“হালাল প্রেম”
পর্ব- ২৯
(নূর নাফিসা)
.
.
জোভানের বাবা মা জেভার সাথে দেখা করে যাবে তাই মিরাজের বাড়ি থেকে একসাথে বেরিয়ে বাবা মাকে জেভার বাড়ির সামনে নামিয়ে শারমায়াকে নিয়ে জোভান রওনা হলো তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। শারমায়া বললো,
“আপনি কি এখন বাসায় চলে যাবেন?”
“না, আবার আপুর বাসায় আসবো বাবা-মাকে নিতে।”
“তাহলে আপনার কাজ আরও সহজ করে দেই। আমাকে খালামনির বাসায় দিয়ে আসুন।”
“সহজ আর কঠিন কি? খালামনির বাসায় যেতে পারবো আর তোমার বাসায় যেতে পারবো না? মাঝরাতে হলেও সমস্যা নেই, দিয়ে আসতে পারবো।”
“না, খালামনির বাসায় দিয়ে আসুন। আমার একটু প্রয়োজন আছে।”
“কতক্ষণ লাগবে?”
“আজ থাকবো আমি৷ কাল সেখান থেকে কোচিংয়ে যাবো তারপর বাসায় যাবো। আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলেই হবে।”
“ওকে।”
“আপুর শাড়ি যে পরে চলে এলাম, রিটার্ন করবো কিভাবে?”
“পরে সুযোগ বুঝে আমার কাছে দিয়ে দিয়ো। তোমারটাও তো আপুর বাসায়। আরেকটু আগে মনে করলে না, তোমারটা তো নিয়ে নিতে পারতে।”
“থাকুক।”
“আচ্ছা, তাহলে থাকুক। আবার সেখানে গিয়ে থাকবো আর তুমি শাড়ি পরবে।”
শারমায়ার মুখভঙ্গি দেখার জন্য জোভান এক পলক তাকালো তার দিকে। তার দুষ্টুমিতে শারমায়া চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছে তার দিকে। জোভান মুচকি হেসে বললো,
“এভাবে তাকালে টুকটুকির আম্মুকে আরও বেশি ভালো লাগে।”
“আপনার মুখ লক করুন।”
“লক করলে আবার তুমিই অস্থির হয়ে যাবে আমার কথা শোনার জন্য। ওহ্, ভালো কথা। আগামী সপ্তাহে না তোমার রেজাল্ট দিবে?”
“আর মনে করিয়েন না। যখনই মনে হয় কলিজা কাঁপে।”
“কেন? এক্সাম ভালো হয়নি?”
“এক্সাম তো ভালোই দিয়েছি, রেজাল্ট জানি কি আসে!”
“ইনশাআল্লাহ, ভালো হবে। আন্টি থ্রেট দেয় নাকি? আগে আপু স্কুলে থাকতে মাকে বলতে শুনতাম, রেজাল্ট খারাপ হলে পড়াশোনা বন্ধ, বিয়ে দিয়ে দিবো। তোমার তো বিয়ে হয়েই গেছে, তোমাকে কি বলে? সংসারে পাঠিয়ে দিবো?”
শারমায়া হেসে উঠলো তার কথায়। জোভান হেসে বললো,
“আন্টি যদি বলে থাকে, আমি কিন্তু রাজি।”
“আপনি কি চান আমার রেজাল্ট খারাপ হোক?”
“আরে, না। আমি তো মজা করছিলাম।”
সন্ধ্যার আগেই শারমায়াকে খালামনির বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে জোভান চলে গেলো। বাসায় প্রবেশ করতেই ভাবি বললো,
“ওরে বাবা! কে আসছে রে এটা!”
সুষনা তাকে দেখে অবাক হলো এবং ভাবির জবাব দিলো,
“মিসেস জয়।”
শারমায়া বললো,
“তুমিও জানো তার নাম জয়?”
“ওহ্, জোভান। তোর ভাইয়ার মুখে জয় শুনি তাই জোভান মনে থাকে না।”
“ওহ্। আচ্ছা, ভাইয়ার সাথে তার কেমন সম্পর্ক?”
“কেন তুই জানিস না?”
“পরিচিত জানি, কিন্তু কেমন পরিচিত সেটা জানি না।”
“স্কুলে নাকি সিনিয়র ভাই ছিলো আবার ব্যবসায় পার্টনারশিপ। সেদিক থেকে বন্ধুত্বও।”
“ওহ্।”
“তুই কোথায় গিয়েছিলি?”
“বেড়াতে।”
ভাবি জিজ্ঞেস করলো,
“জোভান ভাইয়ার সাথে নাকি?”
“হুম।”
“সুন্দর লাগছে খুব। ভাইয়া এলো না যে?”
“সে আরেক জায়গায় যাবে তাই আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে।”
“এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে? দেখাও করলো না৷ পালিয়েছে নাকি আমাদের ভয়ে?”
“না, বাবা-মাকে আপুর বাসায় রেখে এসেছে। গাড়ি নিয়ে এসেছে তো, উনাদের আবার বাড়িতে নিয়ে যাবে।”
“ওহ্। সাফওয়ানা জানে তুমি এসেছো?”
“ওফ্ফ! দাঁড়াও, আগে আম্মুকে জানিয়ে দেই। আম্মুও জানে না আমি এখানে আসবো।”
শারমায়া তার মায়ের কাছে কল করে জানিয়ে দিলো। সাফওয়ানার পরীক্ষা চলছে আর সে বেড়াতে চলে এসেছে তার জন্য শারমিন বকাঝকা করেছে যা শারমায়া হজম করে নিয়েছে। রাতে ঘুমানোর সময় সুষনাকে বললো,
“আপু, কাল পার্লারে যাবো একটু।”
“হঠাৎ পার্লারে কেন? ব্রু প্লাগ করবি নাকি?”
“না..”
“কে ব্রু প্লাগ করবে? পিটিয়ে ছাল তুলে ফেলবো!”
শারমায়া জবাব দেওয়ার আগে অন্ধকার রুমে খালামনির ধমকে ভয় পেয়ে গেছে দুজনেই। সুষনা লাইট জ্বালিয়ে বললো,
“ওহ্, মা! তুমি এখানে কি করছো?”
“চার্জার নিতে আসছি। তোর বাবার ফোনের চার্জার নষ্ট হয়ে গেছে।”
“সাড়া নেই, শব্দ নেই এভাবে কেউ ধমক দেয়? কলিজা ফেটে যাওয়ার কথা!”
“তোদের কলিজা এতো নরম কেন? কে ব্রু প্লাগ করবে? শারমায়া?”
শারমায়া জবাব দিলো,
“না খালামনি। অন্য কাজে পার্লারে যাওয়ার কথা বলছিলাম।”
“পার্লারে কি কাজ?”
“প্রয়োজন আছে একটু।”
“কি প্রয়োজন, শুনি?”
“নাক ফুটো করবো।”
“নাক ফুটো করতে পার্লারে যাওয়া লাগে? আমিই করে দিতে পারবো।”
“এহ! দরকার নেই আমার। সুচ দেখলেই ভয় লাগে।”
“তাদের এতো মোটা হাতুড়ি দেখতে ভয় লাগে না?”
সুষনা বললো,
“হাতুড়ি তোমার সুচের অনেক চেয়ে ভালো। মাত্র এক সেকেন্ড সময় নিবে।”
“আমরা আর নাক ফুটো করি নাই। ঘরের কোণে পার্লার পেয়ে কত ঢং তোদের।”
পরদিন কোচিং মিস দিয়ে সুষনার সাথে পার্লারে গেলো শারমায়া। যাওয়ার সময় খালামনি স্বর্ণের নাকফুল ধরিয়ে দিলো হাতে। এটা খালামনির পক্ষ থেকে গিফট। মেশিন দেখে শারমায়া সুষনাকে খামচে ধরে রেখেছে। ফুটো করার পর ব্যাথা পেয়ে চিৎকার করেনি তবে অশ্রু ঝরে একাকার! সুষনা টিস্যু দিয়ে তার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
“ফাজিলটা সাহস দেখিয়ে আসছেও, আবার ভয়ে খামচে আমার চামড়া কেটে ফেলছে। জোভান ভাইয়ার সাথে পাঠানোর প্রয়োজন ছিলো। যার বউয়ের অত্যাচার সে সহ্য করে নিতো।”
পার্লারের মহিলা হাসছে তার কথা শুনে। শারমায়া লজ্জা পেয়ে বললো,
“আপ্পি…চুপ।”
শারমায়া নিজেকে আয়নায় দেখে বললো,
“খালামনি এটা কি দিয়েছে? এতো বড় নোজপিন আমি পরে থাকবো! কেমন মহিলা মহিলা লাগে!”
সুষনা হেসে বললো,
“দিতে আর ছোট দিবে কেন? তাই বড়টাই দিয়েছে। আপাতত পরে থাক, শুকালে খুলে ফেলিস। আমি একটা ছোট বানিয়ে দিবো।”
“দিয়ো, দিয়ো। গিফট পেতে কার না ভালো লাগে। ব্যাথা করছে তো, আরও বাড়বে না পরে?”
পার্লারের মহিলা বললো,
“ব্যাথার একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিয়ো। সেড়ে যাবে।”
পরক্ষণে তারা বেরিয়ে এলো। আসার পথে সমুচা কিনে নিলো। বাসায় ফিরে সমুচা খেতে খেতে খাবারদাবার সম্পর্কে খালামনির মস্ত তালিকা মাথায় প্রবেশ করালো। টক জাতীয় খাবার নিষিদ্ধ, চিংড়ি খাওয়া নিষিদ্ধ, বেগুন খাওয়া নিষিদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি! এসব খেলে ঘা শুকাবে না, চুলকাবে। নাক ফুটিয়েছে না খাবারের কিসমত মেরেছে জানা নেই তার!
বিকেলে জোভান কল করেছে,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় তুমি? বাসায় ফিরেছো?”
“না, খালামনির বাসায়।”
“কোচিং-এ যাওনি আজ?”
“উহুম। আপনি অফিস যাননি?”
“হুম, অফিসেই আছি।”
“সাথে কে?”
“কেউ না।”
“অবসরে মনে পড়েছে নাকি আমাকে?”
“সবসময়ই মনে থাকে আমার একটা বউ আছে।”
“লাঞ্চ করেছেন?”
“হুম। দুপুরে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”
শারমায়া একটু বিস্মিত হলো তার কথায়। অতঃপর স্বাভাবিকভাবে বললো,
“আপনি জানেন কিভাবে?”
“দেখেছি আমি।”
“কোথায় দেখেছেন?”
“তুমি বলো আগে কোথায় গিয়েছো।”
মিথ্যে বলা ঠিক হবে না তাই সত্যিটাই বলে দিলো,
“পার্লারে গিয়েছিলাম।”
“পার্লারে! তুমি পার্লারেও যাও?”
“আপনি কোথায় দেখেছেন?”
“আমি রিকশায় দেখেছি তোমাকে। বোরকা পরনে ছিলে। তোমার সাথে আরও কেউ ছিলো। কে?”
“সুষনা আপু। কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কিভাবে? আমি তো আপুর বোরকা পড়েছি, তা-ও আবার নেকাবসহ।”
“পোশাকে কি আসে যায়, মন চিনলে দেহ চিনতে কতক্ষণ? তোমার গঠন আমার মুখুস্ত। ইনশাআল্লাহ, শত ভীড়ের মাঝেও চিনে ফেলবো।”
মানুষটার কথা যত শুনে ততই মুগ্ধ হয় শারমায়া। তাকে চুপ থাকতে দেখে জোভান বললো,
“পার্লারে কেন গিয়েছো?”
“একটু প্রয়োজন ছিলো।”
“কি প্রয়োজন?”
“পার্সোনাল প্রয়োজন।”
“বলতে কি সমস্যা? আমি তো তোমার পার্সোনালই। গার্লফ্রেন্ডকে তো আর জিজ্ঞেস করছি না। বউয়ের পার্সোনাল বিষয় আমি জানবো না তো কে জানবে? ফেসিয়াল করেছো?”
“উহুম।”
“তুমি এমনিতেই আমার কাছে অনেক সুন্দরী। এসব করো না। এই, তুমি ব্রু প্লাগ করনি তো আবার? এসব কিন্তু আমার একদম পছন্দ না।”
“না, করিনি।”
“তাহলে কেন গিয়েছো?”
“এমনি। আপুর সাথে গিয়েছি।”
“তা তো বুঝলাম, তোমার কি প্রয়োজন ছিলো?”
“এটা জানাবো না।”
“কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি ব্রু প্লাগ করেছো।”
“করিনি, ব্রু প্লাগ।”
“তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভিডিও কল দেই?”
“না।”
“এখন তো আর আমাদের রুমে নেই। অফিসে আছি।”
“আপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?”
জোভান থমকে গেলো৷ সে তো বেশ উত্তেজিত ছিলো শারমায়ার লুকানো কথাটা জানার। এতে কি অবিশ্বাস প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে? হয়তোবা একটু বেশিই জোর করে ফেলছে। তাই সে বললো,
“ডিয়ার, তেমন কিছু নয়। আচ্ছা, আর জোর করবো না। লাভ ইউ।”
শারমায়া কোনো প্রত্যুত্তর না করায় জোভান বললো,
“রাগ করেছো? আর জিজ্ঞেস করবো না। লাভ ইউ তো।”
শব্দটা কি তাহলে স্যরি’র ক্ষেত্রে উচ্চারণ করলো জোভান? আন্দাজ করতে পেরে শারমায়ার খুব হাসি পেলো। থ্যাংকস জানাতে “ভালোবাসি” আর স্যরি প্রকাশ করতে “লাভ ইউ”! কথা বলার এতো স্টাইল সে কোথায় পায়? সে হাসি চাপা রেখে বললো,
“আপনি কি রাগ করেছেন?”
“উহুম। তুমিও রাগ করবে না। আমি আর জোর করবো না।”
“আমি রাগ করিনি।”
“সিরিয়াসলি?”
“হুম।”
“লাঞ্চ করেছো?”
“হ্যাঁ।”
“কি খেয়েছো?”
“সমুচা খেয়েছিলাম আর মুরগির মাংস দিয়ে ভাত।”
ওদিকে খালামনির হাক পড়লে শারমায়া জবাব দিলো, “আসছি।” তাই জোভান বললো,
“আচ্ছা, রাখি তাহলে। তুমি যাও।”
“আপনি রাগ করেছেন?”
“রাগ করিনি তো। এখন রাখি, রাতে কল করবো। আরও কিছু বলবে?”
“উহুম।”
অতঃপর কল কেটে দিলো। শারমায়া একটু পরপরই আয়নায় দেখছে নিজেকে। নোজপিনের কারণে চেহারায় একটা ম্যাচিউর ভাব চলে এসেছে। নিজেকে দেখে সে মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বললো,
“আপনি কি জানেন, আপনার জান আপনার জন্য নাক ফুটো করেছে এবং এখন নোজপিন পরে আছে? কৃত্রিমভাবে কেন দেখবেন শখের জিনিস? আমি তো সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিয়েছি। সারপ্রাইজ প্রত্যক্ষ উপভোগ করতে হয়। আসলেই নোজপিন নিজেকে বউ বউ ভাবায়। আমিও নিজেকে এখন বউ বউ ভাবছি। আপনার বউ।”