#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
২৪তম পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু
মারজুক সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আজ শুক্রবার তাই হসপিটালে যাওয়ার তেমন তাড়া নেই। শুক্রবারে প্রাইভেট ভাবে যে মেডিকেলে বসে সেখানে ও নিষেধ করে দিয়েছে আজ যাবে না বলে।
নামাজ পড়েই বাজারে গেলো। আজ মায়ের সব পছন্দের খাবার ও নিজে রান্না করবে। বাজার করে এসে নাস্তা বানানোর কাজে হাত দিলো। আজ সকালের নাস্তায় ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা আর বেগুন ভাজা হবে। মায়ের প্রিয় খাবার। আর এটা অবশ্য নাবিলার ও প্রিয় একটা খাবার সবদিক ভেবেই এটা করা হয়েছে।
নাবিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মারজুকের ব্যস্ততা দেখছে আর মাঝে মাঝে দু একটা ছোটোখাটো কাজ করছে৷ মারজুক আজকাল ওকে ভারি কোনো কাজে হাত লাগাতে দেয় না। কষ্ট হলেও নিজেই করে।
নাবিলা অবশ্য এ নিয়ে অনেক ঝামেলা করে । এভাবে বসে খেতে খেতে আমি তো এমনিই রোগা হয়ে যাবো। অবশ্য পা গুলো তো এখন ফুলে একাকার অবস্থা। ফ্লোরে পা রেখে হাটতে খুব কষ্ট হয়। সোহানা ম্যাডাম সেদিন বলেছে, ডেলিভারির ডেট যত এগিয়ে ততই এখন শরীরের নানা রকম সমস্যা দেখা দিবে। তাই এসব নিয়ে নাবিলা এখন আর ভাবে না।
নাবিলা মাঝে মাঝে মারজুককে বলে, কত মানুষেরই তো এ মুহুর্তে পাশে থাকার কেউ থাকে না তারা কি নিজের কাজ নিজে নিজে করে না? তারা কেউ কি না খেয়ে থাকে? কিন্তু এ মানুষটাকে বোঝানো অসম্ভব!
তার এক কথা নাবিলা অন্তত এই একটা মাস কোন ভারী কাজ করবে না। কোনো ধরনের রিস্ক ও নিতে পারবে না।
এইতো সকালে বাজার থেকে দেশী মাগুর মাছ এনেছে। নাবিলা সেগুলো কাটতে গেলেই মারজুক ওকে ঠেলে সরিয়ে দেয়।
নাবিলা বললো,, এ মাছগুলো পরিস্কার করা খুব সহজ নয়। এগুলো ভালো করে পরিস্কার না হলে দেখতে খারাপ লাগে।
-ওমনি মারজুক ধমক দিয়ে বললো, বলেছি না কথা কম বলতে। আমি সব পারবো অভ্যাস আছে।
-তারপরেও….
-কপট রাগ দেখিয়ে বললো,, এতই যখন কাজ করার ইচ্ছে তখন তুমিই সব করো। আমি গিয়ে বসে থাকি।
নাবিলা আর কোন কথা না বলে ওখান থেকে চলে এসে ঘর গুছানো শুরু করলো। নাবিলা বুঝতে পারছেনা আজ এমন কে আসবে যার জন্য এতো এতো আয়োজন।
গরুর মাংসের ভুনা , দেশী মুরগী , মাগুর মাছের ঝোল করবে, আবার ছোটো মাছও এনেছে পুঁইশাক দিয়ে রান্না করবে বলে, কুমড়োর ফুল এনেছে ডিম দিয়ে ভাজি করবে, তার সাথে সজনে পাতার ভাজি আর সিমের ভর্তা। নাবিলা বুঝে পায় না এই লোক এতো কিছু একা কি করে করবে?
তাই নিজের মনকে না বুঝাতে পেরে ঘর গুছিয়ে আবারো আসলো কিচেনে।
ততক্ষণে মারজুক টেবিলে নাস্তা নিয়ে এসেছে।
নাবিলাকে দেখে বললো, টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়েছে! খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো!
-নাবিলা মন খারাপ করে বললো, মনে হচ্ছে আমি আপনাকে বিরাট ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি এমন ভাবে কথাটা বললেন। আমি কি আপনার বোঝা হয়ে থাকতে চেয়েছি?আর আমি কি আপনাকে এতো ভারি নাস্তা বানাতে বলেছি? আমার তো পাউরুটি আর কলা হলেই হয়ে যেতো।
-আচ্ছা তুমি সবসময় কথা এতো বেশি কেন বলো? চুপচাপ করে কি খাওয়া যায় না? টেবিলে বসতে বসতে মারজুক বললো।
আর খাবারটা তোমার জন্য বানানো হয়নি, বললাম না স্পেশাল একজন আসবে তার জন্য।
-নাবিলার মন আরো খারাপ হলো। এরকম স্পষ্ট কথা না বললে কি তার হতো না? তারপর বললো, কথাটা কি আপনি আমাকে অপমান করে বলেছেন?
-মারজুক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। মানে? অপমান করলাম কোথায়?
-যেভাবে বললেন আমার কাছে তাই মনে হয়েছে!
-আজকাল তুমি সবকিছুতে বেশি বুঝো। আর কাল রাতে না তুমি আমার সাথে রাগ করে ছিলে। এখন সেই রাগ কোথায় চলে গেলো?
-নাবিলা কিছুটা ইতস্তত করে বললো, সমস্যা তো এখানেই! আমি কারো উপর বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। না হলে তো আমার বয়ে গেছে মানুষের সাথে কথা বলতে!
-নাবিলার এমন কথায় মারজুক শব্দ করে হেসে উঠলো।
-যাক বাবা বাঁচলাম! অবশেষে হাসাতে পারলাম! অনেকদিন পরে আপনার মনের আকাশে রোদ উঠেছে!
-বেশি পন্ডিতি করতে হবে না! খাওয়ায় মনোযোগ দাও! কঠিনস্বরে মারজুকের জবাব।
নাস্তা শেষ করার পরে নাবিলা অনেক জোরাজুরি করে রান্না করার দায়িত্ব নিলো। মারজুক নিষেধ করতেই বললো,, আমি তো দাঁড়িয়েই রান্না করবো। প্লিজ আপনি বাধা দিবেন না।
অবশেষে মারজুক নাবিলাকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে নিজে পাশে থেকে হেল্প করতে লাগলো। রান্না শেষ হয়ে আসার পর মারজুক নাবিলাকে পাঠিয়ে দিলো ফ্রেশ হয়ে পরনের জামা চেন্জ করে নিতে।
মারজুক রুমে শুয়ে ছিলো, এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ। মারজুক হুড়মুড়িয়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
দরজা খুলতেই মার্জিয়া সালাম দিয়ে ভিতরে চলে আসলো।
মারজুক মাকে সালাম দিয়ে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবেগটাকে কন্ট্রোল করতে না পেরে ওখানেই মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। সেলিনাও ছেলেকে অনেকদিন পর নিজের কাছে পেয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। মা ছেলের এমন মধুর মিলন দৃশ্য দেখে মার্জিয়াও অদূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছলো।
নাবিলা চেন্জ করে বের হতে গিয়ে ড্রয়িংরুমে এ দৃশ্য দেখে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে গেলো। একই সাথে বুকের মধ্যে কাঁপন ধরে গেলো। আজ আবার না জানি কত কথা শুনতে হয় এই ভয়ে নাবিলার চেহারা বিষাদে ছেয়ে গেলো। ও দরজার আড়ালে এসে দাড়ালো। মনে মনে নিজেকে তৈরি করছিলো কিছু অপমানজনক কথা হজম করার জন্য।
মারজুক ওর মাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে নাবিলার জন্য রুমের দিকে আসলো। নাবিলা খাটের একপাশে বসে ছিলো মুখটাকে এইটুকুন করে। মারজুক বুঝলো নাবিলা মাকে দেখে ভড়কে গেছে কিছুটা। মারজুককে দেখে নাবিলা কান্নাভেজা চোখে তাকালো। নাবিলার এমন ব্যবহারে মারজুকের হাসি এসে গেলো।
তা চেপে গিয়ে নাবিলার হাত ধরে বললো, কি হয়েছে?
-নাবিলা মুখ তুলে অসহায়ভাবে মারজুকের দিকে তাকালো।
-কি হলো? আচ্ছা থাক বলতে হবে না। চলো আম্মুর সাথে দেখা করবে।
-উনি আপনার স্পেশাল গেস্ট?
-হুম..কেনো দেখে খুশি হওনি?
-ব্যাপারটা তা নয়!
-তাহলে?
-আপনি আমাকে আগে এই কথাটা বললে এমন কি হতো যে আজ মা আসবে।
-তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
-হুম অনেক বড় সারপ্রাইজড হলাম। টপ করে নাবিলার চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
-মারজুক নাবিলার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মনে মনে বললো,, তোমার এ কান্নাটা কিছু পরে হাসিতে রূপান্তরিত হবে।
সারপ্রাইজ তো এখনো আরো অনেক বাকী! বলে নাবিলাকে হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে আসলো।
নাবিলা ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো। সেলিনা বেগমের সামনে এসে নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে সালাম দিলো। ওর কন্ঠ কাঁপছিলো।
সেলিনা উঠে এসে দুহাতে নাবিলার মুখ তুলে বললো, কেমন আছো মা?
নাবিলার চোখ পানিতে ছলছল করছিলো৷ কিন্তু সেলিনার এমন নরম আচরণে নাবিলা চমকে গেলো।
তাও কন্ঠ স্বাভাবিক করে বললো, জী আলহামদুলিল্লাহ! আপনি কেমন আছেন?
সেলিনা কিছু না বলে নাবিলাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আবারো কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তারপরও আমাদের ক্ষমা করে দিও মা! অনেক বড় অন্যায় করেছি তোমার সাথে। অনেক বড় অন্যায়!
নাবিলা বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। এতো বেশি আনন্দ হজম করতে কেনো জানি খুব কষ্ট হচ্ছে। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? আমি কি এতোটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো। চোখ তুলে একবার মারজুক আর মার্জিয়ার দিকে তাকালো। ওরা দুজনে মিটিমিটি হাসতেছে। নাবিলার এই মুহুর্তে মারজুকের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! প্রচন্ড! এমন মনে হচ্ছে যেনো তাজা চিবিয়ে খায়!
এরা সব জানতো আর আমাকে কিছুই বলেনি!
এতক্ষন যে ভয়ে মনটা কাঁপছিলো এখন সে জায়গায় আনন্দের লহরী বাজছে।
চোখ দিয়ে সমানে চোখের পানি ঝরছে। না এগুলো কষ্টের নয় আনন্দের কান্না! অনেক বেশি ভালোবাসা পাওয়ার কান্না।
সেলিনা ছেলের বউকে ধরছে তো ধরছে ছাড়ার কোন নাম নাই। বিভিন্ন ভাবে নিজেদের অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইছে।
এ পর্যায়ে নাবিলা নিজেই তাকে থামিয়ে দিলো, ছি মা! কি করছেন? আমি আপনার মেয়ের মতো। আর আপনি এভাবে আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন যে নিজের কাছেই নিজেকে ছোট লাগছে। আপনি তো আমার আরেক মা। মায়েরা সন্তানের কাছে কি করে ক্ষমা চাইতে পারে।
আর ভুল তো মানুষেরই হয়। আমার সত্যি আপনাদের উপর কখনো কোনো রাগ ছিলো না। তখন আপনাদের রাগ করাটা তো স্বাভাবিক ছিলো। আমার মতো মেয়েকে কেই বা…
-মারে আর লজ্জা দিস না! ভুলের মধ্যে ডুবে ছিলাম আমরা। আমার ছেলে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
নাবিলা শাশুড়ির চোখ মুছে দিয়ে সোফায় বসালো৷ এর মাঝে মার্জিয়া চা করে নিয়ে আসলো।
মার্জিয়া মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, আম্মু নাবিলা এমনি অসুস্থ! তুমি আর কেঁদে ওকে আরো অসুস্থ বানিয়ে দিও না। আর আনন্দের দিনে এতো কান্নাকাটি কিসের? যা হয়েছে তাকে মনে না রেখে সামনে যা হবে সেগুলোর চিন্তা ভাবনা করো।
সেলিনা নিজের সাথে করে আনা গয়না আর শাড়ীটা নাবিলার হাতে তুলে দিয়ে বললো, এটা তোমার শশুর পাঠিয়েছি তোমার জন্য।
-নাবিলা সেগুলো হাতে নিয়ে বললো, মা এগুলার কোন দরকার ছিলো না। আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া ছিলো আপনাদের ভালোবাসার। আজ তা আমি পেয়ে গেছি এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে?
-ভালোবেসেই তো দিয়েছি এগুলা। তোমার শশুর আরো আগেই এগুলো এনে রেখেছিলো। দেয়ার মতো পরিবেশটা ছিলো না বলে দিতে পারিনি।
-আব্বাকে নিয়ে আসেন নি কেনো মা? তাহলে আমি আরো বেশি খুশি হতাম।
-মানুষটা অনুশোচনায় তোদের সামনে আসতে পারেনি। উনার বলা কথাগুলোর জন্য উনি নিজেই লজ্জিত তাই আসে নি।
তাইতো আমাকে পাঠালো।
-মা আপনার বা আব্বার কারো উপর আমার কখনো কোনো রাগ ছিলো না। আপনি আব্বাকে বলবেন উনি যেনো একবার হলেও দেখতে এসে উনার ভালোবাসার হাতটা আমার মাথায় রাখে। তাহলে আমি অনেক বেশি খুশি হবো।
-বলবো মা।
হাসি খুশিতে অনেক আনন্দের একটা দিন পার করলো ওরা। নাবিলার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন ছিলো আজকের দিনটা।
নাবিলা মনে মনে বললো, ধৈর্যের ফল সত্যিই অনেক মিষ্টি হয়। আল্লাহ ওর জীবনের আরো একটা স্বপ্ন পূরণ করে দিয়েছে। একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন! আল্লাহ! আমার কপালে এতো সুখ সইবে তো?
অনেকদিন পর ওরা মা ছেলে একসাথে একই টেবিলে খেতে বসেছে। সেলিনা এতো এতো খাবার দেখে বললো, তোদের আর কোন কাজ ছিলো না তাই তো? আমি কি বাহিরের কোন অতিথি নাকি যে তোরা আমায় এভাবে আপ্যায়ন করছিস।
-মার্জিয়া বললো, মা তুমি আজ প্রথম তোমার ছেলের বাসায় এসেছো। তাইতো তোমার ছেলে তার মায়ের সব পছন্দের খাবার আজ রান্না করেছে। তোামকে অনেক বেশি ভালোবাসে তো। নয়তো আমি যে এতোবার এ বাসায় এসেছি আমার জন্য তো কখনো এভাবে রান্না করেনি।
-মারজুক হাসতে হাসতে বললো, থাপ্পড় দিয়ে তোর দাঁত সব ফেলে দিবো৷ আমি তোর জন্য কখনো এমন রান্না করিনি?
– করেছিস আর কি না পারতে বলে মার্জিয়া হাসতে লাগলো।
নাবিলা অবাক হয়ে দেখছে৷ অনেকদিন পর এ মানুষটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেনল আর তাদের ছোট্ট বাসাটা ও এই এই প্রথম এতো সুন্দর একটা দৃশ্যের সাক্ষী হলো।
মারজুকের আনন্দ যেনো আর ধরেই না৷
কিন্তু ছেলেরা অতিরিক্ত আনন্দ হোক বা অতি কষ্টে কান্না কোনটাই এরা ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না। তাইতো চেয়েও নিজের ভিতরের আনন্দটা প্রকাশ করতে পারছে না।
দুপুরে খাবার শেষে সেলিনা মারজুককে উদ্দেশ্য করে বললো, আজ তোর বাবা নাবিলাকে আর তোকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে?
এ কথায় নাবিলার হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মারজুক বললো, না আম্মু! আব্বু যতদিন আমায় উনার মুখ দিয়ে বাসায় যেতে না বলে আমি যাবো না।
-তুই তো দেখছি তোর বাবার থেকে কম না। তোরা দুজনেই যদি এভাবেই রাগ দেখাস তাহলে আমি কোথায় যাবো?
-আম্মু আমি কোনো রাগ দেখাচ্ছি না। আমি নিজের সাথে নিজে সেদিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি। যতদিন আব্বু আমাদের যেতে না বলে আমি যাবো না তার বাড়িতে। রাগতো শুধু তার নেই আমার ও আছে!
-মার্জিয়া বললো, ভাইয়া না করিস না। মায়ের কথা শুন।
-প্লিজ মার্জিয়া তুইও শুরু করিস না! আম্মু তোমার যদি নাবিলাকে দেখতে ইচ্ছে করে তুমি এসে দেখে যেও আমি যাবোনা।
-সেলিনা নাবিলার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি কিছু বলো মা। বাবা ছেলের এতো মান অভিমানে আমার তো দিশেহারা অবস্থা হয়ে গেছো।
-নাবিলা মারজুকের দিকে তাকাতে মারজুকের অগ্নিদৃষ্টি দেখে মনে মনে ঢোক গিললো।
-আম্মু আমি যাবো না বলেছি যাবো না। আর তাছাড়া নাবিলার শরীরের কন্ডিশনও এখন তেমন ভালো না। জার্নি এখন ওর না করাটাই ভালো। তুমি এসো মাঝে মাঝে, তাহলেই হবে।
-মার্জিয়া মারজুকের কথার পিঠে বললো, আম্মু ভাইয়া ঠিকই বলেছে৷ ভাবির জার্নি করা এখন মোটেই ঠিক হবে না। আর এখান থেকে যেহেতু হসপিটালটা কাছে তাই এখানেই থাকা ওর জন্য ভালো হবে। আর আমি তো আজ থেকে ভাবির কাছে থাকবোই। তোমার ওতো চিন্তা করতো হবে না।
পরে নাতি বা নাতনি যাই হোক হসপিটাল থেকে সোজা বাসায় নিয়ে যাবে।
মার্জিয়ার কথায় সম্মতি দিয়ে সেলিনা সেদিন বিদায় নিলো। আসার সময় নাবিলা ওর শ্বশুরের জন্য বক্স ভর্তি খাবার দিয়ে দিয়েছে।
সেলিনাকে একা বাসায় ফিরতে দেখে, মুনতাসির আহমেদ পিছনের দিকে চোখ বুলিয়ে বললো, কি ব্যাপার ওদের নিয়ে আসো নি?
-তোমার থেকে তোমার ছেলে কম কিসে? যেমন বাপ ছেলেও তার তেমনই হবে।
-মানে কি?
-তুমি নিজের মুখে না বললে তোমার ছেলে আসবে না।
-ওহ আচ্ছা বলে মুনতাসির আহমেদ একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উনি ভেবেছিলেন ছেলে যতই অভিমানই করুক না মায়ের কথা ফেলতে পারবে না। কিন্তু ছেলেটার যে এবারে বড্ড বেশি অভিমান হয়েছে৷ হবেই না বা কেনো? যে সমস্ত ব্যবহার আমি করেছি অন্য কোন ছেলে হলে তো আরো আগেই বাপ ছেলের সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতো। কিন্তু ছেলেটা তো আমার সাথে এতো কিছুর পর ও কোন বাজে আচরণ ও করে নি।
-সেলিনা হতাশার সাথে বললো, তোমাদের বাপ ছেলের মান অভিমানে মাঝখানে থেকে আমার সব কষ্ট করতে হচ্ছে। না পারছি এদিকে যেতে আর না পারছি ওদিকে যেতে। যত্তসব!! বলে সেলিনা উঠে রুমের দিকে গেলো।
সে রাতে মারজুকের সাথে নাবিলার বেশ রাগারাগি হয়েছে। মায়ের আসার ব্যাপারটা নাবিলাকে কেন বলেনি সেই জন্য৷ তার সাথে মায়ের কথাতে বাসায় কেন যায়নি এসব নিয়েও।
মারজুকের সেদিন বেশ বেগ পেতে হয়েছে নাবিলাকে সামলাতে।
তবে সেদিনের পরে তাদের সংসারে কোন অপূর্ণতা ছিলো না। হাসি আনন্দ পুরো সংসারে ছড়িয়ে পড়েছিলো। যদিও বাবার সাথে মারজুকের অভিমানের পালাটা তখনো শেষ হয়নি। তবে মায়ের কাছে শুনেছে, বাবা নাকি একেবারে হসপিটালে এসে ওখান থেকে তার ছেলের বউকে ঘরে তুলে নিবে। সেলিনা দুদিন পর পর এসে নাবিলাকে দেখে যেতো। আর এটা ওটা উপেদেশ দিয়ে যেতো। নাবিলা নিজেকে নিজে খুব ভাগ্যবান ভাবতে শুরু করলো।
ডেলিভারি ডেটের একদিন ওভার হয়ে গেছিলো। ওরা সবাই টেনশানে পড়ে গেলো। রাতে সোহানা ম্যাডামকে কথাটা জানাতে উনি বললো, হসপিটালে নিয়ে যেতে৷ একটা আল্ট্রা করিয়ে নিতে। অনেক সময় ডেটের গরমিল হওয়ায় ডাক্তারদের দেয়া ডেট চেন্জ হতে পারে।
সেদিন ফজরের পরেই নাবিলার পেটের মধ্যে ছিনছিন করে ব্যথা শুরু হলো। মারজুক মসজিদে গিয়েছে। নাবিলা মার্জিয়াকে ডাক দেয়৷ ব্যথা বেশি থেকে বেশি হচ্ছিলো। মার্জিয়া অবস্থার আলোকে বুঝলো এটা লেভার পেইনই হবে। মার্জিয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে মারজুককে ফোন দিতে ও দ্রুত ছুটে আসে। যদিও বাসায় নরমাল ডেলিভারি হতে পারতো তবুও মারজুক রিস্ক নিতে চায়নি বলে বাসায় রাখে নি।আর তাছাড়া বাসায় তেমন পরিস্থিতিও নেই।
মার্জিয়াকে সাথে করে মারজুক নাবিলাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো। মার্জিয়ার ফোন পেয়ে মারজুকের মা বাবা আর নাবিলার মা বাবা ছুটে আসলো……..
চলবে…