#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১২/১৩ তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
আয়ানের অপারেশনটা অনেক ভালো ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মার্জিয়া তো দিনরাত নামাজের পার্টিতে বসে ছেলের সুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছে। আজীম আর মার্জিয়া আয়ানের অপারেশনের দিন দুজনেই রোযা রেখেছে।
রোযা রাখার জন্য নাবিলাই বলেছে বারবার করে। নাবিলা বলেছে সবসময় আমাদের আপন মানুষদের বিপদ-আপদ, অসুস্থতা বা হাসি-কান্না যে অবস্থায় থাকিনা কেন তাদের জন্য নিয়ত করে নফল রোযা রাখা, নফল নামায পড়া এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করাটাই হচ্ছে আমাদের কর্তব্য। এমনকি সন্তানদের জন্মদিনের দিনও কোন হৈ হুল্লোড় বা লোক দেখানোর জন্য উৎসব অনুষ্ঠান না করা উচিত। এটা সম্পূর্ণ বিদআত। মা বাবার করণীয় হলো, সন্তানের ভালো থাকা কামনা করে তার উদ্দেশ্য করে ওই দিন রোযা রাখা। সামর্থ্য থাকলে, পারলে কিছু এতিম বা গরিব বাচ্চাকে খাওয়ানো।
একসপ্তাহ পরে আয়ানকে ডিসচার্জ করা হলো। তবে প্রতি সপ্তাহে এসে ডাক্তার দেখাতে হবে। মারজুকের কথা হলো ওর বাসা যাতে হসপিটালের পাশে তাই মার্জিয়া আয়ানকে নিয়ে ওখানে থাকলে ভালো হবে।
কিন্তু মুনতাসির আহমেদ উনার নাতিকে উনার বাসায় নিয়ে যেতে চান। উনার বাসা দূরে হলেও উনার নিজস্ব গাড়ী আছে সুবিধা অসুবিধায় আসা যাওয়ার কোন সমস্যা হবেনা।
-মারজুক বললো, মার্জিয়া তুই আব্বুকে বলে দে গাড়ী থাকলেও ডাক্তার বলেছে এখন আয়ানের জন্য গাড়ীতে জার্নি করা কোনভাবেই ঠিক হবে না।
-মুনতাসির সাহেব বললো,, তোর ভাইকে বলে দে গাড়ী জার্নি না করতে পারলে আমি ডাক্তারকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো। এতে টাকা বেশি গেলেও যাবে। আমার কি টাকার অভাব আছে? তারপরও অন্য কারো বাসায় আমার নাতিকে আমি রাখবোনা।
-আমার কি টাকার অভাব আছে? কথাটা মারজুকের গায়ে খুব লাগলো। এটা ইঙ্গিতে মারজুককে অপমান করার জন্য বলা হয়েছে। বাবারা এমন করে কথা বলতে পারে ভাবতেই অবাক লাগে!
শুধু এ সমস্ত কিছু কথা শুনতে হবে বলে নাবিলার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মারজুক সেদিনের পর ওকে হসপিটাল আনেনি। মারজুকের মুখে কিছু কথা আসছিলো বাবাকে বলার জন্য। কিন্তু পরক্ষনে নিজেকে দমিয়ে নিলো।
কেননা, বাবা মায়ের সাথে ইসলাম কর্কশ স্বরে কথা না বলতে বারবার করে সতর্ক করে দিয়েছে।
-মারজুক বললো,, টাকার অভাবের কথা এখানে কেন আসছে? এটা আয়ানের সুস্থতার কথা!
এ পর্যায়ে মার্জিয়া বলে উঠলো, তোমাদের দুজনের কারো বাসায় আমি আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে চায়না। আমার নিজের বাসায় ভালো। তোমাদের এসব রেষারেষি আমার সত্যি ভালো লাগছেনা আব্বু।
সন্তান ভুল করতেই পারে তাই বলে তার সাথে এভাবে ব্যবহার করবে তোমরা?
-মারজুক মেঝের দিকে তাকিয়ে কিছুটা দম নিলো। তারপর মার্জিয়ার দিকে তাকিয়ে নরমস্বরে বললো,, থাক মার্জিয়া আমার কথা তোকে শুনতে হবেনা।
তুই আব্বু আম্মুর সাথেই যা।
অনেক বাকবিতন্ডার পরে সিদ্ধান্ত হলো মার্জিয়া আয়ানকে নিয়ে মাসখানেক মারজুকের এখানে থেকে ডাক্তার দেখিয়ে পরে বাবার বাসায় যাবে।
আজ নাবিলার বাবা মা এসেছিলো আয়ানকে দেখতে। তাই সারাদিনের রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ততার পরে সবকিছু গুছিয়ে রুমে আসতে নাবিলার প্রায় রাত বারোটা বেজে গিয়েছিলো। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো মারজুক শুয়ে পড়েছে। নাবিলা গিয়ে ওর শরীরে কাঁথা দিয়ে দিলো। তারপর অযু করে এসে তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য জায়নামাযে দাঁড়াতেই পিছন থেকে মারজুক বলে উঠলো, দাঁড়াও এখন না! আমিও অযু করে আসি। দুজনে একসাথে নামায আদায় করবো।
নামায শেষে নাবিলা বিছানা গুছাতে নিলেই পিছন থেকে মারজুক ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,, আচ্ছা তুমি কি একেবারে স্বল্পভাষী?
-কেন এমন মনে হলো?
-এ কয়দিনে আমি তোমাকে একবারো প্রয়োজনের বাহিরে কথা বলতে দেখিনি। আর হাসতে তো ভুল করেও দেখিনি! এমন গোমড়ামুখো কেন তুমি?
-কে বলেছে আমি কথা বলি না। এইতো এখন বলিনা!
-হুম বলো তো না পারতে আরকি!
-এটুকুই কি যথেষ্ট নয়?
-না। আমি চাই আমার প্রেয়সী আমার সামনে সবসময় গড়গড় করে কথা বলতেই থাকবে। আর তার মুখে যেনো হাসিটা সবসময় লেগে থাকে।
-হুম হাসি! হাসি না আসলে জোর তো করতে পারিনা।
-এমনভাবে বলছো কেন?
-কিভাবে বলবো? যার সর্বস্ব শেষ হয়ে গেছে তার মুখে হাসি আসবে কি করে বলুন তো? জানেন তো, আমি প্রতিমুহূর্তে চাই ভালো থাকতে কিন্তু যখনি ওই বিভৎস ঘটনাটা চোখের উপর ভেসে উঠে তখনি আমার স্বাভাবিক জীবনটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠে। আমি নিজের মধ্যে স্থীর থাকতে পারিনা। নেহাৎ মনের মধ্যে ঈমানের ভয় রয়েছে নয়তো অনেক আগেই হয়তো..
-মারজুক নাবিলার মুখ চেপে ধরলো, যা বলেছো ওই পর্যন্ত ঠিক আছে। যা হয়েছে তা যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবে ততই তোমার জন্য উত্তম।
-চেষ্টা তো করছি না পারলে কি করবো?
-মারজুক খাটে শুয়ে নাবিলার দিকে ফিরে বললো,, আল্লাহ সব ঠিক করে দিবে।
কিছুক্ষন পর মারজুক নাবিলার চুলের ভিতর আঙুল চালাতে চালাতে বললো,, এই শুনোনা?
-শুনছি!
-ভালোবাসি!
-কি শুরু করেছেন?
-কই কি শুরু করেছি শুধু ভালোবাসি বলেছি!
-তাতো জানি! এখন আপনার ভালোবাসি বলার সময়? সরুন ঘুমাবো!
-ঘুমাবে তা তো আমিও জানি! কিন্তু গত কয়দিন ধরে আমি বলে যাচ্ছি ভালোবাসি কই একবারো তো তুমি প্রতিত্তুরে ভালোবাসি বলোনি! তুমি জানো তোমার মুখে এই কথাটি শুনার আমার অনেক ইচ্ছা।
-নাবিলা বললো,, কেন ভালোবাসি না বললে বুঝি ভালোবাসা থাকেনা!
-তা না! তবে শুনলে একটু নিজের কাছে অন্যরকম ভালো লাগে! আর তাছাড়া…
-সত্যি বলতে আমি আপনাকে এখনো ভালোবাসতে পারিনি।
-মারজুক নাবিলাকে ছেড়ে সরে যেতে নিলে নাবিলা হাত ধরে টেনে বললো,, রাগ করে সরে যাচ্ছেন?
-মারজুক মন খারাপ করে বললো,, তোমার উপর রাগ করার অধিকার তো এখনো পাইনি! তাই রাগ করার প্রশ্নই আসেনা!
-আমি জানি আপনি রাগ করেছেন। কিন্তু কি জানেন তো? আপনি হয়তো আমাকে আগে থেকে দেখেই ভালোবাসতেন। তবে বিয়ের আগ পর্যন্ত আপনি কখনো আমার ভাবনায় ছিলেন না। বিয়ের পর থেকে আপনার সাথে আমার একটু একটু চেনা জানা হয়েছে। হুম এখন হয়তো ভালোবাসাটা নেই কিন্তু আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে যাবে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা উপর থেকে জোড়া লাগানো থাকে। তাই আল্লাহ নিজেই তাদের মাঝে ভালোবাসার সৃষ্টি করে দেন। একাসাথে থাকতে থাকতে তারা একে অপরের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হয়ে যায়। আর আমি তো আপনার কাছ থেকে দূরে সরে থাকি না। সবসময় কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করি যাতে আমাদের মনের দুরত্বটা খুব সহজে কমে আসে৷
-মারজুক চুপ করে আছে।
-নাবিলা বললো,, দেখেন আপনি যদি আজ আমার রাগ করে বা অসন্তুষ্ট হয়ে রাত কাটাম তবে সারারাত ফেরেশতারা অভিসাপ দিতে থাকবে।
এছাড়া রাসূল (সাঃ) বলেছেন,,
যখনি কোন স্ত্রীলোকের দ্বারা দুনিয়াতে তার স্বামী কষ্ট পায়, তখনই জান্নাতের ঐ স্বামীর জন্য নির্ধারিত হুর বলে, হে নারী! তুমি তাকে কষ্ট দিওনা। আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন। তিনিতো তোমার কাছে বিদেশী মেহমানের মন। অচিরেই তিনি তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবেন।
হাদীসে আরো আছে, যে মহিলা এমন অবস্থায় মৃত্যুবরন করবে যে তার স্বামী তার উপর অসন্তুষ্ট, সে নারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।
হাদীসে আরো আছে, তিন ব্যক্তির নামাজ কবূল হয়না এবং তাদের নেকী আসমানের দিকে উত্তোলিত হয়না। তারা হলো-
১.পলাতক গোলাম, যে পর্যন্ত না সে তার মনিবের কাছে ফিরে তার হাতে ধরা দেয়।
২. সেই নারী যার উপর তার স্বামী নারায, যে পর্যন্ত সে তার স্বামীকে রাগ ভাঙিয়ে নেয়।
৩.মাতাল যতক্ষণ না হুশে আসে।
তাই
প্লিজ আপনি রাগ করে থেকে আমাকে এতগুলো আযাবের ভাগিদার করবেন না। আমার সত্যি এরকম মুখের উপর কথা বলাটা উচিত হয়নি বলে নাবিলা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে কন্ঠ কেমন ভরাট হয়ে গেছে।
-মারজুক নাবিলার এরকম আচরণে হকচকিয়ে যায়। আরে আরে কি করছো! নাবিলা! বোকামি করছো কেন?
নাবিলাকে নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে নিয়ে বললো, আরে আমি সত্যি রাগ করিনি। এমনি একটু মন খারাপ হয়েছে। তাই বলে তার জন্য আল্লাহ তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবে এমন রাগ আমি কখনোই করবোনা।
নাবিলা! প্লিজ স্বাভাবিক হও! আমি বলছি তো আমি রাগ করিনি। আর এরকম ছোটখাটো একটা ব্যাপারে আমি রাগ করবো কেনো?
আর আমার ব্যাপারে তুমি এখনো পুরোপুরি জামতে পারোনি থাকতে থাকতে বুঝে যাবে আমি কোন ব্যাপারে হুট করে রেগে যায়না। রাগটা আমার স্বভাবে নেই।
তুমি যা বলেছো তাতো সত্যি বলেছো এটা তো দোষের কিছু বলোনি..
এমন সময় দরজার বাহিরে থেকে মার্জিয়া চেঁচিয়ে উঠলো, ভাইয়া তোদের বিয়ে হয়েছে কতদিন রে?
মারজুক আর নাবিলা একে অপরের মুখের দিকে তাকালো।
পরক্ষনে মারজুক সমস্বরে চেঁচিয়ে বললো,, এতোরাতে তুই হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন জানতে চাইছিস? আর সময় পাইলি না?
-না আগে বল না কতদিন হয়েছে! পরে বলছি।
-২০দিন। কিন্তু কেন?
-মাত্র বিশ দিন হলো তোদের বিয়ের আর তোরা এখনি রাগারাগি শুরু করেছিস? লোকে কি বলবে বলতো?
-তোকে কে বললো আমরা রাগারাগি করছি? তার মানে এতক্ষণ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলি?
-দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আপনাদের কথা শুনতে আমার বয়ে গেছে! আপনারা এতো জোরে কথা বলছেন যে আমি রুমে টিকতে পারছিলাম না। আমি কেন পাশের ফ্লাটের মানুষও হয়তো আপনাদের কথা শুনতেছে। আয়ান তো বললো,, আম্মু মামা আর মামিমা মনে হয় ঝগড়া করছে। এবার বুঝো?
-মারজুক আর নাবিলা দুজনে মুখে হাত দিয়ে হেসে উঠলো।
মার্জিয়া বললো, কথা একটু আস্তে বল! তোদের ঝগড়া আমাদের কেন শুনাচ্ছিস?
-তুই যাবি এখান থেকে? নাকি আমি বের হবো?
-না আপনার আর কষ্ট করে দরজা খুলতে হবেনা আমিই যাচ্ছি বলে শব্দ করে হাসতে হাসতে মার্জিয়া রুমে চলে গেলো…..
নাবিলা বললো,, ছি!! কি লজ্জা! আপু সব শুনে ফেললো। আপনি এতো জোরে কেন কথা বলতে গেলেন?
-মারজুক দাঁত খিচিয়ে বললো,, আমি কি ইচ্ছে করে বলেছি?
নাবিলা বললো,, দূর! আপনার সাথে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে…….
চলবে………
#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১৩তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
মার্জিয়া আয়ানকে নাবিলার কাছে রেখে আয়ানের কিছু জরুরী জিনিস আনতে মার্কেটে গিয়েছে। নাবিলা আয়ানকে কোনভাবে সামলাতে পারছেনা। আয়ান খুব দুষ্টামি করে। ডাক্তারদের কড়া নিষেধ এসময় আয়ানের নড়াচড়া একটু কম করতে হবে। না হলে ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু বাচ্ছা মানুষ ওদের কি আর এসবের খেয়াল আছে? এ জন্য ওর উপর কড়া নজর রাখতে হয় সবাইকে। আয়ানকে একা রেখে নাবিলা রান্না করতেও যেতে পারছেনা। আজ বাসায় মারজুকের হসপিটালের কয়েকজন ডাক্তার আসবে । উনারা নিজে থেকে আসতে চেয়েছেন তাই মারজুকও না করতে পারেনি।
নাবিলার নিজের শরীরটাও আজ বেশি ভালো লাগছেনা। সকাল থেকে কেন জানি শরীরটা কিছুক্ষণ পর পর গুলিয়ে আসছে। যতবার বমি হবে মনে করে ওয়াশরুমে গিয়েছে একবারো হয়নি। গলা পর্যন্ত চেপে আছে। না এদিক না সেদিক। খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। গ্যাসের সমস্যা হলো কি না কে জানে?
নাবিলা মারজুকের ফোনে কল দিয়ে ওর অবস্থার কথা বলতে, মারজুক বললো ওর ড্রয়ারে সেকলো এবং বমির ইমিসটেট ঔষধ আছে ।
একটা বমির ঔষধ আর একসাথে দুইটা গ্যাসটিকের ঔষধ খেয়ে নিতে। নাবিলা ওর কথামতো ঔষধ খেয়ে নিলো। ধীরে ধীরে বমির ভাবটা কেটে গিয়ে শরীরে একটু ভালো লাগতে শুরু করলো। আয়ান গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো।
নাবিলা উঠে গিয়ে রান্না বসালো। মার্জিয়া থাকতে সব রেডি করে রেখেছিলো। এখন শুধু চুলায় দিবে আর রান্না হবে। এর মধ্যে মার্জিয়াও এসে গেছে। মার্জিয়া সব ঘরদোর গুছিয়ে এসে নাবিলার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে রান্নার কাজটা করতে লাগলো।
রান্নার শেষ পর্যায়ে মার্জিয়া নাবিলাকে ডেকে বললো, ভাবি আর যা আছে আমি গুছিয়ে নিবো। তুমি গিয়ে গোসল করে রেডি হয়ে নাও।
নাবিলা কিচেন ছেড়ে বেরুতেই দরজার পাশের কলিংবেলটা বেজে উঠলো। নাবিলা ভালো করে ওড়নাটা গায়ে দিয়ে দরজার পাশে গিয়ে ভিতর থেকে দেখার চেষ্টা করলো বাহিরে কে এসেছে। মারজুককে দেখে হাসিমুখে দরজা খুলে সালাম দেওয়ার সাথে সাথে মারজুক মুচকি হেসে সালামের জবাব নিয়ে আস্তে করে নাবিলার নাক টেনে দিলো।
আপনি সবসময় আমার নাক টানেন কেন?
-তোমার খাড়া নাকটা দেখতে অনেক কিউট লাগে তাই! রাগ করো নাকি এমন করলে?
-না রাগ করবো কেন? এমনি বলেছি। কি ব্যাপার আপনি এতো তাড়াতাড়ি? মেহমানরা আসেনি?
-জী আমি আপনাকে সাহায্য করতে একটু তাড়াতাড়ি চলে এলাম। বাকীরা পরে আসবে বলে নাবিলাকে জড়িয়ে ধরতে নিলে নাবিলা সটকে সরে গেলো।
-কি করছেন? আপু আছে তো বাসায়!
-আপু আছে তো কি হয়েছে? আমি তো আমার বউকে বলে আগাতে নিলে নাবিলা বললো,, আপনার হয়তো লজ্জা নাই। কিন্তু আমার তো আছে বলে দৌড়ের গতিতে রুমের দিকে চলো গেলো।
মারজুক আয়ানকে দেখে কিচেনে গিয়ে মার্জিয়াকে বললো,, কিরে আর কতদূর?
-এইতো শেষ হয়ে এলো।
-আচ্ছা তোকে একটা কথা বলতাম?
-হুম বল।
-আসলে বিয়ের পরে তো নাবিলার একবারো ওর বাবার বাসায় যাওয়া হয়নি। এখন ওর বাবা আজ আমায় ফোন দিয়ে বললো, নাবিলাকে দুদিনের জন্য বেড়াতে যেতে দিতাম।
-তো যাবে সমস্যা কি? ঠিকইতো এভাবে অচেনা একটা জায়গায় একনাগাড়ে এতদিন থাকা যায় নাকি। আয়ানের অসুস্থ হওয়ার জন্যইতো সব গড়বড় হয়ে গেছে।
-তোকে বাসায় একা রেখে..
-আমার কোন সমস্যা হবেনা। তুই ভাবিকে যেতে দে। দুদিন গিয়ে বেড়িয়ে আসুক। মনটাও ভালো লাগবে।
আর আমি যখন আছি তোর খাবারের ও তেমন সমস্যা হবেনা।
রাতে ঘুমানোর আগে নাবিলা মারজুককে বললো,, আজ নাকি চন্দ্র গ্রহন?
-হুম। রাত ১১টা ১০ মিনিট থেকে শুরু হবে।
-একটা প্রশ্ন জানার ছিলো?
-কি প্রশ্ন?
-অনেকেই বলে সূর্য গ্রহন বা চন্দ্র গ্রহণের সময়ে নাকি খাবার খাওয়া যায় না? আবার নাকি গর্ভস্থ বাচ্চার ও এতে ক্ষতি হয়? অনেককেই বলতে শুনেছি যদিও আমি এটা বিশ্বাস করিনা। তবুও জানার ইচ্ছা থেকেই প্রশ্নটা করলাম।
-নাবিলা চন্দ্র গ্রহণ আর সূর্য গ্রহন দুটিই আল্লাহর অন্যতম এক নিদর্শন। এতে বান্দার জন্য কোন ক্ষতি নেই। এগুলো আমাদের দেশের কিছু অজ্ঞ লোকের তৈরি করা কুসংস্কার। ইসলাম আমাদের অনেক সহজ বিধি বিধান দিয়েছে কিন্তু এরকম কিছু অজ্ঞ লোকের কারণে সেই সহজ নিয়মগুলো আমাদের কাছে কঠিন হয়ে উঠে।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্নিত আছে, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, কারো মৃত্যু অথবা জন্মের কারণে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ হয়না বরং তারা হলো আল্লাহর নিদর্শন সমূহের মধ্যে দুটি নিদর্শন। তাই তোমরা যখন তাদের দেখবে তখন দুরাকাত নামায আদায় করে নিবে।
(সুনানে আন- নাসায়ী ১৪৬১)
নাবিলাকে পরদিন ওর বাবা এসে নিয়ে গেছে। মারজুক নিজের ব্যস্ততার জন্য যেতে পারেনি। কিন্তু রাফিউল সাহেব জোর গলায় বলে গেছেন এখন আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার মেয়ে আসার সময় যদি তুমি না নিয়ে আসো আব্বাজান, তবে কিন্তু মেয়ে আমি দিবোনা। বিয়ে করেছো একটা দিন শশুরবাড়ি গিয়ে থাকবেনা এটা কি করে হয়?
মারজুক যাবে বলে শশুরকে কথা দিয়েছে তাই নাবিলা ওখানে তিনদিন থাকার পরে মারজুক আজীমকে সাথে নিয়ে কাল দুপুরে ওখানে খেয়ে নাবিলাকে নিয়ে বিকালেই চলে আসছে।
নাবিলা আসতেই মার্জিয়ারা আজ সকালে চলে গেছে বাবার বাসায়।
কয়েকদিন থেকে নাবিলার শরীরটা কেমন জানি করছে। এদিকে পিরিয়ডের তারিখ ও আঠার দিন পিছিয়ে গেছে৷
লজ্জা আর সংকোচে নাবিলা মারজুককে কথাটা জানালো। সেদিনই রাতে ফিরবার সময় প্রেগন্যান্সি ডিটেকশানের একটা কাঠি নিয়ে আসলো নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
নাবিলাকে পুরোপুরি নিয়ম নলে দেওয়াতে পরদিন সকালে নাবিলা পরীক্ষা করে দেখলো পজেটিভ আসছে। তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মারজুককে দেখালে মারজুক তা ভালো করে দেখে মুচকি হেসে নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আলহামদুলিল্লাহ!
লজ্জায় নাবিলা মারজুকের বুকে মুখ লুকালো।
নাবিালর পরিবারের সবাই খুশি হলো। এমনকি মার্জিয়া ও যখন খবরটা শুনলো তখন ও কান্না করে দিয়ে বললো, দেখো ভাবি এই সন্তানই তোমাদের আর বাবা মায়ের দুরত্ব কমাবে।
নাবিলা বাসায় একা আছে নতুন বাসা, নতুন জায়গা কিছুই চিনেনা। আর তাছাড়া এ অবস্থায় খালি বাসায় থাকা ঠিক না। তার উপর নাবিলার একবার মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়াতে সোহানা ম্যাডাম বলেছে এবারে ওর প্রতি ভালো করে যত্ন নিতে হবে। এই জন্য প্রতিদিনই মারজুক মাগরিবের পরপরই হসপিটাল ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আজো তার ব্যতিক্রম হলো না। হসপিটাল থেকে বাসা দশমিনিটের হাঁটা রাস্তা তাই মারজুক প্রতিদিন হেঁটেই যাওয়া আসা করে। এমনিতে আজ সারাদিন মেঘলা ছিলো। হসপিটাল থেকে বেরুতেই আকাশের দক্ষিণ পশ্চিম কোণা থেকে উঠে এলো জমাটবাঁধা কালো মেঘের সারি। তারপরই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। মারজুক দৌড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের একটা দোকানে দাঁড়ালো। শীতের শেষ সময় এখন। এ সময় সাধারণত বৃষ্টি হওয়ার কথা না। তাই ছাতাটাও আনা হয়নি। কিন্তু এখন তো বড্ড মুশকিলে পড়ে গেছে ছাতা না থেকে।
সাতপাঁচ ভাবছে এমন সময় মারজুকের খেয়াল গেলো তার পাশের একটি টুলে ফুল নিয়ে বসে আছে ৮/৯ বছরের ছেলে।
মারজুকের কি মনে হতে ও একটা গাঁদা আর গোলাপের সংমিশ্রণের ফুলের মালা কিনে নিলো। মারজুক ফুলের মালাটা হাতে নিয়ে চেয়ে আছে। পৃথিবীতে এতো এতো সুন্দর ঘ্রাণ যুক্ত ফুল থাকতেও মারজুকের কেন জানি এই কটকটে হলুদ রঙের গাঁদা ফুল টাকেই বেশি ভালো লাগে।
কিছু একটা ভাবতেই মারজুক নাবিলার নাম্বারে ফোন দিলো। কি জানি মেয়েটা এই ঝড়বৃষ্টির মাঝে বাসায় একা একা কি করছে? প্রথমবার ফোন দিতেই ওপাশ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। মারজুক আবারো ডায়াল করলো নাবিলার নাম্বারে। একে একে পাঁচবার ফোন দেয়ার পরে ও ওপাশ থেকে নাবিলার কোনো সাড়া না পেয়ে মারজুকের চিন্তা শুরু হয়ে গেলো।
কি ব্যাপার মেয়েটা কোথায় গেলো?ফোন ধরছেনা কেনো?
আর কিছু না ভেবেই মারজুক দোকানদারের থেকে একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে তাতে ওয়ালেট আর মোবাইলটাকে ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো।
একপ্রকার দৌড়ের মধ্যে দিয়ে বাসার নিচে আসলো।
দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌতালায় নিজের ফ্লাটের সামনে চলে এলো। কলিংবেল চাপতে যাবে খেয়াল করলো দরজা বাহির থেকে লক করা।
মারজুক আরো বেশি আশ্চার্যান্বিত হয়ে গেলো। কি ব্যাপার ও কোথায় গেলো দরজা লক করে? ওর বাবার বাসায় নয়তো? ওখানে গেলেতো আমাকে বলে যেতো! এরকম ভাবনা চিন্তা করতে করতে মারজুক নিজের কাছে থাকা চাবিটা নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে গেলো। পুরো রুমে খুঁজলো বারান্দায় দেখলো কোথাও নাবিলার চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ড্রেসিং টেবিলের উপর ওর ফোনটা রাখা আছে। মারজুকের চিন্তা আরো বেড়ে গেলো৷
কোথায় গেলো,, কোথায় গেলো ভাবতে মারজুকের ভিতর অজানা ভয় এসে ভর করলো। মারজুক কি করবে বুঝতে পারলোনা। নাবিলার বাবার কাছে জিজ্ঞেস করতে পারছেনা কারণ নাবিলার ফোন যখন এখানে তখন তো ওই বাসায় যাওয়ার কথা না! খালি খালি উনারা টেনশন করবে। মারজুক ভেজা শরীরে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে বসে পড়লো……..
চলবে……..