হারানো সুর পর্ব-১০

0
555

হারানো সুর-১০ম পর্ব
©শাহরিয়ার

ভয়ে ভয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সাবাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরার কিছু ক্ষণের মধ্যেই সাবা ঘুমিয়ে পরলো। আমার চোখেও প্রচন্ড ঘুম এসে জমা হয়েছে। দু’চোখের পাতা এক করে ফেলেছি, এমন সময় মা এসে ডাক দিলো। আমি দরজা খুলে দিতেই মা বললো না খেয়ে কেন চলে আসলি।

আমার ক্ষুধা লাগেনি মা, আপনারা খেয়েছেন?

মা: আমরা খেয়েছি আয় এখন তুই ও খাবি। সত্যিই আজ তোর হাতের রান্না অনেক মজা হয়েছে। নিজে কেমন রান্না করলি তা নিজে খেয়ে দেখবি না তা কি করে হয়?

আমি আচ্ছা ঠিক আছে আমি আসছি।

মা: আসছি না এখুনি আমার সাথে চল।

আর কোন কথা না বলে মায়ের সাথে ডাইনিং এ চলে আসলাম। মা নিজের হাতে খাবার বেড়ে দিলো। সত্যিই খাবার ভীষণ ভালো হয়েছে। আমার খেতে খেতে শাকিলদের বাড়িতে প্রথম দিনের কথা মনে পরে গেলো।

তিন চার রকমের রান্না করেছি আমি, শাকিল শাশুড়ি আম্মা আরও দুই তিনজন খাবার টেবিলে বসে আছে, আমি সব রকম রান্না নিয়ে তাদের সামনে রাখলাম। আম্মা সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে নিজেও প্লেটে খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। সকলে খাচ্ছে আর একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আমার ভীষণ ভয় ভয় লাগছিলো। হঠাৎ একজন বলে উঠলো বাহ বউ মায়ের হাতেতো যাদু আছে। আজ কত বছর পর এতো ভালো রান্না খেলাম তার কোন হিসেব নেই।

সাথে সাথে সকলেই বলে উঠলো সত্যিই রান্নার প্রশংসা না করে পারছি না। খুবি দারুণ রান্না হয়েছে। শাকিল তখনো চুপ করে খেয়ে যাচ্ছিলো। আমি খুব ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখছি তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। আমার ভয় আরও বেড়ে যাচ্ছে তবে কি শাকিলের আমার রান্না পছন্দ হয়নি?

হঠাৎ করেই শাকিল বলে উঠলো, দেখতে হবে না রান্না কে করছে? শাকিলের এমন কথা শুনে সকলে হো হো করে হেসে উঠলো। শাশুড়ি আম্মা বলে উঠলো, এই ছেলে বউ পাগলা হবে। লজ্জায় শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে আমি সেখান থেকে দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে আসি।

কিরে মা আর একটু দিবো নাকি?

মায়ের কথায় আমি কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবতায় ফিরে আছি, উনার দিকে তাকিয়ে না মা আর লাগবে না। বলে খাবার শেষ করে টেবিল থেকে উঠে চলে আসি নিজের রুমে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি কেমন আছে আম্মা। মানুষটা আমাকে ভীষণ ভালো বাসতো।

মা বাবা হারা এতিম মেয়ে ছিলাম, উনিই আমাকে বুঝিয়ে ছিলেন মা কেমন হয়। তার আদর ভালোবাসা কেমন হয়। আজ সেই মানুষটা কেমন আছে আমি জানি না। মানুষটা যে ভাবেই থাকুক না কেন ভালো থাকুক সুস্থ থাকুক এটাই আল্লাহর কাছে দোয়া করি।

যদি কখনো সুযোগ হয় তাহলে শাকিলের সামনা সামনি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করবো আমার কি অপরাধ ছিলো শাকিল? কেন তুমি আমার সাথে এমন করলে? কি ভুল ছিলো আমার যার জন্য আমার সুখের সংসারটা তুমি ভেঙে চূরমার করে দিলে? এতো ভালোবাসার বিনিময়ে তুমি আমার সাথে কি করে পারলে এতো বড় প্রতারণা করতে? যদি কখনো আল্লাহ আমাকে সুযোগ করে দেয় তবে অবশ্যই আমি এই প্রশ্ন গুলো ঠিকই করবো প্রেমিক নামক ঐ প্রতারক মানুষটাকে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম। ফজরের নামাযের পর, নাস্তা বানিয়ে টেবিলে দিয়ে নিজের রুমে এসে বই নিয়ে পড়তে বসেছি। এটা এখন আমার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গিয়েছে। স্যার চলে যাবার পর মা আমাকে পড়া দেখিয়ে দিবে। মা বলেন আমি খুব ভালো ছাত্রী অল্প বুঝালেই আমি সব পড়া খুব সহজে মুখস্ত করে নিতে পারি।

ছোট বেলা থেকেই আমি লেখা পড়ায় ভালো ছিলাম। যার কারণে স্কুল পড়তে আমার কোন রকম টাকা লাগতো না। স্কুল থেকেই বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। সেই টাকা দিয়েই বেশ ভালো ভাবে আমার লেখাপড়া হয়েছিলো। কতই না সুন্দর ছিলো সেই সকল দিন গুলো।

হঠাৎ নবম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার পর, রেজাল নেবার দিন পরিচয় হলো শাকিলের সাথে। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে ওর বাড়ি। আমাদের স্কুল থেকেই এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে নাকি পাস করেছিলো। তাই স্যার ম্যাডামদের সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি রেজাল্ট কার্ড নিয়ে আনন্দ করতে করতে বের হচ্ছিলাম। দরজার সামনে আসতেই শাকিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যাই।

শাকিল: সরি সরি আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি বলে হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।

আমি প্রথমে তার হাত ধরতে না চাইলেও যখন বুঝতে পারলাম একা উঠে দাঁড়াতে খুবি কষ্ট হচ্ছে তখন উপায় না পেয়ে তার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ালাম।

শাকিল: আমার মনে হয় আপনার খুব বেশী ব্যথা লেগেছে, চলুন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।

আমি ফিঁক করে হেসে দিয়ে বললাম, না না ভাইয়া আমার তেমন লাগেনি আমি ঠিক আছি। আসলে ভুলটা আমারই আমি এভাবে দৌঁড়ে না বের হলেই পারতাম।

এরপর শাকিল নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলো। দু’জন গল্প করতে করতে স্কুল গেটের বাহিরে চলে আসলাম। দু’জন দু’জনের সম্পর্কে জানলাম। বেশ খানিকটা পথ এক সাথে হাঁটলাম। তারপর আমি শাকিলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিক্সায় উঠে নিজের বাড়ির পথে রওনা হয়ে গেলাম। প্রথম দেখাতে তার সাথে কথা বলেই আমি হয়তো তার প্রেমে পরে গিয়েছিলাম। কে জানতো সেই মানুষটাই বদলে এক সময় অন্য নারীতে আসক্ত হবে। কথা গুলো ভাবতেই চোখের কোনে জল এসে জমা হয়েছে।

মা: দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে রত্না কি করছিস পড়তে বসেছিসতো?

আমি দ্রুত চোখের কোন থেকে পানি মুছে জ্বি মা পড়তে বসেছি।

মা: আচ্ছা পড় আমি একটু পর আসছি জাহাঙ্গীর বের হবার পর।

জ্বি আচ্ছা, বলে আমি আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম আমাকে যে অনেক বড় হতে হবে। নিজের যোগ্যতায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমাকে যে শাকিলের মুখোমুখি হতে হবে।

এভাবেই দিন গুলো কেটে যেতে লাগলো। দেখতে দেখতে এ বাড়িতে চার মাস কেটে গেলো, কিভাবে কেটে গেলো টেরই পেলাম না। হেমন্তের শেষে শীত চলে এসেছে। আমার বা সাবা দু’জনের কারোরই তেমন ভারী কোন কাপড় নেই শীতের। মাকে বলবো কি বলবো না কথা গুলো ভাবছিলাম। এমন সময় স্যার তার ডিউটি শেষ করে বিকেলে বাড়িতে ফিরে, আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সাবাকে ডাক দিলো। আমি সাবাকে নিয়ে শুয়ে ছিলাম। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বললাম স্যার ভিতরে আসেন।

জাহাঙ্গীর: না ভিতরে আসবো না তোমরা দু’জন একটু রেডি হয়ে বের হও। মার্কেটে যাবো। শীত পরেছে খুব, সকলের জন্য শীতের জামা কিনতে হবে। আমি মায়ের রুমে যাচ্ছি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হও।

কথাটা বলেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করলো। মানুষটা বড্ড কঠিন হলেও সব দিকে খেয়াল আছে এটা একটা ভালো দিক। আমি সাবাকে রেডি করে নিজেও রেডি হয়ে রুমের বাহিরে এসে দেখি উনি সেখানে নেই। বুঝতে পারলাম মায়ের রুমে গেছে। যাবো কি যাবো না ভাবতে ভাবতে মায়ের সাথে হাঁটতে হাঁটতে উনিই নিচে নেমে আসলো।

মা: নিচে নেমে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো আমার শরীরটা ভালো না তোরাই যা। আর তাছাড়া আমার শীতের পোশাকের শেষ নেই।

কি হয়েছে আপনার মা? আমাকে জানাবেন না? আমি মার্কেটে যাবো না। আগে আপনি সুস্থ হোন তারপর শীতের জামা কাপড় কেনা যাবে।

জাহাঙ্গীর: আম্মুর তেমন কিছু হয়নি, তোমরা চলো বাসায় রেস্ট নিক ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চা মেয়েটা শীতে কষ্ট করছে।

আমি উনাকে খুব ভয় পাই, উনার কথার উপর আমি কথা বলতে পারি না। তাই মাথা নিচু করে উনার সাথে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম।
বাড়ির বাহিরে বের হতেই গাড়িতে যেয়ে বসলো স্যার, আমি কোথায় বসবো বুঝতে পারলাম না। পেছনে বসতে যাবো এমন সময় স্যার সামনের দরজা খুলে দিয়ে বললো সামনে বসো। পেছনে বসলে মানুষ মনে করবে আমি তোমাদের বাড়ির ড্রাইভার।

উনার কথায় আমি বেশ লজ্জা পেয়ে দ্রুত সামনে যেয়ে দরজা খুলে উঠে বসে পরলাম। গাড়ি খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো শহরের ব্যস্ত রাস্তা ধরে। বিশাল বড় একটা শপিং মলের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো। আমি খুব ভয়ে ভয়ে শপিং মলের ভিতর ঢুকলাম। প্রতিটা দোকান খুব সুন্দর ভাবে সাজানো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম।

জাহাঙ্গীর: এমন বোকার মত হা করে তাকিয়ে থেকো না, মানুষ কি মনে করবে? ভাববে জীবনে কোন দিন এতো বড় শপিং মলে আসোনি।

তাদের ভাবনাটা তো ভুল না স্যার, আমি সত্যিই কখনো এতো এতো দোকান দেখিনি কখনো।

জাহাঙ্গীর: তার জন্য তা মানুষকে বুঝাতে হবে?

কথা বলতে বলতে একটা দোকানের ভিতর ঢুকে সেখান থেকে সাবার জন্য বেশ কয়েকটা জামা কিনে দিলো। তারপর আরেকটা দোকানে ঢুকে আমার জন্য আর মায়ের জন্য শাল আর শীতের জামা কিনে দিয়ে বললো পছন্দ হয়েছে?

আমি আস্তে করে বললাম হ্যাঁ হয়েছে কিন্তু এগুলো তো অনেক দামী। স্যার আপনার জন্য কিছু কিনলেন না?

জাহাঙ্গীর: মুচকি হেসে আমার অনেক রয়েছে, আপাতত প্রয়োজন নেই।

এরপর শপিং মলের আরেকটা ফ্লোরে নিয়ে আসলো আমাকে আর সাবাকে, যেখানে শুধুই খাবার দোকান। স্যার এখানে কি করবো আমরা?

জাহাঙ্গীর: চুপ সব সময় স্যার স্যার করবে না, মানুষ তাকিয়ে দেখে। এখানে খাবার খাওয়ার জন্য এসেছি।

তাহলে আমি কি বলে ডাকবো স্যার?

জাহাঙ্গীর: আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে হবে না। চুপচাপ থাকবা রোবট দেখেছো কখনো? রোবটের মত থাকবে আমি নড়তে বললে নড়বা। বসে থাকতে বললে বসবা।

এরপর একটা টেবিলে বসে খাবারের অর্ডার করলো। আমি চুপচাপ বসে খেতে শুরু করলাম। খাওয়া শেষ হতেই আমরা শপিং মল থেকে বের হয়ে আসলাম। তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরে আসলাম। আমার আর সাবার ব্যাগ গুলো আমাদের হাতে বুঝিয়ে দিলো আর মায়ের ব্যাগটা হাতে করে নিয়ে স্যার উপরের দিকে উঠে গেলো। আমি ব্যাগ গুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। ব্যাগ থেকে শালটা বের করে গাঁয়ে জড়িয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। এতো সুন্দর লাগছিলো যেনো নিজেকেই নিজে চিনতে পারছিলাম না। অবাক নয়নে তাকিয়ে শুধু নিজেকেই নিজে দেখে চলছি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here