স্রোতের টানে পর্ব-১৩

0
4020

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:১৩

পরদিন ফারিহা ভার্সিটিতে এসে ক্লাসে গিয়ে দেখলো নওশীন শিহাব বসে আছে।ফারিহা গিয়ে ওদের সাথে বসলে নওশীন উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো,
“ফারিহা ঢাকায় কবে আসলি?কেমন আছিস?”

“ভালো আছি,,তোরা কেমন আছিস?”

“হ্যাঁ আমরা ভালোই আছি।তোর কথা বল কক্সবাজার কেমন ঘুরলি হুমম?”

নওশিনের কথা শুনে ফারিহা একটু চুপ হয়ে গেলো।কারণ কক্সবাজার গিয়ে তো ওর সব শেষ।ফারিহার সাথে এতো কিছু হয়েছে কিন্তু ফারিহা নওশীনকে বুঝতে না দিয়ে হাসি মুখে বললো,

“হ্যাঁ খুব ভালো ঘুরেছি। অনেক মজা হয়েছে”

শিহাব সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,
“তোর চোখ,মুখ এরকম লাগছে কেনো?সব ঠিক আছে তো?”

শিহাবের কথা শুনে ফারিহা থতমত খেয়ে গেলো। তারপর কোনরকমে জোরপূর্বক হেসে বললো,
“কই কিরকম লাগছে?আমি ঠিক আছি! এখন বল তোরা এই দুদিন আমাকে মিস করিস নি?”

নওশিন ফারিহা কে জড়িয়ে ধরে বললো,
“অনেক মিস করেছি।ফারিহা আয়ান ভাইয়ার সাথে তুই ভালো আছিস তো??”

“হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো আছি!খারাপ থাকবো কেনো!”

শিহাব বললো, “কিন্তু আয়ান ভাইয়া তো আঙ্কেলের থেকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তোকে বিয়ে করলো। তোর সাথে এত ভালো ব্যবহার করে?ঘুরতে নিয়ে যায়?আমার কেমন যেনো সন্দেহ হচ্ছে!”

“হুম ঘুড়তে নিয়ে যায়।তোরা এতো প্রশ্ন করছিস কেনো?আমাকে দুই দিনের নোটগুলো দে”

ফারিহা কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলতে থাকলো।শিহাব কিছু একটা সন্দেহ করে কিন্তু ফারিহা খুব দক্ষতার সাথে ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছে।
ফারিহা আজকে একটা ফুলহাতা লাল রঙের ড্রেস পরেছে,সাথে কালো হিজাব।এর জন্য ওর হাতের আর গলার দাগ গুলো বুঝা যাচ্ছে না।যদিও ঠোঁট আশপাশ অনেক ফুলে ছিলো।ফারিহা মেকআপ দিয়ে সেগুলো ঢেকে দিয়েছে।

.
ক্লাস শেষে ফারিহা,শিহাব,নওশীন রেস্টুরেন্টে গেলো। ফারিহা রেস্টুরেন্টে এসে কিচেনের দিকটা সব ঠিক আছে নাকি দেখছিলো তখন শিহাব এসে বললো,
“ফারিহা তুই আবার কাজ করছিস?এমনিতে গতকালকে জার্নি করে এসেছিস।তারপর আজকে ভার্সিটিতে আসলি।এখন কি কাজ না করলে হয়না?”

ফারিহা হেসে বললো, “আরে কাজ করছি না তো। সব ঠিক আছে কিনা দেখছি। তোর এতো আমার খেয়াল রাখতে হবে না, নওশীনের খেয়াল রাখ”

শিহাব ভ্রু কুঁচকে বললো, “আমি কেনো ওর খেয়াল রাখতে যাবো?”

ফারিহা দুষ্টু হেসে বললো, “বুঝি বুঝি..সববব বুঝি”

শিহাব কিছু বলতে যাবে তখন নওশীন এসে বললো,
“ফারু আঙ্কেল এসেছে ”

মিস্টার আজাদ এসেছে শুনে ফারিহা একটু ভয় পেয়ে গেলো। কেননা রেস্টুরেন্টের বাইরে আয়ানের বডিগার্ডরা আছে।আয়ানের কাছে নিশ্চয়ই খবর যাবে যে ফারিহা মিস্টার আজাদের সাথে কথা বলেছে।এসব ভেবে ফারিহা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। শিহাব ফারিহার চোখমুখ দেখে বললো,
“ফারিহা তোর বাবা এসেছে।যা, দেখা করবি না?”

ফারিহা শিহাবের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। ফারিহা ও চায় ওর বাবার সাথে দেখা করতে,কথা বলতে। কিন্তু তার জন্য আয়ান ওর সাথে কি করতে পারে সেটা ফারিহার অজানা নয়!
ফারিহা আস্তে আস্তে হেঁটে কিচেন প্লেস থেকে বের হয়।
ফারিহাকে আসতে দেখে মিস্টার আজাদ একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে ফারিহাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর অস্থির কন্ঠে বললো,
“মামনি তুই ঠিক আছিস?আমি তোকে আর ওই আয়ানের কাছে যেতে দেবো না।তার জন্য আমার যা করতে হয় করবো।আমি তোকে আর কষ্ট পেতে দিবো না। আই এম সরি মামুনি আমি তোকে রক্ষা করতে পারিনি।আই এম সরি..”

মিস্টার আজাদের কথা শুনে ফারিহা অবাক হয়ে গেলো।ও বুঝতে পারছে না বাপী কি বলতে চাইছে। ফারিহা জোরপূর্বক হেসে বলে,
“বাপি কি বলছো এসব?কিসের কষ্ট!আমি তো ঠিক আছি!”

মিস্টার আজাদ ফারিহাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফারিয়ার গালে হাত রেখে বললো,
“আমার কাছে আর কিছু লুকাস না ফারিহা।আমি সব জানি”

“ক্ কি জানো?”

“আয়ান তোকে কক্সবাজার নিয়ে গিয়ে অনেক অত্যাচার করেছে,তাই না?আয়ানকে তো আমি ছাড়বো না।এতদিন শুধু চুপ ছিলাম তোর কথা শুনে। কিন্তু আমি জানতাম না তুই আমাকে মিথ্যে বলছিস!”

“বাপি আমি কোন মিথ্যা বলিনি!কি বলছো তুমি এসব? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না”

মিস্টার আজাদ পকেট থেকে ফোন বের করে একটা অডিও চালু করলো। ওখানে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ফারিহা চিৎকার করে আয়ান কে ছাড়তে বলছে।আয়ান ফারিহার সাথে জোড়াজুড়ি করছে আর ফারিহা চিৎকার করে বলছে,
আমার কষ্ট হচ্ছে,,ছাড়ুন।প্লিজজজ এরকম করবেন না।বাপ্পিইইই..

অডিওটা শুনে ফারিহা থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো। এখানে শিহাব আর নওশীন ও ছিলো।ওরা দুজনই স্তব্ধ হয়ে ফারিহার দিকে তাকালো।ফারিহার উপর দিয়ে এত বড় একটা ঝড় বয়ে গেলো তারপরও মেয়েটা এতো শান্ত আছে কিভাবে!
ফারিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে মিস্টার আজাদ বললো,

“তুই এতদিন বলেছিলি তুই আয়ানের সাথে ভালো আছিস তাই আমি কিছু বলিনি।কিন্তু এইটার পর আমি আর তোকে আয়ানের কাছে যেতে দিবো না। তুই আমার কাছেই থাকবি,দেখি আয়ান কি করতে পারে”

কিছুক্ষণ পর মিস্টার আজাদ আবার বললো, “আমাকে ক্ষমা দিস মা,আমি তোকে রক্ষা করতে পারিনি।তোর সাথে আয়ান এরকম করলো কিন্তু আমি তোকে রক্ষা করতে পারি নি”

ফারিহা চুপচাপ সব শুনছে।ফারিহা শুধু ভাবছে আয়ান কি করে এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে পারলো।কিছুক্ষণ পর ফারিহা শান্ত কন্ঠে মিস্টার আজাদকে বললো,
“এটা তুমি কোথায় পেলে?তোমাকে কে দিলো এটা?”

“আয়ান দিয়েছেন!আর আমাকে বলেছে,ও তোকে আরো আর অত্যাচার করবে আমি নাকি কিচ্ছু করতে পারবোনা।কিন্তু এবার আমি দেখিয়ে দেবো যে আমি আমার মেয়ের জন্য কি করতে পারি”

ফারিহা থম মেরে পাশে থাকা চেয়ারে বসলো।আয়ান ফারিহার কষ্টগুলো মিস্টার আজাদকে শোনানোর জন্য এসব রেকর্ড করেছে? মেয়েকে জোর করছে আর সেই অডিও বাবাকে দিচ্ছে?ছি…!!
ফারিহা জানতো আয়ান খারাপ কিন্তু এতটা খারাপ কখনো কল্পনা করতে পারেনি।মিস্টার আজাদ ফারিহার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“ফারিহা বাড়ি চল”

“না বাপি! আমি যাবো না”

মিস্টার আজাদ অবাক হয়ে বললো,
“ফারিহা তুই এখনো ওই আয়ানের কাছে যাবি?দেখ তোর জীবনে এই কিছুদিন যা হয়েছে সব ভুলে যা। তোকে আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে”

“চাইলে শুরু করা যায় না বাপি। আর আমি যদি এখন বাড়ি যাই আয়ান তোমাকে ছাড়বে না”

“তো কি হয়েছে? আমি ওর সাথে লড়তে রাজি।কিন্তু আমি আর তোকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবোনা মা”

ফারিহা মিস্টার আজাদের হাত ধরে বললো,
“বাপি প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো আমি যেতে পারবো না”

ফারিহা জানে ফারিহা যদি এখন মিস্টার আজাদের সাথে বাড়ি যায় তাহলে আয়ান ওর বাবার অনেক বড় ক্ষতি করবে।আয়ানের ক্ষমতা সম্পর্কে এই কিছু দিনে ফারিহার ধারণা হয়ে গিয়েছে।ফারিহা চায়না ওর বাপির কোনো ক্ষতি হোক।দরকার হলে ও সব কষ্ট সহ্য করবে কিন্তু ওর বাপী যেন কষ্ট না পায়।
ফারিহা চুপ করে বসে আছে দেখে শিহাব ফারিহাকে ওর দিকে ঘুরিয়ে বললো,

“ফারিহা তুই আমাদের এসব কিছু বললি না কেনো? তুই এতো ভালো অভিনয় করতে কবে থেকে শিখলি?”

নওশীন এসে ফারিহার গালে হাত রেখে বললো,
“তুই এতো কষ্টে আছিস কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে দিস নি কেনো?কেন সব লুকাচ্ছিস?কি করে এসব সহ্য করছিস তুই?ওই লোকটা তোর সাথে…”

নওশীন চুপ করে গেলো।ওর গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না।ফারিহার আচরণ থেকে ওরা একটুও বুঝতে পারেনি যে ফারিহা এতো কষ্টে আছে।শিহাবের ফারিহা হাত ধরে বললো,
“ফারিহা আঙ্কলের কথা শুন।বাড়ি ফিরে যা,, পরে যা হবে দেখা যাবে”

ফারিহা ওর বাপির দুহাত ধরে বললো,
“বাপি আমি জানি তুমি আমার উপর রাগ করে আছো কেনো তোমাকে এতোদিন কিছু বলিনি।তুমি উনার উপরেও রাগ করে আছো!কিন্তু আমাকে উনার সাথেই থাকতে হবে।প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো,,আমার কোন উপায় নেই”

মিস্টার আজাদ তাচ্ছিল্য হেসে বললো,”আমি জানি তুই কেনো আমার সাথে যেতে চাচ্ছিস না।আয়ান নিশ্চয় তোকে হুমকি দিয়েছে যে,আমার সাথে গেলে আমার ক্ষতি করে দেবে।তাই না??”

ফারিহা চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মিস্টার আজাদ হেসে ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আমাকে এতো ভালবাসিস?কিন্তু আমিও যে তোকে ভালোবাসি। তোর কষ্ট গুলো আমি দেখতে পারবো না।ফিরে চল..”

ফারিহা মিস্টার আজাদকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমি পারবো না বাপি। আমি তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেখতে পারবোনা,আমার যাই হয়ে যাক না কেনো! আই লাভ ইউ বাপি, আই লাভ ইউ সো মাচ”

এটা বলে ফারিহা মিস্টার আজাদ কে ছেড়ে ওর ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায়। মিস্টার আজাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মিস্টার আজাদ পেছন থেকে ফারিহাকে ডাকলেও ফারিহা শুনলোনা।
মিস্টার আজাদ ধপ করে চেয়ারে বসলো।নওশীন তাড়াতাড়ি করে এক গ্লাস পানি এনে মিস্টার আজাদ কে দিয়ে বললো,
“আঙ্কেল শান্ত হোন।একটু পানি খান ”

মিস্টার আজাদ নওশীনের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খেলো।নওশিন আবার বললো,
“আঙ্কেল ফারিহাকে ভুল বুঝবেন না।ওর দিক থেকে ও সঠিক।আমার মনে হয় আয়ান খান ওকে কোনো হুমকি দিয়েছে তাই ও আপনার সাথে যেতে চাচ্ছেনা। ধৈর্য ধরুন সব ঠিক হয়ে যাবে”

মিস্টার আজাদ কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নাড়ালো।আজকে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।ওনার মেয়েকে কেউ দিনের পর দিন অত্যাচার করছে কিন্তু ওনি কিচ্ছু করতে পারছে না।নিজের মেয়ের আর্তনাদ যদি বাবা শুনে তখন সেই বাবার মনের অবস্থাটা কি হতে পারে!

.
বাড়িতে এসে ফারিহা দৌড়ে রুমে চলে আসলো। তারপর বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করে দিলো।আয়ান কি করলে পারলো ওই অডিওটা মিস্টার আজাদকে দিতে।ওর বাপী কত কষ্ট পেয়েছে। লজ্জায় ঘৃণায় কষ্টে ফারিহা হাউমাউ করে কান্না করছে।

সবসময়ের মতো এবারও আয়ানের বডিগার্ডরা আয়ান কে ফোন করে বলে যে মিস্টার আজাদ ফারিহার সাথে দেখা করতে রেস্টুরেন্ট এসেছিলো। আয়ান এবার কিছু বলে না,উল্টো বাঁকা হাসে!
কারণ আয়ান জানে আজকে কেনো মিস্টার আজাদ ফারিহার সাথে দেখা করতে গিয়েছে।আয়ানের বডিগার্ডরা বলেছে মিস্টার আজাদকে নাকি খুব অস্থির দেখাচ্ছিলো।আয়ানের শুনেই এতো মজা লাগছে,দেখলে তো আরো ভালো লাগতো! কিন্তু ফারিহার কি অবস্থা?

আয়ান কি যেনো ভেবে ল্যাপটপ অন করলো।আয়ানের পুরো বাসায় সিসি ক্যামেরা আছে।আর তার ফুটেজ ওর ল্যাপটপের সাথে কানেক্ট করা। আয়ান ওদের রুমের ফুটেজ চালু করে ভ্রু কুঁচকে ল্যাপটপের স্ক্রিনে দিকে তাকালো।ফারিহা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কান্না করছে।ফারিহার কান্না দেখে আয়ানের অস্থির অস্থির লাগছে।কিন্তু আয়ান এই ভেবে নিজেকে বুঝায় যে, ফারিহা ও শত্রুর মেয়ে।আর শত্রু কান্না দেখলে অস্থির না খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আয়ান খুশি হতে পারছে না!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here