স্মৃতির দেয়াল🍁 পর্ব-২৫

0
740

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_২৫
Writer -Afnan Lara
.
বেশ হয়েছে,এবার হিয়া আসছে না কেন মালিশ করে দিতে?এসবে তো বউ কাজে লাগে,এসব ভেবেও তো মানুষ বউয়ের কদর করা শেখে,অবশ্য কাকে নিয়ে ভাবছি!!
এর কাছে তো বউয়ের চেয়ে এক্সের দাম বেশি
.
নীল চুপ করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে
মুন বেশ কিছুক্ষণ ধরে নীলকে লক্ষ করছে,,হঠাৎ দরজায় নক হতেই সে উঠে গিয়ে দেখলো হোটেলের লোক এসেছে খাবার দিতে,মুন খাবারের ট্রেটা হাতে নিয়ে বললো”গরম তেল পাওয়া যাবে?মালিশ করার?”
.
জি ম্যাম
.
তাহলে প্লিস নিয়ে আসুন,আমরা এক্সট্রা পে করবো
.
লোকটা চলে গেলো,মুন খাবারের ট্রেটা রেখে বললো”নিন খান”
.
নীল যেন শুনলোই না,মাথাটা বালিশের নিচে নিয়ে চুপ করে আছে সে
পনেরো মিনিট পর লোকটা আবার আসলো গরম তেল নিয়ে
মুন তেল হাতে নিয়ে দরজা লাগালো,তারপর নীলের দিকে তাকিয়ে বললো”শেষমেষ ঐ বউ কাজে আসছে,কোনো প্রেমিকা নয়”
.
নীল তাও কিছু বলছে না,মুন কাছে এসে বসলো,তারপর হাতে তেল ঘষে নীলের পিঠ থকে কাঁথা সরিয়ে সেখানে মালিশ করা শুরু করতেই নীল মাথা তুলে বললো”আমার কেয়ার করতে হবে না,সকল ব্যাথা সহ্য করতে পারি আমি”
.
আমাকে ঐ পাগলের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ঠিক সেই খাতিরে আমি এখন মালিশ করছি,ব্যস এর বাহিরের কিছু না
আপনার প্রতি আমার কেনো ভালেবাসা নেই,শুধু ঋন চুকাচ্ছি আমি
.
নীল চুপ করে থাকলো,তার ভালো লাগছে মালিশে,,মুনের হাত নরম,আর ছোট হওয়ায় নীলের আরামটা অধিক বেড়ে গেছে
মুন নীলের পিঠ দেখে রীতিমত ক্রাশিত,,মনে হয় যেন লোক লাগিয়ে পিঠকে এত স্মুথ বানিয়েছে,এত সুন্দর মানুষের পিঠ হতে পারে তা নীলের পিঠ না দেখলে মুনের বিশ্বাসই হতো না
পিঠ দেখতে দেখতে সে মালিশ করে যাচ্ছে
.
নীল ঘুমিয়ে পড়েছে,সাথে মুন ও,তাও নীলের ঠিক পাশেই
দুপুর ২টোর দিকে নীলের ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো,চোখ খুলতেই তার চোখ গেলো সবার আগে মুনের উপর
মুন একদম ওর পাশেই শুয়ে আছে,চোখে রাজ্যের ঘুম তার
নীল সাথে সাথে সরে গেলো,তারপর পিঠে হাত দিয়ে বুঝলো ব্যাথা অনেকটা কমে আসছে
মুনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো নীল,মুনের কারণেই এখন তার একটু ভালো লাগছে,খাবার যেমন আনা হয়েছে তেমনি আছে,নীল ও খায়নি,মুন ও না
নীল বিছানা থেকে নেমে শার্ট গায়ে দিয়ে বারান্দায় আসলো,,সুন্দর বাতাস এসে গায়ে লাগছে প্রতি এক মিনিটে
ফাগুনের এই সময়টায় একটা বাতাস আসে,এত সুন্দর তা বলার বাহিরে
পাহাড়ি অঞ্চলে তো মনে দোল খেলে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়,রাঙামাটির কোণা কোণার সাথে নীল পরিচিত
কারণ পুলিশ হওয়ার পরে তার প্রথম পোস্টিং হয়েছিলো রাঙামাটিতে
কম বেশি সবাই নীলকে চিনে এখানে,,নীল নিচে তাকাতেই একটা লোককে দেখলো পিঠে কাঠ নিয়ে যাচ্ছে,উনি নীলকে দেখে থেমে গিয়ে বললেন”স্যার কেমন আছেন?”
.
ভালো,আপনি?
.
ভালো,,তা আপনি এই হোটেলে??বিয়ে করলেন নাকি?
ম্যাডামকে সাথে করে এনেছেন?
.
নীল হালকা হেসে বললো”করতেই হলো”
.
খুব খুশি হলাম আপনার বিয়ের কথা শুনে,ম্যাডামকে নিয়ে আমার বাড়িতে আইসেন
.
বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে লোকটা চলে গেলেন
নীল পিছন ফিরে মুনের দিকে তাকালো
মুন উঠে গেছে ততক্ষণে,,নীলের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বিছানা থেকে নেমে ডিভানে এসে বসলো সে
.
নীল রুমে এসে মুনে দিকে তাকিয়ে ওর পাশে বসলো ডিভানের উপর
.
কি চান আবার?এবার কি ফ্লোরে বসাবেন?
.
নীল মুনের চোট আলা হাতটা ধরলো,তারপর শান্ত গলায় বললো”শুনো তাহা,,আই এম সরি,আমার ওভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি”
.
আপনি ডিভানে শুবেন,আর আমি বিছানায়
কথাটা ঠিক থাকবে,যা বলে ফেলেছেন তা আর ফেরত নেওয়া যাবে না,, যায় ও না
আলাদাই শুবো আমরা
জানি তো কেন আলাদা করে দিলেন,নিশ্চয় হিয়া কিছু বলেছে
.
কাল শপিংমলে হিয়ার সাথে মিট হওয়ার পর থেকে ওর সাথে আর কথা বলিনি আমি
.
মিথ্যা বলবেন না আপনি,হিয়ার সাথে কথা না বলে- না আপনি থাকতে পারেন -না হিয়া পারে
আপনি তো আমাকে বিয়ে করেছেন আপনার আর হিয়ার প্রেমলীলা দেখানোর জন্য
.
কথা শেষ করে মুন বিছানায় গিয়ে বসলো
নীল খাবার নিয়ে বসেছে খাওয়ার জন্য
মুন এখনও চুপ করে আছে এবং ওর খাওয়া দেখছে
নীল হঠাৎ উঠে এসে মুনের পাশে বসে বললো”হা করো”
.
হিয়া জানলে মরে যাবে
.
হা করো,আমি খাইয়ে দিচ্ছি
.
এত আদর??কিসের জন্যে?
.
কেন?আমি কি আমার ওয়াইফের কেয়ার নিতে পারি না?
.
হ্যাঁ পারেন,তবে হিয়াকে ভুলে গিয়ে আমাকে কেয়ার দেখাতে আসবেন তার আগে না,আমি আপনার হাতে কিছু খাবো না
.
মুন উঠে চলে গেলো ফ্রেশ হতে,রেডি হয়ে নেবে কারণ বিকালে সবাই ঘুরতে যাবে বলেছিলো
.
নীলের খারাপ লাগলো,পরে মাথায় আসলো হয়তবা মুনের জায়গায় অন্য মেয়ে হলেও এমন করতো
.
মুন বেশ কিছুক্ষন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বালতি ভর্তি করতে পানির কল অন করার জায়গায় ভুলে শাওয়ারটাই অন করে দিলো ,তারপর তাড়াহুড়ো করে সেটা অফ ও করলো কিন্তু ততক্ষণে সে ভিজে গেছে
ওড়না দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসলো মুন
নীল খাবারের প্লেট টেবিলে রেখে পিছন ফিরতেই মুনকে দেখলো আধভেজা অবস্থায় ব্যস্ত হয়ে নিজের জামা বের করছে ব্যাগ থেকে
.
ভিজলে কি করে?
.
আপনাকে কেন বলবো?
.
নীল চুপচাপ শার্টের উপর দিয়ে জ্যাকেট পরছে,মুন এবার বেশি বেশি করছে,এরকম রুড বিহেভ করার কি দরকার??হাসবেন্ড হই ওর,ঠিক করে কথা বললেই পারে
.
মুন একটা আকাশি রঙের থ্রি পিস পরে বললো”চলুন”
.
কিছুই খেলে না
.
খাব না,আপনার কি?
.
না খেলে আজ তুমি ঘুরতে যাবে না,কাল রাতেও কিছু খাওনি,সারাদিন গিয়ে এখন বিকেল চারটা বাজে
.
না খেয়ে মরে যাব,তাও আপনার এত কেয়ার করতে হবে না আমার,হিয়াকে কল করে জিজ্ঞেস করেন খেয়েছে কিনা,আপনি তো আবার কাল থেকে নাকি ওর সাথে কথা বলেন নি
.
ফাইন!আজকে তুমি এখানেই থাকবে

নীল হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে,বের হয়ে বাহিরে দিয়ে রুম লক করে চলে গেলো,,ভাইয়া ভাবীরা সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে,একসাথে আসলেও সবাই যে যার মতন জায়গায় ঘুরছে,তাই নীল মুনকে নিয়ে বেরিয়েছে নাকি বের হয় নাই তা কেউ জানে না
মুনের খুব খারাপ লাগছে,নীল এতটা খারাপ কি করে হতে পারে
খাবার খাইনি বলে আমাকে বন্দি করে চলে গেলো
আমি এখন একা একা কি করে থাকবো
.
নীল আশেপাশের একটা পাহাড় দেখতে এসেছে,চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছে সে এখন
মাঝে মাঝে ফোন বের করে একটা দুটো ছবি তুলছে
হোটেলের ইলেক্ট্রিসিটি গেছে পানিতে,,নীল যাওয়ার এক ঘন্টার মাঝেই সকল লাইন চ্যুত
মুন এতক্ষণ টিভি দেখছিলো,তার এবার আরও রাগ হচ্ছে নীলের উপর
সন্ধ্যা নেমে এসেছে কেউই আসছে না
মুন গায়ে কাঁথা জড়িয়ে টেবিলে থাকা খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে
তার জীবনে এত কষ্ট লেখা আছে জানলে সে তুষারকেই বিয়ে করতো
নীল এখনও আসছে না,রাত হয়ে গেছে,ভাবীরা ভাইয়ারা সবাই কই,আমাকে কি তাদের মনে নেই??
নীলের তো নিশ্চয় মনে নেই
এত অন্ধকার,একটা মোমবাতি নেই,কারেন্ট কখন আসবে
ভয় করছে অনেক,আমার দোষ,আমি কেন খাবারের উপর রাগ করলাম,লোকটা মুখ ফুটে যাই বলে তাই করে এটা তো জানি আমি,তাহলে রাগ দেখালাম কেন?
কত বড় খারাপ লোক হলে নিজের ওয়াইফকে ঘুরতে এনে রুমে বন্দি করে নিজে চলে যেতে পারে?
আমি এতই খারাপ তার কাছে?হিয়ার এত দাম??
.
মুন কাঁদতে কাঁদতে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়েছে,খাবার খাবারের জায়গায় পড়ে আছে
নীল ফিরলো ৮টার দিকে
এসে দেখলো রিসিপশানে মোমবাতি জ্বলে
সে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো বিকেল থেকে কারেন্ট নেই
ভাইয়া ভাবীরা ও ফিরছে এক এক করে
পপি ভাবী নীলকে দেখতে পেয়ে মুনের কথা জিজ্ঞেস করলেন
নীল বললো সে মুনকে সবেমাত্র রুমে রেখে এসেছে
.
ভাবী আর কিছু জানতে চাইলেন না,চলে গেলেন,নীল একটা মোমবাতি হাতে রুমে ফেরত আসলো
রুমের দরজা খুলতেই তার নিজের বুকটা কেঁপে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে
পুরো রুম জুড়ে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই
আজ কি সে বেশি করে ফেললো?
মোমবাতিটা টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে খাবারগুলো দেখলো নীল
তার মানে খাবার ও খায়নি
.
নীল দরজা লাগিয়ে মুনের পাশে এসে দেখলো ও ঘুমাচ্ছে
নীল ওর গায়ে কাঁথা টেনে দিতেই মুন জেগে গিয়ে একটু পিছিয়ে বললো”কে?”
.
আমি
.
মুন মোমের আলোয় কোনোরকম নীলকে চিনলো তারপর মুখটা ভার করে আবারও শুয়ে পড়লো
নীল কি যেন ভেবে মুনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো”মুন আমাকে মাফ করে দাও,আমি জানতাম না বিকেল থেকে এখানে কারেন্ট ছিল না,এতটা সময় তুমি একা ছিলে ভাবতেই খারাপ লাগছে অনেক”
.
বাদ দিন,আমি এমনিতেও আপনার শুধু দায়িত্ব ছাড়া আর কিছু না
দায়িত্ব জিনিস ফ্লোরে রাখলেও কি,বিছানায় রাখলেও কি,সেটা না ভাঙ্গলেই হয় এটা দেখার বিষয়
.
মুন নীলকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে একটু দূরে সরে গেলো
নীলের খুব খারাপ লাগছে,নিজেই নিজেকে দোষারোপ করছে সে এখন
মুন প্রচুর কেঁদেছে আজ,তাই আর এখন চোখ দিয়ে পানি আসছে না তার
সে বুঝে গেছে নীলের কাছে তার বিন্দুমাত্র দাম নেই,কদর নেই,নাহলে এতটা কেউ করতে পারে না নিজের ওয়াইফের সাথে
মুন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চোখটা খুলতেই কিসের যেন কান্নার আওয়াজ পেলো
চমকে উঠে বসলো সে
কে কাঁদছে?
.
সামনে তাকিয়ে দেখলো বারান্দায় নীল দাঁড়িয়ে থেকে বারবার চোখ মুছতেছে
আমি কি স্বপ্নে দেখতেছি নাকি সত্যি উনি কাঁদছেন,হিয়া কি মরছে নাকি
মুন এগিয়ে এসে বললো”কি হয়েছে হিয়ার?”
.
নীল মুনের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো”খুব কষ্ট দিয়েছি তোমায়,আর কখনও এমন হবে না মুন”
.
মুন মনে মনে ভাবলো তার জন্য কাঁদছিলো তাহলে
.
নীল মুনকে জড়িয়ে ধরেছে এ প্রথম সেটা মুনের মাথায় নেই,তার মাথায় ঢুকছে না নীল হঠাৎ বদলে গেলো কেন
.
নীল কাঁদতে কাঁদতে বললো”সেও অন্ধকারে অনেক ভয় পায়,তার শরীর খারাপ হয়ে যায় অন্ধকার দেখলে
তাহলে নিশ্চয় মুনের ও খারাপ লেগেছে,ভয় পেয়েছে সে
.
মুন নীলকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো”জড়িয়ে ধরলে এতক্ষণ যে আমি কষ্টে ছিলাম সেটা ঠিক হয়ে যাবে?
আর কত আমাকে কষ্ট দিবেন আপনি??আর কত?”
.
নীল নিচের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতেছে চুপচাপ
ছেলেদের জীবনেও কাঁদতে দেখেনি মুন,এ প্রথম দেখলো
আর নীল এরকম ইমোশনাল হয়ে গেছে কেন সেটাই ভেবে পাচ্ছে না মুন
নীলকে টেস্ট করতে সে বললো”আপনার তো খুশি হওয়া উচিত,আমাকে এরকম ফেলে রেখে ঘুরতে গেলেন এটা যদি হিয়া শুনে সে তো খুশিতে মরেই যাবে”
.
নীল চোখ মুছে মুনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ চলে গেলো রুমে,সেখানে এক কোণায় বসে বললো”মাফ করে দাও প্লিস,তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমার নিজের আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে এখন ”
.
শেষে সরি বলতে সবাই পারে,সরি টা যেন না বলতে হয় এমন প্রতিজ্ঞা কজনে করে?
.
(ওদের মিলটা শীঘ্রই হবে)
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here