#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:১২
সকালে চোখ খুলে ফারিহা প্রথমে আয়ানকে দেখতে পেলো।গতকালকের কথা মনে পড়ে ফারিহা ডুকরে ওঠলো। ফারিহার সারা শরীর ব্যথা করছে।আয়ান রাতে কামর খামচি দিয়ে ওর শরীরে অসংখ্য দাগ বসিয়ে দিয়েছে।আয়ান ফারিহাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।ফারিহার গায়ে একটা সুতোও নেই।আয়ানের ছোঁয়া ফারিহার কাছে বিষাক্ত লাগছে। ফারিহা মুখ ফিরিয়ে নিলো।তারপর আস্তে আস্তে আয়ানের হাত দিয়ে আয়ানকে সরিয়ে সাদা চাদরটা গায়ে পেঁচিয়ে বিছানা থেকে উঠলো।ওরনাটা সোফায় আর জামাটা ছিড়ে ফ্লোরে পড়ে আছে।
আয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে।ফারিহা একবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেলো।
ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে ফারিহা আস্তে আস্তে নিচে বসে পড়লো। ফারিহা একদৃষ্টিতে সামনে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ঝরনার পানির সাথে ফারিহার চোখে পানিগুলো মিশে একাকার হয়ে গেলো।
পানি গায়ে পড়াতে ফারিহার গায়ে খামচির জায়গাগুলো ঝলছে।কিন্তু ফারিহার কোনো ভাবান্তর নেই।ওর কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না।ফারিহা কখনো ভাবতে পারেনি ওর জীবনে এরকম একটা রাত আসবে!সব মেয়েরা এইরাত নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। তার স্বামী তাকে আদর করবে, ভালোবাসবে। কিন্তু ফারিহার স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে।
ফারিহা দুই হাঁটু ভাঁজ করে হাটুর উপর হাত রেখে মুখ গুঁজে বসে থাকলো।
আয়ান ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানা হাতরে কাউকে পায় না। আয়ান চট করে চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ফারিহা নেই।কিছু সময়ের জন্য আয়ানের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠলো।আয়ান বিছানা থেকে উঠে কোমরে টাওয়াল জড়িয়ে ওয়াশরুমে কাছে গেলো।তারপর ভেতর থেকে পানির আওয়াজ শুনে একটু শান্ত হলো।
তারমানে ফারিহা ওয়াশরুমে আছে।
আয়ান ঘুরে দাঁড়ালে নিচে ফ্লোরে পড়ে থাকা ফারিহার ছেঁড়া জামা টা দেখে।আয়ান ফ্লোর থেকে জামাটা উঠিয়ে সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসলো। ও কি কাজটা ঠিক করলো? মিস্টার আজাদ কে কষ্ট দেওয়ার জন্য ফারিয়ার সাথে এরকম জঘন্য কাজ করতে পারলো!
আসলে আয়ানের ফারিহার উপর অনেক রাগ উঠেছিলো।আয়ানের বারণ করা সত্তেও ফারিহা মিস্টার আজাদের সাথে কথা বলেছে।তাই আয়ান ঐদিন চুপ থাকলেও কালকে রাতে শান্ত থাকতে পারেনি।আর তাছাড়া ফারিহা ওর বাবাকে বলেছে ও নাকি ভালো আছে!তাহলে তো আয়ানের প্লেন সাকসেসফুল হবে না।আয়ান তো চাই মিস্টার আজাদ কে কষ্ট দিতে। তাই গতকাল রাতে ফারিহার সাথে অমানুষের মতো আচরণ করেছে।
আয়ানের এবার বিছানার দিকে চোখ গেলো।সাদা বিছানার চাদরটা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।আয়ান একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো।
প্রায় অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও ফারিহা ওয়াশরুমে থেকে বের হচ্ছে না দেখে আয়ান ওয়াশ রুমের দরজার কাছে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“ফারিহা,,এই এতোক্ষণ ওয়াশরুমে কি করছো? তোমার শাওয়ার শেষ না?বের হও..”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহা কেঁপে ওঠলো। এতোক্ষণ চুপচাপ ঝরনার নিচে বসে ছিলো।আয়ান আবার দরজা ধাক্কা দিলে ফারিহা ফ্লোর থেকে উঠে।
ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না দেখে আয়ান অস্থির হয়ে পড়লো।ফারিহা ভেতরে এতক্ষণ কি করছে? কিছু বলছে না কেনো?ও ঠিক আছে তো?আয়ান এবার একটু জোরে বললো,
” ফারিহা,,এই ফারিহা তুমি ঠিক আছো?কি হলো কিছু বলছো না কেনো?দেখো আমার কিন্তু এবার রাগ উঠছে”
কিছুক্ষণ পর ফারিহা ওয়াশ রুমে দরজা খুলে বের হয়।পরনে একটা নেবি ব্লু রঙ্গের লং কুর্তি আর কালো প্লাজো।চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে বেঁধে রাখা। কান্নার কারণে ফারিহার চোখ মুখ একদম লাল টকটকে হয়ে আছে।
আয়ান ফারিহাকে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ফারিহা কিছু বলছিলো না দেখে আয়ানের অনেক ভয় হচ্ছিলো।দ্য গ্রেট মাফিয়া কিং আয়ান খান, যার ভয়ে কিনা বড় বড় মন্ত্রী-মিনিস্টার কাঁপে সে এই সামান্য একটা কারণে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো!
আয়ান ফারিহা গালে হাত রেখে চমকে উঠলো।তারপর বললো,
“ফারিহা তোমার গা এতো ঠান্ডা কেনো?কতক্ষণ ধরে ওয়াশরুমে পানিতে ভিজেছো?
“আ্ আমি ঠিক আছি”
এটা বলে ফারিহা আয়ানকে সরিয়ে দিয়ে ব্যালকনির দিকে চলে গেলো।আয়ান একবার ফারিহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তারপর কিছু একটা ভেবে ওয়াশ রুমে চলে গেলো।
আয়ান শাওয়ার শেষে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে ফারিহা এখনো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আইয়ান ফারিহার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করে।তাই ব্যালকনিতে গিয়ে ফারিহার চুল থেকে টাওয়াল খুলে টাওয়াল দিয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে বললো,
“চুলগুলো মুছলে না কেনো? ঠান্ডা লেগে যাবে তো”
আয়ান হঠাৎ চুলে ধরায় ফারিহা কেঁপে ওঠলো। আয়ানের কেয়ার করা ওর কাছে অসহ্য লাগছে।তবুও ফারিহা কিছু বললো না।আয়ান ফারিহার চুলগুলো মুছে ওর হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো। হোটেলের একটা ছেলে এসে ওদের ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেলো।আয়ান ব্যালকনিতে যাওয়ার আগেই ব্রেকফাস্ট অর্ডার করেছিলো।
আয়ান ফারিয়াকে হাত ধরে সোফায় বসালো।তারপর কিছুক্ষন পর বললো,
“কি হলো?কথা বলছো না কেনো?ব্রেকফাস্ট টা কমপ্লিট করো”
এবার ফারিহা কথা বললো।ফারিহা বললো,
“আমি খাবো না”
আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“খাবে কি খাবে না সেটা শুনতে চাইনি।খেতে বলেছি খাও”
ফারিহা আবার না সূচক মাথা নাড়ালো।আয়ান পরোটা ছিড়ে ফারিহার মুখের সামনে ধরে বললো,
“আমি আর কিছু শুনতে চাই না,খাও”
আয়ানের রাগে দৃষ্টি দেখে ফারিহা চুপচাপ খেতে থাকলো।ব্রেকফাস্ট শেষে আয়ান ওর ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে ফারিহার হাতে দিলো।ফারিহা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকালে আয়ান বললো,
“তোমার শরীরে ব্যথা আছে না?পেনকিলার টা খাও। ব্যাথা কমে যাবে”
ফারিহার শরীরে সত্যি ব্যথা করছে। কালকে রাতে আয়ানের জোর করার কারণে তার উপর আবার এতো খামচি কামড়!ফারিহা চুপচাপ ওষুধ টা খেয়ে নিলো।আয়ান ফারিহাকে বললো,
“কিছুক্ষণ পর আমরা বের হবো। রেডি হয়ে নাও”
.
ফারিহা গাড়িতে বসে একদৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।আর আয়ান একমনে ড্রাইভ করছে। এখানে আসার আগেও ফারিহা কতো খুশি ছিলো!ফারিহা ভাবতেই পারেনি কক্সবাজার এসে ওর জীবনে এতো বড় একটা ঝড় বয়ে যাবে। কক্সবাজার আসার পর থেকেই আয়ান ফারিহার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করেছিলো।ওর দুষ্টমিগুলো প্রশ্রয় দিয়েছিলো।
হোটেল রুমে এসে মজা করা।পার্টি তে ডান্স করা। সমুদ্রের পানিতে নামা।স্থানীয় মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করা।ফারিহা আইনের সাথে একদম স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো। যদিও বিয়ের পর থেকে ফারিহা আয়ানের সাথে কখনো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেনি।সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতো।কিন্তু এখানে এসে ফারিহা আয়ানকে বন্ধু ভাবতে শুরু করে। বন্ধু?ফারিয়া তাচ্ছিল্য হাসলো..
একসময় ফারিহা সিটের সাথে মাথা হেলিয়ে দিলো। এমনিতেই ফারিহার গাড়িতে উঠলে ঘুম পায় তার উপর কালকে রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি।তাই এখন চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
____________
চোখ খুলে ফারিহা অবাক হয়ে গেলো।ও এখন আয়নাের রুমে শুয়ে আছে।ওরা ঢাকায় আসলো কখন?ফারিহা এতোক্ষন ঘুমিয়ে ছিলো।ফারিহা ভাবছে ওকে রুমে নিয়ে আসলো কে?ফারিহা আয়ানের কথা ভেবে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে 2 টা বাজে।তারপর এদিক ওদিক তাকালো তখন একটা সার্ভেন্ট রুমে আসলো। তারপর ফারিয়াকে বললো,
“ম্যাম আপনি উঠে পড়েছেন?আপনি কি এখন লাঞ্চ করবেন?”
“তোমাদের স্যার কোথায়?”
“স্যার তো আপনাকে রুমে দিয়ে অফিসে চলে গেলো”
ফারিহা ভাবছে এতোক্ষণ ড্রাইভ করে এখন আবার অফিসে গিয়েছে কাজ করার জন্য।লোকটার কি ক্লান্ত লাগে না? ফারিহা নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে গেলো!ও আয়ানের কথা কেনো ভাবছে! ফারিহা সার্ভেন্টটা কে বললো,
“আমি এখন খাবো না।পরে..”
“ওকে ম্যাম”
ফারিহা ওঠে ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য।ফারিহার বাপির কথা খুব মনে পড়ছে। দুই দিন বাপির সাথে কথা হয়নি।তাছাড়া নওশীন আর শিহাবকেও মনে পড়ছে। কক্সবাজার যাওয়ার পর ওদের সাথে একবার কথা হয়েছিলো।
ফারিহা ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
.
অফিসে এসে আয়ান অনেকগুলা ইম্পর্টেন্ট ফাইল চেক করে।তারপর অনেকগুলো ফাইলে আয়ানের সাইন বাকি ছিলো এগুলো কমপ্লিট করলো।সব কাজ শেষ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো।তারপর কি যেন ভেবে মিস্টার আজাদকে কল দিলো।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর মিস্টার আজাদ কল রিসিভ করে বললো,
“ফারিহা কোথায়?”
আয়ান ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো,
“প্রথমেই মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন?মেয়ে জামাই কেমন আছি জিজ্ঞেস করবেন না?”
“আগে বল ফারিহা কোথায়?ও কেমন আছে? তোমরা কি এখন ঢাকায়?”
” ওওও…তার মানে আমরা যে কক্সবাজার গিয়েছিলাম সে খবর জানেন দেখছি”
” হ্যাঁ জানি কিন্তু তুই ফারিহাকে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলি সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না।আমার মেয়ে কেমন আছে?”
আয়ান একটু ন্যাকা সুরে বললো,
“ইশশ..মেয়ের জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে? দূর থেকে এতো কষ্ট!কাছ থেকে মেয়ের কষ্ট দেখলে না জানি আপনি কি করতেন।ভাবতেই আমার মজা লাগছে”
“তোকে…”
মিস্টার আজাদকে থামিয়ে দিয়ে আয়ান বললো,
“শ্বশুরমশাই আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে”
মিস্টার আজাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কি সারপ্রাইজ? ”
“আপনাকে একটা অডিও পাঠাচ্ছি।সেটা শুনুন”
তারপর পৈশাচিক হাসি দিয়ে আয়ান কল কেটে দিলো।অডিওটা শোনে মিস্টার আজাদের একি অবস্থা হবে সেটা ভাবতেই আয়ানের মজা লাগছে..
চলবে…