“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৩৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“পানিশমেন্ট না পেলে এই অনুতপ্ত কাল সকাল হতেই উধাও হয়ে যাবে। ইফাজের রুমের সামনে নারিকেল গাছ আছে। তাকে যদি নারিকেল গাছের মাঝামাঝিতে সারারাত বেঁধে রাখি কেমন হবে?”
শারমায়া হেসে উঠলো এবং বললো,
“একদমই না। আরও কিছু বলবেন?”
“কেন, তাড়া আছে?”
“উহুম। আপনার জন্যই বলছি।”
“বাবা বললো তোমার পাসপোর্ট নাকি রেডি। যাবে না কাল রিসিভ করতে? আংকেল নাকি নিয়ে যাবেন। কাজ না থাকলে আমিই যেতাম।”
“না, আব্বুই ফ্রি আছেন। আচ্ছা, স্যার কাগজপত্র কেন জমা দিলো? অযথা পাসপোর্টের কি প্রয়োজন? আমি তো দেশ ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।”
“সুযোগ আছে করে নিয়েছে। কেন, তোমার স্যারের কর্মে তুমি খুশি হওনি? আমি তো দারুণ খুশি। আমরা দেশের বাইরে হানিমুনে যেতে পারবো যখনতখন।”
“আপনি অনেক বেশি কথা বলেন।”
“জানি তো।”
জোভান আরও কিছুক্ষণ কথা বললো শারমায়ার সাথে। নাক অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় পরদিন নোজপিন খুলে তারপর বাবার সাথে পাসপোর্ট আনতে গেলো শারমায়া। পিছু নিলো সাফওয়ানা। বাড়ি ফেরার পথে আবার বাবার সাথে ঘুরেও এলো কিছুক্ষণ। সাখাওয়াত সাহেব মেয়েদের নিয়ে কোথাও গেলে তাদের পছন্দের কুলফিমালাই খাওয়াতে ভুলেন না যেন।
.
আজ ফারিয়াকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। ভাবি বাসায় নেই তাই সে শারমায়াকে বললো মেহমানদের সামনে তার সাথে যেতে। শারমায়ার চাচীও বললো বড় বোন হয়ে উপস্থিত থাকতে। শারমায়া তার মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে রাজি হয়ে গেলো। দুপুরের দিকে জোভান কল করলে শারমায়া কথা বলতে লাগলো। এমনি সাফওয়ানা এসে বললো,
“আপু, ফারিয়া আপু তোমাকে যেতে বলেছে।”
“আসছি।”
সাফওয়ানাকে জবাব দিয়ে জোভানকে বললো,
“আরও কিছু বলবেন?”
“কেন?”
“না মানে ফারিয়া আপু একটু ডাকছিলো। আপুকে দেখার জন্য মেহমান আসবে। ভাবি বাসায় নেই, তাই আমাকে থাকতে বললো।”
“তুমি মেহমানদের সামনে যাবে?”
“হুম।”
“উহুম, আপুকে রেডি হতে সাহায্য করো কিন্তু মেহমানদের সামনে যাবে না।”
“কেন? গেলে কি সমস্যা?”
“অনেক সমস্যা। যাবে না। আপুর কাজে হেল্প করে চলে এসো।”
“আপু যেতে বলেছে, আমি এখন না করি কিভাবে!”
“তুমি হ্যাঁ ই বা করলে কিভাবে? আপুও একটা মেয়ে তুমিও একটা মেয়ে। মানে বয়সের সীমাবদ্ধতা বুঝাতে চাইছি। এনি হাউ, কৌশলে না করে দাও।”
“আপুর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে হেল্প করে। এখন তার প্রয়োজনে আমি না গেলে কি ঠিক হবে?”
“শারমায়া, সবক্ষেত্র একরকম না। এই ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”
“ওকে।”
শারমায়া বিষণ্ণ মনে কল রেখে চলে গেলো ফারিয়ার কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহমান চলে আসবে তাই ফারিয়া পোশাক নিয়ে শারমায়াদের ফ্ল্যাটেই চলে এলো। বেশ চিন্তিত হয়ে ফারিয়াকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করলো শারমায়া। অতঃপর ফারিয়া প্রস্তুত হলে এদিকে সাফওয়ানা এসে বললো,
“আপু, চাচী তোমাদের যেতে বলেছে।”
“মেহমান এসেছে?”
“হুম।”
“শারমায়া চল।”
“দাড়াও এক মিনিট।”
শারমায়া তার মায়ের রুমে এসে মাকে খুঁজলো জোভানের ব্যাপারটা জানানোর জন্য। না পেয়ে সাফওয়ানাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো শারমিন চাচীদের ফ্ল্যাটেই আছে। সাফওয়ানাকে ডাকতে বললে সে বললো,
“আমি আর যেতে পারবো না। মেহমানরা ড্রয়িংরুমে বসে আছে।”
মা থাকলে তো ফারিয়ার সাথে মাকেই পাঠিয়ে দিতো। তা আর সম্ভব হলো না। সে আবার জোভানকে কল করলো,
“হ্যাঁ, বলো?”
“আমি আপুর সাথে গেলে কি খুবই সমস্যা? আপুও বলেছে, চাচীও বলেছে। আমি নিষেধ করি কিভাবে।”
“তাহলে তুমিই ভালো জানো।”
শারমায়া চুপ করে রইলো তাই জোভান বললো,
“আরও কিছু বলবে? ব্যস্ত আছি একটু।”
“না।”
শারমায়া কল কেটে দিয়েছে। ওদিকে ফারিয়া ডাকতে লাগলে শারমায়া এগিয়ে এসে বললো,
“আপু, আমার না যেতে ভালো লাগছে না। আমি আম্মুকে ডেকে দেই তুমি আম্মুর সাথে যাও।”
“মেরে ফেলবো একদম। আমার কতটা আনইজি লাগছে তুই জানিস? আয় বোন, প্লিজ।”
ফারিয়া জোরাজোরি করতে লাগলে সে বললো,
“আচ্ছা, দাড়াও। আসছি।”
শারমায়া তার শ্বাশুড়ি মায়ের দেওয়া নোজপিনটা বের করে নাকে পরলো। অতঃপর হিজাব স্টাইলে ওড়না প্যাচিয়ে বেরিয়ে এলো তার সাথে। তাকে নিয়ে মেহমানদের সামনে এসে দেখলো তার মা-ও এখানেই আছে। এবার তারও কিছুটা স্বস্তি বোধ হলো। তবে মেহমানদের সামনে বড় বোন হিসেবেই পরিচয় দিলো। প্রায় ঘন্টাখানেক চাচীদের ফ্ল্যাটে কাটিয়ে সে নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে দেখলো সাফওয়ানা তার ফোনে গেমস খেলছে। সে ফোন টেনে নিয়ে বললো,
“পড়া কোথায়? পড়তে বস গিয়ে।”
“এহ! নিজের পড়ার খবর নেই, অন্যের পড়ায় পোদ্দারি করতে আসছে। মেহমানরা চলে গেছে?”
“হুম।”
“আপুকে পছন্দ হয়েছে?”
“সেটা আমার কাছে বলে যাবে?”
“তুমি না সেখানেই ছিলে?”
“আমি আপুর সাথে ছিলাম। আমাদের অনুপস্থিতিতে তারা কথাবার্তা বলেছে চাচী আর আম্মুর সাথে।”
“ওহ্, ভাইয়া কল করেছিলো।”
“কখন?”
“এইতো, আট-দশ মিনিট হবে।”
শারমায়া আবার কল করলো কিন্তু জোভান কেটে দিলো। ভাবলো ব্যস্ত আছে তাই আর দিলো না। মাগরিবের নামাজ পড়ে কল করলে ডায়াল হলো কিন্তু রিসিভ হলো না। ডিনারের পর আবার কল করলো একই অবস্থা। শারমায়া বারবার ট্রাই করার পর শুধু ডায়াল হতে লাগলো কিন্তু রিসিভ হচ্ছেই না। সাফওয়ানা ঘুমাতে এলে সে সাফওয়ানার কাছে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর ভাইয়া তখন কল করে কি বলেছে রে?”
“আমি সালাম দিয়েছি। জবাব দিয়ে কেমন আছি জিজ্ঞেস করলো। তারপর তুমি কোথায় জানতে চাইলো। আমি বলেছি এখন ঘরে নেই চাচীদের ফ্ল্যাটে গেছে একটু। তারপর বললো, ওহ্ ওকে। আর কিছু না।”
শারমায়া এবার বেশ বুঝতে পারছে সে রাগ করে ফোন রিসিভ করছে না। শুয়ে শুয়ে সে আরও কয়েকবার ডায়াল করলো, মেসেঞ্জারে নক করলো। কোনো রেসপন্স পেলো না। মন খারাপ করে তার কথা ভাবতে ভাবতেই চোখে ঘুম নেমে এলো। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একটু পরপর ডায়াল এবং টেক্সটে ট্রাই করে ব্যর্থ সে। কোচিং-এ গেলো মন খারাপ করেই। ক্লাসে পূর্বের মতো এতোটা মনযোগ ছিলো না। কোচিং শেষে অফিস-রুমের সামনে দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় জোভানের কন্ঠ শুনে সে অফিস রুমে তাকালো। জোভান একজন টিচারের সাথে কথা বলছে। হাতে কিছু কাগজও দেখা যাচ্ছে। সে বন্ধুদের বিদায় দিয়ে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো জোভানের সাথে একটু কথা বলার জন্য। পরক্ষণেই ডানপাশে তাকিয়ে লাল গাড়িটা দেখতে পেল। শারমায়া সংকোচ নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। গাড়িতে কাউকে না দেখতে পেয়ে সে গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসলো। বসে বসে শুধু এটাই প্রার্থনা করতে লাগলো, জোভানের সাথে যেন কেউ না আসে। মিনিট ছয়েক পর জোভানকে হাতে প্যাচানো কাগজ নিয়ে একাই বের হতে দেখা গেলো। গাড়ির দরজা খুলে জোভান তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো। আজ তার মুখে সবসময় লেগে থাকা হাসিটা নেই। শারমায়া সালাম দিলে জোভান গাড়িতে বসতে বসতে বললো,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। হঠাৎ এখানে কেন?”
“কেন, বসতে পারিনা আপনাদের গাড়িতে?”
“প্রয়োজন থাকলে অবশ্যই।”
“ফোন রিসিভ করছেন না কেন?”
“সাইলেন্ট করা ছিলো।”
“অন্যসময় তো সাইলেন্ট থাকে না। আজ হঠাৎ সাইলেন্টের প্রয়োজন কেন পড়ে গেলো?”
“অন্যসময় তো কারো অবহেলার পাত্র হতে হয়নি। তাই।”
কথাটা বিঁধলো শারমায়ার মনে। সে স্যরি বলতে গিয়েও বললো না। তবে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো জোভানের দিকে। জোভান গাড়িতে চাবি সংযুক্ত করতে করতে বললো,
“আমি তো এখন এইপথে যাবো না। অফিসে কাজ আছে সেখানে যেতে হবে। তোমাকে রিকশা করে দিবো?”
“আমি রিকশায় যাবো না।”
“আমার জরুরি কাজ আছে।”
“তাহলে করুন আপনার কাজ। নিষেধ করেছে কে?”
শারমায়ার জিদ্দি কথার বিপরীতে জোভান আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। শারমায়ার বাসার পথেই যাচ্ছে গাড়ি। জোভানের মুখে কোনো শব্দ নেই। শারমায়াও চুপচাপ তার দিকেই তাকিয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। পথ তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, জোভান যে একবারও তাকাচ্ছে না তার দিকে। এতোটা অবহেলা সহ্য হচ্ছে না শারমায়ার। কান্না আসছে তার। সে ধাধানো কন্ঠে বললো,
“আপুর সাথে আমার সম্পর্ক অনেক ভালো। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আমি না করতে পারিনি আপুকে। চাচীও বলেছে যেতে।”
জোভান কিছু বললো না তাই শারমায়া আবার বলতে লাগলো,
“পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছি। আপনি সেখানে থাকলে বুঝতেন পরিস্থিতি। আম্মুর কাছে বলেই আমি গিয়েছি। আম্মুও ছিলো সেখানে। আর তারা আমাকে দেখেই বুঝেছে আমি বিবাহিতা।”
কথা বলে জোভানের প্রতিক্রিয়ার আশায় রইলো কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়াই করলো না জোভান৷ সে নিরবে ড্রাইভ করছে। শারমায়া চোখ মুছে ফোন বের করে জোভানের সামনে ধরে বললো,
“দেখুন, আমি কিভাবে গিয়েছিলাম সেখানে। দেখুন না একবার।”
জোভান ফোনের স্ক্রিনে এক পলক তাকিয়েছে শুধু। কিন্তু ছবি দেখে কিছু বললো না। এদিকে বাসার সামনে এসে পড়েছে অথচ জোভানের রাগ ভাঙাতে পারলো না তাই আরও বেশি কান্না আসছে তার। সে তার হাত স্পর্শ করে বললো,
“আর কখনো অবাধ্য হবো না।”
“আমি চাই না তুমি আমার বাধ্য হয়ে চলো। জাস্ট একটু সচেতন থাকার জন্য বলি। চাইলে এটাও এভোয়েড করতে পারো।”
“আপনি এমন করছেন কেন?”
“বাসায় চলে এসেছি।”
“আপনি আমার সাথে কথা বলুন আগে।”
“আমার কাজ আছে, যেতে হবে।”
“আমি নামবো না গাড়ি থেকে।”
জোভান তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ফোনে কথা বলবো পরে। বাসায় যাও।”
শারমায়া তবুও বসে রইলো চুপচাপ। জোভান গাড়ি থেকে নেমে বামপাশে এসে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে বললো,
“এসো…”
যদিও সে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে তবুও শারমায়ার ভালো লাগছে না। কেননা সে এখনো জোভানের সেই হাসিমাখা মুখখানা দেখতে পারেনি। আর তা দেখা না পর্যন্ত শান্তি নেই। শারমায়া অপরাধী মনোভাব নিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“লাভ ইউ।”
জোভান হাত গুটিয়ে নিয়ে ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর শারমায়াকে ঠেলে বামপাশেই গাড়িতে বসে দরজা লক করতে করতে বললো,
“নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবো আমি। পাগল করেই ছাড়বে তুমি আমাকে।”
জোভান একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই হকচকিয়ে গেলো শারমায়া। জোভান তার কানের নিচে ঠোঁট ছোঁয়াতেই শারমায়া হেসে উঠলো এবং জোভানের দুষ্টুমি থেকে মুক্তি পেতে তাকে ঠেলতে লাগলো। জোভান বললো,
“কি হলো?”
“আমি নামবো। সরুন।”
“নামার চান্স শেষ।”
জোভানের মুখে দুষ্টুমির হাসি দেখে শারমায়া তাকে ধাক্কিয়ে ডানপাশ দিয়েই নামতে গেলে জোভান হেসে তার হাত টেনে বললো,
“এই, এদিকে নামো।”
অতঃপর দু’হাতে শারমায়ার মুখখানা ধরে কপালে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে বললো,
“লাভ ইউ টু। আপুকে পছন্দ হয়েছে তাদের?”
“হুম।”
“বিয়ে তাহলে খেতে পারবো আরেকটা।”
শারমায়া মুখ চেপে হাসলো। জোভান গাড়িতে রাখা প্যাচানো কাগজটা তার হাতে দিয়ে বললো,
“এটা নিয়ে যাও।”
“কি এটা?”
“রয়েল বেঙ্গল টাইগার।”
“এটা দিয়ে আমি কি করবো?”
“কি আর করবে, দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে পারবে। একজন দিয়েছিলো শখ করে, তাই নিয়েছি। লাগলে নিয়ে যাও।”
“দেয়ালে প্রাণীর ছবি ঝুলানো ঠিক না। ঘরে ফেরেশতা আসে না।”
জোভান নামতে নামতে বললো,
“আচ্ছা, প্যাচানোই থাক তাহলে।”
“সাবধানে যাবেন।”
শারমায়া গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে আবার পেছনে এসে বললো,
“আচ্ছা দিন, প্যাচানোই রেখে দিবো।”
জোভান মুচকি হেসে কাগজটা দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।