“হালাল প্রেম” পর্ব- ১০

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে শারমায়া এনগেজমেন্টে দেওয়া কার্ডটি হাতে নিলো। কার্ডটি খুলে দেখলো এতেও একটা চিরকুট…
“বসেছিলাম অজানা এক তুমির অপেক্ষায়,
অবশেষে আজ পৌঁছে গেলাম সেই তুমির ঠিকানায়।
বাবার পছন্দ আমার জন্য সবসময় সেরাই হয়। আমার জীবনসঙ্গী হিসেবে বাবা আমার জন্য এক সেরা তুমিকেই পছন্দ করেছে আমি নিশ্চিত। আপত্তিকর কিছু শুনিনি, তবুও এককভাবে জানতে ইচ্ছে করছে সম্পর্কের অগ্রগতিতে তোমার কোনো আপত্তি আছে কি না? কল করতে ইচ্ছে না করলেও একটা টেক্সট করবে আশা করি।”
চিরকুট পড়ে শারমায়া মৃদু হাসলো। সাথে ফোন নম্বর দিয়েছে। অতপর ফোন হাতে নিয়ে এসএমএস করার জন্য কিছু লিখলো আবার মুছে দিলো। আবার লিখলো আবার মুছে দিলো! প্রায় দুমিনিট ধরে ভাবছেই, রিপ্লাই করবে কি না! অবশেষে লিখে পাঠিয়ে দিলো,
“তখনও আপত্তি ছিলো না, এখনও নেই।”
অতপর কিছু খাওয়ার জন্য কিচেনে গেলো। সাফওয়ানা পেয়াজ মরিচ কুচি করে চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখছে। মাখা শেষ না হতেই শারমায়া এক মুঠো নিয়ে মুখে দিলো। সাফওয়ানা মেজাজী গলায় বললো,
“মাখা শেষ করছি, রাক্ষসী!”
শারমিনের হাতে ঢাকনা ছিলো। তিনি ঢাকনা দিয়েই সাফওয়ানাকে মারার জন্য হাত তুলে বললেন,
“এমন করতে হবে কেন তোর! খাওয়ার জন্য মাখছিস না!”
“তাই বলে এখনই খাবে! মাখলে খেতে পারবে না! খালি আমাকে বকে। একটা মুড়িও দিতাম না। পারলে মেখে খা। রাক্ষস খোক্কশ!”
শারমায়াকে বকে গোমড়ামুখু হয়ে সাফওয়ানা মুড়ির বোল নিয়ে বেরিয়ে গেলো। শারমায়া তার পিছু পিছু যেতে যেতে বললো,
“আমি খেতে না পারলে তোরও খাওয়া হবে না পুচকে…!”
পেছন থেকে শারমিন বললো,
“দেখ, শারমায়া। খোচাখুচি করিস না। তুই আলাদা নিয়ে খা।”
কে শুনে কার কথা! শারমায়া গেলোই। প্রথমে একটু হইচই শোনা গেলো পরে আবার মিলেমিশেই খেয়েছে। তবে শর্ত ছিলো খাওয়া শেষে শারমায়া বোল ধুয়ে রাখবে। অতপর দুজনেই পড়ার জন্য নিজের রুমে এলো। শারমায়া ফোন হাতে নিলো জোভানের কোনো টেক্সট এসেছে কি না তা দেখার জন্য। সাতটা মিসড কল বুসরা ও নিধির। আর জোভানের একটা মেসেজ। বারো মিনিট পূর্বে রিপ্লাই এসেছে,
“সামনে যা হবে তাতেও আপত্তি থাকবে না তো?”
শারমায়া রিপ্লাই করলো,
“কি হবে সামনে?”
এরই মধ্যে বুসরার ফোন এলো। শারমায়া রিসিভ করে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম। ”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। দোস্ত, কি শুনছি এসব! তুই নাকি এনগেজড?”
“তোকে কেন বলবো! তুই তো আমাদের সাথে কোচিংএ ভর্তি হলি না।”
“ওটা তো আমার বাসা থেকে অনেক দূর। তাই আব্বু আম্মু নিষেধ করেছে। প্লিজ দোস্ত বল…! নিধির কাছে শুনার পর তো আমার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার উপক্রম হয়েছে!”
“তাহলে আগে হার্ট অ্যাটাক করে হসপিটাল ভর্তি হ। তারপর মিষ্টি নিয়ে তোকে দেখে আসবো আর বলে আসবো ।”
“দোস্ত, বল না…প্লিজ?”
“হুম।”
“হুম কি?”
“হুম মানে হুম।”
“তুই এনগেজড?”
“হ্যাঁ।”
“অবিশ্বাস্য! এটা কি করে করতে পারলি তুই? দাওয়াত দিলি না কেন? পোলাও মাংস না খাওয়াতিস, কোক বিস্কুট হলেও তো চলতো। এমন পাষাণ কিভাবে হতে পারলি। এমন তো নয় যে তুই দুর্ভিক্ষে আছিস! তা-ও যদি হয়ে থাকে তো বলতি আমরাই খাবার নিয়ে যেতাম! তা-ও যেতাম!”
“ওরেব্বাস! এসে কি করতি শুনি?”
“তোর মতো এমন ফ্রেন্ড আমি জগতে দেখিনি! তোদের কাপলদের সাথে একটা সেলফি তুলে স্মৃতি হিসেবেও তো রেখে দিতে পারতাম।”
“হুহ! স্মৃতি ছবিতে রাখতে হয় না। স্মৃতি মনে গাঁথা থাকলেই হয়। যা, বিয়েতে ইনভাইট করবো।”
“পাক্কা তো?”
“ইনশাআল্লাহ।”
“ওকে, মনে থাকে যেনো। ভাইয়ার একটা ছবি পাঠা।”
“কেন?”
“দেখবো।”
“পরপুরুষের দিকে নজর দেওয়া হারাম।”
“আশ্চর্য! আমি দুলাভাইয়ের উপর নজর দিতে যাবো কেন! জাস্ট দেখবো তোর সাথে কেমন মানিয়েছে।”
“মানালেও আমার, না মানালেও আমার। অযথা তুই দেখে কি করবি! ছবি দিবো না, এটাই ফাইনাল। ক্রাশ খাওয়ার আর জায়গা পায় না! হুহ্!”
“বাব্বাহ! জামাই নিয়ে এতো বড়াই! দেখিস, আমার জামাইর ছবি মিডিয়াতে দিয়ে দিবো।”
“মিডিয়াতে দিবি কেন? তোর জামাই কি সন্ত্রাসী হবে?”
“সাদিয়া….!”
“হিহিহি… অযথা রেগে যাচ্ছিস কেন বাবু? ভুল কিছু বললাম? সন্ত্রাসের ছবিই তো বেশিরভাগ মিডিয়াতে আসে।”
“জাস্ট, মেজাজটা বিগড়ে দিছোস! তোর সাথে আর কথা নাই। ফোন রাখ! ফোন রাখ!”
“হিহিহি… ধন্যবাদ।”
বুসরা নিজেই কল কেটে দিলো। শারমায়া হাসতে লাগলো এবং দেখলো জোভানের রিপ্লাই এসেছে,
“কি হবে আবার। বিয়ে। নাকি বিয়ে হয়ে গেছে আমাদের, হু?”
শারমায়া মৃদু হেসে রিপ্লাই করলো,
“উহুম, তখনও আপত্তি নেই।”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
শারমায়া ফোন রেখে শীটগুলো নিলো পড়ার জন্য। এমনি আবার নিধির ফোন।
“তুই এভাবে পালিয়ে গেলি কেন তখন? ভেবেছিস কি, সরি বললেই মাফ করবো? মোটেও না। ডবল ট্রিট নিয়ে ছাড়বো।”
“ওকে। এবার পড়তে দে। তোরা অনেক এগিয়ে, আমি তোদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছি।”
“রাখ তোর পড়া! তুই ট্রিট না দিলেও ভাইয়ার কাছ থেকে নিয়ে ছাড়বোই ছাড়বো!”
“ওকে। এবার ফোন রাখ।”
“রাখবো মানে! ভাইয়ার কাছ থেকে যে নিবো, এখনো তো ভাইয়াকেই চিনলাম না। ফটো দে।”
“কেন?”
“কেন আবার, দেখবো।”
“উহুম, নজর টজর লাগলে আবার সমস্যা। ছবি দেওয়া নিষেধ।”
“ওই, তোর কি মনে হয়? তোর জামাই আমি নিয়ে যাবো!”
“শিওর না বলেই তো সাবধান থাকছি।”
নিধি রেগে বললো,
“সাদিয়া…তুই দেখে নিস, তোর জামাইরে আমি বাড়ি থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসবো।”
“ওকে, এবার দয়া করে ফোন রাখ।”
“রাখবো না।”
“ওকে, আমিই রাখছি। আর শোন, সে যদি অন্য কোনোভাবেও গায়েব হয় তাহলে তোর দোষ। বুঝলি, তোর দোষ। কারণ থ্রেডটা আমি তোর কাছ থেকেই পেয়েছি।”
অতপর শারমায়া ফোন রেখে হাসতে লাগলো। এরপর বেশ কিছুক্ষণ পড়লো তারপর আবারও এক ফ্রেন্ডের কল তার এনগেজমেন্ট এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করার জন্য। শারমায়া তাকেও রাগিয়ে দিয়েছে।
পরবর্তী এক সপ্তাহ রুটিন মাফিক চলছিলো। বাড়িতে আড্ডা, কোচিং-এ আড্ডা ও পড়াশোনা, সাফওয়ানার সাথে নিয়মিত দুষ্টুমি, রাতে পড়াশোনা ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর ঘুমাতে যাওয়ার সময় জোভানকে নিয়ে ভাবনার জগতে লুকিয়ে থাকা। বন্ধুবান্ধব তাকে প্রতিদিনই বিরক্ত করে জোভানের ছবি দেখার জন্য কিন্তু শারমায়া দেখায় না। এরমাঝে জোভানের সাথে আর কোনোরকম যোগাযোগ হয়নি। হঠাৎই শুক্রবার জোভান তার পরিবার নিয়ে হাজির। আত্মীয়স্বজন কেউ আসেনি, শুধুমাত্র জোভান, তার বাবা-মা, জেভা ও তার হাসব্যান্ড নিলয়। আর অতিরিক্ত এসেছে কাজী সাহেব। এদিকে শারমায়ার বাবা হুজুর দাওয়াত করেছে। আজই তার বিয়ে হবে এটা আজই জেনেছে সে এবং কল্পনার বাইরে ছিলো জোভান এমন পাগলামো করবে! তারমানে তার মাথায় এমন কিছু চলছিলো বলেই সেদিন বলেছিলো “সামনে যা হবে, তাতেও আপত্তি নেই তো”! না, আজও আপত্তি নেই, কিন্তু সে বিস্মিত! আগেও বাবা-মাকে ফোনে খালা মামাদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে শুনেছিলো কিন্তু সে ভেবেছিলো পড়াশোনা শেষে যে প্রোগ্রাম করবে সেই ব্যাপারে বলেছে। এদিকে আজ জেভার কাছে জানলো, জোভান নাকি তাকে পাগল করে ফেলেছে বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলতে বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে। তাদের প্রেমের বয়সের মজাটা যেন এভাবে নষ্ট না করে। কথাগুলো বলতে বলতে জেভা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছিলো আর শারমায়া লজ্জায় কাতর! আশরাফ স্যার সাখাওয়াত বদরুদ্দোজার কাছে প্রস্তাব করলে তিনি আর অমত পোষণ করলেন না। বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে থাকলে সম্পর্কের স্থায়িত্বের ব্যাপারে তিনিও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন। সেই ভেবে আজই বিয়ে দিয়ে দিলেন। এপরিবারের মধ্যে কেবল ফুয়াদ, ও তার চাচা উপস্থিত ছিলো। চাচী শারমায়ার বিয়ে নিয়ে হিংসে করে নিজেও আসেনি মেয়েকেও আসতে দেয়নি৷ তার রাগ হলো, ফারিয়া শারমায়া থেকে বড় ছিলো। তাহলে শারমায়ার বিয়ে আগে কেন হলো। নিশ্চয়ই শারমিন শত্রুতা করে এমনটা করেছে! আজ বিয়েতে শারমিন বারবার ডাকার পরও এলো না শারমায়ার চাচী। যদিও এসব ব্যাপারে কিছু বলেননি তিনি কিন্তু গোমড়া মুখু হয়ে বসে ছিলেন। আর নানান অযুহাতে জানিয়ে দিয়েছেন আসবেন না তিনি। চালাকি করে ফারিয়াকে নানা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন গতকাল। শুধু আজ নয়। গত কয়েকদিনের লক্ষ্মণই প্রকাশ করে দিয়েছে যে, তিনি এই বিয়েতে সন্তুষ্ট না । তাই শারমিনের মন্তব্য,
“হুহ্! বসে থাকুক মনভরা প্যাচ নিয়ে! আমি তো আর ঘটক দিয়ে সমন্ধ নিয়ে আসিনি। স্যার শারমায়াকে আগে থেকেই চেনে তাই নিজে এসেই সমন্ধটি পাকা করেছেন। এখানে কিভাবে বলা যায় যে শারমায়াকে বিয়ে দিবো না, ফারিয়াকে দেখে যান! এটা কি বলা যায়! ঘটক এলে এক কথা যে, আমার মেয়েকে এখন বিয়ে দিবো না। আপনি ফারিয়ার জন্য সমন্ধ নিয়ে আসুন। হুহ্!”
সম্পর্কে ব্যাঘাত সৃষ্টি এড়াতে সাখাওয়াত এসব নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলেন শারমিনকে।
শারমায়া আজ বউ সেজেছে ঠিকই কিন্তু ঘরোয়াভাবে। জেভা নিজে বিয়ের জন্য আনা শাড়ি তাকে পরিয়েছে। হালকা সাজে সাজিয়েছে সাফওয়ানা ও জেভা উভয়ই। অতপর বিয়ে। আজও খুব অস্থিরতা অনুভব করছিলো শারমায়া। তবে বিয়ের পর জোভান এককভাবে আজ তার সামনে দাড়িয়ে মনের অনুভূতি জানতে চেয়েছিলো। সে লজ্জার সাথে হেসে জবাব দিয়েছে,
“আজকের বিয়ে স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।”
আর স্বপ্নের অনুভব বিলীন করে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে জোভান তার কপালে কোমল স্পর্শ দিয়েছে। সাথে একটা কাপল শোপিচও দিয়ে গেছে জোভান। তার সাথে চিরকুট,
“মিসেস, বিয়ের আগে প্রেম হারাম। কিন্তু বিয়ের পরের প্রেম তো হালাল। আমরা হালাল প্রেমে জড়িত হবো। আমাদের গল্প হবে হালাল প্রেমের গল্প। দুনিয়াতে আমাদের প্রেম যত গভীর হবে, ইনশাআল্লাহ আখেরাতেও আমাদের দাম্পত্য জীবন ততই সুখসমৃদ্ধির সাথে স্থায়ী থাকবে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here