“হালাল প্রেম”
পর্ব-২৫
(নূর নাফিসা)
.
.
“ওহ্, এই ব্যাপার! ভাবি শুনেন, সিনথিয়া, মিমি, মুনিয়া, জুথি, রাফিকাসহ আরও অনেকের সাথে জোভানের এফেয়ার আছে।”
জোভান রেগে জোরে একটা ঠুসি দিলো মিরাজের মাথায়। মিরাজ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে পিছিয়ে গিয়ে বললো,
“ওহ! উল্টো বলে ফেলছি, তাই না? তাই বলে আমি খাটো হওয়াতে সবাই শুধু আমার মাথায় মারবি! ভাবি শুনেন, জোভান একেবারে খাটি মানে হালাল। ওর মধ্যে কোনো ত্রুটি নাই। কতটা ভালোবাসে জানি না, তবে শারমায়া সাদিয়া বলতে পাগল।”
এমনি আবার সিনথিয়ার আগমন। সে বললো,
“আমার জামাইয়ের এতো প্রশংসা কিজন্য, শুনি?”
মিরাজ জিভ কেটে বললো,
“ক্রাশ থেকে জামাই! ব্যাটা এখন বিয়াইত্তা। আর বইলো না তো এসব, মুখে একটু সামাল দাও।”
“কেন? সতীনের সংসারে আগুন লাগছে নাকি?”
মিরাজ জবাব দিলো,
“লাগতে কতক্ষণ?”
“তো লাগায় দেই একটু, জ্বলতে থাকুক। একটু আধটু আগুন না লাগলে সংসারে প্রেম জমে না।”
জোভান বললো,
“এমনিতেই আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে, আর জ্বালিয়ো না। দয়া করে যাও এবার।”
“জামাই তুমি এটা বলতে পারলা! রাগ করছি কিন্তু!”
মিরাজ সিনথিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আরে, তুমি তো আমার। তার দিকে তাকাও কেন বারবার! এই যে তোমার জামাই তোমার পাশে।”
“সর, তুই আমার চেয়ে কত খাটো দেখছোস! আরও এক ফুট লম্বা হো আগে।”
“বাপেরে বলছিলাম তো কমপ্লিন কিনা দিতে। চিন্তা করো না, এবার থেকে বনবিটা খামু। ভাবি কিন্তু রাগ করছে অনেক, স্যরি বলো আগে।”
সিনথিয়া মিরাজের সাথে স্টেজের দিকে যেতে যেতে পেছনে ফিরে বললো,
“সতীন, জামাই কিন্তু অনেক ভদ্র। এতো রাগ কইরো না। আমরা সবাই ফ্রি…”
জোভান শারমায়ার একটা হাত মুঠোয় নিয়ে বললো,
“ট্রাস্ট মি।”
“আমরা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো? যার বিয়ে তাকেই তো দেখলাম না এখনো।”
শারমায়াকে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে দেখে জোভানের মুখটা সামান্য মলিন হয়ে গেলো। সে আর কিছু না বলে শারমায়ার হাত ধরে হেটে স্নিগ্ধাদের ছাদে চলে এলো। এখানে আরেক স্টেজ। স্নিগ্ধাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। তারা আসতেই ইফাজ বললো,
“ওইতো, এসে গেছে কাপল অফ দ্যা ইয়ার। কিরে এতো দেরি কেন? কখন না বলে আসলাম উপরে আসার জন্য।”
“কথা বলছিলাম নিচে। কেমন আছো স্নিগ্ধা?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভাইয়া। আপনারা কেমন আছেন?”
“আমরাও আলহামদুলিল্লাহ।”
“খুব কিউট তো ভাবি! অনেক খুশি হয়েছি ভাবি আসাতে। এদিকে এসো ভাবি।”
শারমায়া হাসিমুখে বললো,
“না, ঠিক আছে।”
“আরে এসো তো ছবি তুলি। ভাইয়া আসেন।”
পাশে বসা মেয়েদের উঠিয়ে স্নিগ্ধা নিজেই সিট ফাঁকা করে দিলো। জোভান তার ফোন দিয়ে গেলো ইফাজের কাছে। অতঃপর তারা উভয়ে স্নিগ্ধার সাথে ছবি তুললো। ইফাজ তুলেছে ফোনে আর ক্যামেরা ম্যান ক্যামেরায়। স্টেজ থেকে নেমে এসে শারমায়া বললো,
“দুজায়গায় কেন স্টেজ? নিচের এরিয়াটাই তো বেশি ভালো।”
ইফাজ জবাব দিলো,
“এখানে মুরব্বিদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। উনাদের কার্যক্রম শেষে স্নিগ্ধাকে আবার নিচে ফেলে দিবো। তার জামাই এসে যদি পারে ধরবে, না ধরলে কিচ্ছু করার নেই।”
আশেপাশের কয়েকজন হেসে উঠলো। স্নিগ্ধা বললো,
“ছি, ভাইয়া! এইভাবে বিদায় দিবেন ছোট বোনকে! ভাবি, আসলে উছিলায় আমার বিয়ে আর মূল কাজ তাদের। আমার জন্য একটা কোঠা তৈরি করে এতো বড় স্টেজ তারা নাচানাচি আর পার্টি করার জন্য নিয়ে নিছে। জয় ভাইয়াকে কিন্তু আজ গান গাইতেই হবে। অনেকদিন হলো ভাইয়ার কণ্ঠে গান শুনি না।”
শারমায়া একটু বিস্মিত হয়েই তাকালো জোভানের দিকে। জোভান গান গাইতে জানে সে তো জানতো না! এদিকে জোভান স্নিগ্ধাকে জবাব দিলো,
“সম্ভব না।”
“না, মানি না। মানবো না। অবিবাহিত জীবনে এটা আমার শেষ আবদার। সাদাত ভাইয়া ও ইফাজ ভাইয়াকে নাচতে হবে।”
ইফাজ বললো,
“নাউজুবিল্লাহ! জীবনে দেখেছো আমাকে নাচতে?”
“তাইতো দেখতে চাইছি।”
“আমি নাচতে পারি না।”
“না পারলেও পারবেন। মিরাজ দাদামশাই আছেন তো, নাচিয়ে নিবে।”
পরক্ষনে মুরুব্বিদের কার্যক্রম সম্পাদিত হলো, সকলের খাওয়াদাওয়াও হলো। অতঃপর স্নিগ্ধাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হলো। বাচ্চারা ও যুবক-যুবতীরা সবাই এখানে। এতোক্ষণে মিরাজ ও তার কাজিন এবং বন্ধুবান্ধবরা মিলে সকল ব্যবস্থা করে ফেলেছে। জোভান শুধু শারমায়ার সাথেই ছিলো৷ একটু পরপর শারমায়ার অভিমানটা ভাঙানোর সুযোগ খুজছিলো কিন্তু শারমায়া সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে প্রোগ্রামকে প্রাধান্য দিলো। প্রোগ্রামে ব্যান্ডপার্টি ডাকা হয়েছে। প্রথম দুটো গান ব্যান্ডপার্টির লোকেরা গাইলো পরবর্তীতে মিরাজ ও তার বন্ধুরা গাইবে। জোভানকে টানাটানি শুরু করলে জোভান বারবার নিষেধ করছে। মিরাজ বললো,
“এমন ভাব দেখাচ্ছিস কেন? ভাবি আপনার নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?”
“নাহ! আমি কিছু বলিনি। আমি তো জানিই না আপনার বন্ধু গানও গাইতে পারে।”
মুহুর্তেই জোভানের চেহারায় বিষন্নতা নেমে এলো। শারমায়া চাপা কষ্ট নিয়ে কথা বলেছে সেটা ভাবতেই জোভানের কষ্ট সাড়া দিলো মনে। মিরাজ জবাব দিলো,
“তাহলে আজ জানা ও শোনার সুযোগ এসেছে। ওই ব্যাটা, চল। ভাবি না করেনি তো!”
স্নিগ্ধা ও দুতিনজন মেয়েও বারবার বলছে যেতে। আবার এদিকে মিরাজের ধাক্কায়ও অবশেষে জোভান চলে গেলো। স্নিগ্ধা শারমায়াকে ডেকে নিজের পাশে বসালো। শারমায়াও হাসিমুখে বসলো। ব্যান্ডপার্টির লোকদের বিশ্রামে পাঠিয়ে সরঞ্জাম নিয়ে নিজেরাই বসে গেছে মিরাজের বন্ধুরা। মিরাজের কাছে ড্রাম, সাদাতের হাতে গিটার দেওয়া হয়েছিলো সাদাত সেটা ইফাজের হাতে ধরিয়ে দিলো। এখন জোভান ও ইফাজের হাতে দুইটা গিটার। অন্যান্য সরঞ্জাম অন্য বন্ধুদের হাতে। তারা যৌথভাবে গাইতে শুরু করলো জাস্টিন বেইবারের বেবি গান। ইংলিশ গান শারমায়া শোনে না তবে তাদের বাদ্যযন্ত্রের তালে দক্ষতা দেখে শারমায়া মুগ্ধ। অনেক ভালো বাজাতে পারছে, যেন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। নানান ধরনের লাইটিংয়ের কারণে মনে হচ্ছে এটা তাদের বন্ধুদের একটা কনসার্ট। স্নিগ্ধা শারমায়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“ভালো হচ্ছে না, ভাবি?”
শারমায়া মাথা নাড়ালে সে বললো,
“মিরাজ ভাইয়া যখন ব্যান্ডপার্টি আনার কথা বললো, আমি তখনই বলে দিয়েছি গান তাদেরই গাইতে হবে। চাচ্চুর বিয়েতে অনেক মজা করেছিলাম আমরা। ওসব বক্স বাজানোর পর ভাইয়ারা নিজেরা গান গেয়েছে, সকলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাই এবার বলে দিয়েছি, কোনো প্লেব্যাকের গান ছাড়বে না আর বাইরে থেকে লোক আনবে না। পুরো প্রোগ্রাম নিজেরাই করবে। যন্ত্রপাতিগুলোর জন্য শুধু পার্টি আনা।”
“এটাই তো ভালো। প্লেব্যাক তো প্রতিদিনই শোনা যায়, এমন প্রোগ্রাম আর ক’দিন!”
“হুম। জয় ভাইয়ার কণ্ঠ কিন্তু অনেক সুন্দর। ভাইয়া সবদিক থেকেই একেবারে হিরো। পেয়েছেও তোমার মতো একটা কিউটি বিউটিকে।”
শারমায়া মুচকি হাসলো। উক্ত গান শেষ হতেই সকলে চিৎকার করে আরেকটা গাইতে অনুরোধ করলো। জোভানকে মিরাজের সাথে কথা বলতে দেখা গেলো। অতঃপর মিরাজ এনাউন্স করলো,
“ইংলিশ গান শুনে গালি দিছো কয় জন? তারা আউট হও। আর যারা এনজয় করছো, তাদের জন্য এবার সারপ্রাইজ আছে। আমরা তো জিরো ই! হিরোর একক কণ্ঠে এবার একটা বাংলা গান হয়ে যাক।”
তার পরপর জোভান এনাউন্স করলো,
“বেইবি ডেডিকেটেড ছিলো স্নিগ্ধার জন্য। এবারের গান, ডেডিকেট টু মাই জান…”
যারা শারমায়াকে চেনেছে সবাই শারমায়ার দিকে উল্লাসিত হয়ে তাকিয়েছে। আর যারা চেনেনি তারা সুর তুলছে “জানটা কে?” কেউ কেউ শারমায়াকে তাক করে দেখিয়েও দিচ্ছে। আর শারমায়ার দৃষ্টি কেবল জোভানের দিকে। জানের এনাউন্স স্টেজে না করলে হতো না তার! ওদিকে মিউজিক বাজতে শুরু করেছে। জোভানের গানও চলতে শুরু করেছে…
“বুকের বাম পাশে তোরে যতন কইরা রাখি
তোরে ছাড়া ঘুম আসে না, ওরে পোষা পাখি
স্বপ্ন দিলি বেঁচে থাকার, আশা দিলি না
বেদনার তীর ছুড়ে প্রাণে মারিস না
ও জানরে….
মরণকালে তোরে, শুধু একবার দেখতে চাই
ও জানরে….
শেষ বিদায়ে তোরে, যেনো আমি পাশে পাই…
গান শুনে হৃদপিন্ড ধুকপুক করছে শারমায়ার। এমন একটা গান কিভাবে তাকে ডেডিকেট করতে পারলো! নিশ্চয়ই জোভান কষ্ট পেয়েছে তার আচরণে। তাইতো এমন ফালতু টাইপের গান গাইলো সে। শারমায়া নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখলো যতক্ষণ পর্যন্ত না জোভানের গান শেষ হলো। জোভান গান শেষ করে গিটার রেখে স্টেজ ছেড়ে নেমে যেতে যেতে মিরাজকে বললো,
“আমাকে আর বলিস না কিন্তু। তোরা এনজয় কর।”
জোভানকে নামতে দেখে শারমায়াও আসন ছেড়ে চলে এলো। লোকজনের ভীড়ের পেছন দিক দিয়ে এগিয়ে গেলো কিন্তু জোভানকে পেলো না। এদিক দিয়েই তো আসার কথা, হারিয়ে ফেললো কিভাবে! শারমায়া অশান্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। জোভানকে পাচ্ছে না! স্টেজের ওপাশ পর্যন্ত গিয়ে সকলের মাঝে আবার চোখ বুলালো জোভানের খোঁজে। কান্না এসে যাচ্ছে তার। জোভান কি চলে গেলো নাকি কোথাও! নাহ, এতোটা কেয়ারলেস না সে। হঠাৎই পেছন থেকে জোভানের কণ্ঠ শুনে আৎকে উঠলো।
“কাকে খুঁজছো?”
এমন প্রশ্নে শারমায়া সামান্য রাগান্বিত গলায় বললো,
“এখানে কাকে চিনি আমি, যাকে খুঁজবো?”
শারমায়ার চোখে পানি চিকচিক করতে দেখে জোভানের ব্রু কুচকে গেলো। সে শারমায়াকে হাত ধরে বাড়ির গেইটের দিকে অনেকটা নিরিবিলিতে নিয়ে এলো।
“এসব কি? কাঁদছো কেন তুমি? কি হয়েছে, বলো আমাকে?”
শারমায়া তার পাঞ্জাবী খামচে ধরে নিচু স্বরে জিদ্দি গলায় বললো,
“এসব কি গান গাও তুমি? এগুলো কোনো ভালো লোক গায়? যত্তসব ফালতু মার্কা গান।”
“ভালো মানুষ তো কোনো গানই গায় না।”
“এতোসব জানি না আমি। আই হ্যাট দিস টাইপ সং এন্ড সিংগার টু। তুমি আর কখনো এমন গান গাইবে না।”
জোভান চুপচাপ তাকিয়ে আছে শুধু। শারমায়া তাকে ঝাকিয়ে বললো,
“কি বললাম?”
“গাইবো না।”
“আর তোমার কি মনে হয়, আমি এই মেয়েদের কথায় রাগ করে বসে আছি? এতোটাই অবুঝ মনে হয় আমাকে যে আমি দুষ্টুমি বুঝি না? আর আমি যাকে চিনিই না, ভাবলে কিভাবে যে সে সিরিয়াসলি বললেই আমি বিশ্বাস করে নিবো? আর এটাই বা ভাবলে কিভাবে মিরাজ ভাইয়া এসে সাফাই দিলে আমি মেনে নিবো? তোমাকে বিশ্বাস করতে আমার কোনো সাফাইসাক্ষীর প্রয়োজন নেই, বুঝতে পেরেছো? জাস্ট দেখছিলাম তোমার কান্ডগুলো যে কতটা দুর্বল প্রকৃতির তুমি। আগে কিন্তু এমন মনে হয়নি। সবসময় স্ট্রংই ভেবেছি।”
জোভান আজ পরিতৃপ্ত। দৃষ্টি ভরা প্রেম ও ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে সে উচ্চারণ করলো,
“সমস্যা কি, তুমি বলতে না হয় একটু দুর্বলই হয়ে রইলাম। তবুও তো তোমার লুকিয়ে রাখা প্রেমের প্রকাশ ঘটবে আমার সামনে।”