স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_১০
Writer -Afnan Lara
.
নীল মুনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো,একটা কথাও শুনলো না মুনের
মুন কিন্তু বলেই যাচ্ছে তাকে এখানেই রেখে যেতে কিন্তু নীল তার কোনো কথারই তোয়াক্কা করলো না
ওকে বাসায় আনতেই মা মুনের মুখ ধরে ওর কপালে চুমু খেলেন
চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন”ওর কোনো ক্ষতি করেনি তো ওরা??”
–
নাহ!
.
নীল মুনের হাত এবার ছাড়লো তারপর বললো “নিপা ওকে তোর রুমে নিয়ে যা”
♣
মুন চুপচাপ নিপার রুমের কোণার একটা চেয়ারে বসে আছে,, আসলেই তো এভাবে অন্য কারোর বাসায় থাকাটা ঠিক হচ্ছে না,,আমাকে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে নিতে হবে
.
নীল নিজের রুমে গিয়ে আবারও শুয়ে পড়লো,দরজা লাগালো না আর,তারপর মুনের কথা মাথায় আসতেই উঠে বসলো সে,সামনের ওয়াল মিররটার দিকে চেয়ে গায়ের জ্যাকেট খুললো সে,মাথায় শুধুই মুনের জন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে
আগে যে চিন্তা হতো এখন নতুন চিন্তা যোগ হয়েছে আর সেটা হলো মুন নিজেই এখন এখানে থাকতে চায় না,কি ঝামেলা,এই জন্য বলে মানুষ তার নিজের সুখ সইতে পারে না
একদম ঠিক কথাটা,এখানে মেয়েটার কিসের অভাব??নিপার সাথে এক সাথে ঘুমায়,আমার বাসা ভর্তি মানুষ,একটা কাজ ও তো ওকে করতে হয় না,আমি যদি নিজ থেকে ওকে এখানে রাখতে চাই তাতে ওর কি সমস্যা সেটাই মাথায় ধরে না আমার
.
মুন চেয়ারে বসে এতক্ষণ ভাবছিলো ভবিষ্যতে কি করবে তা নিয়ে তার এতসব ভাবনায় ছেদ ঘটালো কাড়ি কাড়ি মশার দল
বিরক্ত হয়ে সে গিয়ে বারান্দার দরজাটা লাগালো,,তারপর নিপার বিছানার কিনারায় বসে রইলো চুপচাপ
তার মাথায় এসব কিছু বাদ দিয়ে নতুন চিন্তা আসলো এবার আর সেটা হলো আজ রাতে হিয়া আসে কিনা,বা কখন আসে সেটা সে দেখবে
রহস্য উদঘাটন করবে সে
কিছুক্ষণ বাদে নিপা এসে কম্বল টেনে শুতে শুতে বললো সে আজ টায়ার্ড অনেক,মুন যেন গিয়ে ডিনার করে আসে,সে আজ খাবে না
মুন ভাবলো সে খেতে গেলে যদি হিয়া ওসময়ে এসে যায়,তার চেয়ে বরং সে খাবে নাশনজর রাখবে করিডোরের শেষ প্রান্তে
নিপা ঘুমে,নীলের বাবা আজ কয়েকদিন হলো বাসায় নেই,তার পেনসন নিয়ে কিছু কাগজপত্রের জুটঝামেলা হয়েছে সেটা ঠিক করতে তিনি আউট অফ টাউন
নীলের বাকি তিনভাই এখানে থাকে না
বড় ভাই তার ওয়াইফ আর ছেলেমেয়েকে নিয়ে মালয়েশিয়াতে থাকেন,আর মেজো আর সেজো ভাই রাজশাহী, খুলনাতে,কারণটা হলো তাদের চাকরিসুত্রে
ছুটি পেলেই দলবেঁধে সবাই এসে হাজির হয়
আর তাই এখন মা একা বসে ডিনার করছেন,ভেবেছেন মুন এখন আসবে না,আর এখন ওর মনের অবস্থাও হয়ত ঠিক না
এসব ভেবে তিনি আর মুনকে ডাকলেন না
ওদিকে মুন গালে হাত দিয়ে নীলের রুমের দিকে চেয়ে আছে
সময় তার গতিতে শেষ হচ্ছে,দেখতে দেখতে রাত এগারোটা বাজে এখন,মুন আর নীল দুজনের একজনেও ডিনার করলো না
নীল হিয়ার ছবি নিয়ে এতক্ষণ দেখছিলো পরে সময় কাটে না দেখে টিভি অন করলো,আর টিভি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে
এদিকে মুন চোখের পাতা উঁচু করে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে যাতে ভুলেও সে ঘুমিয়ে না পড়ে
রাত আড়াইটার সময় মুন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো,যেখানে বসেছিলো ওখানেই,আর কত ঘুমের সাথে যুদ্ধ করবে
কেউ দেখলো না,জানলো না,পরেরদিন সকাল সকাল সে উঠে চোখমুখ ডলে আশেপাশে চেক করে নিজের মাথায় নিজেই চড় মেরে বললো”আরেকটু জেগে থাকলে কি এমন হতো রে মুন?কেন ঘুমাইলি তুই?হয়ত হিয়া মেয়েটা আড়াইটার সময় এসেছিল,মিস করলাম!!!
সকাল ৬টা বাজে এখন, নিপা ঘুমাচ্ছে
ওকে দেখে এসে মুন ওড়না কোমড়ে বেঁধে ওদের রান্নাঘরে এসে হাজির
মুন হলো পাকা রাধুনী একটা,, তাকে কেউ রান্না থেকে দূরে রাখতে পারে না,এতদিন কি করে যে সে রান্না ছাড়া ছিলো সেটাই ভাবছে সে,বাসায় সে নিজেই সব রাঁধতো
রান্নাবান্না শেষ করে মুন পিছন ফিরতেই দেখলো নাহার হা করে চেয়ে আছে
.
কি??এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?
.
এসব আপনি রাঁধছেন?
.
হুম,,আপনি এক কাজ করেন এগুলো টেবিলে দিয়ে বসেন,আমি হাত ধুয়ে আসি,হলুদ ধরেছিলাম বলে হাত ধুতে হবে,আর মুখেও পানি দেবো
.
আইচ্ছা
.
মুন হাত ধুয়ে হাত মুছে আবারও রুম থেকে বের হতেই দেখলো নীলের রুমের দরজা খোলা,এই সাত সকালে নীলের রুম খোলা দেখে মুন বেশ অবাক হলো,তাই অবাক হয়েই সে নীলের রুমের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ
দরজার ফাঁক দিয়ে দূরে খাটের উপর শুয়ে থাকা নীলের উদম শরীর দেখা যাচ্ছে
মুন লজ্জায় লাল হয়ে আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলো
♣
মা তাড়াতাড়ি করো আমার লেট হচ্ছে
–
তাড়াতাড়ি?টেবিলে সব সাজানো আছে নিয়ে খাওয়া শুরু কর
.
নীল খেতে বসে অবাক হয়ে গেলো,, এত সকাল সকাল এত আইটেম,,তুমি করেছো কি করে?
–
আমি করিনি,করেছে মুন,,আমিও প্রথমে দেখে অবাক হয়েছিলাম
.
নীল খাবার খেয়ে বেরিয়ে গেলো,আর কিছু বললো না,
না কোনো কমপ্লিমেন্ট না কোনো কিছু
অবশ্য মুন ওর কমপ্লিমেন্ট আশাও করছিলো না,সে নীলের রুমটা লুকিয়ে দেখছে এখন
নীল যাওয়ার সময় দারোয়ানকে কড়া করে বলে গেলো কাউকে যাতে ঢুকতে না দেয়,মুনকে যেন বাসা থেকে বের হতেও না দেয়
♣
পাশের বাসার মৌটুসি আন্টি আসলেন নীলের মায়ের সাথে গল্প করতে
নীলের মাকে দেখেই বললেন”ভাবি কেমন আছেন??আচ্ছা!সেটার উত্তর পরে দিয়েন,,শুনলাম নীল নাকি একটা মেয়েকে এনে আপনাদের বাসায় রাখতেছে,তা মেয়ে ওর কি হয়??”
.
মুন দূরে দাঁড়িয়ে কথা শুনতেছে,এতক্ষণ হুদাই করিডোরে পায়চারি করছিল সে,এই বাসায় এত বোরিং লাগে ওর
নিপা সারাদিন তার হবু বরের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত থাকে
আর কেউ নাই সময় কাটানোর
–
নীলের মা এমন প্রশ্ন শুনার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিলেন না,,ইতস্তত হয়ে তিনি বললেন” কিছু হয় না,আসলে মেয়েটা বিপদে পড়েছে তাই নীল ওকে বাসায় নিয়ে এসেছে”
–
তো যত মেয়ে বিপদে পড়বে সবাইকে বাসায় নিয়ে আসবে নীল?? আমার তো মনে হয় নীল ওকে পছন্দ করে
–
নাহ জীবনেও না,,ওর সারাটা মন জুড়ে শুধু একটাই নাম একটাই চেহারা আর সেটা হলো হিয়া,,আজ পর্যন্ত ওকে আমি বিয়ে করাতে পারলাম,,কোনো মেয়েকেই ওর চোখে ধরে না,মুনকে তো মানবিকতার খাতিরে হেল্প করছে সে
–
তো হিয়াকে বিয়ে করেনি কেন তাহলে??
.
মা চুপ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন,আর কিছুই বললেন না
.
মুন হিয়া নামটা শুনতে পেলো আবারও,ঐ হিয়ার কথা দেখি চৌদ্দ গুষ্টি সবাই জানে,তাহলে ওদের বিয়েটাই হলো না কেন সেটাই মাথায় ঢুকছে না
নীলের মা ও দেখি নিজেই রাজি!!
আর ছেলে তো সরকারি চাকরি করে তাহলে ওদের বিয়েটাই হলো না ক্যান,ভাব মুন,ভালো করে ভাব
রহস্যের গন্ধ এসে নাকে লাগছে বারবার
–
তো এই মেয়েটাকে আপনাদের বাসায় রাখা ঠিক হবে না আমি তো কিছু বলতেছি না কিন্তু সব মানুষ তো এমন নম্রভাবে বলবে না আর দেখবেও না,দেখেন এবার শুরু হবে কানাকানি
.
কথাসব শুনে মুন চুপচাপ নিপার রুমে ফিরে এসে নিজের গয়না গুলো হাতে নিলো,নিপার ওয়ারড্রবে ছিলো,এগুলার দাম ১লাখ হবে,এগুলা দিয়ে আমি বাসা ভাড়া করে থাকতে পারবো
কিন্তু কতদিন??সমস্যা না,চাকরি নিয়ে নেবো তাতেই হয়ে যাবে
.
মুন ওড়না ঠিক করে গয়না গুলো নিয়ে নীলের মায়ের কাছে গেলো সোজা
–
আন্টি আমি আসি
–
মানে কি,কই যাচ্ছো তুমি??
–
কদিন তো থাকলাম,এবার তো আমাকে যেতে হবে
–
কই যাবে তুমি??
–
আমার বান্ধুবীর বাসা আছে,রিয়া নাম,,ও একটা ফ্ল্যাটে থাকে,ওর কাছে থাকবো আমি,সমস্যা হবে না,,আপনাদের অনেক ধন্যবাদ আমাকে কদিন আশ্রয় দিয়েছেন,এই ঋন আমি শোধ করতে পারবো না কখনও
.
কথাটা বলে মুন নীলের মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলো
–
নাহ দাঁড়াও,এক মিনিট!!,নীলের অনুমতি ছাড়া আমি তোমাকে যেতে দিতে পারি না
–
উনার সাথে আমার মাত্র কথা হয়েছে
–
কি বললো ও??ওর তো রাজি হওয়ার কথা না
.
উনি বলেছেন আমার যখন এখানে থাকার ইচ্ছে নেই তখন আমি চলে যেতে পারি
.
ওহ তাহলে ঠিক আছে,সাবধানে যেও,গিয়ে ফোন করিও কেমন?
.
মুন নীলের মায়ের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো,
পিছন ফিরে বাসার দিকে একবার তাকালো সে,,
মাত্র কটাদিনে এই বাড়িটা,, এই বাড়ির লোকগুলো এত আপন হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি আমি
.
চোখে পানি এসে গেলো তার,পানি মুছে গেট পর্যন্ত আসতেই দারোয়ান আটকালো ওকে
.
নীল স্যার আপনাকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন
.
আমি উনার অনুমতি নিয়েই যাচ্ছি
.
ওহ,আচ্ছা যান
.
মুন গেট পেরিয়ে একটা রিকশা নিলো,রিকশা করে যাওয়ার সময় পাশ দিয়ে নীলের গাড়ী বাসায় ঢুকলো
মুন দূর থেকে সেটা দেখেই ওড়না দিয়ে মুখটা আড়াল করে ফেললো,ফেরার সময় অন্য একটা জামা পরেছিল বলে নীল ওকে চেনে নাই
.
নীল জিপ থেকে নেমে গলার ঘাম মুছলো রুমাল দিয়ে,,শীতকাল শেষ হতে চলেছে,বসন্তকাল এখন,আর আমাকে দেখে মনে হবে গ্রীষ্মকাল
.
বাসায় ঢুকে নীল শার্ট খুলতে খুলতে সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলো
.
মুন অনেক খুঁজে একটা বাসা পেলো অবশেষে,মাসে ৭হাজার টাকা ভাড়া,,ওর সাথে একটা মেয়ে থাকবে শেয়ারিং করে,তাতেই রাজি হলো মুন
.
নীল ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং এ বসলো,মুখে খাবার দিতে দিতে বললো “তাহা কোথায়?ওকে দেখলাম না আসার পর থেকে”
–
মা চোখ বড় করে নীলের মুখের দিকে তাকালেন
.
মানে?ও তোর সাথে কথা বলেনি?
–
কেন বলবে?আর কি কারণে?
–
মুন তো চলে গেছে,ও নাকি তোর সাথে কথাও বলেছে,তাই তো যেতে দিলাম আমি
–
গেছে মানে?কই গেছে??
.
নীল আর খেলো না উঠে দাঁড়িয়ে গেলো
মা সব বললো নীলকে
.
এখন কোথায় খুঁজবো ওকে,আর আমার তো জানা মতে ওর আর কোনো বান্ধুবী নাই রাঙামাটির মেয়েটা ছাড়া,তাহলে কোথায় গেছে
.
নীল মুনের নাম্বারে অনেকবার কল করলো,,সুইচড অফ
এসময়ে ফোনটাও অফ করে রেখেছে মেয়েটা
.
মুন পড়েছে বিপদে,তার সাথে যে মেয়েটা থাকে তার বয়ফ্রেন্ড এসেছে, আর মেয়েটা রুমডেট করবে
মুনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বের করে দিলো বাসা থেকে,বললো ১ঘন্টা একটু কষ্ট করে বাহিরে থাকতে
মুন বাসার বাইরে রোডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে কি করে একটা জব পাওয়া যায়
.
নীল এক হাত দিয়ে ড্রাইভ করতে করতে আরেক হাত দিয়ে মুনকে কল করেই যাচ্ছে
মুন ফোন অন করলো সবেমাত্র ,সাথে সাথে নীলের কল,
মুন ঢোক গিলে কল রিসিভ করলো উপায় না পেয়ে
–
হ্যালো মুন,তুমি কোথায়??
–
আমি বাসা ভাড়া নিয়েছি,আপনি টেনসন করিয়েন না
–
তুমি আমাকে না বলে কোন সাহসে বের হইছো??এখন বলো তুমি কোন জায়গায় বাসা নিছো??পরের হিসাব পরে চুকিয়ে দেবো
–
না বলবো না,আমি এখানে ঠিক আছি,কিছু হবে না আমার
.
হঠাৎ মুনের পাশ দিয়ে একটা রিকশা গেলো মাইকিং করতে করতে
“মিরপুর ৫নং এ গ্রামীন সিম এর মেলা বসবে,আপনারা আসবেন কিন্তু,,,মেলা!!মেলা!!মেলা”
.”
মুন ফোন চেপে ধরে রাখলো যাতে নীল না শুনে,তাও নীল ঠিক শুনে ফেললো
নীল এবার জোরে ড্রাইভ করে মিরপুরে চলে আসতেছে
♣
এখন কি করবো আমি?? বাসার ভিতর ও তো যেতে পারছি না
যদি এখন এসে পড়েন উনি??
.
মুন মুখ লুকিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে,অশ্রুসিক্ত হয়ে মুনের চোখদুটো চিকচিক করছে
কাউকে ভালো আছি মিথ্যা বললে মুনের কান্না পায়,তাই কাঁদছে সে
চলবে♥