পাত্র হিসেবে খারাপ না।
আসিফের দিকে এবার সোজাসুজি তাকালাম। বুঝলাম, এটাই প্ল্যান। এই কদিন ছেলেটার গুণগান করে আমাকে প্রেমে পড়ানোর প্ল্যান করছে। গ্রেট! বললাম
— আপনি নাকি ডিল করেছেন, তিন তারিখের মধ্যে আমি ইশতিয়াকের প্রেমে পড়ে যাব।
আসিফ এবার আমার দিকে সরাসরি তাকাল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— ইয়েস।
— অ্যান্ড ইউ থিঙ্ক, ইউ ক্যান ডু দ্যাট।
উত্তর না দিয়ে একটা স্মাইল দিল। এর মানে হচ্ছে, ‘আই হ্যাভ নো ডাউট ইন মাই মাইন্ড’। ঠান্ডা চোখে ছেলেটার দিকে এবার তাকালাম। জানতে চাইলাম
— গর্দান যাওয়ার ভয়ে আমি আপনার ‘ফল ইন লাভ উইথ হিম’য়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলব, এই তো?
ছেলেটা কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, দিল না। পরিবর্তে অন্য একটা উত্তর দিল।
— তিন তারিখে উত্তরটা নিজেই পেয়ে যাবেন।
বুঝলাম, এই ব্যাটা আর কিছু বলবে না। চেষ্টাও করলাম না। ব্যাটার প্ল্যান না বুঝতে পারলে, খেলায় অংশ নেয়া যাচ্ছে না। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে শুধু বললাম
— আপনার আগের কেসগুলোর সাকসেস স্টোরি কেমন? আই মিন কতজনকে প্রেমে ফেলতে পেরেছেন?
হ্যান্ডসাম সাহব কথাগুলো শান্তভাবেই শুনল। এরপরে প্রশ্নভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল
— সবগুলো। কোন ফেইলিওর নেই। কেন?
— সেটা তিন তারিখে জেনে যাবেন।
হ্যান্ডসাম এবার আর উত্তর দিল না। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। মনে হল, সেও চ্যালেঞ্জটা অ্যাকসেপ্ট করল। আমিও আর তর্ক বাড়ালাম না। আবার টপিক চেঞ্জ করলাম। বেশ স্বাভাবিকভাবে জানতে চাইলাম
— কি খাওয়াচ্ছেন আজকে দুপুরে?

চলবে

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1310883566093334

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here