হারানো সুর পর্ব-১১

0
610

হারানো সুর-১১তম পর্ব
©শাহরিয়ার

আজ এক নতুন আমিকে আবিষ্কার করলাম। আসলে সুন্দর পোষাকে বা দামী পোষাকে যে মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় তা এই প্রথম আমি বুঝতে পারলাম। চাদরটা শরীর থেকে সরিয়ে রেখে সাবার পাশে বিছানায় শুয়ে পরলাম।

জীবন খুব জটিল, খুব কঠিন, তবুও আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। কঠিনতম জিনিসটাও সহজ মনে হবে যখন আপনি ভালো থাকবেন। আবার যখন দুঃখ কষ্টের মাঝে দিন পার করবেন তখন সহজ অনেক কিছুও আপনার কাছে কঠিন মনে হবে। বেঁচে থাকার যে আনন্দ তা উপভোগ করতে হলে জীবনকে সহজ করে তুলতে হবে। “আলহামদুলিল্লাহ” এই মুহূর্তে আমার জীবনের হিসেব বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে।

মেয়েটাকে বুকের মাঝে নিয়ে থাকতে পারি, সারাদিন নিজের সংসারের মত কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়ে পড়ালেখা করছি। তিন বেলা ভালো খাবার পাচ্ছি, ভালো জামা কাপড় পাচ্ছি এর চেয়ে বেশী একটা মানুষের আর কি প্রয়োজন? হয়তো মানুষের এর চেয়ে বেশী কিছুর প্রয়োজন হয়না। কিন্তু আমার কাছে এসব কিছুই ক্ষণস্থায়ী মনে হয়। আমি লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হতে চাই। এরপর নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। নিজে কিছু করতে চাই। যে আশায় আমি শাকিলের বাড়ি ছেড়েছি একদিন আমার সে স্বপ্ন পূরণ হবে “ইনশা আল্লাহ” এটা আমার বিশ্বাস।

মানুষের জীবনে সুখের মুহূর্ত গুলো হয়তো খুব দ্রুতই চলে যায়। আমার জীবন থেকেও হয়তো তেমনি হচ্ছিলো। আরও দু’টি মাস চলে গেলো। রমজান মাস চলে আসলো। বাড়িতে কাজের চাপ আরও কমে গেলো। স্যার বাহির থেকেই ইফতার নিয়ে আসে সকলের জন্য। শুধু সেহরি আর রাতের খাবার রান্না হয় বাড়িতে। তাও এক সাথেই রান্না হয় শুধু গরম করে নিতে হয়। হালকা শীত না হলে হয়তো গরম করার ও প্রয়োজন পরতো না।

বিগত পাঁচ বছরে এই প্রথম শাশুড়ি আম্মাকে ছাড়া রোজা রাখছি, ইফতার করছি সেহরি করছি। সব কিছুতেই তার কথা মনে পরে। জানিনা উনি কেমন আছেন খুব দেখতে ইচ্ছে করে। একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে। মায়ের আদর ভালোবাসা সত্যিই কখনো ভুলে থাকা যায়না। আমিও শত সুখের মাঝেও আম্মাকে ভুলতে পারি না। মানুষটার কাছ থেকেই যে প্রথম বুঝেছি মায়ের ভালোবাসা কেমন হয়।

স্যার মানুষটা বাহিরে যতটা কঠিন, ভিতরে ঠিক ততটাই যে নরম তা আমি পুরোপুরি বুঝে ফেলেছি। আগের মত আর ভয় লাগে না মানুষটাকে। প্রতিদিন ইফতারের সময় সাবাকে কোলে নিয়ে বসে ইফতার করে। একটু একটু করে খাবার মুখে তুলে দেয়। দেখতে বেশ ভালোই লাগে। শাকিলের কাছে থাকলেও হয়তো শাকিল এভাবে মেয়ের মুখে একটু একটু করে খাবার তুলে দিতো।

দেখতে দেখতে রমজান মাস শেষ হয়ে আসছিলো। পঁচিশটা রমজান চলে গেলো। ছাব্বিশ রমজানের দিন স্যার সেহরির সময় সবাইকে বলে দিলো ইফতারের পর শপিং করার জন্য বের হবে। সবাই যেনো প্রস্তুতি নিয়ে থাকি।

আমি যাবো না শপিং করতে।

জাহাঙ্গীর: কেন যাবে না?

আমার ভয় লাগে এতো বড় শপিং সেন্টারে যেতে। আমার এতো বড় জায়গা এতো মানুষের ভিড়ে থাকতে কেমন জানি লাগে। আমি ঠিক বলে বুঝাতে পারবো না।

জাহাঙ্গীর: জীবনে বড় হতে হলে বড় স্বপ্ন দেখতে হয়। বড় বড় জায়গা বড় বড় মানুষের সাথে চলতে হয়। তুমি যেখানে থাকবে সেই জায়গার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। যে শহরে থাকবে সে শহরের মানুষের মত চলাফেরা করা শিখতে হবে। তবেই তুমি সফল হতে পারবে।

তবুও স্যার আমি যাবো না, আমার সত্যিই কেমন জানি লাগে।

মা: একটা থাপ্পর খাবি মেয়ে, চুপচাপ খেয়ে নে।

আমি আর কোন কথা না বলে সেহরি খেয়ে নিলাম। তারপর নামায পড়ে ঘুমিয়ে পরলাম। সারাদিন বাসার টুকটাক কাজ করতে করতে কেটে গেলো। আসরের নামাযের পর স্যার বাসায় আসলো। এসেই আরেক বার বললো তাড়াতাড়ি সব কাজ কর্ম শেষ করে নিতে। ইফতারের পর পরই শপিং করতে বের হয়ে যাবে মার্কেট গুলোয় প্রচন্ড ভিড় এখন।

ইফতার শেষেই সকলে রেডি হয়ে বের হয়ে পরলাম ঈদের শপিং করার জন্য। শপিং করতে করতে সত্যিই অনেক রাত হয়ে গেলো। দোকান গুলোতে প্রচন্ড রকম ভিড় রমজান শেষের দিকে ঈদ চলে এসেছে তাই হয়তো এতো ভিড় লেগে আছে দোকান গুলোতে। শপিং শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো।

জীবনে প্রথম এতো দামী দামী জামা কাপড় দেখলাম। এতো দামী কাপড় কিনলাম। এতো সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। কোনটা রেখে কোনটা কিনবো বুঝে উঠতে ধাঁধায় পড়ে যেতে হয়। সকলের পছন্দ মত জামা কাপড় কেনা হয়েছে। সাবার জন্য কেনা হয়েছে সবচেয়ে বেশী ড্রেস। স্যারের চোখে যেটাই পছন্দ হয়েছে সেটাই কিনে দিয়েছে মানুষটা। আমি অনেকবার মানা করেছি স্যার এতো কিনে দিতে হবে না। কে শোনে কার কথা উল্টো ঠোঁটে আঙ্গুল লাগিয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে ইশারা করে।

আমার জন্যও দুইটা জামার সেট আর দু’টো শাড়ি কিনে দিয়েছে। সব গুলো ড্রেস আর শাড়ি আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

সব কিছু গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে সাবাকে নিয়ে বিছানায় শুতে রাত বারোটার উপরে বেজে গেলো। শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত থাকায় অল্পতেই চোখে রাজ্যের ঘুম এসে হামলে পরে। আর দু’চোখ খুব দ্রুতই বন্ধ হয়ে আসে, আমি হারিয়েই যাই ঘুমের রাজ্যে।

কত দ্রুত যে দিন চলে যাচ্ছিলো বলে বুঝাতে পারবো না। দেখতে দেখতে চাঁদ রাত চলে আসলো। আমি স্যারকে বললাম মেহেদী পাতা কিনে এনে দিতে। সকলে হাতে মেহেদী নিবো।

জাহাঙ্গীর: মেহেদীর পাতা কোথায় পাবো? টিউব কিনে এনে দিতে পারি।

ঐসব কি হাতে দেয়া যাবে?

জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ যাবে কিছু কোম্পানি হালাল উপায়ে ঐসব মেহেদী বানাচ্ছে সো চিন্তা নেই।

বেশ তাহলে নিয়ে আইছেন। আমি কখনো ঐসব ব্যবহার করিনি। স্যার বাসা থেকে বের হয়ে গেলো মা আরও কি কি যেন কিনে নিয়ে আসার কথা বললো। স্যার চলে যাবার পর আমি মা আর সাবা গল্প করতে বসে পরলাম। মাকে বলতে শুরু করলাম চাঁদ রাতে গ্রামে আমরা কত মজা করতাম। সকলে এক সাথে মেহেদী ভাটতে বসতাম। তারপর সারা রাত বসে একজন আরেক জনের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতাম। কতই না আনন্দ হতো দিন গুলোতে।

মা: মাথায় হাত দিয়ে সে সকল দিনের কথা ভেবে খারাপ লাগছে তাই না? মন খারাপ করিস না মা। দেখবি এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি মাকে বললাম হ্যাঁ দিন গুলো সত্যিই খুব আনন্দের ছিলো। কিছু কিছু দিন কিছু কিছু মুহুর্ত মানুষ চাইলেও ভুলতে পারে না।

মা আর আমি কথা বলতে বলতে স্যার যেয়ে বাজার করে চলেও আসলো। আমার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে এর ভিতর যা যা আসে সবই তোমার কাজে লাগবে। সেদিন কিনে দিতে মনে ছিলো না।

আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখি মেহেদীর পাশাপাশি অনেক রকম কসমেটিক, আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম এসব না আনলেও পারতেন।

জাহাঙ্গীর: ঈদতো আর প্রতিদিন আসে না, একটা বছরে দুটো ঈদ আসে। মানুষ একটু সাজবে আনন্দ করবে এটাইতো নিয়ম।

স্যার আরও বকবক করে যাচ্ছে আর আমি মাথা নিচু করে উনার কথা শুনে যাচ্ছি। মানুষটা যে কি করে এতো সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে কথা বলে মাঝে মাঝে আমি ভীষণ অবাক হয়ে যাই।

রাতের খাবার খাওয়া শেষ হবার পর আমি মা আর সাবা বসে আছি। স্যার বাহিরে কোথায় যেনো বের হয়েছে। আমি সাবার হাতে মেহেদী দিচ্ছি আর মায়ের সাথে গল্প করছি। সাবাকে বেশী মেহেদী দেয়া সম্ভব হলো না ছোট মানুষ প্রচন্ড নড়াচড়া করে বার বার নষ্ট করে ফেলছে। তাই সাবাকে বাদ দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম হাত বাড়িয়ে দেন।

মা: আমার নিতে হবে না, তারচেয়ে বরং তুই নে।

তা হচ্ছে না আপনাকেও নিতে হবে। আমার সাথে মা পেরে উঠলো না। বাধ্য হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি মেহেদী দিতে দিতে অতীতে হারিয়ে গেলাম। বিয়ের পর পাঁচটি বছর ভাটা মেহেদী আমার শাশুড়ি মায়ের হাতে দিয়ে দিতাম। সে কি খুশি হতেন উনি। মায়ের হাতে মেহেদী দেয়া শেষ হলেই শাকিলের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতাম। দিন গুলো সত্যিই অসাধারণ ছিলো। জীবনে হয়তো আর কোন দিনও সে সকল দিন আর মুহুর্ত ফিরে আসবে না। যে দিন চলে যায় সে দিন সে সময় আর কখনো ফিরে আসে না। মানুষের জীবনে এটাই সত্যি এটাই বাস্তবতা। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কলিং বেলটা বেজে উঠলো। ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসলাম। স্যার এসেছে বুঝতে পারলাম। মায়ের হাতে মেহেদী দেয়া শেষ। দরজা খোলার জন্য আমি উঠবো।

মা: তুই বসে থাক আমি খুলে দিচ্ছি।

মা যেয়ে দরজা খুলে দিতেই স্যার ঘরের ভিতর ঢুকে পরলো। স্যার উপরে উঠার আগ মুহুর্তে আমি বললাম স্যার আসেন মেহেদী দিয়ে দেই।

স্যার কিছু বলার আগেই মা যেয়ে উনার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসতে আসতে বললো রত্না খুব সুন্দর করে মেহেদী দিতে পারে।

স্যার কিছু না বলে আমার সামনে বসে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে স্যারের হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি। হঠাৎ করেই আজ শাকিলের কথা এতো বেশী মনে পরছিলো যে আমি দু’চোখে যেন আর কিছুই দেখতে পারছিলাম না। জলে ভরে উঠলো দু’চোখ নিজেকে সামলে নেবার আগেই টপটপ করে কয়েক ফোটা পানি ফ্লোরে আর স্যারের হাতের উপর পরলো।

জাহাঙ্গীর: একি তুমি কাঁদছো কেন?

আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না, সাবাকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে ছুটে চললাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here