হঠাৎ পাওয়া সুখ পর্ব-২৫ শেষ পর্ব

0
5631

#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
শেষ পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু

অপারেশন রুমের বাহিরে সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছেন। প্রায় ৩ঘন্টা হতে চললো এখনো কোন খবর আসছে না। পেইন আছে কিন্তু খুব বেশি নয়। অপারেশন করার কথা উঠলে এতো কষ্টের মাঝেও নাবিলা জানালো ও কিছুতেই অপারেশন করতে দিবে না। ও কষ্ট সহ্য করবে তারপরও সিজার করতে দিবে না। ডাঃ সোহানা নার্সদের নিয় ওটিতে আছে।

মারজুক কিছুক্ষণ ওখানে ছিলো।
নাবিলার কষ্ট দেখে ওর নিজের কান্না চলে আসছিলো। পুরো শরীর ওর কাঁপছিলো ভয়ে। ডাক্তাররা যতই কঠিন মনের হোক না কেনো, তারা নিজেদের আপনজনের কষ্টগুলো কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। অপারেশন টেবিলে তাদের হাত থরথর করে কাঁপতে থাকে। তাই ডাঃ সোহানা ওকে একরকম জোর করে বের করে দিয়েছে।

মারজুক বাহিরে এসে সূরা ইনশিকাক এর ১থেকে ৪নং আয়াত গুলো একটা কাগজে লিখলো।
(আয়াতের আরবী লেখা সম্ভব হয়নি। তাই বাংলা অর্থ দিলাম)
(যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে ও তার প্রতিপালকের আদেশ পালন করবে এবং ইহাই তার করণীয়। এবং পৃথিবীকে যখন সম্প্রসারিত করা হবে ও পৃথিবী তার অভ্যন্তরে যা আছে তা বাহিরে নিক্ষেপ করবে এবং শূর্নগর্ভ হবে।)
মারজুক কাগজটা একটা সুতা দিয়ে পেছিয়ে নার্স আনিকার হাতে দিয়ে বললো এটা নাবিলার বাম রানে বেঁধে দিতে৷ আল্লাহ চাইলে ভালো কিছু হতে পারে৷ আর যদি বাচ্চা আছানীর সাথে জন্ম নিয়ে নেয় তবে সাথে সাথে এটা খুলে ফেলতে হবে।

আরো কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে ভিতর থেকে একটা নবজাতকের কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো। মারজুক মাথা তুলে ওদিকে তাকালো।
একটু পরে নার্স অনিকা বাহিরে এসে জানালো স্যার, আপনার মেয়ে হয়েছে! মিষ্টি খাওয়ান!

মারজুক সাথে সাথে বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ! আনন্দে মারজুকের চোখে পানি এসে গেলো। মারজুক চোখের পানি মুছে বললো, নাবিলা কেমন আছে?

-জ্বি স্যার, ম্যাডাম সুস্থ আছে।

মারজুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

বাহিরে অপেক্ষারত সবাইও সমস্বরে বলে উঠলো, আলহামদুলিল্লাহ!

মুনতাসির আহমেদ উঠে এসে মারজুককে বুকে জড়িয়ে ধরলো। বাবা ছেলের এতো দিনের চাপা কষ্ট, রাগ, অভিমান সব গলে একনিমিষে পানি হয়ে গেলো। বাবা ছেলের কান্নায় এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হলো ওখানে। তবে এই কান্না কিছু হারানোর নয়! এ কান্না আনন্দের! এ কান্না হাজারো মান অভিমানের পরে অনেকটা সুখ একসাথে পাওয়ার কান্না!

কিছুক্ষণ পরে নাবিলাকে কেবিনে দেয়া হলো। তবে কাউকে এখনো বাচ্ছাকে বা নাবিলার সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি।

ডাঃ সোহানা চেয়েছিলেন বাচ্ছাকে আগে তার মায়ের কোলে দিবে। কিন্তু নাবিলা জিদ ধরে আছে, মারজুক তার মেয়েকে কোলে নেয়ার আগে সে বাচ্ছার মুখ দেখবে না। নাবিলার মনে হলো, মারজুক আগে বাচ্ছাকে কোলে নিলে তবেই ও কোলো নিবে তার আগে না! প্রথমে বাবার ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে তাদের মেয়ে পূর্ণতা পাবে।

আনিকা বাহিরে এসে মারজুককে বললো, স্যার, সোহানা ম্যাডাম আপনাকে ডাকছে।

মারজুক চোখ মুছে সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ভিতরে গেলো।

ভিতরে গিয়ে নাবিলার বলা কথাটা শুনতেই মারজুক চোখ বড় বড় করে নাবিলার দিকে তাকালো। সাথে সাথে নাবিলা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।
মারজুক বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে সোহানা ম্যাডামের কাছ থেকে ছোট্ট বাবুটাকে নিয়ে বিছানার উপর শোয়ালো। তারপর ডান কানে আযান এবং বাম কানে একামতের বাক্যগুলো সুষ্পষ্টভাবে শুনিয়ে দিলো। যাতে সারাজীবনের জন্য এ বাক্যগুলো তার মনে গেঁথে থাকে৷

প্রথমবার বাচ্চাটির দিকে তাকাতেই মারজুক অবাক হয়ে গেলো। মাশাআল্লাহ!
পিচ্ছি মেয়েটা একেবারে ৭০% মারজুকের কার্বন কপি। বাকি ৩০% নাবিলার মতো।
কৃতজ্ঞতায় মারজুক সৃষ্টিকর্তার দরবারে আরো একবার মাথা নত করলো।
কোলে নিয়ে কপালে আস্তে করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। অন্যরকম আনন্দে মনটা ভরে উঠলো। আজ থেকে ওর আরো একটা সম্পর্ক আজীবনের জন্য তৈরি হয়ে গেলো। একজন সন্তানের বাবা হয়ে গেলো। প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ, অনুভূতি অন্যরকম। যা কাউকে বলা যায় না।

ডাক্তার নার্সরা সবাই বেরিয়ে যেতেই বাহিরে অপেক্ষারত সবাই হুড়মুড় করে রুমে প্রবেশ করলো।

মার্জিয়া মারজুকের কাছ থেকে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বললো, মাশাআল্লাহ! ভাইয়া, এতো তোর ফটোকপি! দেখেছিস কত মিষ্টি একটা মেয়ে!
ওর নামটা কিন্তু আমিই দিবো এবং সেটা আমি ঠিক করে নিয়েছি!

-মারজুক উৎসাহের সাথে বললো কি নাম?

-হুমায়রা! এর অর্থ কি জানিস ভাইয়া?
হুমায়রা মানে লালাভ গৌরবর্ণা। যা ওর সাথে একেবারে মিলে যাবে।

সেলিনা গিয়ে নাবিলার মাথায় হাত রেখে বললো, কেমন আছিস মা?

-নাবিলা ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো, আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল!

– আজ আমার ঘরটাকে তুই আনন্দে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিস মা!

-নাবিলা কিছুটা ইতস্তত করে বললো, আব্বা আজো আসে নি মা?

-এসেছে তো! বাহিরে আছে মনে হয়।

-আব্বা এখনো আমাকে মেনে নিতে পারে নি তাই না মা?

-নারে মানুষটা তোর সামনে কোন মুখে এসে দাঁড়াবে তাই ভিতরে আসে নি। অনুশোচনাবোধ তাকে দিনরাত জর্জরিত করে দিচ্ছে।

-মা আপনি আব্বাকে আসতে বলুন! উনার উপর আমার কোনো রাগ বা অভিমান নেই। উনি মুরব্বী মানুষ! রাগ সংবরণ না করতে পেরে আমায় কয়েকটা কথা বলেছেন তাই বলে তার উপর রাগ করে থাকবো এটা কোনো কথা!

সেলিনা নাবিলার মাথায় হাত বুলিয়ে মুনতাসির সাহেবকে ডাকতে গেলেন।
এদিকে সবাই নতুন অতিথিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

সেলিনা মুনতাসির আহমেদের হাত ধরে নাবিলার দিকে এগিয়ে আসলো।
নাবিলার বাবা মা আর মার্জিয়া রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো৷ সেলিনা নাতনীকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলো। মারজুক মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

মুনতাসির আহমেদ নাবিলার সামনে বসে আছেন, তবে দৃষ্টি নিচের দিকে । লজ্জায় আর অনুশোচনায় তার মুখ দিয়ে কথা আসছে না।

নাবিলা ছলছল চোখে নিজেই বললো, আব্বা আপনি এখনো আমার উপর রাগ করে আছেন?

-মুনতাসির আহমেদ এই মুহুর্তে নাবিলার হাত চেপে ধরে বললো, মারে তুই আমায় ক্ষমা করে দিস! অনেক অন্যায় করেছি তোর উপর আমি!
সত্যি তোদের বাবা হওয়ার কোন যোগ্যতা আমার নেই বলে ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিলো৷ মারজুক উঠে এসে বাবার কাঁধে হাত রাখলো।

-নাবিলা বললো, আব্বা আপনি এভাবে ক্ষমা চেয়ে আমাকে অপরাধী করবেন না। আপনারা বাবা মা!
আর সন্তান কোনো ভুল করলে বাবা মা কখনো তা মনে ধরে রাখে না। তাহলে সন্তান হয়ে বাবা মায়ের সামান্য ভুলটাকে মনে নিয়ে থাকলে তো আমি কোন মানুষের তালিকায় পড়বো না।
আব্বা আপনি প্লিজ কাঁদবেন না!

-মুনতাসির আহমেদ বললেন, তুই অনেক ভালো মা! অনেক ভালো! তোর মতো উদার ও প্রশস্ত মনের অধিকারী আমি কেন হতে পারিনি? কেনো আত্মহংকারে আমি নিজের অমানুষের পরিচয় দিয়েছি বুঝতে পারছি না।

-আব্বা প্লিজ! কাঁদবেন না! আর কোন কান্না আমি চাই না।

সেলিনা উঠে এসে বললো, কান্নকাটি রেখে এই নাও নাতনীকে কোলে নাও!

মুনতাসির সাহেব চোখ মুছে হুমায়রাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো।

আনন্দে নাবিলার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। এদের সবার আনন্দ দেখেই একবারো মনে হয় না এ বাচ্চাটাই এ পরিবারের একমাত্র মেলবন্ধনের কারণ। একদিন এই স্বপ্নটাই তো দেখেছিলো। এভাবে হাসি খুশিতে একটা পরিবার থাকবে ওর! সংসারের প্রতিটি কোনা জুড়ে এভাবে ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকবে।
আজ তা সৃষ্টিকর্তা পুরোপুরি পূরণ করে দিয়েছে।

রাতে মারজুক মার্জিয়াকে ছাড়া আর সবাইকে ওর বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এত মানুষ একসাথে হসপিটালে থেকে ভিড় জমানোর কোন মানেই হয় না। তাছাড়া ওরা মা বাচ্চা তো মোটামুটি সুস্থ আছে।

মার্জিয়া বাহিরে এসে মারজুককে নাবিলার কেবিনে পাঠিয়ে দিলো। সারাদিনের সবার হৈ হুল্লোড়ে ওদের দুজনের একাকী সময় কথা বলা হয়নি।

মারজুক ভেতরে গিয়ে নাবিলার পাশে বসলো। নাবিলার একপাশে ছোট্ট মেয়েটি ঘুমাচ্ছে।
মারজুককে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নাবিলা বললো, কি হলো চুপ কেনো?

-আজ যা করেছো এটা কি ঠিক করেছো?

-মানে?

-তুমি আসলে এখনো ওই জায়গাতে আটকে আছো। না হলে ওকে প্রথমে আমার কোলে দিয়ে কি বুঝাতে চাইছিলে। আমি কোলে না নিলে তুমি কোলে নিলে কি আমার মেয়ে পূট্ণতা পেতো না। আর এমনতো না ও আমাদের সন্তান নয়। তুমি ও জানো আমিও জানি হুমায়রা আমার ঔরসজাত সন্তান।

-ব্যাপারটা তা না!

-প্লিজ নাবিলা! আমাকে কি কোনো ছোটো বাচ্চা মনে হয় তোমার? তুমি এখনো আমাকে মনে প্রাণে মেনে নিতে পারোনি তাইতো?

-এসব কথা বলার সময় কি এখন?

-নাবিলা! তুমি না মানতে পারলে ও আমি দৃঢ় কন্ঠে আগেও বলেছি এখনো ও বলছি তুমি আমার প্রেয়সী।আমার হঠাৎ পাওয়া সুখ। যাকে এক দেখায় আমার হৃদয়ের অন্তর্স্থলে জায়গা দিয়েছি যেখান থেকে আর সরানোর উপায় নেই এই ব্যাপারটা তুমি আজো বুঝতে পারোনি বা বুঝার চেষ্টা করো নি।

-নাবিলা চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ পরে হুট করে মারজুকের কপালে ওর ঠোঁটের আলতো স্পর্শ ছুঁইয়ে দিয়ে বললো, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি! অনেক ভালোবাসি!

নাবিলার এমন আচরণে মারজুক অনেকটাই অবাক হলো। এরকম পরিস্থিতিতে এরকম একটা কাজ! মারজুক তো ভাবতে ও পারেনি। এক আশ্চর্য্য মিষ্টি শিহরণে হৃদয় কেঁপে উঠলো। এই কেঁপে উঠা যেনো অনন্ত ভালোলাগা। যেনো শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরায় বেজে উঠলো আনন্দ লহরী। দিগ্বিদ্বিক প্রতিধ্বনি তার। এই প্রথম নাবিলা নিজে থেকে ওকে ভালোবাসি বলেছে তার সাথে ওর ঠোঁটের স্পর্শ। এই অনুভূতির কোন ভাষা নেই। কোন সংজ্ঞা নেই! মারজুকের ঠোঁটের কোণে না চাইতেও হাসি ফুটে উঠলো।
আনন্দে চোখের পাপড়িগুলো আবারো ভিজে উঠলো।

-নাবিলা বলতে লাগলো, আপনি কোন সাধারণ মানুষ নন! আপনি একজন মহাপুরুষ! আপনার মতো আর দুইটা মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে এই পৃথিবীতে। একমাত্র আপনি আমার আর হুমায়রার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গা। আপনাকে আমি অবিশ্বাস করিনি, তবে কেন জানি তখন মনের মধ্যে ওমন একটা কথা জায়গা করে নিলো।

-নাবিলা এই ভুলটা আর কখনো করো না! তুমি আমার কতোটা জুড়ে আছো তা আমিই জানি। সেদিন তুমি আমায় একটা কঠিন কথা বলেছো যা আজো আমায় নাড়া দেয় খুব কঠিন ভাবে। আজ আবার আমায় পরীক্ষা করতে গিয়েছো, তুমি জানোনা আমার হৃদয়ে এটা কতটা লেগেছে।

-সরি আর হবে না। সারাজীবনের জন্য বিশ্বাসটা তৈরি হয়ে গেছে। আর কোন আঘাতে এটা ভাঙবে না। কথা দিলাম!

একটা ইমার্জেন্সি রোগী আসায় মারজুককে তখনি বেরিয়ে যেতে হলো।

রাত তিনটা।
মার্জিয়া হুমায়রাকে নিয়ে পাশের বেডে ঘুমাচ্ছে।
নাবিলা অন্য বেডে ঘুমাচ্ছে। মারজুক এখনো ওটি থেকে বের হয়ে আসে নি।
নাবিলা স্বপ্ন দেখছিলো, ওকে কেউ খুব মারছে। শরীরের প্রতিটি জায়গা ফেটে ফেটে রক্ত পড়ছে। রক্তের স্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে। আচমকা এমন ভয়ানক স্বপ্নে হঠাৎই চোখ ছুটে গেলো। শোয়ার জায়গা ভেজা ভেজা লাগতে তাকিয়ে দেখলো, পুরো বিছানায় রক্তে ভেসে গেছে। একনাগাড়ে ব্লিডিং হচ্ছে। নাবিলা কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। এটা কি হচ্ছে?

পাশের বেডে তাকিয়ে দেখলো মার্জিয়া ঘুমাচ্ছে নাবিলা নিজে নিজে উঠে ওয়াশরুমে যেতে নিলেই বেড থেকে নেমে ফ্লোরে দাঁড়াতেই স্রোতের সাথে রক্ত বেরিয়ে আসলো আর সাথে সাথে নাবিলা ওখানেই পড়ে গেলো।

আচমকা কিছু একটার শব্দ হতেই মার্জিয়া চোখ মেলে নাবিলার বেডের দিকে তাকালো। ওকে বেডে না দেখে মার্জিয়া উঠে বসলো। নাবিলার কাতরস্বর কানে আসতেই মার্জিয়া উঠে এসে নাবিলাকে রক্তে রন্জিত দেখে ভয়ংকর এক চিৎকার দিলো। দুজন নার্স ছুটে আসলো।

নাবিলাকে ধরে বেডে তোলা হলো। মার্জিয়া ছুটে গেলো মারজুককে ডাকতে। মারজুক মাত্র অপারেশন শেষে সবে মাত্র নিজের চেম্বারে আসলো। মার্জিয়ার আতঙ্কিত চেহারা দেখে কোনকিছু না বলে একছুটে নাবিলার কেবিনে আসলো।
নাবিলাকে এরকম অবস্থায় দেখে মারজুক হতবিহ্বলের মতো তাকিয়ে রইলো।
চোখগুলো কেমন বড় বড় হয়ে গেছে।

অন্য অপারেশনটা থাকার কারণে ডাঃ সোহানা এখনো হসপিটালে রয়ে গেছেন। খবর পেয়ে তিনি ও ছুটে আসলো। এরকম সুস্থ মানুষের হঠাৎ করে এরকম ব্লিডিং হওয়ার কারণ কেউই বুঝতে পারছে না।

মারজুক কাছে গিয়ে নাবিলার হাত ধরলো। নাবিলার নিঃশ্বাস খুব ধীরগতিতে ওঠানামা করছে।

নাবিলার ব্লিডিং আটকানোর অসংখ্য চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শরীর একেবারে সাদা হয়ে আসছে। ব্লাড দেয়ার ব্যবস্থ করা হয়েছে। কিন্তু নাবিলার শরীর কিছুতেই রক্তগুলোকে নিতে চাইছে না। মারজুককে ওর কাছ থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেও কেউ পারেনি। ও নাবিলার হাত ধরেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।

বাসায় খবর যাওয়ার সাথে সাথে সবাই চলে আসলো।

দুই ঘন্টা ধরে অনেক চেষ্টা করার পরে ডাক্তাররা তাদের ব্যর্থতা মানতে বাধ্য হলো😭😭। নাবিলার নিঃশ্বাসের গতি পুরোপুরি থেমে গেলো। হাত পা জমে বরফ হয়ে এলো😭😭।

আল্লাহ যে মানুষটাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাওয়ার কথা একবার ভাবেন তখন দুনিয়ার বড় বড় সব ডাক্তাররা শত চেষ্টা করলেও তাকে ধরে রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব না । উপরওয়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে যেতেই হবে।
হ্যা নাবিলা এই নিষ্ঠুর পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে দিয়ে পরপারে পাড়ি জমালো😭😭। তার একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন পূরণ হলেও তা আর নিজের চোখে দেখা হয়নি। স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হলো। নিজের সন্তান, নিজের প্রিয়তম স্বামি নিজের মা বাবা এবং অসংখ্য ভালোবাসার মানুষের মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হলো।

মারজুকের জীবনের হঠাৎ পাওয়া সুখটা স্থায়ী হয়নি। যেমনি হঠাৎ পাওয়া সুখ হয়ে এসেছিলো তেমনি হঠাৎই সবাইকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে নিজের একটা স্মৃতিচিহ্নকে প্রিয় মানুষটার আশ্রয়ে রেখে মানুষটা হারিয়ে গেলো।

প্রত্যেকটা মানুষের চোখের পানিতে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো।

সেলিনা ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে সমানে কেঁদে যাচ্ছে।
মুনতাসির সাহেব, বলতে লাগলেন আমার জন্য, শুধুমাত্র আমার করা তীব্র কথার আঘাতগুলো সইতে না পেরে মেয়েটা অভিমান করে চলে গেছে। আল্লাহ তুমি আমাকে কেন রেখেছো? আমাকে নিয়ে যেতে। মেয়েটাকে কেনো এতোবড় শাস্তি দিচ্ছো?.

নাবিলার বাবা মা একপাশে বসে নিরবে চোখের পানি ঝরাচ্ছে।

মার্জিয়া কাকে রেখে কাকে সামলাবে?

মুনতাসির আহমেদকে কোনভাবে বুঝানো যাচ্ছে না মৃত্যুর উপর কারো হাত নেই। এতে তার কোনো দোষ নেই।

মারজুকের দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না। ভাইয়ের বিমর্ষ মুখের দিকে তাকাতেই মার্জিয়ার বুকটা কষ্টে ফেটে যেতে চাইছে। আল্লাহ আমার ভাইটাকে আর কতো পরীক্ষা করবে?

মারজুক তো এখনো নাবিলার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রেখেছে।
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলে উঠলো,
এভাবেই যদি চলে যাবে
তবে কেনো এসেছো?
কেনো এসেছো?
এই শূণ্য জীবনে।
এই খানিক সময়ের
হঠাৎ পাওয়া সুখটা হয়ে না আসলেই কি হতো না?
টপটপ করে চোখ বেয়ে চোখের নদীর স্রোত বেয়ে যাচ্ছে।
মনে মনে বললো, আল্লাহ তুমি এ কোন খেল খেলছো আমার সাথে? আর কতো পরীক্ষায় আমায় ফেলবে?

জানি মৃত্যু সত্য! প্রত্যেক প্রাণী মরণশীল।পৃথিবীর মায়া ছেড়ে সবাইকে একদিন যেতে হবে। কিন্তু এতটা যে সহজ তা আসলেই জানতাম না! সবথেকে কঠিন মুহুর্তটায় সফল করেও একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে এভাবে হুট করে নিয়ে যাওয়ার মতো কঠিন পরিস্থিতি কি আর কিছু আছে৷
একটু আগেই যে মানুষটা কথা বলেছে সে এখন এভাবে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে আছে।

যদি নিয়েই যাবে তাহলে ভালোবাসার বন্ধণ গুলো জড়িয়ে দেয়া কি খুব জরুরী ছিলো? এতো ভালোবাসা, এতো মায়া কেন দিয়েছো?

আল্লাহ আজ তুমি আবারো প্রমান করলে, তুমিই সর্বশক্তিমান! তুমি চাইলে কি না হয়!
তুমি চাইলে কারো কোন ক্ষমতা বা ভালোবাসার জোর নেই আটকাবার।

মার্জিয়া হুমায়রাকে নিয়ে এসে মারজুকের কোলে দিলো। ভাইয়া ভাবি মরে যায়নি। দেখ তার স্মৃতিচিহ্ন তোকে দিয়ে গেছে।

মারজুক অসহায়ভাবে মার্জিয়ার দিকে তাকালো।

মার্জিয়া চোখের পানি মুছে বললো, তোকে শক্ত হতে হবে ভাইয়া। হুমায়রার জন্য তোকে সুস্থভাবে বাঁচতে হবে। দেখ তুই তো অনেক কিছুই জানিস ইসলাম সম্পর্কে। তাহলে তুই এতো ভেঙে পড়লে কি করে হবে? এই ছোট্ট বাচ্চাকে কে সামলাবে বলতো?

মারজুক হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বললো, তোর কি দুর্ভাগ্য রে মা! জন্ম যেদিন সেদিনই মাকে হারিয়েছিস! আল্লাহ তোর সাথে এতো নির্মম ব্যবহার কেনো করলো এর জবাব তুই তার কাছ থেকে নিবি!

নাবিলা চলে যাওয়ার পাঁচ বছর পরে।

মারজুক হসপিটাল থেকে ফিরতেই ছোট ছোট পায়ে হেটে এসে এক জোড়া ছোট্ট হাত বাবা বলে ওকে জড়িয়ে ধরলো। মারজুক মুচকি হাসি দিয়ে ওকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে সোফায় বসে পড়লো।

সেলিনা ভাত নিয়ে আসলো হুমায়রার জন্য৷ হুমায়রা তা দেখে মারজুকের পিছনে লুকালো।
দেখেছিস তোর মেয়ের কান্ড! ভাত নিলেই তার সহ্য হয়না! আমাকে সারা বাড়ি দোঁড়াইছে।
মারজুক বললো, খাবার না খেলে তো হুমায়রা বাবার মতো বড় হতে পারবে না।
ডাক্তার হবে কি করে?

ওমনি পিছন থেকে মুখ বের করে হা করে মুখে ভাত পুরে খেয়ে নিলো।

সেলিনা ক্লান্ত স্বরে বললো, এতো দুষ্ট হয়েছে না তোর মেয়েটা! আমার দুইটা নিয়ে আমাকে এর চারভাগের একভাগ ও কষ্ট করা লাগেনি।
হুমায়রার খাওয়া শেষ হতে মারজুক ওকে নিয়ে রুমে গেলো।

হোমায়রা দাদা দাদির চোখের মনি। নাবিলার হয়তো এ বাড়িতে জায়গা হয়নি কিন্তু ওর বাচ্চা এখন এ পুরো বাড়ী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাবা, দাদা, দাদুর চোখের মণি। যার ছোট ছোট পায়ের ছোঁয়ায় আর টুকটুক করে কথা বলায় পুরো বাড়ী মুখরিত হয়ে থাকে।

মুনতাসির আহমেদ আজো নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনায় ভুগেন। উনার বারবার মনে হয় নাবিলার মৃত্যুর জন্য একমাত্র উনিই দায়ী! মারজুক অবশ্য এই নিয়ে অনেক বুঝিয়েছে, কারো মৃত্যর উপর আল্লাহ ছাড়া কারো হাত নেই। তিনি চাইলে কেউ আটকাতে পারবে না। আবার তিনি চািলে সারা দুনিয়ার সম্মিলিত শক্তি ও কাউকে মারতে পারবে না।

হুমায়রা ঘুমিয়ে পড়েছে। মারজুক বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বাবা মা আজকাল আবারো বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো। তাদের একটাই কথা, আমরা তো আর সারাজীবন থাকবো না। নিজের জন্য না ভাবলে হুমায়রার কথা ভেবে অন্তত দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবতে। হয়তো তাদের চাপাচাপিতে একসময় রাজি হতে হবে।

তবে ১বছর ১২ দিনের জন্য সেই হঠাৎ পাওয়া সুখটা আজো মারজুকের অন্তরে গেঁথে আছে৷ যা থেকে বের হয়ে আসা হয়তো কখনোই সম্ভব নয়। সবাই ভুলে গেলেও মারজুকের মনটা এখনো একাকী নিস্তব্ধ রাতে নাবিলার কথা ভেবে ঠুঁকরে কেঁদে উঠে।
আল্লাহর কাছে প্রতি নামাজে একটাই প্রার্থনা করে, আল্লাহ যেনো নাবিলার জন্য পরকালের সুখটা চীরস্থায়ী করে দেয়। আর নিজের এই জীবনের হঠাৎ পাওয়া সুখটাকে যেনো চিরন্তন ওই সুখের দেশে পুরোপুরি স্থায়ী করে মিলিয়ে দেয়।

***সমাপ্ত***
আপনি কান্না করছেন……!
কেন কান্না করছেন!
জানেন
আপনি একজন ভালো মনের মানুষ!
হা আপনি একজন ভালো মনের মানুষ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here