“হালাল প্রেম” পর্ব- ৪৯

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৪৯
(নূর নাফিসা)
.
.
লোকটা একটা টুকটুকির জন্য কতটা পাগল হলে এমনসব পাগলামো করতে পারে ভাবতেই আনন্দের ঢেউ বইছে শারমায়ার মনে। চোখে ভাসছে সুখের অশ্রু। বেশ কিছুক্ষণ যাবত হাতে নিয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছে। কোমল পায়ের তুলতুলে নরম জুতো। টুকটুকি কাছে থাকলে এখনই পরিয়ে দিতো তার বাবার দেওয়া উপহার। ঘন্টাখানেক পর শারমায়া জোভানের কাছে কল করলে সাথে সাথেই রিসিভ হলো। জোভানই আগে সালাম দিয়েছে। শারমায়া তার মিষ্টি ফল প্রয়োগে বললো,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। বেবি শো কেন কিনেছো?”
“তোমার জন্য না তো। টুকটুকির জন্য।”
“এতোটা অবুঝ তো আমি না, যে কোনটা আমার আর কোনটা বাচ্চার সেটা বুঝবো না।”
জোভান তার কথায় মৃদু হেসে বললো,
“সুইটহার্ট, তুমি আরও বড় কেন হলে না? তোমার গ্রাজুয়েশন কেন আরও আগে কমপ্লিট হলো না? আকর্ষণীয় একটা পরিচয় পেতে আমাকে আরও কতগুলো বছর অপেক্ষা করতে হবে।”
“মনে যেহেতু এতো সাধ ছিলো, পাঠালে কেন আমাকে? এখানে না পাঠিয়ে নিয়ে যেতে নিজের কাছে।”
“আমার আগে তোমার প্রিয়জন পরিজন তোমার বাবা-মা। উনাদের সাধ পূরণ না করে আমার সাধ পূরণে বাধ্য করবো, এতোটা স্বার্থপর তো নই আমি৷ আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। আর ভালোর জন্য করেন বলেই তো তোমাকে পেয়েছি আমি। আল্লাহর কাছে তোমার বরের জন্য দোয়া করো যেন আরও বেশি ধৈর্য দান করেন আমাকে। মিষ্টি আমার প্রিয়। আমি মিষ্টি ফলের অপেক্ষায়।”
“তো করো অপেক্ষা।”
“আমার আবদারটা রাখবে না?”
“কিসের আবদার?”
“বেবি শো দেখেছো, আর কিছু দেখোনি?”
“তো?”
“বলো?”
“সাথে সাথেই বলেছি।”
“সিরিয়াসলি? আমি তো শুনতে পাইনি। আমাকে শুনিয়ে বলো?”
শারমায়া লজ্জায় চুপ করে রইলো। জোভান কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষায় থেকে তাকে ডাকলো,
“সুইটহার্ট? ”
“…”
“টুকটুকির আম্মু?”
“ভালোবাসি, টুকটুকির আব্বুকে।”
“ভালোবাসি, জান। ওফ্ফ! অবশেষে শব্দটা উচ্চারিত হলো তোমার মুখে। এখনো আমার কানে বাজছে। কারণ কি জানো? শব্দটা ডিরেক্টলি হার্টে পৌঁছে গেছে। আচ্ছা, তুমি এতো লজ্জা পাও কেন বলো তো? আমাকে বললে তো হাজারবার বলে ফেলতাম।”
এমনিতেই লজ্জায় মরছে, তারউপর লজ্জা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে পাজি লোকটা। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে মন ভালো হয়ে গেলো উভয়েরই। প্রিয়জনদের অভাব ও স্মৃতি নিয়ে ভালোই কাটছিলো দিন।
কিছুদিন পর হঠাৎ করেই শারমায়া জোভানের সাথে কদাচরণ করলো। জোভান একদমই নিশ্চুপ ছিলো। কেবল সে বারবার একটা কথাই বলে যাচ্ছিলো যেন জোভান তার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে। দিনের পর দিন এতো এতো কথা বলা তার একদম ভালো লাগে না। এসবকিছুতে বিরক্ত হয়ে পড়েছে সে। জোভানকে অসহ্যকর হিসেবে প্রকাশ করলো সে। জোভান ভেবেছিলো কোনো কারণে শারমায়া রেগে আছে। সেই কারণ জানতে সে কয়েকবার একটু শান্তভাবে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু বারবারই কদাচারের সম্মুখীন হতে হলো। চাচ্চু চাচীমার মাধ্যমেও যেন তাকে অশান্তি না দেয় সেই অনুরোধ করলো শারমায়া। জোভানকে এটা ভাবতে বাধ্য করেছে যে, সে জোভানকে ভুলে থাকতে পারলেই শান্তি পায়। কি এমন অপরাধ করলো সেটাই বুঝলো না জোভান। চেষ্টা করেও পারলো না কারণটা তার কাছ থেকে জানতে।
সেদিনের পর থেকে জোভান সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেছে। শত ব্যস্ততার মাঝেও যার জন্য সময় খুঁজে বের করে নিতো, সে-ই আজ প্রকাশ করে তার প্রতি বিরক্ত! নিজের মন ভালো না থাকলেও যার মনটা রাখতো ভালো, সে-ই আজ তার মনে অপ্রত্যাশিত আঘাত দিলো। না-ই বা রাখলো যোগাযোগ, তবুও সে ভালো থাকুক। তার কথামতো জানায়নি কাউকে জোভান। নিজেদের ব্যাপার বাইরে না জানানোই ভালো। হয়তো একদিন নিজেরাই শুধরে নিবে তাদের ভুলগুলো, জ্বেলে দিবে সুখের আলো। সেই দিনের অপেক্ষায় সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেলো।
আজ শারমায়া মাতৃভূমিতে ফিরেছে চাচ্চুর পরিবারের সাথে। শারমায়ার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়েছে আরও বিশ দিন আগে। চাচ্চুরা আসবে তাই আরও বিশ দিন ইংল্যান্ডে কাটিয়ে আজ তারা বাংলাদেশে। এয়ারপোর্টে এসে দেখা পেলো বাবার সাথে। খুশিতে শারমায়া বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়েছে। সাথে এসেছে জোভান। পরক্ষণে জোভানের মুখের দিকে তাকাতেই ভেতরটা কেপে উঠলো। চেহারায় অনেকটা পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি রেখে দিয়েছে। যদিও চাচ্চু চাচীমার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে কিন্তু আগের মতো উৎফুল্লতা ভেসে নেই চেহারায়। কেমন যেন বিষন্নতার ছাপ পড়ে গেছে। এর জন্য কি কেবল শারমায়া দায়ী? নিজের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে ব্যথিত হয়ে উঠলো শারমায়া। জোভান তার দিকে এগিয়ে এলে সে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
এতোটুকু কথার মধ্যে একবারের জন্যও তার চেহারায় তাকায়নি জোভান। কেমন যেন উপেক্ষা করে লাগেজগুলো নিয়ে গাড়িতে তুললো চুপচাপ। আজ “তুমি” সম্বোধনে কোনো দাগ কাটেনি জোভানের মনে। জানে সে কষ্ট দিয়েছে, তাই বলে কি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাও বলা যাবে না? সেই অভিমানে শারমায়াও আর কিছু বললো না। গাড়িতে বসে পড়লো সে। সোয়াদকে কোলে নিয়ে সাখাওয়াত বদরুদ্দোজা জোভানের সাথে সামনে বসলেন। পেছনে দুইজনের সিটে তারা বাকি চারজন বসলো। সারাটা পথ অতিক্রম করতে করতে সে বারবার আয়নায় তাকিয়ে দেখেছে জোভানকে। আর পরিমাপ করার চেষ্টা করেছে জোভান কতটা উঁচু পাহাড় বানিয়েছে অভিমানের। শারমায়া সেই চূড়ায় উঠতে পারবে তো!
তারা প্রথমে এলো শারমায়াদের বাড়িতে, সেখানে দেখা সাক্ষাৎ করে চাচ্চু চাচীমা বেরিয়ে গেলেন জোভানের সাথে নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু বেশিক্ষণ দেরি করলেন না। আবার অতি শীঘ্রই আসবেন বলে। শারমায়াও আর সুযোগ পেলো না জোভানের সাথে একটু কথা বলার। তবে লক্ষ্য করলো জোভান তার বাবা-মাকে পূর্বে আংকেল আন্টি সম্বোধন করলেও এখন বাবা মা বলেই ডাকে।
তারা চলে গেলে বাবা, মা ও চাচীর সাথে কথা বলে কাটলো কিছুটা সময়। মেয়েকে কাছে পেয়ে শারমিনের মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। একা একা এতোসব আয়োজন করে যাচ্ছিলেন সকাল থেকেই। মাঝে মাঝে চাচী এসে সহযোগিতা করে গেছেন। অতঃপর শারমায়া মায়ের হাতে খেয়ে বহুদিন পর আজ তৃপ্ত হলো। পরক্ষণে চাচীদের ফ্ল্যাটে চলে গেলো ফারিয়ার সাথে দেখা করতে। তার তিন বছর বয়সী এক ছেলে আছে আর নবজাতক মেয়ে। ছেলের ছবি দেখেছিলো ইংল্যান্ড থাকাকালীন। আটদিন আগে জন্ম নেওয়া মেয়েকে দেখলো আজ এসে। তাদের যত্নাদীর দায়িত্ব নিজে নিতে চাচী এখানেই রেখে দিয়েছেন। শারমায়া নবজাতককে কোলে নিয়ে সবার প্রথমে মনে করলো জোভানের কাঙ্ক্ষিত সেই টুকটুকির কথা! অতঃপর আপুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে ফ্ল্যাটে চলে এলো। খালামনি আর খালুজি এসেছে দেখা করতে। গতবছর সুষনা আপু তার হাসব্যান্ডের কাছে চলে গেছে। ফুটফুটে একটা বাচ্চাও আছে তার ছয়মাসের। ইংল্যান্ড থাকাকালীন সবার সাথেই দীর্ঘসময় পর পর যোগাযোগ করা হয়েছে। কেবল জোভান ব্যতিত। সাফওয়ানা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশে অনার্স করছে। এক্সাম চলছে বিধায় এখনো দেখা পেলো না শারমায়া। সন্ধ্যায় সাফওয়ানা বাসায় ফিরেই শারমায়াকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো!
“আপু…”
শারমায়া তাকে চেপে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বললো,
“কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভালো আছি এখন। আমার তো আজ এক্সাম দিতে যেতেই ইচ্ছে করছিলো না তুমি আসবে বলে। লিখছিলাম আর বলছিলাম সময় তারাতাড়ি কেটে যা, এক্সাম দ্রুত শেষ হয়ে যা।”
“ইশ! অবশেষে কাটলো সময়! কেমন হয়েছে এক্সাম?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“কতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে আমার সাফুটা। এখন সুন্দরী সুন্দরী লাগে।”
সাফওয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“তুমিও তো মটো হয়ে গেছো।”
“যা গিয়ে ফ্রেশ হো।”
শারমায়া নিজের পূর্বের সিম এক্টিভ করে পরিচিত সেই বারান্দায় এসে জোভানের নম্বরে ডায়াল করলো। কিন্তু ফোন বন্ধ। মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। সে কি নতুন সিম নিয়েছে তাহলে? হতাশার নিশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলো বাইরের অন্ধকার ভুবনে। এতোগুলো বছর পর স্বজনদের দেখে আজ মনে প্রশান্তির বায়ু প্রবাহিত হলেও একটা দিক অপূর্ণতায় ঢেকে আছে। একটা মানুষ কঠিনতর পরিস্থিতিতে না পড়লে সহজে পরিবর্তন হয় না। সেই মানুষটাও পরিবর্তন হয়ে গেছে। তা-ও আবার তারই কারণে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here