#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১৬তম পর্ব ও ১৭ তম পর্ব
লেখা- শারমিন মিশু
ফজরের নামাজ পড়ে মারজুক নাবিলাকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে হাটার জন্য৷ এটা এখন ওদের প্রতিদিনের রুটিন। বাসায় পরিমিত জায়গা নেই হাটার জন্য। আর ভোরবেলা রাস্তাতে তেমন জনারণ্য থাকেনা। হিম হিম বাতাসের সকালের এই মিষ্টি পরিবেশটা আমাদের সবার শরীরের জন্য উপকারী। মাঝে মাঝে কোথাও নাম না জানা দুএকটা পাখি ডেকে উঠে। অদ্ভুত ভালোলাগায় মন ছু্ঁয়ে যায়। আর এরকম সময়ে যদি প্রিয় মানুষটা হাত ধরে হেঁটে চলে তাহলে তো আর কথাই নাই।
হেঁটে এসে দুজনে একসাথে কোরআন তেলাওয়াত করলো। মারজুক এখনো পুরোপুরি সহীহ শুদ্ধ করে কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেনা। কারণ ছোটবেলা থেকে তো সেইরকম কোন সুযোগ পায়নি ইসলামিক জ্ঞান চর্চা করার জন্য, কোরআন হাদীস ভালো করে বুঝার জন্য। এখন নিজের ইচ্ছায় যা একটু চেষ্টা করছে। বিয়ের পর থেকে নাবিলা মারজুককে কোরআন সহীহ শুদ্ধ করে অর্থ বুঝে শিখার জন্য জোর তাকিদ দিয়েছে। কারণ কোরআন ভুল ভাবে তেলাওয়াত করলে মাঝে মাঝে সওয়াবের জায়গায় গুনাহের খাতায় নাম লেখা হয়ে যায়।
নাবিলা প্রতিদিন সকালে মারজুককে দশ আয়াত করে সহীহ শুদ্ধ করে কোরআন শিখায়।
আল্লাহ তায়ালা এবং রাসূল (সঃ) আমাদেরকে কোরআন বুঝে শুনে শিখার জন্য জোর তাকিদ দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
এ হলো এক কল্যানকর কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি অবর্তীর্ণ করেছি। যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধ শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহন করে উপদেশ। (সূরা সাদঃ২৯নং আয়াত)
এখানে আল্লাহ তায়ালা কুরআন অনুধাবন ও উপদেশ গ্রহন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ দুটোর কোনটাই অর্থ বুঝা ব্যতীত সম্ভব নয়। আল কোটআনে এরকম অসংখ্য আয়াত আছে।
শুধু এতটুকুই নয় বরং যারা আল কোরআন তেলাওয়াত করে অথচ অর্থ বুঝেনা আল্লাহ তাদের ও সমালোচনা করেছেন। সূরা বাকারার ৭৮নং আয়াতে আছে,
আর তাদের মাঝে কতক নিরক্ষর লোক আছে যাদের মিথ্যা আশা (আমানিয়্যা) ব্যতীত কিতাব সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই, তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষন করে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (র.) সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেছেন-
যে ব্যক্তি চায়, কুরআন যেভানে নাযিল হয়েছে সেভাবেই পাঠ করবে সে যেন ইবনে উম্মে আবদ (আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ) এর মত পাঠ করে।
কী তার পদ্ধতি? তিনি বলেছেন-
আমাদের মাঝে কোনো ব্যক্তি যখন দশটি আয়াতের তেলাওয়াত করতো তখন সামনে আর অগ্রসর হতোনা, যতক্ষণ না সে দশটি আয়াতের অথ অনুধাবন করত ও সে মোতাবেক আমল করতো।
অর্থাৎ, দশটি আয়াত প্রথমে তেলাওয়াত, তারপর অর্থ -তরজমা অনুধাবন, অতঃপর হিসাব নেয়া যে, এর বাস্তবায়ন আমার জীবনে কতটুকু। এ রকমই ছিলো সাহাবায়ে কেরামের কুরআন তেলাওয়াত পদ্ধতি। কোরআন পড়া শেষে নাবিলা মারজুককে এতক্ষণ এ ব্যাপারগুলোই বোঝাচ্ছিলো।
কিছুক্ষণ পর মারজুক উঠে গিয়ে নাবিলার জন্য পানি নিয়ে আসলো। ইদানিং নাবিলা পানি খাওয়ার পরিমাণ একদম কমিয়ে আনার দিয়েছে। এই মেয়েকে জোর না করলে কখনো বেশি পানি খাবেনা। মারজুক পানির গ্লাস বাড়িয়ে ধরতেই, নাবিলা বললো সকালেই তো এতগুলো পানি খেলাম এখন আবার কি করে?
-যে করেই হোক খেতে হবে! আমার কথা না হয় নাই শুনলে, কিন্তু সোহানা ম্যাডাম সেদিন কি বলেছে মনে নেই?
এসময়ে তোমার পানি যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়া উচিত৷ নয়তো পরে পানি শূন্যতার জন্য কঠিন সমস্যা দেখা দিবে।
আমি দেখেছি তুমি খাবারটাও ঠিক করে খাচ্ছোনা। পুষ্টিকর খাবারগুলোর কথা তো নাই বললাম! তুমি এরকম করলে তোমার যেমন ক্ষতি হবে তেমনি তোমার ভিতরে যে আরেকটি প্রাণ একটু একটু করে বেড়ে উঠছে তার অপুষ্টি দেখা দিবে, গ্রোথ কমে যাবে। সবসময় ছেলেমানুষি চলে?
-আমার খেতে ইচ্ছে না করলে কি করবো?
-জোর করে খাবে। প্রয়োজনে আস্তে আস্তে খাবে।
-প্লিজ আপনি আমাকে জোর করবেন না তো! মানুষের মন ভালো থাকলে সব ঠিক থাকে আর মন যদি ভালো না থাকে কোনকিছুই ঠিক নেই।
– কি নিয়ে সারাদিন এতো এতো চিন্তা করো আমি বুঝিনা!
তোমায় বলেছি এসময় মন যত ফ্রেশ রাখবে ততই তোমার ভালো হবে।
-আপনি জানেন না আমার কি নিয়ে চিন্তা?
-জানি! আর জানি বলেই বলছি, যা হয়েছে সেসব ভুলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করা উচিত নয় কি এখন তোমার?
কতবার বলেছি তোমাকে যা গেছে তা অতীত। অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হয়, অতীতের ঘটনা নিয়ে কষ্ট পাওয়া মোটেই ঠিক নয়। কিন্তু না, তোমার অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলে চলেনা।
এইযে আমি তোমার জন্য পরিবারের বিপক্ষে গেছি, তোমায় এতো ভালোবাসি, তোমার মন ভালো রাখার এতো চেষ্টা করছি এটা কি তোমার একটুখানি আনন্দ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?
–
-কিছু বলবেনা জানি তো! কথায় আছেনা মেয়ে জাতির কোন শোকর নেই, তোমাদের মন যতই ভালো রাখার চেষ্টা করিনা কেন আমরা কোন লাভ নেই বলে মারজুক রেগেমেগে কিচেনের দিকে গেলো।
নাবিলা মনে মনে বলছে, মানুষটাকে এসময় রাগিয়ে দেয়া কি ঠিক হলো? নাবিলা তুই সত্যি একটা অকৃতজ্ঞ মেয়ে ! আর কোথায় কখন তোর কি বলতে হয় এটাও তোর জানা নেই! মানুষটা তোর জন্য এতো করছে তাও তুই ওই ঘটনা ভুলতে পারছিস না! ছি!!! নাবিলা ছি!!! বলে টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে সবগুলো পানি ঢক ঢক করে খেয়ে নিলো। তারপর উঠে কিচেনের দিকে গেলো।
মারজুক রুটির আটা করার জন্য চুলায় পানি বসালো। তারপর ভাজির জন্য সবজি কাটতে লাগলো। নাবিলা পিছন থেকে বললো, সরুন আমি কাটছি!
–
-সরতে বলেছি তো!
-মারজুক তাও কোন কথা বলছেনা।
-কি হলো সরুন বলে নাবিলা মারজুককে হাত দিয়ে কিছুটা ঠেলে সরিয়ে দিতে গেলেই কিচেনে জমে থাকা পানিতে স্লিপ খেয়ে পড়ে যেতে গিয়ে মারজুকের হাতের বাঁধনে আটকা পড়লো।
নাবিলাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মারজুক বললো,, হাঁটতে না পারলে হাঁটার দরকার কি? কতবার বলি সাবধানে হাঁটতে। কে শোনে কার কথা! এখান থেকে যাও আমি নাস্তা রেডি করে নিয়ে পরে ডাক দিবো বলে আবারো কাজে মন দিলো৷
মারজুক সবজি কাটা শেষ করে আটা করে নিলো। নাবিলা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই কেউ যদি নাবিলার উপর রাগ বা অভিমান করতো নাবিলা নিজেই কেঁদে দিতো। এখনো তাই হচ্ছে। নাবিলা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছেনা। কিছু সময় পর কিছু না বলেই হুট করে পিছন থেকে নাবিলা মারজুককে জড়িয়ে ধরলো।
মারজুক নাবিলার মৃদু ফোঁফানির শব্দে নিজেও অবাক হয়ে গেলো। আরে কি হলো? কাঁদছো কেনো?
-নাবিলা নাক টেনে টেনে বললো, আপনি আমার উপর সবসময় রাগ করেন! আমি না হয় একটা কথা মুখ ফসকে বলেই ফেলেছি তাই বলে কি আমি আপনার ভালোবাসা অস্বীকার করেছি?
-আরে আমি রাগ করেছি কে বললো?
-রাগ নয়তো কি? আপনি কেমন গম্ভীর হয়ে আছেন, আমার উপর রাগ করে নিজেই সব কাজ করছেন আমাকে হাত দিতেও দিচ্ছেন না।
-আরে পাগলী আমি রাগ করিনি। এমনি একটু অভিমান হয়েছে তাই!
-আপনার একটু অভিমানে আমার যে পুরো হৃদয় কষ্টে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে তা কি আপনি বুঝেন?
-মারজুক নাবিলার হাত টেনে পিছন থেকে সামনে নিয়ে আসলো। দুহাতে নাবিলার মুখ তুলে বললো, ভালোবাসার মানুষের উপরই তো অভিমান করা যায় পাগলী। তুমি হয়তো জানোনা আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তারপরও তোমার মুখ থেকে এরকম কথা শুনলে আমার খারাপ লাগেনা বলো?
-আমার ভুল হয়ে গেছে আর কখনো এমন হবেনা।
-ঠিকআছে।
– তাহলে সরুন আমি রুটি বানাচ্ছি বলে নাবিলা জোর করে মারজুকের হাত থেকে বেলুন কেড়ে নিজে রুটি বানাতে লাগলো।
আর মারজুক পাশে কোমরে দুই হাত দিয়ে নাবিলার দিকে তাকিয়ে রইলো। সত্যি এই মেয়েকে বুঝা মুশকিল ! কখন কি বলবে তার কোন ঠিক নাই, মন এই ভালো তো এই খারাপ। মেয়েজাতিকে বুঝা পুরুষদের জন্য একেবারে অসাধ্য!
নাবিলা নাস্তা খেতে খেতে বললো,, একটা কথা বলার ছিলো?
-মারজুক খেতে খেতে বললো, কি কথা? কিছু লাগবে নাকি তোমার?
-আরে না কিছু লাগবে না! মা ফোন করছিলো। আপু আসছে গতকাল বাসায়। তাই মা বলছিলো আমাকেও যাওয়ার জন্য একটা দিনের জন্য হলেও।
-হুম
-হুম কি?
-যাবে!
-যাবে মানে? আপনি যাবেন না?
-আমি কি করে যাবো? হসপিটালে এখন দুজন ডাক্তার ছুটিতে আছে এর মাঝে আমি কি করে যাই?
-তাহলে আপনি বিকালে যাবেন আবার সকালে চলে আসবেন।
-এতদূর জার্নি করা…
-থাক যেতে হবে না আপনার। আমিও যাবো না।
-মারজুক নাবিলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,, এতো রাগ কেন তোমার?
-আপনি রাগলে তা হয় অভিমান আর আমার হয় রাগ!
-এ কথায় মারজুক হাসতে হাসতে বললো, থাক আর কিছু বলতে হবেনা। আমি যাবো। এবার তো একটু হাসো! তুমি কি জানো, তোমাকে গোমড়ামুখে একটুও মানায় না।
সকালে নাবিলাকে ওর বাবা এসে নিয়ে গেলো। বিকালে ডিউটি শেষে করে যেতে যেতে মারজুকের প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো। এ বাসায় মারজুক এই প্রথম রাত যাপন করছে। শশুর শাশুড়ী জামাই আদরের কোন কমতি রাখেন নি। দুই জামাই আজ একসাথে শশুরবাড়ী রাত যাপন করছে তাই বাড়ীতে একরকম উৎসব উৎসব পরিবেশ বিরাজ করছে। খাওয়া দাওয়ার পরে মারজু্ক ড্রয়িংরুমে বসে সুমনার হাজবেন্ডের সাথে কথা বলছিলো। আর মনে মনে তার মানসপ্রিয়াকে খু্ঁজছিলো। আসার পর সেই যে একবার ওই মানবীর দেখা পেয়েছিলো তারপর সে লাপাত্তা। এদিকে সবার মাঝখান থেকে উঠে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছেনা।
রাত সাড়ে এগারোটায় মারজুক রুমে আসতেই দেখলো নাবিলা আরো আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মারজুক নাবিলাকে না ডেকে ওর পাশে বসে কপালে ভালোবাসার পরশ ছুঁইয়ে দিলো। ঘুমন্ত নাবিলা ঘুমের মধ্যে একটু কেঁপে উঠলো। আর তাতে মারজুকের হৃদয়ের তানপুরায়ও শব্দ করে উঠলো। তবুও অনেক কষ্টে নিজের ইচ্ছাকে দমন করে নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।
সকালে নাবিলাকো সাথে করে মারজুক বেরিয়ে আসলো। নাবিলার এখন সাতমাস চলছে। নিয়মানুযায়ী আজ ওর চেকাপ করতে হবে। বাচ্ছার পজিশন পরীক্ষা করার জন্য আলট্রাসনোগ্রাফীটা ও করাতে হবে। আলট্রাসনোগ্রাফী রুমে ঢুকতেই নাবিলা মারজুকের হাত চেপে ধরে রেখেছে। কিছুতেই বেরুতে দিচ্ছেনা।
তাই দেখে ডাঃ শাহানা বললো, স্যার আপনি থাকুন সমস্যা নেই। আর তাছাড়া উনি তো আপনার ওয়াইফ।
ডাঃ শাহানা কিছুক্ষন পর বললো,, স্যার বাচ্ছা তো ঠিকঠাক পজিশনে আছে কোন সমস্যা মনে হচ্ছেনা। তবে বাচ্ছা উপুড় হয়ে থাকার কারণে কোনভাবে বুঝতে পারছিনা বাচ্ছাটা ছেলে নাকি মেয়ে! বলে আবারো শাহানা বাচ্ছাটাকে ঘুরানোর চেষ্টা করলো।
কিন্তু বাচ্ছাটা মনে হয় পণ করে রেখেছে দুনিয়াতে আসার আগে কাউকে নিজের পরিচিতি জানান দিবেনা এটা নিজে নিজে ভেবে মারজুকের হাসি পেয়ে গেলো।
তারপরও আরো দশমিনিট পরও না পেরে মারজুক বললো,, ছেড়ে দিন ম্যাডাম! সমস্যা নেই জানতে হবেনা। যা হওয়ার তাই হবে।
এর কিছুদিন পরে মারজুক হসপিটালে যাওয়ার পরে নাবিলা রান্না সেরে কিছু কাপড় চোপড় ধোয়ার জন্য বাথরুমে গেলো।
কিছুক্ষন পরেই কলিংবেল বেজে উঠলো। প্রথমবার না শুনলেও দ্বিতীয়বার শুনে নাবিলা কে এলো ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। শরীর দিন দিন ভারি হয়ে আসছে। এখন আর আগের মত দ্রুত হাটাঁচলা করা সম্ভব হয়না। কেমন যেন একটুতেই হাঁফিয়ে উঠে।
নাবিলা ভাবছে, উনি বোধহয় আজ আবারো কিছু ফেলে গেছেন। প্রতিদিন কিছু না কিছু রেখে যেতে হবে। এই মানুষ কেমনে যে রোগীর সেবা করে আল্লাহ ভালো জানে। মারজুক এসেছে মনে করেই না দেখেই নাবিলা দরজা খুলেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কে ইনি?
একজন অপরিচিত মানুষ ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে৷ মানুষটাকে নাবিলা এর আগে কখনোই দেখেনি। কে হতে পারে ভেবে নাবিলা ভেতর থেকে বাহিরে না দেখে দরজা খোলার জন্য মনে মনে নিজেকে একগাদা বকা দিলো ………..
চলবে……..
#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
১৭তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
নাবিলার সামনে এক ভদ্রমহিলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স ৩০এর কাছাকাছি হবে। নাবিলা সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। কিছুতেই সে এই মহিলাকে চিনতে পারছেনা। কখনো কোথাও দেখেছে বলে মনে হয় না।
নাবিলাকে অবাক করে দিয়ে সেই প্রশ্ন করলো, তুমি নাবিলা না?
-নাবিলা অবাক হওয়ার চরম পর্যায়ে, এমন একজন মানুষ যাকে সে চিনেনা সে কিনা ওর নাম সহ বলে দিলো। নাবিলা হালকা মাথা নেড়ে বললো, জী। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না?
-তুমি আমাকে চিনবে না। আমি লাবন্য! মারজুকের খুব কাছের বন্ধু ।
-নাবিলা এবার আরো একটুখানি অবাক হলো। মনে মনে বললো, মারজুকের মেয়ে বন্ধু আছে? কই কখনো তো কিছু বলেনি উনি। আর উনাকে দেখে ও বুঝা যায় না মেয়েদের সাথে তার বন্ধুত্বের কথা!
নাবিলা বললো, আপু উনি তো আসলে কখনো আপনার কথা বলে নি।
-আসলে আমি বিয়ের পর বাহিরে চলে গেছি। এর মাঝে মারজুকের সাথে সেভাবে আর কখনো যোগাযোগ করা হয়নি। আমি দেশে এসেছি দুই সপ্তাহ হলো।আজিমের কাছে মারজুকের বিয়ের কথাটা শুনেছি। তাই না এসে থাকতে পারলাম না।
-ওহ আচ্ছা। আপনি বসুন আমি আসছি বলে নাবিলা উঠতে নিলে লাবণ্য থামিয়ে বললো, আরে কোথাও উঠতে হবে না। আমি একটু কথা বলে চলে যাবো।
-না তা কি করে হয়?
-আরে সমস্যা নেই বসো আগে কথা বলি!
-না না আপু আপনি আমাদের মেহমান। আর বাসায় মেহমান আসা মানে মেহমানের সাথে ঘরে আল্লাহর রহমত আসা। আপনার মেহমানদারী করতে পারলে আমি ধন্য হবো। আপনি উনার পক্ষের মেহমান। অল্প কিছু হলেও যা আছে সেটুকু দিয়ে মেহমানের মেহমানদারী করা আমাদের রাসূলের সুন্নাত। এতোবড় একটা নেয়ামত থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন না আপু। কথা পরেও বলা যাবে
-লাবণ্য হেসে বললো,আচ্ছা ঠিক আছে।
আচ্ছা মারজুক কোথায়? ডিউটিতে নাকি?
-জী আপু।
-কখন ফিরবে?
-উনি তো সন্ধ্যার সময় ফিরে। আমি কি ফোন দিয়ে আপনার কথা বলবো?
-না না তোমার বলতে হবে না। আমাকে ওর নাম্বার দাও আমিই বলছি।
-মারজুকের নাম্বার লাবণ্যকে দিতে নাবিলার কেমন জানি অস্বস্তি কাজ করছে। চেনা জানা নেই একজন মেয়ে হুট করে এসে বলছে সে উনার পরিচিত। এখন আবার নাম্বার চাইছে। ভদ্রতার খাতিরে নয়তো সুন্দর করে কথা বলছি। কিন্তু লাবণ্য আসলেই কি উনার পরিচিত? নাকি অন্য কেউ? অজ্ঞান পার্টির সদস্য ও তো হতে পারে? ভাবতেই নাবিলা শিউরে উঠলো। আজকাল ঢাকা শহরে এরকম অহরহ দূর্ঘটনাগুলো ঘটছে। চেনা মানুষের পরিচয় দিয়ে ঢুকে সব অঘটন ঘটিয়ে চলে যায়।অবশ্য মেয়েটাকে দেখে তেমন মনে হচ্ছেনা।
কিন্তু এভাবেই সুন্দর কথা বলে মানুষের ক্ষতি করে কিছু মানুষ।
তখনি নাবিলার মনে পড়ে গেলো, আল্লাহ আমাদেরকে কারো সম্পর্কে না জেনে শুধু অনুমানের ভিত্তিতে মিথ্যা ধারণা পোষণ করতে নিষেধ করেছে।
আল্লাহ বলেন-
অনেক বেশি ধারণা করা থেকে বিরত থাক, কারণ কোন কোণ ধারণা গোনাহের কাজ। (সূরা হুজুরাত -১২)
হাদীসে বলা আছে-
‘তোমরা কুধারণা হতে বেঁচে থাকো, কেনন খারাপ ধারণা করা মিথ্যার শামিল।’ আরো বলা আছে-” আমার উম্মতের জন্য তিনটা বিষয় জরুরী ১.অশুভ লক্ষণ ২.হিংসা ও ৩. খারাপ ধারণা থেকে বেঁচে থাকা।”
‘আল্লাহ মুসলিমের উপর মুসলিমের রক্ত প্রবাহিত করা, সন্মান নষ্ট করা এবং খারাপ ধারণাকে হারাম করেছেন।
নাবিলা মনে মনে আল্লাহর দরাবারে তওবা করে নিলো।
-নাবিলাকে এভাবে চুপ থাকতে থেকে লাবণ্য বললো, কি হলো? কোথায় হারিয়ে গেলে?
-মুচকি হেসে বললো,, না না কিছুনা! নাম্বারটা নিন বলে নাবিলা আর পাঁচসাত না ভেবে মারজুকের নাম্বারটা লাবণ্যকে দিয়ে নিজে কিচেনের দিকে গেলো।
মারজুকের পকেটে থাকা ফোনটা মৃদু ভাইব্রেশনে নড়ে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে অপরিচিত নাম্বার দেখে একটু ভেবে ধরবে কি ধরবেনা করে ফোনটা ধরতেই সেই সাড়ে সাত বছর আগের খুবই চেনা কন্ঠস্বরটা শুনে মারজুক কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো।
ওপাশ থেকে লাবণ্য হ্যালো হ্যালো করো যাচ্ছে।
মারজুক নিজেকে সামলে নিয়ে কন্ঠে কিছুটা গাম্ভীর্য্য এনে সালাম দিয়ে বললো, কেমন আছিস?
-দুই মিনিট পর তোর কথা বেরুলো তাহলে।
আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
-না চাইতেও মারজুক কথা বলতে বাধ্য হলো, আলহামদুলিল্লাহ!
-বাব্বাহ তোর কথা দেখি পুরোই চেন্জ। পাক্কা হুজুর হয়ে গেলি নাকি?
-মানার চেষ্টা করছি ইসলামের বিধিবিধান গুলো একটু একটু করে। তোর খবর বল, দেশে কবে ফিরলি?
-এইতো দুই সপ্তাহ হলো।
-ওহ! বাচ্ছারা কেমন আছে?
-ওরা ভালো আছে। বলতো আমি এখন কোথায়?
-কোথায়?
-লাবণ্য রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো, স্যার আমি এখন আপনার ড্রয়িংরুমে বসে আছি।
-মারজুক কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। সেরেছে রে! লাবণ্য বাসা চিনলো কি করে? এখন নাবিলাকে যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয় তাহলে তো অভিমানীনীর রাগ ভাঙাতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। লাবণ্যটার তো কোন বিশ্বাস নাই। এই মেয়ের যা মুখ খোলা অভ্যাস। সুযোগ পেলেই তরতর করে সব বলে দিবে।যদিও এখন ও ইসলাম মানছি কিন্তু একসময় তো লাবণ্যর সাথে গলায় গলায় মিল ছিলো। একসময় এই লাবণ্যকেই তো নিজের করে চেয়ে এসেছি। হয়তো আজ পরিস্থিতি ভিন্ন!
-কিরে চুপ কেন?
-না কিছুনা।
-তুই কি এখন বাসায় আসতে পারবি? তাহলে আমি কিছুসময় বসবো!
-মারজুক না বলতে গিয়েও থেমে গেলো। বাসায় যাওয়া উচিত। কি জানি নাবিলার কানে কি লাগাচ্ছে বলা যায়না। তুই বস আমি আসছি বলে ফোন কেটে মারজুক একঘন্টা সময় ছুটি নিয়ে হসপিটাল ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। এতো বছর পরে লাবণ্য হঠাৎ কেন? বাসা চিনলো কি করে? কি জন্য এসেছে? কোন পিছুটানে নয়তো? কিন্তু আজ লাবণ্যর সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিট কথা বলার কোন উপায় নেই মারজুকের।
ইসলাম মানার পর থেকে গায়রে মাহরাম নারীদের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলেছে। হসপিটালে মহিলা ডাক্তারদের সাথে প্রয়োজনে কথা বলতে হয়। কিন্তু সে সময়ও নিজের গাম্ভীর্য্য বজায় রেখে কথা বলে এসব ভাবছে আর হাটছে।
নাবিলা ঝটপট সুজির একটা পিঠা বানিয়ে নিলো, নুডুলস্ করলো, চা বানালো। ঘরে কিছু ফল ছিলো সেগুলো কেটে ট্রেতে সাজিয়ে নিলো।
নাবিলা সেগুলো নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো। লাবণ্য বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। নাবিলার দিকে তাকিয়ে বললো, বাসাটা তো বেশ সুন্দর সাজিয়েছো!
-নাবিলা মুচকি হাসলো।
-তোমার এখন কয় মাস চলছে?
-জী সাত মাস।
-বিয়ে হলো কতদিন?
-নাবিলা কিছু বলতে নিলেই বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। নাবিলা দরজা খুলতে নিলেই লাবণ্য বললো, দাঁড়াও আমি খুলছি। মারজুক এসেছে মনে হয়। নাবিলা ওখানে থ’ মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। এই মেয়েটা একটু বাড়াবাড়ি করছে বলে নাবিলার মনে হলো।
লাবণ্য দরজা খুলতেই মারজুক নাবিলা ভেবে হাসি দিতে গিয়ে লাবণ্যকে দেখে থমকে গেলো। দৃষ্টি নিচের দিকে দিয়ে সালাম দিয়ে রুমে ঢুকে দরজা আটকালো।
মারজুক নাবিলার দিকে তাকিয়ে ওর অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করলো। নাবিলা একবার মারজুকের দিকে তাকিয়ে আবারো নিচের দিকে দৃষ্টি দিলো। নাবিলার এ আচরণে মারজুকের বুকের কোথাও গিয়ে একটা ধাক্কা লাগলো।
লাবণ্য এসে সোফায় বসতেই মারজুক অন্য সোফাতে বসতে বসতে বললো,, কেমন আছিস?
-এইতো ভালো। তুই?
-আলহামদুলিল্লাহ!
-কতদিন পর তোকে দেখছি বলতো? আমি তো ভেবেছি তুই কোনদিনই বিয়ে করবিনা।
– কেন এমন ভাবার কি আছে? তোরা সবাই বিয়ে করে নিজ নিজ জায়গায় স্যাটেল হতে পারলে আমি কেন পারবোনা?
-লাবণ্য কিছুটা মন খারাপ করে বললো, তা ও ঠিক। তুই কিন্তু অনেক বদলে গেছিস! তুইতো পাক্কা হুজুর হয়ে গেছিস দাঁড়ি রেখে।
বেশভূষাও সব পাল্টে গেছে।
-দাঁড়ি রাখা নবীর সুন্নাত। একজন মুসলমান হিসাবে ইসালমকে যতটুকু মানতে হয় আমি ততটা মানার চেষ্টা করছি।
এমনিতে বয়স তো আর কম হচ্ছেনা। যুবক থেকে তারুন্যে চলে এসেছি। আর তাছাড়া জীবন তো আর একজায়গায় থমকে থাকেনা। জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় পেরিয়ে গেছি।
-আমি কিন্তু নিজেকে একদম চেন্জ করতে পারিনি। সেই আগের মত ছটপটে রয়ে গেছি। কিন্তু তুই আর আজিম অনেক বদলে গেছিস।
-তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা বাচ্ছাদের আনিস নি কেন?
-ওদের সাথে করে হাটতে গেলে আমার অস্বস্তি লাগে। ওদের বাবাই ওদের সামলায়। আমি পারিনা বাচ্চাদের সামলাতে।
-মা হয়ে একথা বলছিস?
-আরে বাদ দে! তা দিনকাল কেমন যাচ্ছে তোর?
-আলহামদুলিল্লাহ! অনেক ভালো যাচ্ছে। তোর কথা বল কি করছিস ওখানে? ডাক্তারি কমপ্লিট করেছিস?
-হুম ওখানেই একটা হসপিটালে এখন জয়েন আছি।
নাবিলার পুরো মন ঈর্ষায় জ্বলে যাচ্ছে। এই মেয়েটা এতো হ্যাংলার মত কথাবার্তা কেনো বলছে? আবার বলে বাচ্চা সামলাতে নাকি অস্বস্তি লাগে। এটা মা নাকি অন্য কেউ? আর আমার উনি কি সুন্দর করে কথা বলছে। যদিও দৃষ্টি নিচের দিকে আছে তারপরও!
-কিছু সময় ভেবে লাবণ্য বললো,, তা বিয়ে করবিনা করবিনা করেও আঙ্কেল আন্টির অমতে বিয়ে করলি কেন? জানিস তারা কেমন কষ্ট পাচ্ছে! তুই তাদের একমাত্র ছেলে!
-মারজুক কি বলবে ভেবে পেলোনা। তোকে আমার বাবা পাঠিয়েছে তাইনা লাবণ্য?
-লাবণ্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, না না আঙ্কেল আমাকে পাঠায়নি। আমি নিজে থেকে এসেছি।
-মিথ্যা বলবিনা। মিথ্যা বলা আমার পছন্দ নয়।
যে তুই নিজে কখনো এই এতো বছরে আমার সাথে দেখা তো দূরের কথা কখনো কথা বলিস নি, আজ তুই এভাবে হুট করে আমার বাসায় চলি এলি তার তো কোন না কোন কারণ নিশ্চয় আছে এটা আমি তোর ফোন পেয়েই বুঝেছি।
-লাবণ্য মাথা নিচু করে বললো, হুম আঙ্কেলই আমাকে পাঠিয়েছে। আমি যেন তোকে একটু বুঝায়, যাতে তুই এই সম্পর্ক ছেড়ে তাদের কাছে ফিরে যাস।
-মারজুক নাবিলার দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর চোখ পানিতে ছলছল করছে।
মারজুক বললো, শুন লাবণ্য, আসলে বাবা মায়ের পছন্দের সাথে আমার মিল ছিলো না। তাদের পছন্দ ছিলো অতি আধুনিকা বড়লোক আর শিক্ষিত মেয়ে। আর আমার পছন্দ হয়েছে দ্বীনদারী, শিক্ষিত, নম্র, ভদ্র সাধারণের ভিতর অসাধারণ এই রমণীকে বলে নাবিলার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখালো। হ্যা তার জীবনের একটা দুঃসহ অধ্যায় আছে। কিন্তু সেখানে নাবিলা পুরোপুরি পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু সে কারণে সে যে একটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেনা৷ তা তো হতে পারেনা।
বাবা মায়ের পছন্দে করলে হয়তো আমার ঐর্শয্যের অভাব হতোনা । তাদের মান সন্মান উঁচু হতো তাদের সমাজে।
কিন্তু নাবিলাকে পেয়ে আমি তার থেকেও মহামূল্যবান কিছু পেয়েছি। এ আমার অর্ধাঙ্গীনি! সবসময় এমন কাউকে চাইতাম। আমি আমার সুখ খুঁজে নিয়েছি। ওকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিন আমার মনে হয়েছে ও আমার হাজার বছরের খুঁজে চলা ক্লান্ত চোখের হঠাৎ পাওয়া সুখ। সত্যি ওকে বিয়ে করে আমি ধন্য। এই মেয়েটা আমায় শিখাচ্ছে কিভাবে আমি পরকালে জান্নাতে যেতে পারবো, কিভাবে দুনিয়াদারি মায়ায় না পড়ে জাহান্নামের আগুন থেকে আমি বাঁচবো, কিভাবে ইসলামের ছায়াতলে নিজেকে একটু একটু করে মেলে ধরবো।
-লাবণ্য বললো, তারপরেও বাবা মায়ের মনে কষ্ট দেয়া কি….
-প্লিজ লাবণ্য এইসব ব্যাপার নিয়ে আর কিছু বলিস না! আর ভালো লাগেনা।
মারজুক এতক্ষণ ভদ্রতা রক্ষা করে কথা বললেও এখন আর পারছেনা। এভাবে লাবণ্যর সাথে কথা বলা কিছুতেই ঠিক হচ্ছেনা। তার উপর সে এসেছে বাবার হয়ে ওকালতি করতে।যার জন্য না চাইতে মেজাজ চটে গেছে। আর তাছাড়া ওর বেশভূষা দেখলেও কেমন লাগবে। আবার পাশে নাবিলা দাঁড়িয়ে আছে। কে জানি মেয়েটা কি ভাবছে? এমনিতেও লাবণ্যর শেষের কথাগুলো ওর কতটা লেগেছে কে জানি!
মারজুক লাবণ্যকে পরিপূর্ণ এড়িয়ে যেতেই বললো, তোরা কথা বল। আমার এক্ষুনি হসপিটালে যেতে হবে! ভদ্রতা রক্ষার্থে বললো,, দুপুরে কিন্তু খেয়ে যাবি।
লাবণ্য বেশ বুঝতে পারছে মারজুক তাকে ইগনোর করছে। তাই নিজেও পরিস্থিতি বুঝে বললো, না আমিও এক্ষুণি চলে যাবো। অনেকদিন তোদের সাথে দেখা হয়নি, কথা হয়নি তাই হুট করে চলে এলাম। এখন যেতে হবে মার্কেটে কিছু কাজ আছে বলে মারজুকের আগেই লাবণ্য বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
যাওয়ার আগে মারজুককে বললো, যেই জন্য এসেছি এখানে এসে জানলাম আমি ভুলে ছিলাম। তুই নাবিলার সাথেই ভালো থাকবি আমি জানি।
ভালো করে খেয়াল রাখিস এখন ওর দিকে। আর এভাবে একা একা বাসায় থাকা রিস্কি হয়ে যাবে। কোন কাজের মেয়ে রাখতেও তো পারিস?
-কাজের লোক খুঁজে পাচ্ছিনা। তবে কিছুদিন পরে মার্জিয়া চলে আসবে।
-ওহ আচ্ছা। নাবিলাকে জড়িয়ে বললো, ক্ষমা করে দিও নিজের অজান্তে হয়তো তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
নিজের খেয়াল রেখো। আর পাগলটাকে কখনো কষ্ট দিওনা। অতিরিক্ত চাপা স্বভাবের কারণে জীবনে অনেক কিছু সাফার করেছে এবার তুমি একটু ওকে পূর্ণতা দিও বলে লাবণ্য বেরিয়ে গেলো।
লাবণ্যর পিছন পিছন মারজুক ও বেরিয়ে গেলো। এই মুহুর্তে নাবিলার সামনে থাকা কোনভাবে ওর পক্ষে সম্ভব নয়।
সেদিন রাতে ফিরার সময় মারজুক নাবিলার জন্য কাশেম বিন আবু বকরের জ্যোৎস্না রাতে কালো মেঘ উপন্যাসটা নিয়ে আসলো। মারজুক এই কয় মাসে বেশ বুঝে গেছে নাবিলাকে কেউ যদি কোন বই উপহার হিসাবে দেয় তখন রাগারাগি বা মন খারাপ যাই থাকুক না কেন, এক নিমিষে সব উধাও হয়ে যায়।
কলিংবেল চাপ দিতে নাবিলা দরজা খুলে সালাম দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মারজুক বুঝলো সমস্যা গুরুতর।
মারজুক রুমে গিয়ে দেখলো আজ নাবিলা আগেই চেন্জ করার জন্য জামাকাপড় গুলো বের করে রেখেছে৷ অন্যদিন হলে নাবিলা মারজুকের টাওয়াল এগিয়ে দিতো৷ যা যা লাগে সব দাঁড়িয়ে থেকে করতো কিন্তু আজ পুরো উল্টো।
মারজুক ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই নাবিলা চা নিয়ে রুমে আসলো। চা টেবিলে রেখে বেরিয়ে যেতে নিলেই মারজুক বলে উঠলো, আজ বোধহয় কারো মনের আকাশে একটুখানি মেঘ জমেছে?
-আজাইরা কথা বলবেন না।
-কি হয়েছে তোমার?
-আমার আবার কি হবে?
-কোনো কারণে কি মন খারাপ?
-না বলে নাবিলা বেরুতে নিলেই মারজুক বলে উঠলো, তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি গ্রহন করলে খুশি হবো।
-নাবিলা রঙিন কাগজে মলাট বাঁধা বইটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
মারজুক বুঝলো এতো সহজে উনার রাগ ভাঙবেনা।
রাতে খাওয়ার পরে খাটে বসে মারজুক ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো। নাবিলা ওপাশ ফিরে শুয়ে ছিলো। আজ প্রয়োজন ছাড়া মারজুকের সাথে একটা কথাও বলেনি। খাবার টেবিলেও চুপচাপ খেয়ে উঠে এসেছে। মেয়েটা চুপচাপ থাকে ঠিক আছে কিন্তু এতটাও চুপচাপ থাকেনা।
কিছু সময় পর নাবিলা এপাশ ফিরে বললো, আপনার যে মেয়েবন্ধু আছে কখনো তো বলেন নি?
-আচ্ছা ম্যাডামের তাহলে এজন্যই রাগ হয়েছে।
-বলেন নি কেনো?
-সেরকম সময় এবং সুযোগ হয়তো হয়ে উঠেনি।
তোমাকে বলা উচিত ছিলো কিন্তু বলতে পারিনি।
-কাহিনীটা কি বলবেন?
-কাহিনী আর কি, লাবণ্য আমার কলেজ জীবনের বন্ধু ছিলো। তখন আমি জানতাম না মেয়েদের সাথে ফ্রি মাইন্ডে মেশার ভয়াবহতা কতটুকু। যখন থেকে জানি তখন থেকে নিজেকে গুঁটিয়ে নিয়েছি এসব থেকে।
বন্ধু বললে ভুল হবে, লাবণ্য তার থেকেও একটু বেশি ছিলো আমার জীবনে। অনেকটা পছন্দ করতাম আমি ওকে। কিন্তু নিজের চাপা স্বভাবের জন্য হারিয়ে ফেললাম। আগে আমার আফসোস হতো লাবণ্যকে হারানোর জন্য। মাঝেমাঝে আল্লাহর কাছে অভিযোগ ও করতাম ওকে আমার করে না পেয়ে। কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝতে পেরেছি আল্লাহ সেদিন আমাকে ঠকায়নি, তোমার মত মেয়েকে পাবো বলে সেদিন লাবণ্যকে হারিয়েছি। সেইজন্য প্রতিনিয়ত মহান রবের কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি।
কারণ আল্লাহ কখনো তার বান্দার খারাপ চাইনা। তিনি তো সর্বোত্তম পয়সালাকারী।
জানি তোমার খারাপ লাগছে তোমার হাজবেন্ডের মেয়েবন্ধু আছে জেনে। কিন্তু বিশ্বাস করো, ওর বিয়ের পর থেকে কখনোই আমার সেভাবে যোগাযোগ বা কথা হয়নি। আজ ও যেঁচে আমার বাসায় এসেছে, এখন আমি যদি তাকে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতাম ব্যাপারটা ওতো ভালো হতোনা। তবে আমি যদি জানতাম ও বাবার কথায় এখানে এসেছে তাহলে ওর সাথে ভুল করেও কথা বলতাম না।
–
-কথা বলবে না আমার সাথে? এখনো আমাকে বিশ্বাস হচ্ছেনা?
-আপনাকে আমি কখনোই অবিশ্বাস করতে পারবোনা। কারণ যে মানুষ আমার বিপদের সময়ে আমার হাত ধরেছে সে আর যাই হোক আমার বিশ্বাসে আঘাত করবে না।
আর কথা না বলার কি আছে? আপনি তো দোষের কিছু করেন নি! তবে এটা ঠিক আপনাকে ওর সাথে কথা বলতে দেখে আমার একটু খারাপ লেগেছে। মনে হয়েছে আপনি আমাকে কোনভাবে ঠকিয়েছেন। আমার অসহায়তার সুযোগে। কিন্তু এখন আর সেই খারাপ লাগাটা নেই। এবং আপনার প্রতি যে ভুল ধারণা ছিলো তাও কেটে গেছে।
-তাহলে একটুখানি হাসির ঝিলিক দেখাও!
-নাবিলা একটু শব্দ করে হেসে মারজুকের হাতের উপর মাথা দিয়ে দুই হাতে ওকে জড়িয়ে ধরলো। আজ বিনা কারণে আপনাকে আমি ভুল বুঝেছি প্লিজ ক্ষমা করে দিবেন!
-দূর পাগলী। ভালোবাসার মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে হয় বুঝি? আর দোষ তো আমারও ছিলো। আমি যদি তোমাকে আগেই সব বলতাম তাহলে তো আর এই ভুল বুঝাবুঝিটা হতো না।
-আচ্ছা যান, ভুলে ভুলে কাটাকাটি। আর কোন মান অভিমান রাখার দরকার নেই।
-মারজুক নাবিলার বাচ্চামো কথায় হেসে দিয়ে ওকে পরম আবেশে সাবধানতার সাথে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো……
চলবে……….