“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৫০
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে মায়ের সাথে রান্নার টুকটাক কাজ করতে করতে শারমায়া বললো,
“আম্মু, তোমাদের জামাই আবার বাবা মা ডাকে কবে থেকে?”
“কবে থেকেই তো। তুই যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই।”
“উনাদের দাওয়াত করবে কবে? ছোট চাচ্চু তো দুমাস পর চলে যাবেন।”
“বাব্বাহ! সেই চিন্তা আপনার করতে হবে?”
“চিন্তার কি হলো! জাস্ট জানতে চাইলাম।”
“এসপ্তাহেই হবে। উনারা একেবারে বিয়ের প্রোগ্রামের ডেট ফিক্সড করে যাবেন। তোর শ্বাশুড়ির সাথে কথা হয়েছে?”
“উহুম।”
“তো কথা বললি না! ফাজিল মেয়ে, নিজের মুখে একবার আসতেও তো বলবি। তারা মেয়ে মেয়ে করে পাগল, আর আমার মেয়ে ভুলে থাকায় যেন মশগুল।”
শারমায়া সেখান থেকে চলে আসতে আসতে মনে মনে বললো,
“ঠিকই বলেছো আম্মু। তোমার মেয়ে ভুলে থাকতেই মশগুল হয়ে পড়েছে।”
খুব বড়সড় নিশ্বাস ফেলে ফোন হাতে নিয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের নম্বরে ডায়াল করলো শারমায়া। অতঃপর কথা বললো, জুলেখা ইয়াসমিন, তানহা ও জুথিকার সাথে। অতঃপর মায়ের ফোন চেক করে দেখলো জোভানের পূর্বের নম্বরই আছে। সে ডায়াল করে দেখলো রিং হচ্ছে। সাথে সাথেই আবার কেটে দিলো শারমায়া। পরক্ষণে নিজের ফোন থেকে ট্রাই করে দেখলো সংযোগ দেওয়া সম্ভব না। তাহলে কি ব্লকে রেখেছে তার নম্বর!
দুদিন পর দুপুরের দিকে শারমায়া সাফওয়ানাকে নিয়ে নিউমার্কেট গিয়েছিলো কিছু কসমেটিকস কেনার জন্য। দুজন রেস্টুরেন্টে ফুচকা খেয়ে গল্প করতে করতে রিকশায় রওনা হলো বাড়ির পথে। মাঝ পথে রিকশা অচল হয়ে পড়ায় দুজনকে নেমে যেতে হলো। এমন জায়গায় সমস্যা দেখা দিয়েছে যে আশেপাশে রিকশার দেখা নেই। তারা সামনের দিকে হাটতে লাগলো। মোর পর্যন্ত যেতে পারলে রিকশা পাওয়া যাবে। এর আগে পেলে তো ভালোই। কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পরই তাদের নিকটে লাল রঙের একটা গাড়ি স্লো হলো। দুজনেই তাকিয়ে জোভানকে দেখতে পেলো। সাফওয়ানা হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
“ওইতো, ভাইয়া। এই না হলে হিরো! বিপদের সময়ই তো হিরোদের এন্ট্রি।”
জোভান তার হাসির বিপরীতে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
“সাফওয়ানা, বাসায় যাচ্ছো?”
“হ্যাঁ।”
” ওঠো তাহলে।”
“আমাদের বাসায় যাবেন ভাইয়া?”
“না, অফিসে যাচ্ছি। ওই রাস্তায় গাড়ি টেনে নামিয়ে দিয়ে আসবো। কতক্ষণ আর লাগবে।”
কথা তো বললোই না, এতোক্ষণে এক বারের জন্য তার চেহারায়ও তাকালো না জোভান। সে কি দেখতে এতোটাই খারাপ হয়ে গেছে? শারমায়ার রাগ হলো তার উপর। তাই সাফওয়ানা উঠতে চাইলেও শারমায়া তার হাত ধরে ফেললো এবং জোভানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“না, আমরা রিকশাতেই যেতে পারবো। অযথা কারো অফিসের সময় নষ্ট না করলেও চলবে। আমাদের এতো তাড়া নেই।”
সাফওয়ানা তার আচরণে বিস্মিত হয়ে উচ্চারণ করলো,
“আপু…”
“চুপ! কোনো কথা না।”
জোভানের ঠোঁটের কোণের সেই হাসিটা মুহুর্তেই বিলীন হয়ে গেলো এবং কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ হলো শারমায়ার দৃষ্টিতে। অতঃপর আর কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো। স্পিড এতোটা বাড়িয়ে গাড়ি টানলো যে শারমায়ার ব্রু সামান্য কুচকে গেলো। এমনকি সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলো কারণ জোভানের গাড়ি সামনের ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগতে যাচ্ছিলো! সে ব্রেক নিয়ন্ত্রণ করে ফেলায় একটুর জন্য বেঁচে গেছে। ট্রাক স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকায় সে স্পিড কমিয়ে পাশ কাটিয়ে ট্রাককে ওভারটেক করেছে। শারমায়া সাফওয়ানা উভয়েই ভয়ে কেঁপে উঠেছে। এখনই একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। এতো রাগ আসে কোত্থেকে তার মাঝে! সাফওয়ানা রাগান্বিত হয়ে শারমায়াকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার চোখে পানি টলমল করতে দেখে আর বললো না কিছু। শারমায়া চোখ মুছে সাফওয়ানাকে বললো,
“বাসায় গিয়ে কিছু বলবি না এ ব্যাপারে।”
“অযথা এমনটা না করলেও পারতে। ভাইয়া রাগ করেছে।”
“চল।”
অতঃপর হনহনিয়ে হেটে মোর পর্যন্ত চলে এসে রিকশা নিলো। সারাটা পথ দোয়া ইউনূস পড়তে পড়তে বাসায় এসেছে সে। অতঃপর ইফাজের নম্বরে ডায়াল করে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম৷ আলহামদুলিল্লাহ, ভাবি। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনার ভাই কি অফিস পৌঁছেছে?”
“হ্যাঁ, অফিসেই তো।”
“না, মানে বাইরে দেখা হলো একটু আগে। ফোন দিলাম, ডায়াল হচ্ছে না। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“ওহ্, এসেছে। আমি তো একটু বাইরে বেরিয়েছি, তাই দিতে পারছি না ভাবি। তার কাছে গিয়ে কল দিবো।”
“না, থাক। কল দিতে হবে না। জানলামই তো। পরে কল দিয়ে কথা বলে নিবো।”
“ওকে।”
চারদিন পর শারমায়ার পরিবার দাওয়াত করলো তাদের। জেভাসহ জোভানের বাসার সবাই এসেছে। আগে শ্বশুর বাড়ির লোকজন এলে তার ভারি লজ্জা লাগতো। কিন্তু আজ সবাইকে দেখে শারমায়ার বেশ আনন্দ লাগছে। কতোদিন পর এই মুখগুলোর দেখা পেলো। সে সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে জেভার আট মাস বয়সী মেয়ে নোভাকে কোলে নিলো। জোভান পাশের রুমে গেছে যেখানে সাফওয়ানা সোয়াদ ও আহনাফ আছে। বাকিরা সবাই ড্রয়িংরুমে এসে বসেছে। শারমায়া তাদের সাথে কথা বলে নোভাকে কোলে নিয়ে বের হতে যাচ্ছিলো অপরদিকে জোভান ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো। দুজনেই হঠাৎ ব্যালেন্স ঠিক করে ফেলায় অল্পের জন্য ধাক্কা খায়নি। জোভান থেমে সাথে সাথেই বলে ফেললো,
“স্যরি।”
শব্দটা শারমায়ার মনের সব আনন্দকে ধূলিসাৎ করে দিলো। সে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জোভানের চেহারায়। জোভান পাশ কাটিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। শারমায়া ধীর পায়ে হাটতে লাগলো নিজের রুমের দিকে। যেই লোকটার কাছে স্যরি শব্দটা বিরক্তিকর ছিলো আজ সে-ই শব্দটাকে আপন করে নিলো? তাহলে কি হৃদয় থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলেছে ভালোবাসাকে? তার ভালোবাসা কি এতোই দুর্বল যে সামান্য অভিমানের কাছে হার মেনে যায়! বিষন্ন মনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা অশ্রু। দু-তিন মিনিট পর হঠাৎই কোলে থাকা নোভা কেঁদে উঠলে তার ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে নোভার কপালে চুমু দিলো। অতঃপর এক হাতে চোখ মুছে তাকে শান্ত করতে পায়চারি করতে লাগলো। পরক্ষণে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলো তাদের খাবার দাবার দেওয়ায় সাহায্য করতে।
বড়রা সবাই বিয়ের প্রোগ্রামের ব্যাপারে কথা বলছে ড্রয়িংরুমে। জেভা মেয়েকে শারমায়ার রুমে শুয়িয়ে দিতে এলো ঘুমিয়ে গেছে বলে। শারমায়া বিছানা রেডি করে দিলো। জেভা নোভাকে শুয়িয়ে দিতে দিতে প্রোগ্রামের শপিংয়ের কথা বলতে লাগলো শারমায়ার সাথে। এমনি জোভান এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপু, বাবা মা ডেট ফিক্সড করার আগে শারমায়ার মতামতটা নিয়ে নিয়ো। পরে যেন কোনো সমস্যা না করে।”
তার কথায় শারমায়া স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। বিয়ে হয়েছে শ্বশুর বাড়ি যাবে স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে সে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, জোভান এমন কিছু ভাবলো কিভাবে! জেভাও কিছুটা বিস্ময়ের সাথে বললো,
“এই শুনে যা। পরে সমস্যা হবে মানে?”
“না, মানে তার যদি কোনো আপত্তি থেকে থাকে তাহলে ডেট ফিক্সড করার কি প্রয়োজন!”
“আপত্তি থাকবে মানে? তার মতামতই বা কেন নিতে হবে? এখন কি তোদের নতুন বিয়ে হচ্ছে যে পাত্র পাত্রীর মতামত নিবো? বিয়ের পাঁচ বছর চলছে এখন উঠে মতামতের কথা! প্রোগ্রাম হলেও সে শ্বশুর বাড়ি যাবে, না হলেও যেতে হবে।”
“তবুও, কার মনে কি চলে বলা তো যায় না।”
জোভান কি বলছে এসব! কার মনে কি চলে মানে কি? সে যদি জেদের বশেই বলে সম্পর্ক শেষ করে দিবে তাহলে কি জোভান নিশ্চুপে সেটাই মেনে নিবে? ভাবতেই অন্তর কাঁদছে শারমায়ার। সে কথায় সামান্য জেদ নিয়েই বললো,
“আপু, আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং উনি কি চাইছে সেটা জেনে নাও।”
জোভান তার দিকে এক পলক তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। জেভা বিস্মিত হয়ে তার যাওয়ার দিকে একবার তাকালো, শারমায়ার দিকে একবার তাকালো। অতঃপর বললো,
“বা…রে! কি হলো আবার দুজনের! সম্পর্ক পুরনো হচ্ছে বুঝি, তাই রাগারাগির পর্ব শুরু নাকি? ঝগড়াঝাটি নিজেদের মাঝেই রাখো। বড়দের কাজে আবার ব্যাঘাত সৃষ্টি করো না। আমার ভাইটা তো সহজে রাগে না। নিশ্চয়ই জরুরী কথা অমান্য করেছো।”
“হুম, ভাই তোমার। আমি তো পর হয়ে গেছি।”
“যাহ পাজি মেয়ে। পক্ষ নিচ্ছি না কারো। বড় হয়েছো তো। বুদ্ধিও অনেক বেড়েছে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং ঠিক রেখো। একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবা, রাগ কমে যাবে। ভালোবাসার কাছে সব জাতিই দুর্বল। শীঘ্রই মিটিয়ে নিয়ো। আমি যাই। শুনে আসি দিন তারিখ কবে নির্ধারিত হলো।”
জেভা চলে গেলে শারমায়া খাটে হেলান দিয়ে নোভার চেহারায় তাকিয়ে রইলো। তবে মন তার অন্যদিকে। ভাবছে কেবল জোভানকে নিয়ে। মানুষটা একদমই পাত্তা দিচ্ছে না তাকে। একদমই সুযোগ দিচ্ছে না নিজেকে তার সামনে উপস্থাপন করার। না দেক। সে-ও দেখে নিবে পাত্তা না দিয়ে কোথায় যায়। তার ঘরে গিয়েই সুযোগ খুঁজে নিবে তাকে মানিয়ে নেওয়ার। সেদিন পালাবে কোথায় টুকটুকির আব্বু?