“হালাল প্রেম” পর্ব- ৩৬

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৩৬
(নূর নাফিসা)
.
.
মা আর সাফওয়ানা চলে গেলে শারমায়া দরজা লাগিয়ে কিচেনে এলো। অতঃপর আবার সবজি কাটায় মনযোগ দিলো। ভেতরে ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে অথচ বাইরে সে নিশ্চুপ। একটু পরপর চোখ ঝাপসা হয়ে এলে কেবল নিরবেই অশ্রু মুছে যাচ্ছে। ভাতের মার গালতে গেলে হাতে গরম মার পরে যায়। মনে যখন ব্যাথা থাকে, দেহের ব্যাথা যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠে। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে শারমায়ার। সে কান্না চাপা রাখার চেষ্টায় ঠোঁট কামড়ে রেখে হাত ঠান্ডা পানিতে রাখলো। পরবর্তীতে সবজি রান্না করে চুলা অফ করে দিলো। আর ইচ্ছে করছে না কিছু রান্না করতে। সে হাতমুখ ধুয়ে নিজের রুমে বসে রইলো। কিন্তু এই জোভান নামক ব্যক্তিটা যে একটুও শান্তি দিচ্ছে না। সেই কখন থেকে মাথার ভেতর যন্ত্রণা হয়ে বসে আছে, যার থেকে মুক্তি মিলছে না এক সেকেন্ডের জন্যও। যন্ত্রনা যেন বেড়েই যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত চাপে শারমায়া এবার হু হু করে কেঁদে উঠলো। দু-তিন মিনিট কান্না করে শান্ত হয়ে সে ফোন হাতে নিলো। ইফাজের নম্বর খুঁজে তাকে কল করে হসপিটালের ঠিকানা নিয়ে নিলো। অতঃপর বোরকা হিজাব পরে ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে চাচীর কাছে চাবি দিলো এবং একা একাই রওনা হলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে কেবিনের সামনে এসে জোভানকে বেডে বসে থাকতে দেখলো। পাশে আছে দুই পরিবারের সদস্যগণ। কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে কথা বলছে আর শুনছে। জোভানের হাতে, পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে চোখ আবারও ঝাপসা হয়ে গেলো৷ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে প্রথমে চোখ পড়েছে সাফওয়ানার এবং তারপরই জোভানের। বাকিরা বিপরীতমুখী হয়ে ছিলো। জোভান হেসে হেসেই কথা বলছিলো, তাকে দেখার পর হাসিটা বিলীন হতে লাগলো। জোভানের দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষেপ হওয়ায় শারমায়া আর একমুহূর্তের জন্যও দাঁড়ালো না এখানে। সে উল্টোদিকে হাটতে লাগলে পেছন থেকে জেভা ডাকলো তাকে। শারমায়া পেছনে ফিরে দেখলো জেভা অন্য একটা কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে। শারমায়া একহাতে দুচোখ মুছে তার দিকে এগিয়ে এসে সালাম দিলো। জেভা সালামের জবাব দিয়ে বললো,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“বাসায়।”
“জয়ের সাথে দেখা করবে না?”
“তার সাথে কেন দেখা করতে যাবো।”
শারমায়ার অভিমানী উক্তিতে জেভা মুচকি হেসে তার হাত ধরে ভেতরে এনে চেয়ারে বসতে বললো৷ অতঃপর আরেকটি চেয়ার টেনে নিজে বসে বললো,
“ছেলেটা অনেক পাজি। কারো কথা শোনে না। যার জন্য তাকে মোটরসাইকেল কিনে দিলো না বাবা, আজ সে সেই ঘটনাই ঘটায়। এক্সিডেন্ট হয়ে সে আমাকে কল করে বলে, আপু তুমি হসপিটালে আছো? আমি বললাম, হ্যাঁ কেনো? সে বলে, তুমি থাকো আমি আসছি। আমি ভেবেছি কিছু বলবে তাই বলেছি আজ সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরবো। তুই অফিস শেষে বাসায় চলে যাস। উত্তরে জানো কি বলে? বলে, আপু, আমি তো এক্সিডেন্ট হয়েছি, হসপিটালেই আসবো। তুমিই বলো, এমন কান্ডে কেউ এভাবে কোথায় আছি না আছি এসব নিয়ে গল্প করে ফোনে? আমার তো এদিকে ভয়াবহ অবস্থা! তা-ও নাকি সে একা আসছে! পরে দেখলাম রিকশাওয়ালার কাঁধে ভর করে এসেছে। নিজের হাত নিজেই রুমালে চেপে রেখেছে, পা গড়িয়ে রক্ত পড়ে প্যান্ট ভিজে গেছে। এই অবস্থায় কেউ স্বাভাবিকভাবে কথা বলে? জিজ্ঞেস করলাম আশেপাশের কোনো লোক তোকে ধরেনি? সে বললো, লোকজন ধরেছে ঠিকই, তবে সাথে আসতে নিষেধ করে একটা রিকশা ঠিক করে দিতে বলেছে।”
শারমায়া বিষন্নতার সাথে নিষ্পলক টেবিলে তাকিয়ে আছে। জেভা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“টেনশন করছো? টেনশন করো না। আল্লাহ রহমত করেছে।”
“উনি কোথায় কোথায় ব্যাথা পেয়েছে, আপু?”
“পায়ে চামড়া কেটে গেছে। মোটরসাইকেলের চাপ পড়ে হাতের হাড় সামান্য ফেটে গেছে।”
“এক্সিডেন্ট কখন হয়েছে?”
“সকাল এগারোটার দিকে। তারউপর দেখো, এখানে এসে আমাকে রিকুয়েষ্ট করছে আমি যেন কাউকে না জানাই। যদি কাউকে জানাই, তাহলে সে চিকিৎসা নিবে না। এভাবেই চলে যাবে।”
শারমায়া রাগান্বিত গলায় বললো,
“কষিয়ে কয়েকটা থাপ্পড় দিলে না?”
“মেজাজ আমারও খুব খারাপ হয়েছে তখন। অসুস্থ বিধায় বেঁচে গেছে। আর তার এই অবস্থা দেখে বাবা-মাও অতি টেনশনে পড়ে যেতে পারে তাই আমিও একটু সময় নিলাম। তার ড্রেসিং করে একটা অপারেশনে গেলাম সেটা শেষ করে দুপুরের পর বাবা-মাকে হসপিটালে আসতে বললাম৷ তারপর ঠান্ডা মাথায় সব জানালাম। একটু বকা শুনেছি, তা-ও উনারা এতোটা টেনশনে যায়নি তা দেখে সার্থকতা অনুভব করেছি। সরাসরি দেখা আর শুনে আৎকে উঠার মধ্যে অনেক ডিফারেন্স। তাই করতে হলো এটা। তারপর বাবাই বোধহয় আংকেলকে কল করে জানালো। তুমি চলে যাচ্ছিলে কেন? রাগ করে আছো জয়ের উপর?”
“তার উপর কেন রাগ করতে যাবো। আমার আর কোনো কাজকর্ম নেই তো।”
“বাবারে! কি অভিমান! জয় বলেছে আমাকে, তুমিও নাকি নিষেধ করেছিলে বাইক চালানোর কথা। একটু টাইট দিবে, দেখবে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। এসো আমার সাথে।”
“উহুম, আমি যাবো না সেখানে।”
“আরে এসো তো।”
“আপু, প্লিজ। আমি যাবো না।”
“আচ্ছা, বসো। আমি আসছি। এখান থেকে যাবে না কিন্তু।”
“এটা তোমার কেবিন?”
“হুম। বসে থাকো।”
জেভা কেবিন থেকে বের হয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার ফিরে এসে বললো,
“জয়ের পাশে তো কেউই নেই! ছেলেটাকে একা রাখা ঠিক হবে না। তুমি সেখানে গিয়ে বসে থাকো।”
শারমায়া আবারও নিষেধ করতে যাচ্ছিলো কিন্তু জেভা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“এটা বড় বোনের আদেশ। যাও।”
তাকে যেতে বলে জেভা ই হাত ধরে তাকে জোভানের কেবিনে নিয়ে এলো। এখানে শুধুমাত্র সাফওয়ানা ছিলো। তার হাত ছেড়ে জেভা সাফওয়ানাকে বললো,
“সাফওয়ানা, আহনাফ কোথায়?”
“আংকেল আন্টির সাথেই গেছে।”
“আচ্ছা। তুমি আমার সাথে এসো তো একটু।”
শারমায়া সাফওয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,
“আব্বু আম্মু কোথায়?”
“আংকেল আন্টি কি যেন দেখাতে নিয়ে গেলো একটু আগে।”
জেভা বললো,
“ছাদে গেছে, মামাদের প্লট দেখাতে। সাফওয়ানা, এসো তুমি।”
সাফওয়ানা বেরিয়ে গেলে জেভা শারমায়াকে আরেকটু ঠেলে এগিয়ে দিয়ে দরজা চাপিয়ে চলে গেলো। জোভান সবসময়কার হাসিটা প্রকাশ করে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
শারমায়া মনে মনে জবাব দিলেও মুখে কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না। দৃষ্টি মেঝের দিকে রেখে একই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে। জোভান বললো,
“সালাম দিয়েছি তো।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here