হারানো সুর পর্ব-১৮

0
583

হারানো সুর-১৮তম পর্ব
©শাহরিয়ার

দিন গুলো কেটে যাচ্ছে শেষ হয়ে যাচ্ছে একটা একটা করে আমার পরীক্ষা। মনে বিষাদ ভর করেছে। কতশত অভিমান মনের মাঝে এসে জমা পরছে। তবুও আল্লাহর উপর ভরসা রেখে হাসি মুখে বেঁচে রয়েছি। আমি জানি আল্লাহ যা করেন তার বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। নিশ্চই আল্লাহ আমার জন্য যা কল্যানকর তাই রেখেছেন। পাঁচ বছরের বেশী সময় এ বাড়িতে রয়েছি। সবাইকে কত আপন মনে হয়।

অবশেষে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। অবসর সময় গুলোতে আমি পত্রিকা দেখে চাকরির জন্য যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মাও আমাকে বেশ সাহায্য করে চলেছেন। মাঝে মাঝেই আমাকে সাথে করে নিয়ে যান। আমি ইন্টারভিউ দেবার সময় সাবা মায়ের সাথেই থাকে। সাবা এবার নার্সারি থেকে প্রথম শ্রেণীতে উঠেছে। বেশ চঞ্চল হচ্ছে দিন দিন মেয়েটা। কোথাও থেকে তেমন কোন সারা পাচ্ছি না চাকরির। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। অনেকেই বলছে জানানো হবে। আমি এতে হতাশ হইনি, কারণ আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই চাকরি করার। তাই চাইলেই খুব সহজ চাকরি পাবো না এটা আমি ভালো করেই জানি।

এক সকালে স্যার অফিস চলে গেছে, আমি সাবাকে স্কুলে দিয়ে এসেছি। মা মুখটা কালো করে সোফায় বসে রয়েছে। মাকে কখনো এমন ভাবে আমি থাকতে দেখিনি। আমি দ্রুত মায়ের কাছে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলাম মা আপনার কি হয়েছে?

মা: তুই আমার সাথে কথা বলিস না। আমি এতোদিন যদি জানতাম তোর জন্য আমার এতো বড় ক্ষতি হবে, তাহলে প্রথম দিনেই আমি তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। তোকেতো এতোগুলো দিন আমি নিজের মেয়ের মত দেখেছি।

মায়ের কথার কোন কিছুই আমি বুঝতে পারছিলাম না। সব কিছু কেমন এলোমেলো মনে হচ্ছে আমার কাছে। কোথায় আর কি গন্ডগোল লাগলো। মা আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না কি হয়েছে।

মা: আমার ছেলে বিয়ে করতে চায় না এর কারণ তুই। বলেই কান্না করতে শুরু করলো।

মায়ের এমন কথা শুনে আমি অবাকের শেষ চূড়ায় এসে পৌঁছালাম। কি বলছে মা এসব আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। স্যার বিয়ে করছে না এর জন্য আমাকে কেন দোষী বলছে। আমি কি এমন ভুল করলাম? যতটা পেরেছি নিজেকে সামলে রেখেছি। স্যারকে ভালোবেসেও তা প্রকাশ করিনা ভুল করেও। কখনো ভুলেও মনের কথা একটি বারের জন্যও মুখে নিয়ে আসিনি। অথচ আমি কি করে তার বিয়ে না করার পেছনে দায়ী এটাই বুঝতে পারছি না।

মা: রত্না তুই কোথাও চলে যা আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করিস না। তোর কাছে আমি অনুরোধ করছি। তোর যত টাকা লাগে আমি দিবো তবুও তুই সাবাকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যা।

বেশতো মা আপনি বলছেন আমি চলে যাবো। কিন্তু আমার অপরাধটা কি? সেটা কি আমি জানতে পারি কি ভুলের জন্য আমাকে দোষী করা হচ্ছে।

মা: কান্না থামিয়ে দোষ তোর না আমার ছেলের আমি জানি না। কিন্তু আজ যখন আমি ওর রুমে যাই তখন একটা ডায়েরী পাই টেবিলের উপর। ছেলের আমার ডায়েরী লেখার শখ কখনোই ছিলো না। তাই কৌতুহল না থামাতে পেরে আমি ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলাম। ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় শুধু তোকে নিয়েই লেখা। আমার ছেলে নাকি তোকে ভালোবেসে ফেলেছে। তুই বল এটা কি মেনে নেয়া সম্ভব? আমাকেতো সমাজের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে হবে। এ সমাজে বসবাস করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা আমি যে আমার বোনকে কথা দিয়েছি ঝর্ণাকে এ বাড়ির বউ বানিয়ে নিয়ে আসবো। এখন তুই বল আমি কি করবো?

মায়ের কথা শুনে আমি একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এসব আমি কি শুনছি, নিজের কানকেই যেনো আমি বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। স্যারের মনের ভিতর এতো কিছু ছিলো অথচ বাহির থেকে পৃথিবীর কোন মানুষের বুঝার ক্ষমতা হবে না। তার ব্যবহারে এই পাঁচ বছরের ও বেশী সময়ে আমি ভুল করেও বুঝতে পারিনি তার মনের কোনে আমার জন্য জায়গার সৃষ্টি হয়েছে।

হুট করেই মা দু’হাত দিয়ে আমার হাত চেপে ধরলো। মিনতি করে বলতে শুরু করলো প্লীজ রত্না তুই চলে যা। নয়তো সব কিছু ছেড়ে আমাকেই চলে যেতে হবে। হয় এ বাড়ি ছেড়ে নয়তো এ দুনিয়া ছেড়ে। আমি জীবনে কখনো অসম্মানিত হয়নি। আর তাই হতেও চাইনা।

আমি চোখের পানি মুছে এ কি করছেন মা? আপনি আমাকে আদেশ করবেন এ বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্য। আপনি মা আমি সন্তান। আমি আপনার অসম্মানের কারণ হয়ে কখনোই বেঁচে থাকতে চাই না। আমি চলে যাবো বহুদূর চলে যাবো। আপনাকে কোন রকম টেনশন করতে হবে না।

মা: তোর যখন যত টাকা লাগবে যে কোন সাহায্য লাগবে আমাকে বলবি আমি তোকে সাহায্য করবো। বলতে বলতে মা উপরে উঠতে শুরু করলো।

শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। অসময়ে কে এলো চোখের পানি মুছে যেয়ে দরজা খুলতেই দারোয়ান চাচা বললো আপনার নামে এই কুরিয়ারটা এসেছে।

আমি অবাক হয়েছে খামটা হাতে নিলাম। কেননা আমি এখানে থাকি এটা আমার কোন পরিচিত জনরা জানে না। তাহলে কোথায় হতে আসলো এ চিঠি? ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম নিজের রুমের দিকে। ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে খামটা খুলতেই মনের ভিতর আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। আমি আরও একবার প্রমাণ পেলাম আল্লাহ যা করেন তার বান্দার ভালোর জন্যই করেন। আমি চিঠিটা খামের ভিতর ঢুকিয়ে নিলাম। এরপর আমার আর সাবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, জামাকাপড় দু’টো ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম। ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রওনা হলাম সাবার স্কুলের পথে। সাবাকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম।

সাবাকে ফ্রেশ হতে বলে আমি দু’তলায় চলে আসলাম। স্যারের রুমের ভিতর ঢুকে টেবিলের উপর রাখা ডায়েরিটা লুকিয়ে নিয়ে মায়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলাম।

মা রুমের ভিতর থেকে বের হয়ে আসলো। তার মন ভালো নেই আমি জানি। চলুন দুপুরের খাবার খেয়ে নিবেন।

মা: আমার ক্ষুধা নেই, তোরাই খেয়ে নে।

খাবো মা আজ না হয় তিনজন শেষ বারের মত এক সাথে খেয়ে নেই। স্যার আসার আগেই আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তাই মা প্লীজ চলুন না শেষ বারের মত এক সাথে বসে খেয়ে নেই। হয়তো আর কখনোই আপনার সাথে বসে খেতে পারবো না। গল্প করতে পারবো না।

মা: আজই চলে যাবি মানে কোথায় যাবি? এই শহর কত ভয়ংকর সে কি তুই জানিস না? আগে একটা ব্যবস্থা করে তারপর না হয় বাড়ি থেকে বের হবি।

কিছু হবে না মা, যার কেউ নেই তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট্য এই যে গত পাঁচটি বছরের ও বেশী সময় আমি এখানে ছিলাম। এই ব্যবস্থা আল্লাহ করে দিয়েছিলেন বলেই থাকতে পেরেছিলাম। এখন যদি আল্লাহ চান আমাকে অন্য ব্যবস্থাও তিনি করে দিতে পারবেন।

আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মায়ের চোখে পানি টলমল করছে। তাই মাকে হাসানোর জন্য বললাম এখন কি খাওয়ার জন্য যাবেন? নাকি এ বাড়িতে আমার রিজিক সকালেই শেষ হয়ে গেছে?

মা: দু’হাতে চোখের পানি মুছে কি বলিস এসব। দু’জন এক সাথে নিচে নেমে আসলাম। ডাইনিং এ এসে সাবাকে ডাক দিতেই সাবা দ্রুত চলে আসলো ডাইনিং এ। এসে রোজকার মত মায়ের পাশের চেয়ারটাতেই বসলো। মা সাবার মুখে তুলে খায়িয়ে দিচ্ছে আমি জানি এই দৃশ্য আর কোন দিন দেখতে পারবো না। আমার কাছে ক্যামেরা থাকলে শেষ বারের মত ঘটা এই দৃশ্যটা আমি ক্যামেরা বন্দী করে রাখতাম। মায়ের চোখে পানি চলে এসেছে হয়তো মাও বুঝতে পারছে এরপর আর কেউ নানু নানু বলে ছুটে আসবে না তার কাছে। হয়তো এইটুকুন বাচ্চা মেয়েটা আর জ্বালাবে না তাকে। সেই দুই বছর বয়সে আসা সাবা আজ সাত বছর বয়সের বেশী হয়ে গিয়েছে। আদর যত্ন মায়া মমতা কোন কিছুর কমতি ছিলো না মায়ের।

তবুও দিন শেষে সব মায়েরাই চাইবে তার ছেলেটা কিংবা তার মেয়েটা ভালো থাকুক। এর জন্যইতো সারাটা জীবন এতো কষ্ট করা। নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে তাদের মানুষ করা।

দুই মগ গরম গরম চা করে নিয়ে এসে, এক কাপ মায়ের দিকে এগিয়ে দিলাম আর এক কাপ নিজের কাছে রাখলাম। মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে, আমি যদি কোন অন্যায় করে থাকি তবে আমাকে মাফ করে দিবেন। আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনোই আপনাকে কষ্ট দেইনি বা দিতে চাইনি তবুও যদি আমার ব্যবহারে আপনি কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে ক্ষমা করে দিবেন। আমি জানিনা আমি আল্লাহর দুনিয়াতে কি অন্যায় করেছি যার শাস্তি সরূপ আমি তিন তিনটা মাকে হারাতে চলেছি।

মা: আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে রত্নারে আমার হৃদয়টা জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি পৃথিবীর কাউকেই দেখাতে বা বুঝাতে পারবো না। আমি জানি আমি তোর প্রতি অন্যায় করছি, যা করছি তা ঠিক না। কিন্তু আমি তোদের বুঝাতে পারবো না। আমার কেমনটা লাগছে।

ইনশা আল্লাহ মা সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি কোন রকম চিন্তা করবেন না। আর হ্যাঁ নিয়মিত ঔষধ খাবেন। আমি ভালোই থাকবো আমাকে নিয়ে সাবাকে নিয়েও একদম চিন্তা করতে হবে না না।

মা: কিন্তু তোরা যাবি কোথায়?

আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে আল্লাহ যেখানে রিজিকের ব্যবস্থা করে রেখেছেন সেখানেই যাবো।

বাড়ি থেকে বের হবার ঠিক আগ মুহুর্তে মা তার নিজের গলা থেকে সোনার চেইনটা খুলে সাবার গলায় পরিয়ে দিলেন। আমি অনেক নিষেধ করলেও মা শুনলেন না।

মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে পরলাম। বেশী দেরী করলে স্যার চলে আসবে আর তখন বের হওনা সম্ভব হবে না। সোজা রওনা হয়ে গেলাম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। আসতে আসতে রাত আটটা বেজে গেলো। টিকিট কাটতে যেয়ে জানতে পারলাম রাত সাড়ে দশটার আগে কোন বাস ছাড়বে না রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে। কাউন্টারে বেশী সময় বসে থাকতে পারবো না। তাই সাবাকে নিয়ে একটা হোটেলে যেয়ে বসে সাবার জন্য নাস্তা কিনে খাওয়াতে শুরু করলাম। সময় যেনো কাটতে চায় না। প্রতিটা মিনিট কতটা কষ্টে কাটছিলো সে শুধুই আমি জানি। অবশেষে রাত সাড়ে দশটায় বাস ছাড়লো।

দীর্ঘ সময় বাসে বসে থেকে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বাস থেকে নামলাম। চিঠিতে থাকা ঠিকানাটা আরেক বার দেখে সে জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম।

এতো এতো সকাল সকাল আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন এবং বললেন আপনি জার্নি করে এসেছেন ফ্রেশ হয়ে নিন। আপনাকেতো তিন দিন সময় দেয়া হয়েছিলো রিপোর্ট জানানোর জন্য আপনি জয়েন করবেন কিনা।

আমি হাসি মুখে জানালাম আসলে ফ্রী ছিলাম তাই চলে আসলাম।

বেসরকারি ভাবে পরিচালিত এই সংস্থার কাজ হচ্ছে উপজাতি ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার কার্যকম পরিচালনা করা। আমি সব কিছু বুঝে নিলাম। আমাকে থাকার ব্যবস্থা করা হলো স্কুলের কাছেই দুই রুমের একটা বাসা। নিরিবিলি পরিবেশে বাসাটা বানানো। এখানের বাড়ি ঘর গুলো একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়ির দূরত্ব অনেকটাই।

সকাল থেকেই সাবার শরীর খুব অসুস্থ। ভালোই জ্বর এসেছে বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার চেকআপ করে কিছু ঔষধ দিলো।

রাতে বিছানায় বসে রুমনের কাছে চিঠি লেখতে শুরু করলাম। অনেকদিন যোগাযোগ নেই। কেমন আছে কি করছে জানা খুব দরকার।

জাহাঙ্গীর মাকে অনেক বলর কয়ে বুঝিয়েছে। সারা রাত পুরো শহরের অলিতে গলিতে রত্নাকে খুঁজেছে কোথাও ওদের পায়নি।

পরদিন সকাল থেকেই আমি আদিবাসী শিশুদের পড়াতে শুরু করলাম। জীবনের আরেক সংগ্রাম শুরু হলো আমার। একজনকে দিয়ে চিঠিটা পোষ্ট করে দিলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। রুমন চিঠিটা পেলে নিশ্চই উত্তর দিবে এ বিশ্বাসে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here