#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
২৩তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় মুনতাসির আহমেদ বাহিরে থেকে এসে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, তুমি কাল গিয়ে মেয়েটাকে একটু দেখে এসো।
-মেয়েকে দেখে আসবো মানে? মার্জিয়া তো মাত্র কাল গেলো ওর বাসায়।
-আমি মার্জিয়ার কথা বলিনি!
-তাহলে কোন মেয়ের কথা বলছো? সেলিনা বুঝতে পারছে তার স্বামী নাবিলার কথাই বলছে। তারপরও না জানার ভান করে মানুষটার মুখ থেকে স্পষ্ট করে শুনার অপেক্ষা করছে।
-বুঝতে পারছো না নাকি না বুঝার ভান করছো?
-আশ্চর্য্য তো! আমার মেয়ে তো একটাই। এখন তুমি না বললে কি করে জানবো তুমি তোমার কোন মেয়ের কথা বলতেছো।
-মুনতাসির সাহেব রাগতে গিয়েও রাগলেন না। নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে বললেন নিজে নিজে।
সেলিনা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের কাজে যেতে নিলেই মুনতাসির আহমেদ বললেন, আমি নাবিলাকে দেখে আসার কথা বলছি।
সেলিনা ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলো। আনন্দে কথা বলার ভাষা হারিয়ে গেছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এতদিন শুধু আল্লাহর কাছে এই একটা কথাই বলে গেছে, আল্লাহ যেনো মানুষটার মনে একটু বুঝ দেয়।
আজ আল্লাহ তার মনের কথা শুনেছেন। সত্যি আজ আবারো প্রমাণ পেলাম আল্লাহ কখনো তার বান্দাকে নিরাশ করে না। চাওয়ার মতো করে চাইলে তিনি অবশ্যই তার বান্দাকে তার চাওয়া মিলিয়ে দেয়।
কি বললে আবার বলো?
-মুনতাসির আহমেদ চোখ রাঙিয়ে বললো,, ফাযলামি করতেছো আমার সাথে?
-না আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না।
-কি বিশ্বাস হচ্ছে না?
-তুমি এখন যে কথাটি বললে!
-অবিশ্বাসের মতো কিছুই বলি নি। যা বলেছি যা শুনেছো সবটাই সত্যি।
আর যাওয়ার সময় তোমার ছেলের বউয়ের জন্য যে সেটটা বানিয়ে রেখেছিলাম ওটা নিয়ে যেও। আর মার্জিয়াকে সাথে নিয়ে গয়নার সাথে মিলিয়ে একটা শাড়ীও নিয়ে নিও।
-সেলিনা আবেগাপ্লুত হয়ে বললো,, তাহলে তুমিও চলো আমাদের সাথে। আমাদের বলা কথাগুলোর জন্য মেয়েটার কাছে ক্ষমা ও চেয়ে নিবো সেই সাথে ছেলেটাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় নিয়ে আসবো। এ মুহূর্তে মেয়েটার পাশে আমাদের সাপোর্ট থাকাটা খুব দরকার। সময় তো আর খুব বেশি নেই।
-কাল আমি যেতে পারবো না কাল আমার মিরপুরে যেতে হবে।
-তাহলে পরশু যাই।
-বললাম না আমি যেতে পারবো না। কথা বেশি বুঝো।
আর তুমি যদি বুঝিয়ে বলে তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারো তবে নিয়ে এসো। আমি ওই বাসায় যেতে পারবোনা বলে মুনতাসির আহমেদ ভিজে উঠা চোখটা মুছার জন্য অন্যদিকে তাকালো।
-বৃথা কেন লুকাচ্ছো চোখের পানি? তোমাকে তো আমি বুঝি! চলো না আমরা দুজনে যাই। তোমার কেনা জিনিস তুমি নিজেই বউমার হাতে দিবে। ওরা ও খুব খুশি হবে। যত কিছু হোক তুমি গেলে দেখবে ছেলেটা ও আর অভিমান করে থাকতে পারবে না।
-সেলিনা আমি যাবোনা বলেছি না। আর সবচেয়ে বড় কথা তোমার ছেলে আর বউয়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর শক্তি আমার নেই। সেই যোগ্যতা আমার চলে গেছে। যেদিন মনে হবে আমি ছেলের সামনে দাঁড়ানোর মতো মন মানুষিকতা হয়েছে সেদিন আমি যাবো বলে হনহন করে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
মারজুকের সাথে নাবিলার সেদিনের পর থেকে সম্পর্ক অনেকটা নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিলো। মারজুক আগের মতোই নাবিলাকে রান্নায় হেল্প করে, কাপড় ধুয়ে দেয়, একসাথে খেতে বসা, নাবিলার ঠিকমতো যত্ন নেয়া সবকিছু ঠিক ছিলো। তবুও নাবিলার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনকিছুই ঠিক চলছে না। কোথাও যেনো কিছু একটা হারিয়ে গেছে ওদের মধ্য থেকে। হসপিটাল থেকে ফিরে আসার পরে একসাথে চা খেতে খেতে গল্প করাটা এখন আর তেমন জমে উঠে না। প্রয়োজনের তুলনায় মারজুক কথা এখন একেবারেই কম বলে। মারজুকের হাসিমুখটা আজকাল আর খুব একটা দেখা যায় না। এ ব্যাপার গুলো নাবিলার কাছে ভালো লাগে না। না হয় একটা কথা বলেই ফেলেছি পরিস্থিতির চাপে পড়ে তাই বলে এতটা অভিমান করতে হয়?
উনি কি বুঝে না এ ব্যাপারগুলো আমাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছে?
উনার এই কঠিন নিরবতা মেনে নেয়া যে সম্ভব হচ্ছে না।
এ নিয়ে মারজুকের সাথে কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু মারজুক কিছুই বলেনি।
নাবিলা আজকেও রাতে যখন খেতে বসেছে তখন মারজুককে উদ্দেশ্য করে বললো, মানুষ এভাবে পাল্টে যায় কি করে?
-খেতে খেতে মারজুক বলে, কিভাবে পাল্টে যায়?
-আপনি আর আগের আপনি নেই!
-আপনি আর আগের আপনি নেই মানে কি? প্রতিদিন এক কথা বলার কোন মানপ আছে? আমি কি পাল্টে গেছি নাকি কারো সাথে? মারজুক কট্টর বাসায় বললো।
-আমি তা বলিনি!
-তবে কি বলেছো?
-আমি যে ডাক্তার সাহেবকে চিনতাম তার তার কাছ থেকে পাই না।
কারণে অকারণে যে মানুষটা আমার জন্য আমার পছন্দের বইগুলো নিয়ে আসতো না বলে সে গত একমাসে আমায় একটা বইও গিফট করেনি, তারপরেও বলবেন আগের মতই আছেন?
-আমি তো আগের মতই এখনো আছি! আর এখন তুমি নিজে নিজে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গেছো সেখানে আমার কথার কি কোনো দাম আছে?
-হুম আপনি আছেন কিন্তু আপনার মাঝের সে নরম মনের হাসিখুশি মানুষটাকে আমি খুঁজে পাই না। আজকাল আপনি কথায় কথায় রেগে যান। কেমন যেনো হয়ে গেছেন! আমি আপনাকে না এখন বুঝতে পারি না!
আর আমি এমন কি সিদ্ধান্ত নিলাম? একটা কথা বললাম বলে কি তা ফলে গেছে?
-এতো বুঝে লাভ নেই! খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দাও!
-বুঝছি তো এখন আর আমাকে ভালো লাগে না! দেখতে তো এখন আগের থেকে অনেক বাজে হয়ে গেছি! বুঝি তো আমি!
-আজকাল অনেক বেশিই বুঝো তুমি!
মনে মনে বলে,, তুমি কি জানো দিন দিন তোমার সৌন্দর্য্য কত বেশি বেড়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট হয় তোমার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে!
-অনেক বেশি বুঝি না তো! একটু একটু! আপনাকে আমার কেমন জানি রহস্যজনক মনে হয়। এই কতো সহজ সরল মানুষ আপনি আবার কখনো জটিল ধাঁধা মনে হয়। আপনি এমন কেনো?
-এতো কথা বলতে শিখে গেছো?
-আমি এমনই!
-কখনো তো দেখিনি এমন। এখন কথা কম বলে খাওয়ায় মন দাও! খাবার খেতে বসে এতো কথা বলা মোটেও ঠিক না।
-না হয় একটা ভুল করেছি তাই বলে এভাবে শাস্তি দিবেন? ভুল তো মানুষেই করে! আপনি ওই মুহুর্তে আমার জায়গায় থাকলে কি করতেন বলেন?
-আমি তোমাকে কোন শাস্তি দিচ্ছি না নাবিলা! আমার মন যদি তুমি একটুও বুঝতে পারতে তাহলে ওই কথা তোমার মুখ দিয়ে বের হতো না।
এখন অযথা কথা বলে সময় নষ্ট করো না।
এইতো আছি! অনেক ভালো আছি। আর স্বাভাবিক আচরণই তো করছি কোন রাগ বা খারাপ ব্যবহার তো করছি না।
-আপনি হয়তো জানেন না রাগের থেকেও অভিমান কত খারাপ একটা জিনিস। রাগ করলে মানুষ তৎক্ষনাৎ তা প্রকাশ করে ফেলে। আর তখন তার রেশটা প কেটে যায়। কিন্তু অভিমান জিনিসটা এতো খারাপ যে, আস্তে আস্তে একটা মানুষকে শেষ করে দিতে পারে। প্রতিনিয়ত ভিতরে ভিতরে গুমরে মরতে হয়। এটাও মতো কষ্ট আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
-এতো জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলবে না। আর আজাইরা সব চিন্তা বাদ দাও। পরে এসব ভেবে ভেবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তো আমাকেই দৌড়াতে হবে।
-আপনি না… আপনি একটা…
-মারজুক চোখ বড় করে তাকাতেই নাবিলা চোখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিলো।
বিড়বিড় করে বললো, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম কেউ বুঝে না৷ যখন থাকবো না তখন বুঝবেন! এখন সহ্য হচ্ছে না তখন বসে বসে কাঁদলেও লাভ হবে না।
-আবার বিড়বিড় করে কি বলছো?
-কখন কি বললাম?
-শান্তিতে কি একটু খাবারটাও খেতে দিবে না? এমন সময় মারজুকের ফোন বেজে উঠলো।
মারজুক ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মার্জিয়া সালাম দিলো।
-খাবার খাচ্ছি সেজন্য সালামের জবাব দিতে পারছি না। কেমন আছিস?
-আলহামদুলিল্লাহ। তোরা কেমন আছিস?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আজিম আর আয়ান কেমন আছে?
-ওরা ও ভালো আছে। তোর কি কিছু হয়েছে?
-না তো কেনো?
-না কন্ঠে কেমন রাগের ভাব মনে হচ্ছে? ঝগড়া টগড়া করেছিস নাকি বউ জামাই মিলে?
-তোরা মেয়েরা সবসময় একটু বেশি বুঝিস!
-মার্জিয়া হাসি চেপে বললো, থাক আর বলতে হবে না। যা বুঝার বুঝে গেছি।
-মার্জিয়া মেজাজ খারাপ করবি না!
-তোর মেজাজ খারাপ করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। যে জন্য ফোন দিয়েছিলাম, কাল আমি তোর বাসায় আসতেছি?
-ভালো তো!
-আমি একা আসছি না,, কাল আমার সাথে আরো কেউ একজন আসবে।
-মানে আর কে আসবে? আজিম?
-দূর বোকা আজিম আর আমি তো একই ওর কথা আলাদা করে বলবো কেনো?
-তাহলে কে আসবে?
-একজন স্পেশাল মানুষ আসবে?
-আমার আপু এতো ভনিতা না করে আপনি কি বলবেন সেই স্পেশাল মানুষটা কে?
-অনুমান করে বল তো কে?
-থাপ্পড় চিনিস? ফাযিল মেয়ে! তুই কাকে আনবি? কে আসবে? আমি কি করে বলবো? আমার অনুমান ক্ষমতা অতো নেই।
-আম্মু আসবে আমার সাথে।
-মারজুক ভুল শুনেছে মনে করে আবারো বললো, মা.. মা.. মানে কে আসবে বললি?
নাবিলা আগ্রহ নিয়ে মারজুকের দিকে তাকালো।
-আরে আম্মু আসবে!
-সত্যিইই? আমার বাসায় বাসায় আসবে?
-হুম সত্যি!
-মার্জিয়া তুই আমার সাথে হেয়ালি করছিস না তো?
-আরে আমি হেয়ালি করতে যাবো কেনো? আম্মু একটু আগে আমাকে ফোন করে বলেছে কাল সকালে আমার সাথে নাবিলাকে দেখতে আসবে।
-আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তারা দুজনে আসবে তো?
-মার্জিয়া কন্ঠ ছোট করে বললো, না।
-ওহ।
-আচ্ছা আমি এখন রাখি। আয়ান খুব বিরক্ত করছে।
-আচ্ছা ভালো থাকিস।
কথা বলা শেষ করে মারজুক ফোন হাতে নিয়ে একদৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার সাথে ওর চেহারায় উজ্জ্বল একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ওর যে কি আনন্দ হচ্ছে তা কাউকে বলে বুঝানোর মতো না। আজ অনেকদিন পর যেনো ওর মনটা প্রাণ ফিরে পেলো।
-নাবিলা ওর মনের অবস্থা পরখ করে বললো, কি হলো, কে আসবে কাল? আপনার মুখ দেখি আনন্দে কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। স্পেশাল কেউ নাকি?
-মারজুক মুচকি হেসে বললো,, হুম আমার জীবনের সবচেয়ে দামি স্পেশাল একজন মানুষ।
-নাবিলা খুশি হয়ে বললো,, কে?
-তোমাকে বলা যাবে না।
-কেনো?
-সব কথায় কেনো,, কেনো,, করো কেনো? জানো না সবকথা সবাইকে বলা যায় না।
-মন খারাপ করে,, আমি বুঝি আর সবার মতই।
-সব কথায় মুখটাকে এরকম বাংলার প্যাঁচের মত করে নাও কেনো?
-আপনি খুব খারাপ! খুব খারাপ! আমি ঠিকই বুঝছি আপনি বদলে গেছেন! এই আপনি আর সেই আপনির মাঝে কোন মিল নেই বলে খাবার শেষ করে নাবিলা টেবিল গুছাতে লাগলো।
মারজুক নাবিলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মনে মনে বললো, কালকের পর আর কোন কষ্ট বা কান্না তোমার থাকবে না। কাল তোমার একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্নটা পূরণ হতে চলছে। আজকের মত একটু ভালো করে অভিমান দেখিয়ে নাও অভিমানী…….
চলবে……