“হালাল প্রেম” পর্ব- ৪৮

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৪৮
(নূর নাফিসা)
.
.
দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শারমায়াকে নিয়ে ঘুরে রাতে আবার চাচ্চুর সাথে চলে গেছে নাইট ক্লাবে পার্টিতে। চাচ্চুর ফ্রেন্ড দাওয়াত করেছে পুরো পরিবারকে। কিন্তু এই ঠান্ডার মধ্যে তারা বের হবে না তাই দুজন চলে গেলো। নাইট ক্লাবের পার্টি কেমন হতে পারে তা শারমায়ার মাথায় ঘুরছে। মধ্যরাতে তারা বাড়ি ফিরলে শারমায়া জোভানকে ঠেলে ধাক্কিয়ে গোসলের জন্য পাঠিয়ে দিলো। জোভান হাঁচি দিতে দিতে বাথরুম থেকে বের হতে হতে বললো,
“ডিয়ার, একেই কি বউয়ের প্যারা বলে?”
শারমায়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। জোভান মুচকি হেসে বললো,
“হঠাৎ শাওয়ার নিতে কেন পাঠালে, বুঝলাম না।”
“ফ্রেশ হওয়ার জন্য।”
“আমি যেখানে গিয়েছি টোটালি ফ্রেশ একটা জায়গা। ময়লা খুঁজতে গেলে বিশেষ যন্ত্র লাগবে। আর রাস্তায়ও ময়লা লাগার কোনো সুযোগ নেই। গাড়িতে গিয়েছি, গাড়িতে এসেছি।”
“শুধু বাইরে ফ্রেশ থাকলে তো চলবে না। ভেতরেও ফ্রেশ হওয়া দরকার। মাতলামো আমি দেখতে পারবো না।”
জোভান কিছুটা বিস্মিত দৃষ্টিতেই তাকালো তার দিকে। অতঃপর শারমায়ার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি ভাবছো আমি ড্রিংক করে এসেছি? আমি ওসব কিছু খাইনি।”
“হয়েছে, সাধু সাজতে হবে না। জানি না নাকি কিছু? ইফাজ ভাইয়া পাঠিয়েছে না ভিডিও। দেখিনি কিভাবে বিয়ার গিলছে!”
“যার বিয়েতে গিয়েছিলাম না, সে জোর করে খায়িয়েছিলো। নিজের পকেট খরচ করে। ওটাই লাস্ট ছিলো। আর খাইনি।”
“ফাস্ট তো তাহলে ভালোই ছিলো। চাচ্চুর সাথে হুকা টানার ছবিও দেখা আছে।”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“সেটা অভিজ্ঞতার জন্য ট্রাই করেছিলাম। আমি এসব খাই না। সিরিয়াসলি, রেগুলার অভ্যাসে নেই। আজও এমন কিছুই খাইনি। তুমি যেমনটা ভাবছো, তেমন পার্টিও না। এটা গেট টুগেদার পার্টি ছিলো। আর খাবার সব ট্রেডিশনাল। বিশ্বাস করতে পারছো না?”
“অবিশ্বাস করি না। আর কখনো যেন করতেও না হয়।”
জোভান দু’হাতে মুখটা ধরে কপালে চুমু একে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
“আই উইল মাই বেস্ট ট্রাই।”
“শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে একেবারে। জ্যাকেট পরো নাহয় ঘুমাতে যাও। কফি খাবে?”
“উহুম, ঘুমাবো। এসো।”
জোভান বিছানায় উঠে কম্বল টেনে নিতে নিতে বললো,
“ডিয়ার, মিরাজ ও আমি যখন ভার্সিটিতে পড়তাম চাচ্চুর সাথে অনেক ধরনের পার্টিতেই এটেন্ড করেছিলাম জাস্ট কন্ডিশনটা বুঝার জন্য। তবে এসব ড্রিংকস থেকে পিছিয়েই ছিলাম। আর জানো, অনেক ধরনের অভিজ্ঞতাও হয়েছে। আসলে ঘুরাফেরা না করলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। আমার আবার ছোট থেকেই নতুন কিছু দেখলে সেটার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায় এবং সেটা লাভ করার জন্য অন্যরকম আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়। জীবনে অনেক শখ পূরণ করেছি আলহামদুলিল্লাহ। হালাল হারাম বেছে চলারও চেষ্টা করি কিন্তু না জেনে অনেকসময় হারামের স্পর্শেও চলে গিয়েছিলাম। আল্লাহ মাফ করুক। মিরাজ কিন্তু অনেক রকম ডান্স করতে পারে। এখানেই শিখেছিলো। অনেক রকম গেমসও শিখেছি আমরা। চাচ্চু তো একেবারে জিনিয়াস!”
“তোমার ছবি দেখলাম, তুমি নাকি স্কি খেলতে পারো?”
“ফেভারিট খেলা। কাল তো অফডে। চাচ্চু বাসায় থাকবে। যাবো সকালে।”
“ইশ! শখ কতো! হাত পা ভাঙেনি কখনো?”
“শিখতে গিয়ে একটু আধটু ব্যাথা তো পেয়েছিলামই। তবে গুরুতর না। ব্যাথাও মজা লেগেছিলো।”
“আমিও যাবো সকালে।”
“তুমি খেলবে!”
“না খেলি, তোমাদের খেলা দেখবো।”
জোভান হাচি দিতেই শারমায়া বললো,
“দুদিনও হয়নি এসেই সর্দি দাওয়াত করেছে! গরম পানি নিয়ে আসবো? ভাপ নিয়ে দেখো একটু।”
“রাত কত হয়েছে, দেখেছো? এদিকে আসো। শরীর গরম হলে ঠিক হয়ে যাবো। ওভাবে আক্রান্ত হইনি।”
পরদিন সকালে জোভান তার চাচ্চুর সাথে স্কি’তে মেতেছে৷ তাদের খেলা উপভোগ করেছে পরিবার বর্গ। সোয়াদ ও জুথিকা খুশিতে বরফে দৌড়েছে কিছুক্ষণ। মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সকলের পরনে শীতের পোশাক। অনেকেই এখানে আসে তাদের মতো শীতের আনন্দ উপভোগ করতে। জোভানের পারফরম্যান্স দেখাতে শারমায়া সাফওয়ানার সাথে ভিডিও চ্যাটে ছিলো কিছুক্ষণ। সাফওয়ানা বেশ উত্তেজিত!
কখনো খেলাধুলায়, কখনো আড্ডায়, কখনো প্রিয়জনের সাথে ভালোবাসা বিনিময়ে কেটেছে সময়। পুরো নয়দিন ইংল্যান্ডে কাটিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে গেছে জোভান। শারমায়া ঘুমাতে চাইছিলো না, তবুও কৌশলে বাধ্য করেছে তাকে দুপুরে ঘুমাতে। তবে ঘুম থেকে উঠে আর পাশে পায়নি জোভানকে। চাচীমাকে জিজ্ঞেস করলে জানালো বাইরে গেছে। সন্ধ্যার পর জানালো জোভান চলে গেছে। সে জানতো এমন কিছুই করবে জোভান। তাই একবারও বলেনি সে কবে চলে যাবে। তার ভঙ্গিমার কারণে শারমায়া নিশ্চিত ছিলো সে হুট করেই পালাবে। কিন্তু আজই যে পালাবে সেটা নিশ্চিত হতে পারেনি। কান্না আসছে প্রচুর। মন কেঁদেছেও ভীষণ তবে বাইরে প্রকাশ পায়নি পুরোটা। সারাটা রাত আর ঘুম হলো না তার। পরদিন কথা হলো জোভানের সাথে। তার ফোনে কল করলে রিসিভ করেনি। জোভানটাও কম চালাক নয়! ফোন রিসিভ করছে না বিধায় সরাসরি তার চাচ্চুর কাছে কল করে তার সাথে কথা বলতে চাইলো। চাচ্চু এসে ফোন দিয়ে গেছে, সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার মতো বেয়াদবি শারমায়ার মাঝে নেই। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে সালাম দিলে জোভান বললো,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
শারমায়া আর কোনো জবাব দিলো না। জোভান বললো,
“লাভ ইউ, লাভ ইউ, লাভ ইউ সো মাচ। আমি জানতাম তুমি প্রচুর কান্না করবে, আর আমাকে আসতে দিবে না তাই অপরাধটা করতে হলো। এই, কাঁদছো কেন? তুমি জানো, আমার কত কষ্ট হয়েছে তোমাকে রেখে আসতে। ইচ্ছে করছিলো প্যাকেট করে নিয়ে চলে আসি। এখন কাঁদলে তো আমার আরও বেশি কষ্ট হবে। টুকটুকি’স ফাদার লাভ ইউ সো মাচ। জান, কথা বলবে না?”
থেমে থেমে কথাগুলো বললো জোভান। তার মনটাও যে ভালো নেই সেটা কণ্ঠস্বরই প্রকাশ করে দিচ্ছে। তাই মনে প্রচন্ড ব্যাথা থাকা সত্ত্বেও শারমায়া চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় দীর্ঘশ্বাস টেনে ছাড়লো এবং বললো,
“ঠিকমতো পৌছেছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“কি হতো একবার বলে গেলে? আমি তো ভালো করে দেখারও সুযোগ পেলাম না। কতদিন হলো আপনজনদের চেহারা দেখি না। একজন এলো, তাও উঁকি দিয়ে না জানিয়ে চলে গেলো।”
“কি যে হতো সেটা তুমিও ভালো জানো, আমিও জানি। আমি আবার আসবো তো কিছুদিন পর। টুকটুকির আম্মুর জন্য একটা গিফট রেখে এসেছি কাভার্ডে, দেখেছো?”
“লাগবে না আমার কোনো গিফট।”
“আমি টুকটুকির আম্মুকে অনেক আদর করে এসেছি, অনুভব করতে পারোনি? নিজেকে ছুঁয়ে দেখো নিজ হাতে।”
“চাচ্চু বোধহয় বাইরে যাবে, ফোন দিয়ে আসি।”
“ওকে, তোমার ফোনে কল করছি। রিসিভ করো।”
“এখন বলবো না কথা। আমার মন ভালো নেই।”
“আমি চেষ্টা করি ভালো করার?”
“না। আমার মেজাজও ভালো নেই। আপনার শাস্তি পাওয়া দরকার। আমি নিজে ঠিক হবো। তারপর কথা বলবো।”
জোভান মৃদু হাসলো এবং বললো,
“ওকে, কখন কথা বলবে বলো? আমি অপেক্ষা করে কল দিবো।”
“অপেক্ষা যখন করবেনই। সময় বলার কি দরকার।”
“আচ্ছা। তখন কিন্তু ‘তুমি’ সম্বোধন করো। তা না হলে যে অপেক্ষায় তৃপ্তি আসবে না। অপেক্ষার ফল তো মিষ্টি হতে হয়।”
শারমায়া চাচ্চুর ফোন দিয়ে এসে কাভার্ড খুলে দেখলো স্বজনদের জন্য করা টুকটাক শপিং জোভান নিজ দায়িত্বে গুছিয়ে নিয়ে গেছে। শুধু নিয়ে যায়নি, তাকেও গুছিয়ে দিয়ে গেছে। এখানকার রেস্টুরেন্টের খাবারগুলো অন্যদের মতো স্বাদ উপভোগ করতে পারে না শারমায়া। চাচ্চু, চাচীমা, জুথিকা ও সোয়াদ তো খেয়ে খেয়ে অভ্যস্ত কিন্তু শারমায়ার একদমই বাজে লাগে। তাকে মেনু দিলে সে আইটেম সিলেক্টও করতে পারে না স্বাদ কেমন হবে ভেবে! তাই জোভান কিছু আইটেম লিস্ট করে দিয়ে গেছে যেন সেগুলোর মধ্যে ট্রাই করে। কেননা শারমায়ার রুচি সম্পর্কে তার যথেষ্ট ধারণা আছে। ঠান্ডার প্রকোপে বাইরে চলাচলের ব্যাপারে সতর্কতা তো আগেই দিয়েছে। তাছাড়া এই নয় দিনে তাকে অনেক কিছুই শিখিয়ে দিয়ে গেছে যাতে পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খায়িয়ে নিতে অসুবিধা না হয়। গিফট বক্সে রেখে গেছে সেই লাল টিশার্ট সাথে চিরকুট, “পছন্দের জিনিস আমি পছন্দের মানুষকে দিতেই পছন্দ করি। মাঝে মাঝে রাতে এটা পরে ঘুমিয়ে থেকো।”
আরও রেখে গেছে একটা ব্রাশ, একটা এলার্ম-ঘড়ি এবং একটা শাড়ি। সাথে চিরকুট, “সুইটহার্ট, তোমার নিত্য ব্যবহৃত ব্রাশটা আমি চুরি করেছি। এটা দিয়ে ব্রাশ করে এতো বেশি মজা পেতাম, লোভ সামলাতে পারিনি। ঘড়িটা প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়তে জাগিয়ে দিবে। আমাকে বেশি মনে পড়লে শাড়িটা মাঝে মাঝে পরো। অবশ্যই ভিডিও কলে আমাকে নক করবে। শাড়ির ভাজে আরও কিছু আছে৷ সাবধানে খুলে দেখো আর আবদারটা রেখো।”
শারমায়া শাড়িটা ভাজে ভাজে খুলে ছোট একটা গিফট বক্স পেলো। খুলতে সে চরম অবাক! একজোড়া বেবি শো রাখা আছে এখানে। সাথে চিরকুট,
“টুকটুকির আম্মু, একবার ভালোবাসি বলো…♥️”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here