হঠাৎ পাওয়া সুখ পর্ব-৬

0
1115

#হঠাৎ_পাওয়া_সুখ
৬ষ্ঠ পর্ব
লেখা – শারমিন মিশু

নামাজ পড়ার পরে চোখে প্রচন্ড ঘুম চেপে বসেছিলো মারজুকের। কাল সারারাত নির্ঘুম কাটানোর পরে আর চোখ মেলে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। মারজুক মসজিদের ফ্লোরেই শুয়ে পড়েছিলো।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে মনে নাই তবে ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে ঘুম ছুটে গেলো। ঘুম ছুটলে ও কোনভাবে চোখ খুলতে পারছেনা। চোখ বন্ধ রেখেই ফোন রিসিভ করলো।
মারজুক ঘুম ঘুম কন্ঠে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে সেলিনা চেঁচিয়ে উঠলো,,, তুই কিরে মারজুক!!! আজ অবদি কখনো তোকে আমি একবারে ফোন দিয়ে পাইনি! ডাক্তারী কি তুই একা করিস নাকি আরো কেউও করে?
-মা চেঁচাচ্ছো কেনো? আর তুমি কিন্তু সালামের জবাব দাওনি!
-রাখ তোর সালাম!
-মা এসব কি ধরনের কথা! কেউ সালাম দিলে তার জবাব দেয়াটা উচিত। সালামের মাধ্যমে একে অপরের প্রতি শান্তি বর্ষন করার দোয়া করা হয়। আর তুমি অবজ্ঞার স্বরে কি বলছো বুঝতে পারছো?
-সেলিনা এবার স্বর নিচু করে সালামের জবাব দিলো। তারপর বললো,, কতবার তোকে ফোন দিয়েছি ফোনটা একটু চেক কর!
-আম্মু কাল সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। নামাজ পড়তে এসেই মসজিদে ঘুমিয়ে পড়েছি তাই শুনতে পাইনি! আর ফোনটা ভাইব্রেশনে ছিলো।
কি জন্য ফোন দিয়েছো?
-স্নিগ্ধাদের বাড়ী থেকে বারবার ফোন দিচ্ছে তোর কি মতামত জানার জন্য! আমি তাদের কি বলবো?
-আম্মু আমি তো তোমাকে বলে দিয়েছি এই মেয়েকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় তারপরও আবার মতমত কিসের?
-দেখ তুই আরেকটু ভেবে দেখ মেয়েটা কিন্তু খারাপ না! সব দিক থেকে পারপেক্ট!
– আম্মু সকাল সকাল মন মেজাজ খারাপ করোনা। যা বলছি তুমি তাই করো। উনাদের নিষেধ করে দাও। রাখছি! বলে মারজুক ফোন কেটে দিলো। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো মারজুকের। মায়ের উপর খুব রাগ হলো, মা এটা কেন বুঝেনা মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য্য আর টাকা পয়সা যে সব নয়!

শোয়া থেকে উঠে বসে ফোনের দিকে তাকালো। সকাল নয়টা বেজে পাঁচ মিনিট। এর মাঝে হসপিটাল থেকেও ফোন এসেছে দুইবার। মারজুকের তখনি আবার নাবিলার কথা মনে পড়ে গেলো। মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে তো??

একটা হোটেলে নাস্তা সেরে হসপিটালে আসতেই শুনলো মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে। মারজুক একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো! মহান রবের দরবারে শুকরিয়া জানালো।
নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের সব রুগীদের সকাল, দুপুর আর রাতে সুস্থতা অসু্স্থতার,, মেডিসিন খেয়েছে কি না বা কোন মেডিসিন পাল্টে দিতে হবে কিনা খোঁজ খবর নিতে হয় ডিউটি ডাক্তারদের। সেই হিসাবে মারজুক প্রতিটা কেবিনের রুগীদের দেখে ২০২ নাম্বার কেবিনে আসতেই নাবিলার বাবা বেরিয়ে এসে বললো,, আসুন স্যার!
-মারজুক হাসিমুখে সালাম দিয়ে বললো,, বয়সে আপনার ছেলের মত হবো। তুমি করে বলবেন!
-ভদ্রলোক ফ্যাল ফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকলো। উনার জানা মতে এসব বড় ডাক্তাররা হয় খিটখিটে মেজাজের। এদের সাথে বেশী কথা বলা যায়না। বুঝে শুনে কথা বলতে হয়। অথচ এখানে যে তিনজন ডাক্তারের সাথে উনার কথা হলো তিনজনের ব্যবহার খুব অমায়িক । দেখে মনে হয়না এরা একেক জন বিসিএস ক্যাডার!
সত্যি এখনো কিছু ভালো মানুষ দুনিয়াতে আছে!
আনন্দে আবেগে উনার চোখে পানি চিকচিক করে উঠলো।
-মারজুক বললো,, এখন কি অবস্থা?
-জী স্যার একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে।

মারজুক নার্স আনিকাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই শুয়ে থাকা নাবিলা নিজের ওড়নাটা টেনে ভালো করে মাথায় দিয়ে পায়ের নিচ থেকে চাদরটা তুলে পুরো শরীরে ঢেকে নিলো। মেয়েটার মা বোন দুজন অন্যদিকে ঘুরে বসলো। মারজুক এদের আচরণে মুগ্ধ হলো।

মারজুক বেশি অবাক হলো,, কাল যে মেয়েটার কোন হুশ ছিলোনা নিজের সব হারিয়েছে, কোথায় তার শরীরের কাপড় ছিলো সে এখনো নিজেকে আড়ালে গুটিয়ে ফেলছে একজন গায়রে মাহরাম কে দেখে৷ মেয়েটার এহেন আচরণ মারজুকের হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। মেয়েটার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেলো।
মনে মনে বললো,,, এমন একজনকে তো আমি মনে মনে খুঁজেছি!
পরক্ষনে নিজেকে নিজে ধমকালো,, মারজুক কি করছিস! ও তোর হাসপাতালের একজন প্রেসেন্ট! অন্য দৃষ্টিতে কেন তাকাচ্ছিস।
না চাইতেও মারজুক আবারো নাবিলার দিকে তাকালো। মেয়েটা অতি সুন্দরী নয়। শ্যাম বর্ণের মেয়েটার চেহারায় অদ্ভুত এক মুগ্ধতায় ঘেরা। মেয়েটার চোখে কি যেন এক মায়া আছে মারজুক এক অচেনা টানে তাতেই আটকে গেলো। এই চোখের দিকে তাকিয়ে তো অনেক গুলো বছর কাটিয়ে দেয়া যায়! এমনভাবে তাকিয়ে ছিলো ওর মনেই ছিলোনা এই মেয়েটা ওর জন্য একজন পর নারী!
আনিকার ডাকে হুঁশ ফিরলো। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য মনে মনে নিজেকে নিজে এক কঠিন বকা দিলো।
-মারজুক নাবিলার প্রেশার মাপতে গেলে নাবিলা আরো নিজের সাথে নিজে জড়িয়ে গেলো।
মারজুক বললো,, কি করছেন আপনি? আমি আপনার ডাক্তার আমাকে আমার কাজ করতে দিন। প্রেশারটা মেপেই আমি চলে যাচ্ছি।

প্রেশার মেপে প্রয়োজনীয় ঔষধ লিখে দিয়ে মারজুক বেরিয়ে গেলো। আনিকাকে বললো,, নাবিলার ক্ষতগুলো যাতে পরিস্কার করে তাতে মেডিসিন দিয়ে দেয়।

চেম্বারে এসেই মায়ের ১৯টা মিসডকল দেখে মারজুকের মেজাজ চটে গেলো। আম্মু এমন কেনো? নিজের স্ট্যাটাসের জন্য আমায় নিয়ে কেন টানাটানি করছে?
উনাদের স্বার্থ রাখতে গিয়ে আমি তো নিজেকে শেষ করতে পারবোনা। যে মেয়ে এখনই এতো উশৃঙ্খল বিয়ের পরে যে সে কি করতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা থাকেনা।
আমি বুঝতে পারছিনা আম্মু এই মেয়েটাকে নিয়েই কেন টানাটানি করছে? দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব পড়ছে যে এই মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে? যত্তসব!!!
মার্জিয়াও এই মেয়েকে বিয়ে করতে আমায় নিষেধ করেছে সেখানে আম্মু!

বাসায় যাওয়া দরকার আম্মুর সাথে খোলাখুলি কথা বলা দরকার।

নাবিলাকে এক সপ্তাহ হসপিটালে রাখা হয়েছে। এই সাতদিন মারজুক না চাইতেও নাবিলাদের কেবিনের পাশ দিয়ে বারবার আসা যাওয়া করতো।
অবশ্য সেদিন রাতে যা একটু দেখেছে এরপরে নাবিলার মুখমন্ডল ও তেমন দেখেনি!
তারপরও কেন জানি মেয়েটার প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেলো ওর মাঝে! মারজুকের মনে হয় এই বেড়াজাল থেকে বেরুনো সত্যি অসম্ভব!

সন্ধ্যা সাতটায় শেষ হওয়া ডিউটি রাত দশটা পর্যন্ত করেছে। কেন?? কিসের টানে? তা ও নিজেও জানে না! শুধু মনে হতো এই হাসপাতালটাই ওর প্রিয় জায়গা!
হাসপাতালে থাকতেই যেনো ওর বেশি ভালো লাগে!
খাওয়া খেতে গেলে,, ঘুমাতে গেলে নাবিলার ব্যথায় কু্ঁচকে যাওয়া মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে।
অবশ্য নাবিলার সাথে কথা বলতে গেলে হয়নি তেমন! একজন ডাক্তার হিসাবে যতটুকু জানার দরকার ততটুকুই হতো!
মারজুক অবশ্য বেশ বুঝতে পেরেছে,, এই মেয়ে কথা একেবারেই কম বলে! সহজ ভাষায় বলতে গেলে স্বল্পভাষী যাকে বলে!!
এটা কি এখনকার পরিস্থিতির কারণে নাকি আগে থেকে মেয়েটা এমন তা ওর জানা নেই!
নাবিলার বাবার সাথে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। ভদ্রলোক খুব সুন্দর করে কথা বলেন। সুযোগ পেলে বারবার উনাদের প্রতি দয়া করার জন্য হাসপাতালের ডাক্তারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার কথা উনি ভুলেন না!

হসপিটাল থেকে নাবিলার ডিসকার্জ হয়ে যাওয়ার পরে মারজুকের মনে হলো কি যেন একটা হারিয়ে ফেলেছে!! কি যেন নেই! কোথাও একটা শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে!
এটা কি সামান্য আবেগের তাড়না নাকি ভালোবাসা বলে যে কিছু একটা আছে!
অবশ্য এই শূন্যতাকে পূর্নতা দেয়ার একটা উপায় আছে! আর তা হলো নাবিলাকে তিন অক্ষরের একটা শব্দ তিনবার বলে নিজের করে নেয়া!
আচ্ছা আমি যে তাকে নিয়ে এতো ভাবছি এটা তো অন্যায় হচ্ছে! তবে এটাও সত্য আমি তো তাকে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবছি!

কিন্তু তা কি কখনো সম্ভব হবে?

বাবা মা ওর জীবনের কালো অধ্যায়টার কথা শুনলে শুনলে কখনোই মেনে নিবেনা! তাদের কাছে তাদের সোসাইটি বড়! সন্তানের ভালো থাকা নয়!

তারা এটা বুঝবেনা যা হয়েছে মেয়েটার কোন দোষ নাই ও তো পরিস্থিতির স্বীকার!
মারজুক পড়লো চরম বিপাকে! না কোন কিছুতেই শান্তি হচ্ছেনা!

নাবিলাদের ঠিকানা হাসপাতালের রিসেপশান থেকে নিয়ে নিয়েছে মারজুক। কিন্তু যোগাযোগ করার সাহস হচ্ছেনা!

না বাবা মায়ের সাথে কথা বলতেই হবে! এভাবে টানাপোড়েনের মাঝে থাকলে চলবেনা!
আগে মার্জিয়া আর আজিমের সাথে কথা বলি! এ ভাবতে ভাবতে মারজুক মার্জিয়ার ফোনে ডায়াল করলো!

মার্জিয়া ভাইয়ের মুখ থেকে সব শুনে বললো,,, ভাইয়া আমার কিন্তু কোন আপত্তি নাই! কিন্তু আব্বু আম্মু মানবে বলে আমার মনে হয়না! আমি মানছি মেয়েটা ভালো সে পরিস্থিতির স্বীকার কিন্তু আমাদের মা বাবা তা মানবেনা!
-তুই আমার সাথে থাকলে তাদের বুঝানো সহজ হবে! তোরা যদি আমাকে সাপোর্ট দিস তাহলেই হবে!
-হুম আমি সব সময় তোর সাথে ছিলাম আর থাকবো! তবে ওই মেয়ের জীবনের এই সমস্যাটা না থাকলে কোন কথা ছিলোনা। বাবা মাকে বুঝানো কষ্টসাধ্য হবে! তুই তো জানিস ওরা কেমন মন মাইন্ডের মানুষ!
তবে ব্যাপারটা তাদের কাছে লুকিয়ে রাখলে তোর জন্য তাদের মানানো খুব সহজ হবে!

– হুম দেখি কি করা যায়। তবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমি কিছু করতে চাইনা। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কোন সম্পর্ক টিকে থাকতে পারেনা। সবচেয়ে বড় কথা হলো সত্য কোন দিন চাপা থাকেনা একদিন না একদিন তা প্রকাশ পাবেই!

-হুম তবে হুট করে কিছু বলিস না। জানিস তো বাবা মা কেমন রাগী মানুষ! একটু সময় নিয়ে বুঝানোর চেষ্টা কর তাদেরকে। আমি তো আছিই!

– দেখি কি করতে পারি!! বলে বিদায় নিয়ে মারজুক ফোন কেটে দিয়েছে।

এর প্রায় মাসখানিক পরের কথা। আমি ডিউটি শেষ করে হসপিটাল থেকে বেরুতে যাবো তখনি সোহানা ম্যাডামের ফোন তার চেম্বারে যাওয়ার জন্য!
এমুহুর্তে আবার ম্যাডাম কেন? অসহ্য একদম শান্তি নেই এই পেশার মানুষদের! বলে নিজে নিজে বিড়বিড় করতে করতে ম্যাডামের চেম্বারের দিকে গেলো।

ম্যাডাম আসতে পারি বলতেই ভেতরে থাকা চেনা একজন মানুষকে বসে থাকতে দেখে মারজুক ও হাসিমুখে প্রবেশ করলো………
চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here