হারানো সুর-১২তম পর্ব
©শাহরিয়ার
আমার পিছু পিছু স্যার ও আমার ঘরের দিকে এগিয়ে আসে। আমি ঘরে ঢুকতে যাবো এমন সময় স্যার পেছন থেকে ডাক দিতেই আমি দাঁড়িয়ে যাই।
জাহাঙ্গীর: তোমার কি বাড়ির কথা মনে পরছে? তুমি কি বাড়ি ফিরে যেতে চাও কিছু দিনের জন্য?
বাড়ির কথা মনে পরছে এটা সত্যি কিন্তু আমি সেখানে ফিরে যেতে চাই না। যেখানে আমার কোন মূল্য নেই সেখানে আমি যেতে চাইনা। আসলে আজ শাশুড়ি মায়ের কথা খুব মনে পরছে। ছোট বেলায় মা হারানোর পর আমি তার কাছেই মায়ের ভালোবাসা পেয়েছিলাম। শেষ পাঁচটা বছর তার সাথেই কাটিয়েছি প্রতিটা ঈদ। তাই উনার কথা বড্ড বেশী মনে পরছিলো। স্যার আমি প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমি চাই আমার মেয়েটা সুশিক্ষিত হবে মানুষের মত মানুষ হবে।
জাহাঙ্গীর: তার জন্য তোমাকে শিক্ষিত হতে হবে। একজন শিক্ষিত মা পারে তার সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিক করতে, মানুষের মত মানুষ করতে। কখনো ভেঙে পরো না বা হতাশ হইও না, কেননা আল্লাহ মানুষকে নানান রকম ভাবে পরীক্ষা করে থাকেন।
কথা গুলো বলে স্যার আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। সোজা হেঁটে চলে গেলো। আমি চোখ বুঝে মনে মনে বলতে শুরু করলাম আমি হতাশ হইনি কেননা আমি জানি।
” আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।”
[ সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৩ ], আমি কখনোই ধৈর্যহারা হইনা। আমি জানি একজন মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে অনেক অনেক পরিশ্রম করতে হয়।
আজ ঈদের দিন, ফজরের নামাযের পর থেকেই, নানান রকম রান্নার আয়োজন করতে শুরু করেছি, আমি আর মা। এই বিষয়টা আমার জন্য নতুন না। গ্রামেও এমনটা করে থাকতাম, সকাল থেকেই রান্নাবান্না শুরু হয়ে যেতো। সকলে দল বেঁধে এসে সেমাই, পায়েস খেয়ে নামাযে চলে যেতো। এসব রান্না শেষ হলে পোলাও, ভাত আর গোশত রান্না করতাম। নামায শেষে সকলে এক সাথে বসে সেগুলো খেতে খেতে বাড়িতে জমে যেতো খুশ গল্পের আসর। আমি এই ছয় সাত মাসে
তেমন কোন আত্মীয় সজন আসতে দেখিনি এ বাড়িতে। কেন আসে না বা তারা কি দূরে থাকে কিনা তাও আমার জানা নেই। আসলে কখনো এভাবে ভেবে দেখেনি তাই কখনো প্রশ্নও করা হয়নি। আজতো ঈদের দিন কাছাকাছি থাকা আত্মীয় সজনরা চাইলেই আসতে পারে।
নামাযের আগে সামান্য পায়েস খেয়ে বের হয়ে গেলো স্যার। যাবার সময় বলে গেলো নামাযের পর তার কয়েকজন কলিগ আসবে যারা ঈদে গ্রামের বাড়ি যেতে পারেনি। মা বলে দিলো আসবে তাতে সমস্যা কোথায়, যে কয়জন রয়েছে সকলেই যেনো চলে আসে। আমি আর মা মিলে সব রান্না শেষ করে নিলাম।
মা: এবার যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে, রেডি হয়েনে। ওরা আবার নামায পড়ে চলে আসবে।
আমি রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। সাবাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে গোসল করিয়ে ঈদের জন্য কেনা একটা ড্রেস পরিয়ে দিলাম। এরপর নিজে ওয়াশ রুমে ঢুকলাম। গোসল শেষ করে মেরুন রঙের শাড়িটা পরে নিলাম। সাথে স্যারের কিনে নিয়ে আসা রেশমী চুড়ি, শাড়ির সাথে ম্যাচিং একটা মিরর মালার সেট পরলাম। চোখে গাঢ় করে কাজল নিলাম। অনেক গুলো দিন নিজেকে এভাবে সাজানো হয়না।
গ্রামে থাকতে মাঝে মাঝেই সব কাজ শেষ হবার পর সাজগোজ করে বসে থাকতাম শাকিলের জন্য। অনেকেই বলতো নারীদের রাতে একটু সাজগোজ করে স্বামীকে দেখাতে হয় যেনো স্বামীর দৃষ্টি সব সময় স্ত্রীর উপর থাকে। অন্যদিকে না সরে। আমিতো আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। মানুষ যা যা বলেছে তার সব কিছুই মেনে চলার চেষ্টা করেছি। তারপরেও কেন আমার জীবনটা এমন হলো। শাকিল কেন আমাকে ছেড়ে ঐরম একজন মহিলাকে বিয়ে করলো এর উত্তর যে আমার জানা নেই।
চোখের কোনে পানি জমে গিয়েছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে সে পানি মুছে নিলাম। এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। বুঝতে পারলাম স্যার এসেছে, তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিতেই স্যার আর তার কলিগরা ভিতরে ঢুকে পরলো। স্যারের কলিগরা সাবার জন্য নানান রকম খেলনা আর খাবার নিয়ে এসেছেন। সাবা সে সব নিয়ে খেলা করছে আমি আর মা সবাইকে খাবার পরিবেশন করলাম। সবাই আজও খাবারের বেশ প্রশংসা করলো।
খাওয়া শেষ করে সকলে কিছু সময় রেস্ট করে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। সকলে বসে টিভি দেখতে দেখতে স্যার বললো রত্নাকে তো আজ ছবির নায়িকাদের মত লাগছে।
স্যারের মুখে এমন কথা আশা করিনি, তাই লজ্জা পেয়ে গেলাম। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম কোথায় আসমানের পরী আর কোথায় আমি।
জাহাঙ্গীর: নিজেকে কখনো ছোট করে দেখবে না। বরং এটা ভাববে ওদের চেয়ে তুমি ভালো, তুমি সুন্দর। ওরা তোমার তুলনায় অসুন্দর। তবেই দেখবে তুমি এগিয়ে যেতে পারবে বহুদূর। এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে স্যার বললো কাল সকালে আমি একটা টুরে বের হবো দু’দিনের জন্য, তাই সকলে মিলে আজ বিকেলে এক সাথে একটু ঘুরে বেড়াবো তোমরা রেডি হয়ে নিও।
মা: কোথায় যাবি টুরে?
জাহাঙ্গীর: এক কলিগের গ্রামের বাড়িতে যাবো বেড়াতে।
মা: তোকে তো দূরে কোথাও যেতে দিতে ইচ্ছে করে না। বুকের ভিতর কেমন কেমন লাগে।
জাহাঙ্গীর: মা আমি এখন আর সেই ছোট নেই বুঝলে। তোমার ছেলে এখন অনেক বড় হয়েছে নিজের ভালো মন্দ নিজে বুঝতে পারে বুঝলে।
মা: তবুও তোকে দুই দিন দেখবো না।
জাহাঙ্গীর: হুম মাত্র দুই দিনেরইতো বেপার। দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। এখন তোমরা থাকো আমি বাহির থেকে আসতাছি। কথাটা বলেই উঠে চলে গেলো।
মানুষটাকে আমার এখন খুব অদ্ভুত মনে হয়। যখন যা বলে তাই করে। কেন এই ঈদের সময় তাকে বাহিরে বেড়াতে যেতে হবে? মায়ের সঙে থাকবে তাকে সময় দিবে।
ঈদের দিন গুলো আমাদের বেশ ভালোই কাটতো। শাকিল ঈদের সময় আমাদের রেখে কোথাও যেতো না। সারাদিন সময় দিতো। আচ্ছা শাকিল কি এখনো তেমনি আছে? তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে আমাকে যেমন করে সময় দিতো তেমনি করে সময় দেয়? শাকিলের কি একটুও আমার কথা সাবার কথা মনে পরে না? নাকি সে সম্পূর্ণ ভাবে আমাকে ভুলে গিয়েছে।
দুপুরের আগে আগেই স্যার চলে এসেছে। এসেই মাকে বললো দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেই বাহিরে বের হয়ে যাবে। ঈদের সময় ঘুরার জায়গা গুলোতে প্রচন্ড ভিড় হয়। মা বললো ঠিক আছে।
খাওয়া দাওয়া করেই আমরা বের হয়ে পরলাম ঘুরার জন্য। মা স্যারের সাথে সামনে বসেছে আমি আর সাবা পেছনের সিটে বসেছি। অল্প সময়ের ভিতর আমরা চলে আসলাম শিশুপার্কে। স্যার গাড়ি পার্কিং করলো আমরা সকলে গাড়ি থেকে নেমে পরলাম। সত্যিই অনেক সিরিয়াল ভিতরে ঢুকার জন্য। স্যার টিকেট সংগ্রহ করলো তারপর গেটে যেয়ে দায়িত্বে থাকা লোকটার সাথে কথা বলে আমাদের ডাক দিলো। আমরা যেতেই আমাদের আগে ঢুকতে দিলো। বুঝতে পারলাম উনি নিশ্চই জানিয়েছেন পুলিশের লোক। তাই আমাদের আগে ঢুকতে দেয়া হয়েছে।
ভিতরে ঢুকা সহজ হলেও কোন রাইডে উঠা ততটা সহজ হলো না। অনেক কষ্টে তিন চারটা রাইডে উঠতে উঠতেই সন্ধ্যা হয়ে এলো। তবুও বেশ উপভোগ করলাম। সন্ধ্যায় বের হয়ে গেলাম আমরা পার্কের ভিতর থেকে। এরপর বাড়ি ফিরে আসলাম। সকলে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম এক সাথে। স্যার খেতে খেতে মাকে বললো কোন রকম সমস্যা হলে তাকে ফোন দেবার জন্য। সে টেবিল থেকে উঠে চলে গেলো। একটু পর মা ও চলে গেলো নিজের রুমে আমি সব কিছু গুছিয়ে চলে আসলাম আমার রুমে।
পরদিন সকালে নাস্তা করেই স্যার বের হয়ে গেলো তার টুরে। আমি আর মা বাড়িতে রয়ে গেলাম। হঠাৎ করেই রাতে খাবার টেবিলে অনুভব করলাম স্যার নামক মানুষটা নেই। আমি মাকে বললাম স্যার খেয়েছে কিনা তার জন্য ফোন দিয়ে জানার জন্য।
মা: হ্যাঁ ঠিকই তুই বস আমি ফোন দিয়ে আসি।
মা চলে গেলেন স্যারকে ফোন দেবার জন্য আমি বসে টেবিলে বসে সাবার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি। মা ফোনে কথা বলে ফিরে এসে জানালো যে স্যার খেয়েছে।
দু’টো দিন কেমন জানি বাড়িটা খালি খালি লাগছিলো। অবশেষে স্যার বাড়িতে ফিরে আসলো। বাড়িটা আবার আগের মতই হইচই আর আনন্দে ভরে উঠলো। দেখতে দেখতে ঈদের পাঁচটা দিন কেটে গেলো। স্যারের ছুটিও শেষ হয়ে গেলো। স্যার আবার অফিসের কাজে যাওয়া শুরু করলো। এদিকে আমাকেও মা পড়তে বসতে বললো।
মা: হাসতে হাসতে বলতে লাগলো তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শুরু করে দে আর কিছু দিন পরেই কলেজে যেয়ে পরীক্ষা দিতে হবে ফার্স্ট ইয়ারের। আর খারাপ হলে কিন্তু উপরে তুলবে না কলেজ কর্তৃপক্ষ।
আমি মাকে বললাম ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি অবশ্যই ভালো করবো।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। আমি আর মা বিকেলে ঘরে বসে চা খাচ্ছি আর টিভি দেখছি এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো এই অসময় কে আসলো আবার।
আমি যেয়ে দেখছি, বলে উঠে যেয়ে দরজা খুলতে অপরিচিত একটা মেয়েকে দেখতে পেলাম। কে এই মেয়ে ভাবতে না ভাবতেই সে আমাকে ঠেঁলে ভিতরে প্রবেশ করলো। খালা খালা বলে দৌঁড়ে যেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
মা: আরে ঝর্ণা তুই হঠাৎ করে কোন রকম খবর না দিয়ে।
ঝর্ণা: খবর দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকতো। তোমাদের সারপ্রাইজ দিতেই চলে আসলাম।
মা: বেশ করেছিস এসেছিস। যা উপরে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।
ঝর্ণা উপরে চলে গেলো আমি বুঝতে পারলাম এটা স্যারের খালাতো বোন। মেয়েটা বেশ সুন্দরি বলতেই হবে। তবে কিছুটা অহংকারি এটা তার ঘরে ঢুকার সময় আমাকে ধাক্কা দিয়ে যাওয়াতে অনুমান করা যায়। এসব যখন ভাবছি ঠিক তখনি মা ডাক দিলো।
চলবে…