“হালাল প্রেম” পর্ব-২০

“হালাল প্রেম”
পর্ব-২০
(নূর নাফিসা)
.
.

ইশার আযান পড়ে গেছে। শারমায়া বই পড়া রেখে দ্রুত চলে গেলো ওযু করতে। সাফওয়ানা ঝিমাচ্ছে আর পড়ছে। বই সামনে নিলেই তার শুধু ঘুম পায়। শারমায়া ওযু করে এসে নামাজ আদায় করে নিলো। অতঃপর রুম থেকে বেরিয়ে এলো মায়ের রুমে। শারমিন সাখাওয়াত বসে বসে বোখারী শরীফ পাঠ করছেন। শারমায়া অযথা ঘুরে আবার চলে গেলো। হাতে ফোন৷ আটটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। একদিকে সে জোভানের কলের অপেক্ষায় আছে অন্যদিকে মা কোনো কাজে ব্যস্ত হয় কি না তআ দেখার অপেক্ষায়। রান্নাবান্না তো শেষ। এখন আর কি কাজ করবে! সময় কাটাতে হয় বই পড়বে নয়তো ড্রয়িংরুমে টিভি দেখবে। এতে তো তার পরিকল্পনা সফল হবে না! কি করা যায়! জোভানকে কি আসতে নিষেধ করবে! এমনি ফোনটা বেজে উঠলো আর শারমায়া কেপে! সে ফোন রিসিভ করে ড্রয়িংরুমে চলে এলো।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি রওনা দিয়েছি।”
“আচ্ছা।”
জোভান সাথে সাথেই কল কেটে দিলো যার ফলে শারমায়া বুঝতে পারলো সে গাড়িতে আছে। সেকেন্ডের কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে শারমায়ার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। জোভান তো চলে আসছে, কিন্তু সে বাসা থেকে বের হবে কিভাবে! এমন হযবরল অবস্থায় পড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে তার। মাথায় ধরছে না কিছু! সে আবার মায়ের রুমে এলো এবং ভেজলিনের কৌটা হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে ঘষতে লাগলো। শারমিন সাখাওয়াত বললেন,
“এই, তুই এমন করে ঘুরঘুর করছিস কেন? পড়া শেষ?”
“না। ভেজলিন নিতে আসলাম। ঠোঁট কেমন খসখসে হয়ে আছে। লিপজেলটা সাফওয়ানা কোথায় যেন রাখছে।”
“তাই বলে দুই ঘন্টা ধরে ঘষতে হবে?”
“কই দুই ঘন্টা ধরে ঘষছি! এক মিনিট ও তো হয়নি।”
“মিনিট গুনতে হবে না আর। গিয়ে পড়তে বস।”
“যাচ্ছি।”
শারমিন আবার বইয়ের দিকে মনযোগ দিলেন। শারমায়া ধীর পায়ে দরজার কাছে এসে থেমে গেলো এবং বললো,
” আম্মু, নামাজ পড়ছো?”
“না।”
“আযান দিছে তো।”
“শুনছি। পড়বো।”
“কখন পড়বা?”
শারমিন দৃষ্টি আবার তার দিকে নিক্ষেপ করে বললো,
“কেন?”
“না। এমনি। তুমি না বলো আযান দিলে সাথে সাথে নামাজ পড়তে হয়। আজ তুমি এখনো পড়নি যে!”
“মাত্র তো আযান দিলো। তোদের মতো দুতিন ঘন্টা তো বসে রই নি। যা গিয়ে নামাজ পড়। তারপর পাঠ্যবই পড়। তোর আব্বু এলে ডিনার করবি।”
“ওকে। তুমিও তাড়াতাড়ি নামাজ পড়ো। দেরি করে নামাজ পড়া ভালো না।”
শারমায়া মনে মনে কাঁদতে কাঁদতে রুমে চলে এলো। কিছুক্ষণ রুমে পায়চারি করলো, কিছুক্ষণ বই হাতে নিয়ে বসে রইলো। মিনিট পাঁচেক অতিক্রম হতেই সাফওয়ানাকে ঠেলে ধাক্কিয়ে পাঠালো দেখে আসার জন্য যে মা নামাজ পড়ছে কি না। কিন্তু সাফওয়ানা এসে জানালো মা বই পড়ছে। শারমায়া হতাশ! দু-তিন মিনিট পর এবার শারমিনই এলো তাদের রুমে।
“এই, নামাজ পড়েছিস তোরা?”
শারমায়া জবাব দিলো,
“আম্মু, আমি পড়েছি। সাফওয়ানা পড়েনি।”
“সাফওয়ানা, নামাজ পড় আগে। তারপর পড়তে বস।”
“আম্মু, আমার চোখ গুলো দেখো কেমন ছোট হয়ে গেছে।”
“থাপড়াইয়া দাত ফালায় দিবো। দশটার আগে পড়া থেকে উঠবি না।”
“তুমি না বলছো, আব্বু এলে পড়া শেষ করতে!”
“তোর আব্বু তো দশটার দিকেই আসবে।”
“নয়টা, সাড়ে নয়টায় ও তো আসতে পারে। আগে আসলে আমি আগেই উঠবো।”
“চাপাটাই আছে শুধু! এতো বড় পোলাপানদের নাকি এমন ধাক্কায় ধাক্কায় পড়াতে হয়।”
বলতে বলতে শারমিন চলে গেলো। সাফওয়ানা বই বন্ধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ধপাস করে খাটে শুয়ে পড়লো। শারমায়া কিছুটা আশার আলো খুঁজে পেলো আর দ্রুত ওয়ারড্রব থেকে বোরকা হিজাব নিলো। সাফওয়ানা খাটে গড়াগড়ি দিয়ে উঠে বসে শারমায়াকে বোরকা হিজাব পড়তে দেখে বললো,
“আরে, আরে! কোথায় যাও?”
“যাই গা…হিহিহি…!”
“এ! যাও গা? কই যাও গা?”
“যেদিকে দুচোখ যায়।”
“আজকাল পাবনা যেতে বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তোমার মাঝে। দাড়াও, ভাইয়াকে বলি আগে থেকেই সিট বুকিং রাখতে।”
বলতে বলতে সাফওয়ানা ওযু করার জন্য বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলো। শারমায়া দ্রুত হিজাবের পিন আটকে বললো,
“নামাজ পড়বি এখন?”
“হুম।”
“একটু পরে যা।”
“কেন?”
“আমি একটু বাইরে যাবো। দরজাটা লাগিয়ে তারপর নামাজ পড়।”
“সিরিয়াসলি! এতো রাতে তুমি বাইরে যাবে! আমি তো ভাবছিলাম মজা করতে বোরকা পড়ছো!”
“এতো রাত কোথায়। আটটাও বাজে নাই।”
“যাইহোক রাত তো। কোথায় যাবে তুমি?”
“একটু নিচে যাবো। তোর ভাইয়া এসেছে।”
“ভাইয়া এসেছে, তো উপরে আসতে বলো।”
“না, এখন আসবে না। একটু প্রয়োজনে এসেছে আবার চলে যাবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো। তুই আম্মুকে বলিস না তার কথা। আম্মু আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলিস আমি একটু ফারিয়া আপুর কাছে গেছি।”
“পাশাপাশি ফ্ল্যাট, তুমি বোরকা পড়ে আপুর কাছে যাবে এটা আম্মু বিশ্বাস করবে!”
“তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। যা বলছি তা কর। একটা কিটক্যাট পাবি।”
“আমি কিন্তু ঘুষ নেই না। উপহার নেই।”
“এহ! কি নেক বান্দা রে! আমিও ঘুষ দেই না। ঘুষি দেই।”
উভয়েই হেসে উঠলো। সাফওয়ানা বললো,
“তুমি নিচে যাবে তাও আবার ভাইয়ার সাথে দেখা করতে সেখানে বোরকা পড়ে বের হওয়ার কি আছে আর এমন লুকোচুরি করারই বা কি আছে! এমন তো নয় যে বয়ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছো!”
“কথা বলার সময় নেই। চুপ থাক। আর যা বলছি তা করবি। দেখে আয় তো, আম্মু নামাজে দাঁড়িয়েছে কি না?”
সাফওয়ানা দেখতে চলে গেলো এদিকে জোভান কল দিলো।
“আমি এসে গেছি তো। কোথায় তুমি?”
“আসছি। দুইটা মিনিট অপেক্ষা করুন।”
জবাব দিয়ে এবার শারমায়া সাথে সাথেই কেটে দিলো এবং বড় পার্সটা হাতে নিলো। সাফওয়ানা এসে ইতিবাচক সিগন্যাল দিলে সে বেরিয়ে এলো। তাড়াহুড়ো করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সে নিচ তলায় এসে জোভানকে আবার কল দিলো।
“আপনি কি ন্যাশনাল ব্যাংকের সামনে এসেছেন নাকি কাছাকাছি পৌছেছেন?”
“আমি গাড়ি থেকে নেমে ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে তারপর তোমাকে কল করেছি।”
“ওহ্, আচ্ছা।”
“কিন্তু তোমাকে দেখছি না কেন? তুমি কি এখন বাসায়?”
“হ্যাঁ, বের হচ্ছি।”
“আমি বাসার দিকে এগিয়ে আসবো?”
“না, আমিই আসছি।”
“দুই মিনিট কিন্তু অলরেডি শেষ।”
শারমায়া মৃদু হেসে বললো,
“আরও দুতিন মিনিট বোনাস দিন। হাটতে যতটুকু সময়।”
“ওকে। ধীরেসুস্থে সাবধানে এসো।”
“হুম।”
শারমায়া আরেকটু এগিয়ে আসতেই ন্যাশনাল ব্যাংকের সামনে জোভানকে প্যান্টের পকেটে দুহাত রেখে পায়চারি করতে দেখতে পেল। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে তার দৃষ্টি নিচের দিকে। সে ছায়ার সাথে খেলা করছে নাকি পায়চারি করতে করতে কিছু ভাবছে কে জানে!
সামনের দিকে পায়চারি করে আবার পেছনে ফিরতেই শারমায়াকে দেখতে পেল জোভান। তাই পায়চারি থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে এবার স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। যখনই শারমায়া তাকে সামনাসামনি দেখে, তার মুখের মুচকি হাসিটা সবসময় ফুটে থাকতে দেখে। আর এটাই যেন তাকে লজ্জায় ফেলতে যথেষ্ট! যেমনটা এখনো হয়ে গেছে। শারমায়া কাছাকাছি আসতেই এবার তার আগে জোভান সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন?”
“তোমাকে দেখার পর আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো।”
“সবসময় এভাবে বলতে হবে! এখন রাস্তায় আছি।”
“তো কি হয়েছে! কেউ শুনছে নাকি আমাদের কথা?”
“শুনতেও তো পারে।”
“তো শুনুক! সমস্যা কোথায়?”
“কিছু না। চাপটার বাদ দিন।”
“আচ্ছা, দিলাম বাদ।”
“নামাজ পড়েছেন?”
“হুম, নামাজ পড়েই রওনা দিয়েছি। আচ্ছা, এবার তো কিছু জানতে চাইতে পারি নাকি?”
“কি?”
“হঠাৎ জরুরী তলব যে? তাও আবার এখানে?”
“এমনি।”
“এমনি বলতে কিছু আছে! ব্যাংকের সামনে ডেকেছো টাকাপয়সা জমা টমা করবে নাকি?”
“আমি তো করবো না। আপনি চাইলে করতে পারেন।”
“আচ্ছা, আমি করবো? একাউন্ট আছে তোমার?”
“উহুম।”
“ওফ্ফ! বাঁচালে। আমার পকেটে জমা রাখার মতো টাকাও নেই।”
কথা বলে জোভান হেসে উঠলো। শারমায়া বললো,
“একাউন্ট থাকলেও রাখতে দিতাম না। চলুন এদিকে একটু হাটি।”
জোভান শারমায়ার সাথে সামনে পা বাড়িয়ে বললো,
“ডিয়ার, তুমি রিজন বললে না কেন?”
“বলতেই হবে?”
“এই সন্ধ্যায়, রাস্তায় দেখা করা, একা আসতে বলা এতো হিন্স দেখে জানতে ইচ্ছে করছে খুব।”
“তাহলে বলেই দেই। বলেছিলেন না, মাঝে মাঝে পালিয়ে এসে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাটবো আমরা? আজ খুব ইচ্ছে হলো ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পথ ভুলে যেতে। তাই পালিয়ে এলাম।”
জোভান অবাক করা খুশি হয়ে শারমায়ার পিঠে হাত রেখে বললো,
“এতো তাড়াতাড়ি তোমার মাঝে ইচ্ছে জাগবে আমি ভাবতেও পারিনি। আন্টি কিছু বলেননি একা বেরিয়েছো যে?”
“বললাম না, পালিয়ে এসেছি। আম্মু দেখেনি আমাকে।”
জোভান পথ চলা থামিয়ে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে উঠলো। শারমায়া বললো,
“হাসির কি আছে?”
“কিছু না৷ চলো।”
দুতিন কদম ফেলে নিচু শব্দে আবারও হেসে উঠলো জোভান। শারমায়া বললো,
“আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমি পালিয়ে এসেছি?”
“অবিশ্বাস করছি না। তবে সাফওয়ানা কাজটা করলে স্বাভাবিক মনে করতাম। তোমার ক্ষেত্রে এটা অস্বাভাবিকের চেয়েও বড় কিছু মনে হচ্ছে।”
“আমি সত্যিই পালিয়ে এসেছি। আম্মু নামাজ পড়ছিলো। এই সুযোগে আমি বেরিয়ে গেছি। সাফওয়ানাকে শুধু বলে এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে নিচে এসেছি। আমি আসা পর্যন্ত যেন সে ম্যানেজ করে।”
” সুইটহার্ট, আমি ভাবতেও পারছি না এই সন্ধ্যায় এতো বড় একটা সারপ্রাইজ দিবে। আচ্ছা, বাসায় ফিরলে আন্টি যখন জিজ্ঞেস করবে তখন কি বলবে?”
“পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।”
“নার্ভাস?”
“একটু একটু।”
“আমি আন্টির কাছে কল করে বলি, তাহলে আর কিছু বলবে না তোমাকেও জবাবদিহি করতে হবে না।”
“এই, না। তাহলে পালানোর মজা থাকবে না।”
“আচ্ছা, বাসায় ফিরে সমস্যা হলে কল দিয়ো।”
“ওকে।”
শারমায়া পিঠ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“রাস্তায় আছি না? আনইজি লাগছে।”
জোভান হাত তার সামনে বাড়িয়ে বললো,
“এই মুখোরিত সন্ধ্যাতে, নিরিবিলি পথে,
লণ্ঠনের হলুদ আলোতে, পাশাপাশি হেটে,
তোমার হাতখানি, পারি কি স্পর্শ করতে? ”
শারমায়া মুচকি হেসে হাত রাখলো তার হাতে। প্রিয়জনের হাত মুঠোয় নিয়ে পথ চলতে চলতে জোভান বললো,
“শারমায়া, রেস্তোরাঁয় যাবে ডিনারের জন্য?”
“আজ না, প্লিজ৷ অন্য আরেকদিন। আজ সময় কম, আজ শুধু একটু হাটবো।”
“বাদাম চলবে?”
শারমায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলে জোভান বললো,
“সামনে পাওয়া যাবো। চলো।”
এদিকে মানুষ একটু কম থাকায় শারমায়া জোভানের হাত ছেড়ে পার্স থেকে গিফট বক্স বের করলো। অতঃপর জোভানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“হ্যাপি ফার্স্ট মান্থ ফার্স্ট ইভিনিং।”
জোভান বিস্ময়ের সাথে ঠোঁটের এক কোণে হাসি ফুটিয়ে গিফট বক্স হাতে নিলো এবং বললো,
“এখন খুলে দেখবো?”
“খুলুন।”
জোভান হাটতে হাটতে বক্স খুললো। ঘড়ি দেখা মাত্র তার পা থেমে গেলো এবং ঠোঁটের কোণে উঁকি দেওয়া হাসি এবার উভয় দিকে প্রশস্ত হয়ে গেলো। সে নতুন ঘড়ির বক্সটা শারমায়ার হাতে ধরিয়ে নিজের হাতে থাকা ঘড়িটা খুলতে খুলতে বললো,
” ‘সুন্দর’ বলে প্রশংসা করবো না কখনো। প্রিয়’র কাছ থেকে পাওয়া সবকিছু হৃদমাঝেই তুলে রাখবো।”
হাতে থাকা ঘড়ি খুলে পকেটে রেখে জোভান হাত বাড়িয়ে দিলো শারমায়ার দিকে। এবার সেই হাতে শারমায়া পড়িয়ে দিলো তার উপহার। জোভান তার হাত মুঠোয় নিয়ে আবার হাটতে হাটতে বললো,
“ভালোবাসি, প্রিয়।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here