হারানো সুর-৯ম পর্ব
©শাহরিয়ার
মা সাবাকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকলো। আমি মায়ের দিকে কৌতুহলি চোখে চেয়ে রয়েছি।
মা: কিরে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তুই কি রোস্ট রান্না করতে পারিস?
আমি মাথা নেড়ে বললাম না পারি না তবে দেখিয়ে দিলে পারবো।
মা: হাসি দিয়ে আচ্ছা আমি দেখিয়ে দিবো। রোস্ট বানানো খুবই সহজ। এখন তুই ওর জন্য খাবার রেডি কর।
আমি মাথা নেড়ে সাবার জন্য খাবার রেডি করতে শুরু করলাম। খাবার রেডি হতেই মায়ের হাতে তুলে দিলাম মা খাবার আর সাবাকে নিয়ে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমি রান্নায় মনোযোগ দিলাম। পোলাও রান্না হয়ে যেতেই মা সাবাকে ঘরে শুয়িয়ে দিয়ে রান্না ঘরে চলে আসলো। আমি মাকে বললাম রান্না হয়ে গেছে।
মা: আচ্ছা দেখো কিভাবে রোস্ট রান্না করতে হয়।
এরপর মা আমাকে দেখিয়ে দিতে শুরু করলো কিভাবে রোস্ট রান্না করতে হয়। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে মা যেভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে আমি সেই ভাবে রান্না করতে শুরু করলাম। অনেকটা সময় লাগলো রোস্ট হতে।
মা: এবার যেয়ে ফ্রেস হয়ে নাও। অনেক বেলা হয়ে গেছে।
আমি মায়ের কথা মত রান্না ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। নিজের রুমে এসে শাড়ি নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম। লম্বা একটা শাওয়ার শেষ করে আমি রেডি হয়ে বের হতেই দেখলাম, দুই তিনজন লোক অনেক গুলো বেলুন ফুলিয়ে বাড়ির ভিতর খুব সুন্দর করে সাজিয়ে চলছে। আমি তাদের কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই মা এসে আমাকে প্রশ্ন করলো কেমন হচ্ছে সাজানো?
আমি মাথা নাড়িয়ে তারপর মুখ দিয়েও বললাম খুব সুন্দর হয়েছে। হঠাৎ এতো আয়োজন নিজেকে আর চুপ করে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলাম না। মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম। মা বললেন না এতো আয়োজন কেন?
মা: এবার মা উচ্চ স্বরে হেসে দিয়ে বলতে শুরু করলো, আরে আজ জাহাঙ্গীরের জন্মদিন তাইতো এতো আয়োজন। আমার একমাত্র ছেলের জন্মদিন। আমিতো বিশাল আয়োজন করতে চাই কিন্তু ও করতে দিতে চায় না। অল্প কিছু অফিস কলিগদের সাথে নিয়েই পালন একটু আনন্দ করে এই দিনটা পালন করে থাকে। অথচ একটা সময় ছিলো যখন ওর জন্মদিনে পুরো বাড়ি রঙ বেরঙের আলোক সজ্জায় সাজানো হতো। পুরো বাড়ি ভর্তি মেহমান দিয়ে ভরা থাকতো। আত্মীয় স্বজনদের মিলন মেলা লেগে যেতো আমাদের বাড়িতে। ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে আর কোন রকম বড় ধরণের অনুষ্ঠান করতে চায় না ছেলেটা। আমিই জোড় করে এই সকল অনুষ্ঠান করে থাকি। ওর অফিসের কয়েকজন কলিগদের দাওয়াত করি, যাতে করে ওর ভালো লাগে সে জন্য।
আমি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, পানি চিকচিক করছে। তবে এ পানি কষ্টের পানি না, এটা আনন্দের পানি। মায়ের চোখে সন্তানের জন্য যে ভালোবাসা থাকে। সে ভালোবাসায় চোখের কোনে কিছু হীরা চিকচিক করে জ্বলছে। এতো আনন্দ দেখে আমার নিজের চোখের কোনে কখন জল চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। লোক গুলোর ঘর সাঁজানো শেষ হতেই কাছে এসে বললো আমাদের কাজ শেষ আমরা কি চলে যেতে পারি?
মা খুশি হয়ে ওদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে হ্যাঁ বাবা তোমরা যেতে পারো। আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করবে।
ছেলে গুলো খুশি হয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। আমি মায়ের চোখে সন্তানের জন্য ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। কতটা ভালোবাসেন একজন মা নিজের সন্তানকে। তা উনাকে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না। জীবনে এই প্রথম আমি এতো বড় বাড়ির কোন অনুষ্ঠান দেখছি। আর এতো বড় আর সুন্দর জন্মদিনের আয়োজন এই প্রথম দেখছি। কত টাকা না খরচ হয় এমন একটা আয়োজন করতে। আমার মেয়ের জন্মদিনে কেক নিয়ে যেতো শাকিল সে কেক কাটতাম সবাই মিলে। তাতেই আমার কাছে বেশ আনন্দ লাগতো। আর এতো বড় বাড়ি এতো আয়োজন। তাহলে এদের আনন্দের শেষ কোথায়?
কথা গুলো ভাবছিলাম যখন ঠিক তখনি কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি দৌঁড়ে যেয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পেলাম একটা লোক বিশাল একটা কেক এর প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতো বড় কেকে এর আগে আমি কখনোই দেখিনি। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি কেকটার দিকে। ডেলিভারির ছেলেটা বলে উঠলো ম্যাম কেকটা কোথায় রাখবো।
আমি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতে বললাম। ছেলেটা কেক নিয়ে যেয়ে ডাইনিং এর উপর রাখলেন। মা এসে কেকটা চেক করে ছেলেটাকে বিল সাথে কিছু টাকা বেশী দিয়ে বললো আজ আমার ছেলের জন্মদিন আজ আমি অনেক খুশি। আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আজ কত খুশি এই মানুষটা। আর খুশি হবারই কথা ছেলের জন্মদিন বলে কথা।
আরও কিছু টুকটাক কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে আসলো। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠলো। আমি সালাদ রেডি করছিলাম। মা বললো তুই কাজ কর আমি যেয়ে দেখি কে আসলো।
মা যেয়ে দরজা খুলতেই জাহাঙ্গীরের বেশ কিছু সহকর্মী বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়লো। মা ওদের বসতে বললো। ওরা সকলে বসে গল্প করছে। মা আমার কাছে এসে জানতে চাইলো আর কতক্ষণ লাগবে। আমি তাকে জানিয়ে দিলাম আমার শেষের দিকে।
মা: আচ্ছা আমি মেহমানদের হালকা নাস্তা দেই, ততক্ষণে তুই তোর কাজ শেষ করে নে। হয়তো আর অল্প সময়ের মাঝেই জাহাঙ্গীর চলে আসবে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম ঠিক আছে, মা চলে গেলেন মেহমানদের নাস্তা দেবার জন্য। অল্প সময়ের ভিতর আমার সব কাজ শেষ হয়ে গেলো। আমি সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে নিলাম। এমন সময় আবারো কলিং বেল বেজে উঠলো আমি বুঝতে পারলাম জাহাঙ্গীর এসেছে। মা দরজা খুলে দিতেই উনার সহকর্মীরা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করলো।
মা টেবিলের উপর বিশাল কেকটা রেখে আমাকে ডাক দিতে রান্না ঘরে আসলো।
মা: তাড়াতাড়ি সাবাকে নিয়ে আয় কেক কাটবো এখুনি।
আমি কি করবো? এতো মানুষের ভিড়ে আমার লজ্জা লাগবে মা। তার চেয়ে বরং আপনারাই কেক কাটুন। আমি পরে খাবার পরিবেশন করবো।
মা: মেয়ে বলে কি পাগল নাকি তুই? তুই আর সাবা দু’জনই এ বাড়ির সদস্য তোদের রেখে কেক কাটবো অসম্ভব। তাড়াতাড়ি সাবাকে রেডি করে নিয়ে আয়।
আমি মাথা নেড়ে বললাম ঠিক আছে। মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমিও তার পিছু পিছু বের হয়ে রুমে গিয়ে সাবাকে ঘুম থেকে তুলে সুন্দর দেখে জামা পরালাম। তারপর ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম অনুষ্ঠানের দিকে। আমি জীবনে কখনো এতো বড় লোক বাড়ির অনুষ্ঠানে উপস্থিত হইনি। তার উপর এতো অপরিচিত মানুষ এসব ভাবতেই ভীষণ ভয় লাগছিলো আমার। ভাবতে ভাবতে ভয়ে ভয়ে অবশেষে উপস্থিত হলাম সেই টেবিলের সামনে। সকলে জাহাঙ্গীরকে ঘিরে রেখেছে। টেবিলের উপর রাখা কেকের উপর মোমবাতি জ্বলছে। আমি যাবার পর জাহাঙ্গীর এসে সাবাকে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে যেয়ে আবার দাঁড়ালো কেকের সামনে। তারপর ফুঁ দিয়ে মোমবাতি গুলো নিভিয়ে ফেললো। এরপর ছুড়ি দিয়ে কেক কাটতে শুরু করলো। সকলে এক সাথে হাত তালি দিচ্ছে সাথে বলতে শুরু করলো হ্যাপি বার্থডে টু ইউ জাহাঙ্গীর। আমিও সবার সাথে সাথে হাত তালি দিচ্ছি কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
কেক কাটা শেষ হতেই মায়ের মুখে কেক তুলে দিলো। মা আবার উনার ছেলের মুখে কেক তুলে দিলো। কি সুন্দর এক অপূর্ব দৃশ্য। আমার মা বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো কোনদিন আমার জন্মদিন পালন করলে নিশ্চই এভাবে আমার মুখে কেক তুলে দিতো। এরপর জাহাঙ্গীর উনার হাতে থাকা কেক থেকে কিছুটা অংশ সাবার মুখে তুলে দিলো। মা আমাকে ডাক দিলেন। সাথে সবাইকে সোফায় বসতে বললো। মা কেক কেটে কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললো সবাইকে দিয়ে দেবার জন্য। আমি একে একে সবার হাতে তা পৌঁছে দিলাম। কেকের সাথে পায়েস আর কোল ড্রিংস, পানিও সবার কাছে আমি আর মা দু’জন মিলে দিয়ে দিলাম।
সবার কেক খাওয়া শেষ হবার পর মা সবাইকে ডাইনিং এ এসে বসতে বললো খাবার খাওয়ার জন্য। জাহাঙ্গীর বললো সবাইকে খাবার দিতে সে পরে খাবে। বলেই সাবাকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। আমি আর মা সবাইকে খাবার দিলাম। সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলো সকলে খুব প্রশংসা করলো খাবারের। মা বললো এসব রত্নাই রান্না করেছে। সকলের খাবার শেষ হবার পর জাহাঙ্গীর আসলো। সকলে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর। জাহাঙ্গীর সাবাকে আমার কোলে তুলে দিলো।
মা: নে সবাইতো চলে গেলো এবার তুই খেয়ে নে।
জাহাঙ্গীর: তোমরাও সাথে বসো।
আমি না না স্যার আপনি আর মা খেয়ে নিন আমি পরে খাবো।
আমি উনাকে স্যার বলেই ডাকি, কেন জানি উনাকে দেখলে আমার প্রচন্ড রকম ভয় লাগে। হয়তো পুলিশ অফিসার বলেই এমনটা লাগে। উনি মুচকি হেসে খেতে বসলেন। এই হাসির কারণ আমি জানি উনাকে আমি যতবার স্যার বলি ঠিক ততবারই উনি এভাবে হাসেন।
আমি দু’জনকে খাবার বেড়ে দিলাম। প্রথমে পায়েস দিলাম, পায়েস খাওয়া শেষ হবার পর পোলাও আর রোস্ট তুলে দিলাম।
জাহাঙ্গীর: খেতে খেতে আজ খাবারে কেমন জানি ভিন্ন রকম স্বাদ পাচ্ছি।
মা: কেন রে বাবা কোন সমস্যা?
জাহাঙ্গীর: না মা কোন সমস্যা নেই। খাবার খুব ভালো হয়েছে।
মা: আজ সব রান্না রত্নাই করেছে আমি শুধু একটু আধটু দেখিয়ে দিয়েছি।
জাহাঙ্গীর: বলো কি মা এ মেয়ে রাঁধতেও জানে নাকি? আমিতো ভেবেছিলাম শুধু ভয়ে কাঁপতে আর কাঁদতে জানে। পেয়াজ কাটলে যে মেয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলবে সে মেয়ে এতো ভালো রান্না করতে পারে আগে জানতাম না।
স্যার যে মেয়ে কান্না করতে পারে, সে মেয়ে রান্নাও করতে জানে। ঐযে একটা কথা আছে না যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে। কথাটা বলেই জিব্বায় কামড় দিলাম হায় আল্লাহ আমি কি বলতে কি বলে ফেললাম।
জাহাঙ্গীর: হাসতে হাসতে বাহ বাহ বেশ ভালো কথাওতো বলতে পারো দেখছি।
এবার আমি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। কি বলবো কিছুই বুঝতে পারলাম না। জাহাঙ্গীর খাবার শেষ করে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠতে উঠতে বললো বেশ ভালো রেঁধেছো।
ধন্যবাদ স্যার বলেই মাথা নিচু করে সাবাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে একটা দৌঁড় দিলাম।
আর মনে মনে বলছি এই মানুষটাতো বাঘ ও না ভাল্লুক ও না তবুও কেন আমি এতো ভয় পাই?
চলবে…