স্বয়ম্বরা (৬ষ্ঠ পর্ব) রাজিয়া সুলতানা জেনি

স্বয়ম্বরা (৬ষ্ঠ পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি


মেজাজ তখন আমার সপ্তমে চড়ে আছে। স্পেশালি ইশতিয়াক চৌধুরীর পরিচয় পাওয়ার পরে। হারামজাদা রাবণের পথ ধরেছে। তাও আবার নিজে কিডন্যাপ করার মুরোদ নেই, কিডন্যাপার ভাড়া করেছে। রাগটা যখন মাথায় কিলবিল করছিল, তখন আবার জানতে পারলাম রুমে ক্যামেরা আছে। রাগটা সাথে সাথে তিনগুণ বেড়ে গেল।
ক্রুদ্ধ চোখে যখন ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন ছেলেটাও কিছুটা অপরাধবোধ নিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমাকে বোধহয় অ্যাসেসও করল কিছুক্ষণ। তবে এবারের চাহনি ওয়াজ নট মাচ কনফিডেন্ট। মন বলছে, ব্রেকডাউন করবে। বললাম
— আমি একটা কথা বারবার বলি না।
— আই সোয়্যার, ঐ রুমে কোন হিডেন ক্যামেরা নেই। ট্রাস্ট মি।
— না। রুম চেঞ্জ হবে। আপনার রুমে আমি থাকব, আপনি আমার রুমে। আই বিলিভ, আপনার রুমে কোন সিসি ক্যামেরা নেই।
হ্যান্ডসাম বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। হয়তো কিছুটা চিন্তা করল, আর কিছু বলবে কি না। অবশেষে, জানাল,
— ওকে।
রুম চেঞ্জ হল। আমি হ্যান্ডসামের রুমে এলাম। ক্যাবিনেটের জিনিসগুলোও এক্সচেঞ্জ হল। দুটো ঘরে আসবাবও একইভাবে সাজানো। এক্সট্রা বলতে এক আলমিরা বই। আর একটা ল্যাপটপ। ল্যাপটপটা আসিফ সাথে নিয়ে গেল। ঘরের চারদিকে তাকালাম। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, এঘরে ক্যামেরা নেই। ছেলেটা বেরিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় কি ভেবে নিজেই জানালো,
— জানিনা বিশ্বাস করবেন কি না, তারপরেও বলছি, ও ঘরের মত এঘরেও কোন ক্যামেরা নেই। তবে স্পীকার আর মাইক্রোফোন, এঘরেও আছে।
বলার ভঙ্গিতে মনে হল, সত্য বলছে। আনলেস প্রুভ আদারওয়াইজ, আপাততঃ এটা বিশ্বাস করা ছাড়া আমার উপায় নেই। স্পীকার আর মাইক্রোফোনের ব্যাপারটা আমি নিজেই অ্যালাউ করলাম। প্রয়োজনে কথা বলা যাবে।
একটা ব্যাপার ক্লিয়ার হল, হ্যান্ডসাম নিজেকে যতটা হার্টলেস দেখাতে চাইছে, ততোটা না। ইমোশনাল গেম খেলা যাবে মনে হচ্ছে। তবে আজকে আর না। একদিনের জন্য অনেক হয়েছে। কোন প্ল্যান করলে আগামীকাল করতে হবে। কাজটা সোজা হবে না, তবে মনে হচ্ছে অসম্ভব হবে না।
একটা ব্যাপারে আমি সিওর। টাকার লোভ দেখিয়ে লাভ হবে না। এথিকস ফেথিকসের কথাগুলো কেবল হুমকি বলে মনে হচ্ছে না, ব্যাটা আসলেই বোধহয় বেশ নীতি মেনে চলে। ওর পেট থেকে কিছু বের করতে চাইলে অন্য লাইনে ট্রাই করতে হবে। সুন্দরী মেয়েদের হাতে ঈশ্বর একটা অমোঘ অস্ত্র দিয়েছেন। রূপ। সেটা ব্যাবহার করা যেতে পারে। আই থিঙ্ক হি লাইকস মি। ওর তাকানোতে কিছুটা হলেও প্রেমিক ভাব আছে। কাজে লাগানো খুব কঠিন হবে না।
এসি অন করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে গিয়ে আবিস্কার করলাম, ঘুম আসছে না। আসলে কিছুক্ষণ আগেই তো অজ্ঞান দশা থেকে জাগলাম, ঘুম আসবে কোথা থেকে? আমার মনে হয় এখন আর ঘুম আসবে না। কয়েকবার এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম
— মিস্টার আসিফ, জেগে আছেন?
— আছি।
— ঘুম আসছে না।
— আমার আলমিরাতে কিছু গল্পের বই আছে। ইবুক লোডেড একটা ট্যাবও আছে। ওগুলো পড়তে পারেন।
— আমি সব ধরনের বই পড়ি না।
— একটু চেক করে দেখুন। আপনার পছন্দের বইও আছে।
উঠে এগিয়ে গেলাম। আলমিরা খুললাম। বইয়ের কালেকশান বেশ ভালোই। তিনটে বই পেলাম আমার ফেভারেট রাইটারের। এগুলো পড়া হয়নি। অনেকদিন থেকে খুঁজছিলাম বইগুলো। বিছানায় একটা আইপড আর একটা ট্যাব রাখা। সাথে হেডফোন। কি মনে করে ওদুটাও হাতে নিলাম। বিছানায় গিয়ে বসলাম। বইগুলোর জন্য ব্যাটাকে একটা কৃতজ্ঞতা জানানো যেতে পারে। বললাম
— থ্যাঙ্কস।
— ওয়েলকাম।
এমন সময় চিন্তাটা মাথায় আসল। তাই তো, কেমন আছেন? একটু কথা বলতে পারলে ভাল হত। জিজ্ঞেস করলাম
— আরেকটা হেল্প করা যায়?
— বলুন।
— বাবা কেমন আছে, খবরটা জানা যাবে? আপনিই ফোন করুন। তথ্যটা পেলেই আমার হবে।
— লিভিং রুমে চলে যান। টিভি ছাড়ুন। ওটা আপনার বাসার সাথে কানেক্টেড।
এই হারামজাদা তো দেখি মহা চিজ। আমাদের বাসায়ও সিসি ক্যামেরা ফিট করে ফেলেছে। কবে থেকে ফলো করছে আমাদেরকে? আমার বেডরুমেও লাগিয়েছে নাকি? প্রশ্নটা করতে যাব এমন সময় আওয়াজ ভেসে এল
— আপনার বাসার বেডরুমে কোন সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়নি। শুধু আপনার বাসার লিভিং রুমে আর আপনার বাবার বেডরুমে। সেটাও গতকাল লাগিয়েছি। আপনি যেন বাবাকে দেখতে পান, সেজন্য।
ব্যাটা তো দেখি মাস্টার প্ল্যানার। আমি কি করব, কি চাইব, সবই হোমওয়ার্ক করে রেখেছে আগে থেকে। ফিলিং ইম্প্রেসড। রুমে একটা ঘড়ি ছিল, তাকিয়ে দেখলাম রাত এগারোটা। মানে বাবা এখনও ঘুমায়নি। টক শো দেখছে।
বাইরে বেরিয়ে এলাম। লিভিং রুমে ঢুকলাম। লাইট জ্বালাবার জন্য সুইচ খুঁজছি এমন সময় নিজে থেকেই লাইট জ্বলে উঠল। নিশ্চয়ই ঐ ব্যাটার কাজ। মানে এখানেও ক্যামেরা আছে। এটা মেনে নেয়া যায়। মাইক্রোফোনও কি আছে? টেষ্ট করে দেখা যায়। বললাম
— থ্যাঙ্কস।
— রিমোটে ওয়ান চাপ দিলে লিভিং রুম, টু চাপ দিলে আপনার বাবার বেডরুমের ক্যামেরার ভিউ দেখতে পাবেন।
তার মানে এখানেও স্পিকার আর মাইক্রোফোন আছে। ব্যাটা কিডন্যাপিং কে মহা প্রফেশনাল টাচ দিয়েছে দেখি। সবদিকেই টেকনোলজি ছড়িয়ে আছে। টিভি অন করলাম। বাবার এখন বেডরুমে থাকার কথা। টু চাপ দিলাম। বাবা যথারীতি বেডরুমে শুয়ে টক শো দেখছে। বেশ নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে। আমার ভয়েসে কি এমন বলেছে যে বাবা এমন নিশ্চিন্তে আছে? জিজ্ঞেস করতে যাব এমন সময় স্পিকার আবার বলে উঠল
— আপনার বাবাকে বলা হয়েছে, আপনি বান্ধবীদের সাথে সিলেট ট্যুরে গেছেন। সপ্তাহ খানেক পরে ফিরবেন।
এই ব্যাটা তো দেখছি জিনিয়াস। না বলতেই বুঝে যাচ্ছে। থট রিডিংয়ের কোন ম্যাশিন আছে নাকি ব্যাটার কাছে? কথাটা বললাম না। নাহ, এই চিন্তাটা ব্যাটা ধরতে পারল না। কিংবা ধরলেও জানান দিল না। ওদিক থেকে কোন উত্তরও আসল না।
খানিক্ষণ বাবাকে দেখলাম। বোর লাগছে। টিভি বন্ধ করত যাব, এমন সময় কথাটা মনে আসল। জিজ্ঞেস করলাম
— আপনার টিভিতে আর কি কি দেখা যায়?
— আপনার ফেভারেট চ্যানেল ফর্টি ফাইভ থেকে ফিফটি ফাইভ পর্যন্ত।
ভ্রু কুচকে গেল। ফর্টি ফাইভ দিলাম। আসলেই আমার ফেভারেট চ্যানেল। বাকীগুলো টপাটপ চেক করলাম। স্পট অন। একটা ছেলে দেখি আমার সম্পর্কে ইনস অ্যান্ড আউটস সবই জানে। হঠাৎ কেন যেন ব্যাপারটায় অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। বললাম
— আপনি তো দেখছি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন।
— সরি ফর দ্যাট। খানিকটা রিসার্চ তো করতেই হয়েছে।
— তা রাবণ সাহেব নিজে সীতাহরণ না করে আপনাকে ভাড়া করলেন কেন?
— সরি ম্যাডাম।
— এথিকস?
— না, রুলস। ক্লায়েন্টকে অযথা প্রশ্ন আমরা করি না।
— আই সি। তা উল্টোটা কি করা যায়? কিডন্যাপিংয়ে আপনার জব এক্সপেরিয়েন্স সম্পর্কে যদি একটু জানতে চাই, বলা যাবে?
— যাবে। কি জানতে চান, বলুন?
— এই… ধরুন… এই প্রফেশানে কবে থেকে বা… কিভাবে এলেন।
— এই প্রফেশানে আছি বছর দুয়েক।
— বাট কেন? ইউ নো অ্যা লট অ্যাবাউট টেকনোলজি।
— তা জানি। এটাকে হবি বলতে পারেন।
— হবি? ওকে…হোয়াট অ্যাবাউট পার্সোনাল লাইফ?
— কি জানতে চান বলুন
— ম্যারিড?
— না।
— গার্লফ্রেন্ড?
— ছিল।
— ছিল কেন?
— ডাইড। ইন অ্যা কার অ্যাক্সিডেন্ট।
— সরি।
— ইটস ওকে।
— আমার সম্পর্কে কিছু জানবার নেই?
— সবই তো জানি।
— কি জানেন?
— একটা প্রাইফেট ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে থার্ড ইয়ারে পড়েন। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। মা ক্যান্সারে মারা গেছেন। হট টেম্পারড। ভেরি চুজি। অ্যান্ড স্টিল সিঙ্গেল।
ঘাড় কাত করে ব্যাপারটা অ্যাপ্রেসিয়েট করলাম। ফিল করলাম ছেলেটার সাথে গল্প করতে ভালোই লাগছে। বললাম
—লিভিং রুমে আসুন না। সামনা সামনি বসে গল্প করি।
কিছুক্ষণ কোন উত্তর পেলাম না। এরপরে দেখলাম, হ্যান্ডসামের রুমের দরজা খুলে গেল। ধীরে ধীরে হেঁটে এগিয়ে আসল। সাদা টিশার্ট আর ঢিলা একটা পায়জামা পড়ে আছে। ড্যাশিং লাগছে। হাতে মোবাইলটা নিয়ে এগিয়ে এসে একটা সোফায় বসল। কিছুক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আসিফ ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল ‘কি ব্যাপার’। উত্তরে কিছু না বলে একটা স্মাইল দিলাম। এরপরে ওর দিকে তাকিয়েই জানতে চাইলাম
— আমার কিন্তু একটা ব্যাপার মাথায় আসছে না।
— কি সেটা?
— আপনি এই প্রফেশানে কেন? আই মিন ইউ সিম কোয়ায়েট ইন্টেলিজেন্ট। আসলে… রাবণের হেল্পার হিসেবে আপনাকে কেন যেন মানায় না।
— প্রশংসা? না তিরস্কার?
কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বোঝার চেস্টা করলাম কথাটা কিভাবে নিচ্ছে। মনে হল, ‘রাবণের হেল্পার’ কথাটায় আপত্তি নেই। তারপরও সফট অ্যাপ্রোচে বললাম
— অ্যা বিট অফ বোথ।
— থ্যাঙ্কস।
— আর আমার প্রশ্নের উত্তরটা?
এবার আমার দিকে সোজাসুজি তাকাল। আবার সেই স্মাইল। বলল
— প্রফেশানটা আমি চুজ করিনি, প্রফেশান আমাকে চুজ করেছে।
অবাক হলাম। জানতে চাইলাম
— বুঝলাম না।
এবার কিছুটা উদাস হয়ে বলতে শুরু করল
— একসময় আমি সিকিউরিটি এক্সপার্ট ছিলাম। ভাল চাকরী করতাম। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি ডিজাইন করতাম।
শেষের শব্দটা কানে বাজল। জানতে চাইলাম
— ‘তাম’ কেন? এখন করেন না?
— না। একবার এক ব্যাঙ্কে রবারি হয় আর ব্লেইমটা আসে আমার ওপর। ইনভেস্টিগেশানে ডাকাতদের একজন স্টেটমেন্ট দেয়, আমি নাকি ওদের ভল্টের পাসওয়ার্ড দিয়ে হেল্প করেছি। সে কারণে জেলও হয়।
— তারপর?
এবার বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় হেলান দিল। এরপরে বলল
— তারপর? তারপর আমার জীবনে ‘শান্ত কেন মাস্তান’ টাইপ ফিল্মের নায়কের মত হয়ে যায়। অনেস্টির এমন পরিণাম দেখে অভিমানে প্রফেশনাল কিডন্যাপার হয়ে গেলাম।
ব্যাটা কি চাপা মারছে? না সত্যি? চেহারা দেখে আন্দাজ করতে পারছি না। হোয়াটেভার, ক্যারেক্টার বেশ ইন্টেরেস্টিং। নিজেকে অবশ্য ‘শান্ত কেন মাস্তান’ টাইপ সিনেমার বিবেক টাইপ হিরোইন হিসেবে কল্পনা করছি না। কেবল নিজের মধ্যে, একজন থ্রিলার গল্পের থ্রিলপ্রেমী নায়িকার উদগ্রীবতা ফিল করলাম। মনে মনে হাসলাম। আমি কি এই ব্যাটাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি? পরে ভাবা যাবে। আপাততঃ গল্প এগিয়ে নিলাম। জানতে চাইলাম
— ফ্যামিলিতে আর কে কে আছেন?
— বাবা।
— মা?
— শি ইজ নো মোর।
— সরি।
— ইটস ওকে।
— একটা কথা বলব?
— বলুন।
— আপনার রান্নার হাত কিন্তু বেশ ভাল।
— আই নো।
— মা শিখিয়েছে?
— না। মা যখন মারা যান, আমি তখন খুব ছোট।
এরপরের কথাটা ঠিক কোন কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম
— আচ্ছা, আপনাকে যদি ভাল হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়, নেবেন?
— প্রলোভন?
— ধরুন তাই।
— না, নেব না।
এমন সময় হ্যান্ডসামের ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা ড্রয়িংরুমের সেন্টার টেবিলের ওপরই রাখা ছিল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল, ক্লায়েন্ট। আসিফ ফোনটা ধরতে যাচ্ছিল। আমি হাত বাড়িয়ে ওকে আটকালাম। বললাম
— আপত্তি না থাকলে, আমি একটু কথা বলতে চাই।
কি ভেবে ব্যাপারটা মেনে নিল। মোবাইলটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। ফোনটা রিসিভ করলাম। কানে লাগিয়ে কথোপকথন শুরু করলাম।
— হ্যালো

চলবে
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1310285012819856

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here