“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৪৫
(নূর নাফিসা)
.
.
প্রায় দেড় মাস যাবত শারমায়া এখানে আছে। আশেপাশের পরিবেশ একটু-আধটু তার চেনা আছে। প্রতি উইকেন্ডে পারিবারিকভাবে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে তারা। বেশ ভালোই কাটছে সময়। তবুও নিজ পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে ভালো লাগার মাঝেও ছেয়ে আছে কিছু বিষন্নতার রাশি। প্রতিদিন কিংবা একদিন পরপর কথা হচ্ছে বাবা মা ও সাফওয়ানার সাথে। জোভানের সাথে প্রতিদিনই কথা হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে জেভা ও শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথেও।
বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। বিকেলের ছায়া পড়তেই ঘোলাটে হয়ে এসেছে প্রকৃতি। সন্ধ্যায় থেকে স্নো পড়ছে। শীতের জামা কাপড় মুড়ে ঘরে অবস্থান করে মন্দ লাগে না বাইরের পরিবেশ দেখতে। প্রতিটি দম্পতির জন্য হয়তো রোমাঞ্চকর মুহুর্ত। আর যদি থাকে এমন দুষ্টু প্রকৃতির দু-তিনটা বাচ্চা তাহলে তো রোমাঞ্চিত মুহুর্তে বোমা ফাটবেই একটু পরপর। সন্ধ্যার দিকে ড্রয়িং রুমে বসে কফি খেতে খেতে চাচীমা ও চাচ্চুর সাথে গল্প করছিলো শারমায়া। ওদিকে দুই ভাইবোন খেলতে খেলতে তুমুল ঝগড়া বেঁধেছে। যখনই, “মা” বলে চিৎকার করে তানহা বলে “তোর বাবাইকে বল।” পরক্ষণে বাবাইকে ডাকলে মিজান বলে “বাবাই আজ বাসায় নেই।” শারমায়া তাদের কান্ড দেখে হেসে দুজনের ঝগড়া থামাতে গেছে। সোয়াদ ছেলেটা আসলেই পাজি। এলোপাথাড়ি মারে জুথিকাকে। জুথিকা একটা দিতে দিতে সে চার-পাঁচটা দিয়ে বসে। শারমায়া টেনেও আনতে পারছে না সোয়াদকে। তানহা লাঠি হাতে এসে বললো,
“শারমায়া, তুমি ছেড়ে দাও। দুজনেই এই মুহূর্তে বের হো বাসা থেকে। দ্বিতীয় বার ফিরবি না। গো আউট!”
বলতে বলতে সোয়াদের পায়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করতেই সোয়াদ শারমায়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। শারমায়া তাকে নিয়ে সরে এলে সোয়াদ তার বাবাইয়ের কাছে যেতে যেতে বললো,
“আমি বাবাইয়ের কাছে বিচার দিবো।”
“তোর বাবাইকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যা বাসা থেকে।”
সোয়াদ তার বাবার কোলে বসে দু’হাতে মুখখানা ধরে বললো,
“বাবাই, পঁচা মা মেরেছে আমাকে।”
“ওকে, পঁচা মাকে নানু বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তোমাকে একটা ভালো মা এনে দিবো।”
“আমিও নানুবাড়ি যাবো।”
“তুমিও যাবে? তাহলে ভালো মা কার জন্য নিয়ে আসবো?”
“তোমার জন্য।”
“বাপের ব্যাটা, সেই বাপকেই দেয় ছ্যাকা!”
শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তানহা জুথিকাকে সাথে নিয়ে এসে বললো,
“দেখো মেয়েটাকে মেরে কি করেছে।”
জুথিকার হাতে খামচি দিয়ে কেটে ফেলেছে সোয়াদ। তানহা অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিয়েছে। জুথিকা কাঁদছে তাই সোয়াদকে বকা দিয়ে টেবিলে বসিয়ে রেখে মেয়েকে কোলে নিয়ে অন্যরুমের দিকে চলে গেলো। সোয়াদ গাল ফুলিয়ে রেখেছে। বেশ কিউট লাগে তার গাল ফুলানো। শারমায়া তার সাথে কথা বলে বলে তাকে স্বাভাবিক করলো।
রাতে ঘুমানোর সময় জোভানকে ও তার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোকে স্মরণ করতে ভুলে না শারমায়া। তার কাছ থেকে পাওয়া চিরকুট দুইটাও নিয়ে এসেছে সাথে। প্রায়ই পড়ে। পড়তে পড়তে মুখুস্ত হয়ে গেছে তবুও পড়ে। ইফাজ মেসেঞ্জারে কিছু ভিডিও পাঠিয়েছিলো জোভানের গান রেকর্ডিং, তাদের ফানি ভিডিও, সাথে তাদের ঘুরাফেরা মুহুর্তের বেশ কিছু ছবিও। এগুলো দেখে আর হাসে মনটা ভালো রাখার চেষ্টায়।
শারমায়া ল্যাবরেটরিতে যাচ্ছে। কোনো গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই হাটতে হাটতেই চলে যাচ্ছে। দিনদুপুরেই ভুবনে কেমন যেনো অন্ধকার নেমে আসছে। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। একদমই নির্জন পরিবেশ। খুব ভয় লাগছে তার। অথচ সবসময়ই এদিকে মানুষের আনাগোনা থাকে। পথ শেষ হচ্ছে না বিধায় একসময় সে দৌড়াতে লাগলো। দৌড়াতে দৌড়াতে হাপিয়ে উঠেছে সে। ধীরে ধীরে তার দমও বন্ধ হয়ে আসছে। একপর্যায়ে হুট করেই সে চোখ খুলে ফেললো। চোখের খুব নিকটে কারো মাথা দেখতে পেয়ে চমকে গেলো। কেউ তার মুখ চেপে রেখেছে যার ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে শরীরে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ঠেলে উঠে বসে পড়লো। ভয়ংকরভাবে হাপাচ্ছে সে। তার সামনেই বসে আছে চকচকে দৃষ্টির অধিকারী জোভান। দেহে একটা ব্ল্যাক কোয়ার্টার প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই নেই। তার এই অবস্থা আরও বেশি ভয় পায়িয়ে দিয়েছে শারমায়াকে। ভয়ে কম্পিত দেহের অধিকারী শারমায়ার চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে। জোভান মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলতেই শারমায়া দুহাতে এলোপাথাড়ি মারতে ঝাপিয়ে পড়লো তার উপর। জোভান হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে নিলো ঠিক যতটা শক্ত করে চেপে নেওয়া সম্ভব। শারমায়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে। পথভ্রষ্ট স্বপ্ন হলেও এটা স্বপ্ন নয়। জোভান সত্যিই এসেছে তার কাছে। কিন্তু শারমায়ার কান্না যে কোনোমতেই কমছে না! জোভান বললো,
“সুইটহার্ট, স্টপ। স্টপ ক্রায়িং। এই, সাউন্ড বাইরে গেলে চাচ্চু চাচীমা কি মনে করবে! হয়েছে তো অনেক। এমন করলে কিন্তু আমি চলে যাবো।”
জোভানের নানান কথায় কোনো কাজই হচ্ছে না। একপর্যায়ে সে হেচকি তুলে কান্না করতে লাগলো। কান্নার কারণে তার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! জোভান তাকে সোজা করে বসালো। সে ভয় পেয়ে গেছে তার অবস্থা দেখে! শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টায় শারমায়ার বুকে স্লাইড করতে করতে ভয়ার্ত কণ্ঠে জোভান বললো,
“শারমায়া কি হয়েছে? এই, কথা বলো। পানি পান করবে?”
শারমায়া মাথা দু’দিকে নাড়ালেও জোভান গ্লাসে পানি নিয়ে তাকে ধীরে ধীরে পান করালো। কিছুক্ষণ পর শারমায়া অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আবার মিশে রইলো জোভানের সাথে। জোভান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কম্বল টেনে তাকেসহ প্যাচিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। শারমায়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু শারমায়া কান্না করে হাপিয়ে গেছে তাই কথা বলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলো। জোভানও আর বিরক্ত করলো না।
সকালে ঘুম থেকে জেগে শারমায়া তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত জোভানের দিকে। ঠান্ডার প্রকোপে উষ্ণতা পেয়ে বেশ আরামে ঘুমাচ্ছে জোভান। এতোক্ষণে লক্ষ্য করলো তার ওড়না নিজের কাছে নেই। শারমায়া জোভানের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেওয়া হাত সরিয়ে উঠার চেষ্টা করতেই জোভানের ঘুম ভেঙে গেলো। সে তাকে আরও জড়ো করে নিয়ে বললো,
“আজ তো অফ ডে, ঘুমাও।”
শারমায়া তাকে ঠেলে বললো,
“সরুন, আপনার সাথে থাকলে একটা দিনও নামাজ পড়া হয় না।”
“থাকলেই মাত্র তিনদিন। আজ নিয়ে দুদিন মিস হলো। এলার্ম দিয়ে রাখলে না?”
“এমনিতেই সজাগ হই, তাই এলার্ম দেই না।”
“আপনার ওইপাশে আমার ওড়না। দিন।”
“প্রয়োজন দেখছি না তো।”
“আছে।”
“নেই, নেই।”
“আপনি হঠাৎ এখানে কেন?”
“তোমার জন্য।”
“আসবেন সেটা আগে বললেন না কেন?”
“সারপ্রাইজ দিবো বলে।”
“এমন সারপ্রাইজে আমি তো মরেই যাচ্ছিলাম! চাচ্চু চাচীমাও জানতো না?”
“চাচ্চু জানতো। তবে জানাতে নিষেধ করেছি। তুমি রাতে এভাবে কান্না করলে কেন বুঝলাম না। কেন কান্না করলে?”
“কান্না করবো না, আমি কতদিন ধরে পরিচিত মুখগুলো দেখি না। আমার মনের অবস্থা আপনি বুঝবেন কি?”
“বুঝতেই তো চাই। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমার কান্না দেখে। আমার লাইফে কখনো এভাবে কাউকে কান্না করতে দেখিনি। তুমি এখানে আসার সময় কেঁদেছো সেটা স্বাভাবিক কিন্তু গতরাতে যা করলে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। তুমি কি ভয় পেয়েছিলে আমাকে দেখে?”
“আপনাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো তখন।”
“কেন? আমি আবার কি করলাম! সারপ্রাইজ দিতে চাইলে খুন হতে হয়?”
“সারপ্রাইজ দিচ্ছিলেন?”
জোভান ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে শারমায়ার ঠোঁট স্পর্শ করতেই শারমায়া রাগান্বিত গলায় বললো,
“আবার!”
জোভান আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
“সুইট মর্নিং, মিষ্টি বউ। আমাকে কাছে পেয়ে এখন কেমন লাগছে?”
“বলে বুঝাতে পারবো না।”
অতঃপর সে মুচকি হেসে হাতপায়ের বন্ধনে বাঁধতেই শারমায়া বললো,
“এসব কি পড়েছো। কাপড়চোপড় নিয়ে আসোনি?”
“কেন, খারাপ কিছু পড়েছি?”
“লজ্জা লাগে না এতোবড় হয়ে ছোট ছোট প্যান্ট পরতে? আমারই তো লজ্জা লাগছে।”
জোভান হেসে বললো,
“তাই তো আমার লাগে না। সবাই লজ্জা নিয়ে বসে থাকলে কিভাবে! লাগেজ খোলার সময় নেই। তাই কাভার্ড থেকে নিয়ে শাওয়ার নিয়েছি।”
“এই ঠান্ডার মধ্যে রাতে গোসল!”
“হুম। ফ্রেশ না হয়ে তোমার কাছে আসি কিভাবে।”
“আসার আগে আব্বু আম্মুর সাথে দেখা করে এসেছিলে?”
“হুম, পরশু বিকেলে সাফওয়ানার সাথে ঘুড়ি উড়ালাম কিছুক্ষণ। আন্টি কি কি যেন পাঠিয়েছে তোমার জন্য।”
“কেমন আছে তারা?”
“সবাই ভালো।”
“খুব মিস করছি আব্বু আম্মুকে। কতদিন হলো সাফুর সাথে ঝগড়া হয় না।”
“কেন, ভিডিও চ্যাট করে ঝগড়া করবে। ডীষুম ভীষুম করে ফোনই ভেঙে ফেলবে।”
চোখ ভেজা থাকলেও শারমায়া মৃদু হাসলো তার কথায়। অতঃপর বললো,
“এই রুম পেইন্টিং নাকি তুমি করেছো?”
“হুম, পছন্দ হয়নি?”
“সব কাজেই পারদর্শী! আর যেখানে যায় সেখানেই নিজের একটা রুম ফিক্সড রাখে। এতো রুম দিয়ে করবে কি শুনি?”
“মানে?”
“এইযে এখানে নিজের একটা রুম বরাদ্দ, নিজ বাসায় একটা, আপুর বাসায়ও একটা।”
“কি যে বলো গো তুমি। তোমার আমার তো একটাই রুম। একসময় এখানে আমি থাকতাম বলে আমার জন্য রুম স্যাপারেট ছিলো। সবসময় কি থাকবে? আর আপুর বাসায় ওটা গেস্টরুম বলতে পারো। তাদের রেগুলার গেস্ট আমিই। তাই আমি গেলে থাকি মাত্র। বাচ্চাকাচ্চা বড় হয়ে গেলে তো তাদেরই হবে না এই রুমে।”
শারমায়া ঠোঁটের এক কোণে দুষ্টুমি হাসি ফুটিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“আবার শ্বশুর বাড়ি গেলেও আরেকটা হবে।”
জোভান শরীর কাপিয়ে হেসে উঠে বললো,
“আচ্ছা, শ্বশুর বাড়ি আমরা দিনে বেড়াতে যাবো রাতের পূর্বেই চলে আসবো। তাহলে আর স্যাপারেট রুম লাগবে না।”
শারমায়া ব্রু কুচকে বললো,
“কেন? আমাদের বাসায় রুমের অভাব পড়েছে? দুই জামাই একত্রে গেলেও একটা রুম খালি থাকবে।”
“তুমিই তো খোটা দিচ্ছো।”
শারমায়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আমি খোটা দিচ্ছিলাম?”
রেগে গেছে বিধায় জোভান শারমায়াকে নিজের সাথে চেপে ধরতে ধরতে বলল,
“ওপ্স! লাভ ইউ, জান। ইটস টাইম টু লাভ। নট ঝগড়াঝাটি।”