হারানো সুর-১৭তম পর্ব
©শাহরিয়ার
মা বললো দু’দিন পর যাবে, আমাকে আর সাবাকেও সাথে যেতে বললো। আমি বললাম না মা সামনে আমার আর সাবার দু’জনের পরীক্ষা।
মা: তাও ঠিক কিন্তু তোরা দু’জন কি একা থাকতে পারবি যদি কোন সমস্যা হয়?
কোন সমস্যা হবে না মা, তাছাড়া গেটেতো দারোয়ান থাকেই সব সময় বাড়িতে তো আর বাহিরের লোকজন আসা যাওয়া করতে পারবে না।
মা: তবুও জাহাঙ্গীর তোদের দু’জন কেও সাথে নিতে বললো। অনেক দিন তুইও কোথাও দূরে ঘুরতে যাসনি।
চাইলেইতো আর সব কিছু সব সময় সম্ভব হয়না মা। আপনি স্যারকে একটু বুঝিয়ে বলবেন স্যার ঠিক বুঝে যাবে। মা আমি নিজে কিছু করতে চাই।
আমার এখন সারাদিন ঘর বন্দি হয়ে থাকতে ভালো লাগে না। বাহিরের জগৎটার সাথেও পরিচিত হওয়া দরকার।
মা: বেশতো তোর যদি ভালো না লাগে তুই এক কাজ করতে পারিস। পত্রিকায় চাকরির অনেক খবর আসে। সেখান থেকে ভালো দেখে এপ্লাই কর। কোথাও রেফারেন্স লাগলে আমি আছি জাহাঙ্গীর আছে। কোন রকম সমস্যা হবে না। কিন্তু তার আগে সেমিস্টারের পরীক্ষাটা ভালো করে দিয়ে শেষ কর।
আচ্ছা মা ঠিক আছে। বলে নিজের কাজ কর্ম করতে শুরু করলাম। আমি আসলে বুঝতে পেরেছি স্যারের প্রতি আমি বেশ ভালোই দূর্বল হয়ে পরেছি। তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটা চাকরি করার খুব প্রয়োজন। স্যারকে ভুলে থাকার জন্য এই চাকরি করা প্রয়োজন। আমি কি করে এতোটা অবুঝ হলাম বুঝতেই পারছি না। জীবনে একবার ভালোবেসে ঠকেছি আবার কি করে কাউকে এ মন ভালোবাসতে পারে? তাও যার যোগ্য নই। যাকে কখনো মন খুলে বলতে পারবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাইতো আল্লাহর নিকট সব সময় চাই মা কিংবা স্যার কোন ভাবেই যেনো আমার অন্তরের ভিতরের কথা জানতে বা বুঝতে না পারে। আমার মেয়েটার ভবিষ্যৎ আমি কোন ভাবেই নষ্ট করতে পারি না। বিয়ে না করে আমি সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।
দেখতে দেখতে দু’টো দিন কেটে গেলো। সকাল সকাল মা আর স্যার রেডি হয়ে ডাইনিং এ চলে আসলো। আজ ভার্সিটিতে আমার ক্লাশ নেই। সকালে উঠেই নাস্তা বানিয়ে ডাইনিং এ রেখে রুমে চলে এসেছি। এসে সাবাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে স্কুল ড্রেস পরালাম। এরপর ওকে ডাইনিং এ পাঠিয়ে দিলাম নাস্তা করার জন্য।
জাহাঙ্গীর: তোমার মা কি করে মামুনি?
সাবা: ঘর গুছিয়ে রাখছে। আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে তাই।
স্যার দুই তিন বার উচ্চ স্বরে আমাকে ডাক দিলো। আমার ভিতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। এই মানুষটার সামনে আমি যেতে চাই না। সামনে পরতে চাই না কেন বুঝে না মানুষটা? অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
জাহাঙ্গীর: তোমার ঘর গোছানোর কাজ কি আগে? আমরা আর একটু পর বের হয়ে যাবো, তোমাদের সাথে যেতে বললাম যাবে না। বেশ ভালো কথা কিন্তু একটা মানুষ যদি বাড়ি থেকে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য রওনা হয়। তখন তাদের সাথে থাকতে হয় এটাতো তুমি বুঝ। নাকি বুঝ না?
মা: আহ থাম কি করছিস? ওর কাজ ছিলো সেগুলো করতে হবে না?
স্যার এতো গুলো বছরে কখনো আমার সাথে এতোটা উচ্চ স্বরে কথা বলেনি। আমার চোখ দু’টো ভিজে আসছে। বহু কষ্টে আটকে রেখেছে। যে কোন সময় তা সমুদ্রের স্রোতের মত বয়ে যেতে শুরু করতে পারে।
জাহাঙ্গীর: খুব শান্ত গলায় বললো নাস্তা খেতে বসো। আবার কবে এক সাথে খাবার খাবো তার ঠিক নেই।
আমি সাবার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। আসলে আমি কি বলবো তাও বুঝতে পারছি না। আর স্যারের এমন ব্যবহারেরই বা কারণ কি তাও আমার অজানা। নানান রকম কথা ভাবছি আর নাস্তা খাচ্ছি। এমন সময় মা বললো।
মা: চার বছরের ও বেশী সময় আমরা এক সাথে ছিলাম প্রায় সবটা সময়। এভাবে তোকে একা রেখে যেতে আমাদের একটু ভালো লাগছে না। বিশেষ করে সাবাকে। সেই পিচ্চি পুতুলটা আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে। ওকে না দেখে থাকতে আমার খুবি কষ্ট হবে। এ জন্যই বলেছিলাম তোরাও চল আমাদের সাথে।
অনেকটা সময়ে নিজেকে বেশ সামলে নিয়েছি। মুখে হাসি ফুটিয়ে মা আপনারা যান। পরবর্তিতে না হয় আমরাও যাবো আর দশ বারো দিন পর সাবার পরীক্ষা আপনিই বলেন এ সময় কি কোথাও যাওয়া সম্ভব?
এভাবেই আরও অনেক কথা হলো আমাদের সকলের মাঝে। এক সময় মা আর স্যার বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেলো কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম গাড়িটা অদৃশ্য হবার আগ পর্যন্ত। তারপর সাবাকে সাথে নিয়ে রওনা হলাম স্কুলের উদ্দেশ্যে।
সাবাকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম। বাড়িটা একদম ফাঁকা, মা থাকতো সব সময় বাড়িতে আজ মা নেই বাড়িতে, গল্প করার মত কেউ নেই। আমি আমার জীবনে দু’জন মানুষকে কখনো ভুলতে পারবো না। আমার শাশুড়ি আম্মা আর এক স্যারের মা। এদের দু’জনের কাছ থেকে এতো এতো ভালোবাসা পেয়েছি যা কাউকে বলতে বা বুঝাতে পারবো না।
বিকেলে সাবাকে পড়াতে বসেছি আজ বাড়িটা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। প্রতিদিন বিকেলে এ সময় মা আর আমি বসে গল্প করি টিভি দেখি আর চা খাই। আজ একদমই ভালো লাগছে না।
রাতের খাবার খেতে এসেও একই অবস্থা পুরো নিরব হয়ে রয়েছে বাড়িটা। মা নেই স্যার নেই। আজ খাবার খেতেও ভালো লাগছে না।
দেখতে দেখতে তিনটা দিন চলে গেলো। স্যারের সাথে কি তবে ঝর্ণার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলো? হলেই বা আমার কি? এমনটাইতো হবার কথা আমারতো কষ্ট লাগার কোন কারণ নেই বরং আমার আরও খুশি হবার কথা। তবে এতো কষ্ট কেন লাগছে বুঝতে পরছি না। মনে হচ্ছে বুকের উপর বিশাল বড় একটা পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।
সাবাকে পড়াতে বসেছি এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। আমি দৌঁড়ে যেয়ে দরজা খুলতেই মা আর স্যারকে দরজার সামনে দেখতে পেলাম। মা মুখটা কালো করে রেখেছেন। স্যারকে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই দেখতে পেলাম। আমি বাহিরে আরো কাউকে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু না আর কেউ আসেনি। মা আর স্যার বাড়ির ভিতর ঢুকলো।
আমি মায়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে দু’তলায় নিয়ে উঠতে শুরু করলাম। মা ও পিছু পিছু আসছে। দু’তলায় উঠে মায়ের রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম মা শরীর কি খারাপ লাগছে?
মা: নারে মনটাই ভালো নেই।
কেন মা কি হয়েছে?
মা: আর বলিস না কোন ভাবেই ছেলেটাকে বিয়েতে রাজী করাতে পারলাম না। কোন না কোন উসিলা দেখাবেই ছেলেটা। ঝর্ণা মেয়েটার মুখের দিকে আর তাকানো যায় না। বোনটার ও মন খারাপ। আরও কিছু দিন সময় চেয়ে এবারের মত চলে আসলাম।
কথা গুলো শুনে কেন জানি বুকের উপর থেকে পাথর চাপা কষ্টটা কমে যেতে শুরু করলো। মা চা খাবেন চা করি।
মা: হ্যাঁ কত দিন তোর হাতের চা খাই না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তুই যেয়ে চা রেডি কর।
আচ্ছা ঠিক আছে বলে আমি সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে আসলাম। রান্না ঘরে ঢুকে চায়ের পানি গরম দিলাম।
হঠাৎ করেই ডাইনিং এ এসে স্যার বললো এককাপ চা বেশী করে কইরো। সাবা আর স্যার ডাইনিং এ বসে গল্প করছে। তাদের সাথে এসে মা ও যোগ দিলো। আমি চা বানিয়ে নিয়ে ডাইনিং এ তাদের সাথে যোগ দিলাম।
সাবা: নানু গ্রামের বাড়ি দেখতে কেমন?
মা: খুবি সুন্দর তোমার পরীক্ষা শেষ হোক এক সময় তোমাকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে যাবো।
সাবা খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। স্যার সাবাকে বললো তুমি গ্রামে যেয়ে কি করবে? এখানেই ভালো আছো। গ্রামে ধূলাবালি কাদামাটি হাঁটতে পারবে না খেলতে পারবে না। তার চেয়ে আমাদের শহর খুব ভালো।
আমি স্যারের কথা শুনে হাসছি।
জাহাঙ্গীর: এই হাসছো কেন? আমি কি ভুল বললাম?
হ্যাঁ স্যার অনেকটা ঐরকমই।
জাহাঙ্গীর: মানে কি রকম?
ঐ যে বললেন ধূলোবালিতে ভরা, আসলে স্যার গ্রামের চেয়ে শহরে ধূলোবালি বেশী। আর কাদামাটির কথা বলছেন। গ্রামের মেঠোপথ, কৃষি জমি এসবের ঘ্রাণই আলাদা। গ্রামের কাদামাটি শরীরে মেখেই আমি বড় হয়েছি। আমি গ্রামের মেয়ে গ্রামে যে সুখ আছে তা আপনি পৃথিবীর কোন শহরে পাবেন না। আমার খুব ইচ্ছে যদি কখনো সুযোগ হয়। তবে গ্রামে খুব সুন্দর একটা দু’তলা বাড়ি করবো। যার ছাদে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস আর সে বাতাসে দোল খাওয়া ধান ক্ষেত দেখা যাবে।
স্যার কিছু বলতে যাবে তার আগেই মা স্যার কে থামিয়ে দিলো।
মা: কি শুরু করলি তোরা দু’জন। একটুতো থামবি, চা খেয়ে নেই শান্তিমত তারপর না হয় ঝগড়া করিস দু’জন মিলে।
আমি আর স্যার এক সাথে হেসে উঠলাম। সাবা বলে উঠলো সবাই চুপ করো নানু চা খাবে।
সাবার কথায় এবার সকলে এক সাথে শব্দ করে হেসে উঠলাম। আজ তিনদিন পর বাড়িটা পরিপূর্ণ হয়েছে। গত তিনটা দিন বাড়িটা নিরব নিস্তব্ধ হয়েছিলো। আজ গল্প হাসি আনন্দে মেতে উঠেছে পুরো বাড়িটা। বেশ ভালো লাগছে আসলে বাড়ি এমন না হলে কি হয়? হাসি থাকবে আনন্দ থাকবে, সে হাসি আর আনন্দে চাপা পরবে অনেক দুঃখ কষ্টের গল্প।
রাতের খাবার খেয়ে সাবাকে নিয়ে বিছানায় এসে শোয়ে পরতেই। মনে হলো ঘুমের দেশ থেকে আজ সকল ঘুম আমার চোখে বেড়াতে এসেছে। মুহুর্তেই ঘুমিয়ে পরলাম।
দেখতে দেখতে দিন চলে যায়। সাবার পরীক্ষা চলে এসেছে। আমার মাথায় খুব চিন্তা হচ্ছে আমার ও পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে আর কিছুদিন পর। আমি জানি সাবার পরীক্ষা ভালো হবে। ওর ব্রেণ খুবি ভালো। আমার প্রস্তুতিও আল্লাহর রহমতে ভালো। এবার পরীক্ষা শেষ হলে আর একটি বছর ভার্সিটিতে থাকবো। তারপর শেষ হয়ে যাবে আমার ভার্সিটি জীবন। তার আগেই আমাকে একটা জব জোগার করতে হবে যাতে করে নিজের একটা ঠিকানা করতে পারি।
দেখতে দেখতে সাবার পরীক্ষাও শেষ হয়ে এলো। এদিকে আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। সাবার স্কুল বন্ধ তাই ওকে বাসায় মায়ের কাছে রেখে আমি চলে আসি পরীক্ষা দিতে। মাঝে মাঝে স্যার আমাকে ভার্সিটিতে দিয়ে যেতে চায়। আমি কোন না কোন উছিলা দেখিয়ে স্যারের সাথে আসি না। মানুষটাকে যে আমার ভুলে যেতে হবে ভুলে থাকতে হবে। যেমন করে ভুলে আছি শাকিল নামক সেই বেঈমানটাকে। আমার জীবনে যে সুখের কোন সুর বাজে না। হারিয়ে খুজি বার বার সুখের ঠিকানা। নদীর জোয়ার ভাটার মত হয়ে গিয়েছে জীবনটা। সুখ এখন মনে হয় আমার কাছে মরিচিকা। হারানো সুর যতই খুজিনা কেন, সে সুর আর ফিরে পাবো না।
চলবে…
[আসসালামু আলাইকুম, গল্পটা শেষের পথে, হয়ত্র আর আর এক থেকে দুই পর্ব হবে। তাই নাইস নেক্সট না লেখে ভুল গুলো তুলে ধরবেন। যেনো আগামিতে ভুল গুলো শুধরে নিতে পারি। বানান ভুল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, ধন্যবাদ সবাইকে]