“হালাল প্রেম” পর্ব- ৫১

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৫১
(নূর নাফিসা)
.
.
দু’সপ্তাহ পর প্রোগ্রাম নির্ধারিত হলো। সামনে রমজান মাস। তার পূর্বেই কার্যাদি সম্পন্ন করে নিতে চায় তারা। পরবর্তী সপ্তাহে সাফওয়ানা ও শারমায়াকে সাথে নিয়ে শপিংয়ে গেলো জোভান, জেভা ও চাচীমা তানহা। বাচ্চাদের সব বাসায় রেখে এসেছে। কেবল নোভা আছে সাথে। শপিং, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া সবই চললো ভালো। শারমায়ার বড্ড মনে পড়ছিলো পূর্বে শপিংয়ে যাওয়ার দিনগুলোকে। সবসময় জোভান তার হাত মুঠোয় ধরে হাটতো। মাঝপথে অভিমানের পাহাড় গড়ে উঠায় আজ ছিলো ব্যতিক্রম। তার একটুও ভালো লাগলো না শপিং।
হলুদের প্রোগ্রাম, বিয়ের প্রোগ্রাম সবই সম্পন্ন হলো ধুমধামে। গত তিনদিন যাবত বাড়িতে মেহমান এসে জমজমাট করে তুলেছে বিয়ে বাড়ি। বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবদের সাথে সাক্ষাৎ হলো শারমায়ার। আবার কেউ কেউ দূরে চলে গেছে বিধায় উপস্থিত হতে পারলো না। সে-ও উপস্থিত হতে পারেনি কারো বিয়েতে। যতই আপন আর পরিচিত হোক শ্বশুর বাড়ি, বাবার বাড়ি ত্যাগ করতে মন মানে না কোনো মেয়ের। সারাজীবন মা বাবার কাছে থাকতেই আকুপাকু করে মন। যদিও সমাজ সংস্কৃতির প্রভাবে তাকে ছেড়ে যেতেই হয় স্বজন। সন্ধ্যার বিয়ে বাড়ি জমেছে হৈ-হুল্লোড় আর কান্নার রোলে, কিছুটা সময় পরই সব নিরব হয়ে গেলো পিত্রালয় ছেড়ে কন্যা চলে গেলে।
নতুন জায়গা, নতুন ঘর, নতুন সংসার, নতুন সাজে নতুন অনুভূতি জন্মেছে মনে। আজ মনে হচ্ছে, জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে নতুন করে। মিনিট পাঁচেক হলো জেভা অল্প খাবার খায়িয়ে দিয়েছে, চাচীমা ও জোভানের মামাতো বোন মাথাটা হালকা মেসাজ করে দিয়ে তাকে একা বসিয়ে রেখে চলে গেছে। প্রচন্ড কান্না করার ফলে শারমায়ার মাথা ঝিম ধরে আছে। প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলো সে। পথঘাট কিছুই লক্ষ্য করেনি শারমায়া। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেও পারছিলো না ঠিকমতো। কেউ তাকে ধরে ধরে হাটিয়েছিলো। আবার সিড়ির ধারে কতক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে পালন করা হয়েছে তাদের রীতিনীতি। অতঃপর জোভানের কোলে চড়ে সিড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করে প্রবেশ করেছে নতুন ঘরে। আশেপাশে কে ছিলো আর কে ছিলো না সেসব কিছুই জানা নেই তার। তবে ইফাজ, সাদাত ও মিরাজের কন্ঠ তার কান ঝালাপালা করে ফেলেছে। আরও অনেকেই ছিলো কিন্তু সবার কণ্ঠ পরিচিত না। জোভানের দিকেও তাকাতে পারেনি শারমায়া। তবে জোভান কোলে নিয়েছে এটা নিশ্চিত। তাছাড়া অন্যকেউ তো আর কোলে নিবে না তাকে। এমনিতেই আগের থেকে মোটা হয়ে গেছে, তারউপর ভারি পোশাকাদিতে তাকে কোলে নিয়ে হাটতে বেশ কষ্ট হয়েছে বেচারার, তা ভাবতেই ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটে উঠলো শারমায়ার। সে যদি স্বাভাবিক থাকতো, মোটেও এই কষ্টটা পোহাতে দিতো না প্রিয়কে। সারাটা দিন তার উপরও তো ধকল কম যায়নি। ক্লান্ত হয়নি নাকি? এখনো ফিরছে না কেন সে? শারমায়া ডানে বামে তাকিয়ে রুমের সজ্জিত আসবাবপত্রের উপর চোখ বুলালো। ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, কাভার্ড, ছোট টি-টেবিল সহিত দুই সিটের সোফা ও খাট। সবই কাঠের ফার্নিচার শুধু টি টেবিলটা গ্লাসের। কেবল আলমারিটা দেখতে একটু পুরনো, আর সবই নতুন। বাইরে সমাগম ভেতরে নিরবতা। কিছুক্ষণ পর দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দ শোনা গেলো। জোভান দরজা হালকা খুলেছে, মিরাজ তার পকেটে হাত দিয়েছে। জোভান বললো,
“নাই তো রে ভাই। সবই তো দিয়ে দিলাম। শেরওয়ানিটা খুলে দিয়ে দিবো এবার?”
“না, থাক। শেরওয়ানি ভাবিরে দিস। বেস্ট অফ লাক।”
ওদিকে জেভার চেচানো কন্ঠ ভেসে এলো,
“ওই মিরাজ, ছাড়বি নাকি এবার। তোর বউ কাঁদছে, বাসায় যা।”
জোভান রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। শারমায়া সালাম দিতে গেলো, তার গলা দিয়ে আওয়াজই বের হলো না। দ্রুত হালকা কেশে আবার চেষ্টা করলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি? তুমি?”
শারমায়ার গলার স্বর আবার নিচু হয়ে গেলো। যেন বিড়বিড় করে কথা বলেছে। জোভান কি শুনতে পায়নি তার কথা? আবার বলবে? জোভান শেরওয়ানি খুলে কাভার্ডে ঘাটাঘাটি করছে। অতঃপর টিশার্ট নিয়ে পরে ফেললো। শারমায়ার কথা বলতে খুবই অস্বস্তি লাগছিলো তাই আর জিজ্ঞেস করলো না। আপনি আর তুমির মধ্যেও গুলিয়ে ফেলেছে। জোভান বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এলো। অতঃপর ফুলে সজ্জিত বিছানায় চলে এলো। শারমায়ার অস্বস্তি যেন হুট করেই কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। জোভান বালিশ ঠিক করে রেখে চাদরের উপর ছড়ানো লাল ও সাদা গোলাপের আলগা পাপড়িগুলো একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
“খেয়েছো কিছু?”
“হুম।”
“চেঞ্জ করতে চাইলে করে এসে ঘুমিয়ে পড়ো।”
অতঃপর শুয়ে পড়লো জোভান। শারমায়া তার স্বাভাবিকতায় যতটা আশার আলো খোঁজে পেয়েছিলো, মুহুর্তেই তা অন্ধকারে হারিয়ে গেলো। এই রাত নিয়ে তার কত পূর্বপরিকল্পনা ছিলো। আর তা কি না সব ভ্রান্ত স্বপ্নে রূপান্তরিত হলো! তবে এর জন্য শারমায়া নিজেকেই ভেবে নিলো অপরাধী। শীঘ্রই মানিয়ে নিবে, সেই আশাবাদীও। সে বেদনাকে একপাশে ঠেলে দিয়ে বললো,
“আমার কিছু কথা বলার আছে।”
জোভান চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিলো,
“সকালে বলো। রাত একটা বেজে গেছে, ঘুমাও।”
শারমায়ার চোখে পানি চলে এসেছে। সে ধাধানো গলায় বললো,
“এখনই বলা প্রয়োজন। সকালের অপেক্ষায় বসে থেকে মুহুর্তগুলোকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না।”
“আমার ক্লান্ত লাগছে। ঘুমাতে দাও।”
“একবার শুনো। নিজেকে প্রেজেন্ট করার সুযোগ তো দাও।”
জোভান কোনো কথাই বললো না। শারমায়ার চোখ থেকে টুপটাপ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে আবার বললো,
“টুকটুকির আব্বু, আই লাভ ইউ।”
জোভান চোখ খুলে কড়া কণ্ঠে বললো,
“রুম ছাড়তে বাধ্য করো না।”
আর কিছু বলার নেই শারমায়ার। সে স্তব্ধ হয়ে গেছে। এমনিতেই অপরাধী, এখন এতোটা বিরক্ত করবে না যে তাকে নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। শারমায়া মেহেদী রাঙা হাতে চোখ মুছতে মুছতে নেমে গেলো বিছানা ছেড়ে। অতঃপর বাথরুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ভেবেছিলো আজ রাতটা তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু না, সেটাও সম্ভব হয়ে উঠলো না তার পক্ষে। জোভান কতটা উত্তেজিত ছিলো তার এই বধূসাজ দেখার জন্য। কতটা অপেক্ষায় জেগে ছিলো আজ সারারাত জাগবে বলে। সব ব্যর্থতার সমুদ্রে ভেসে গেলো। বধূ সাজে নিজেকে দেখার পর এতোক্ষণ যাবত চেপে রাখা কান্না এবার বাঁধ ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এলো। জোভানের বুকে ঠাঁই পেলেই না সার্থক হতো এই কান্না। হু হু কান্নার শব্দ ওদিকটাও যন্ত্রণাময় করে তুলেছে। তবে সেটা ধৈর্যের বাঁধ ভাঙেনি। খুব পাকাপোক্ত একটা দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে জোভানকে চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় দেখে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর নিজেই লাগেজ খুলে সালোয়ার কামিজ বের করে হাতে নিলো। চেঞ্জ করে, সমস্ত সাজ মুছে নিতে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। চুলের ভাজ খুলতে খুলতে সবমিলিয়ে ঘন্টাখানেকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলো। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো আড়াইটা বাজতে চলেছে। চুলে টান পড়ায় মাথা ব্যাথা আবার বেড়ে গেছে। অল্প পানি পান করে শারমায়া পাশের বালিশে শুয়ে পড়লো। সময়ের সাথে সাথে অশ্রু ধারাও প্রবাহমান। উভয়ের কেটে গেলো নির্ঘুম রাত। যদিও নির্ঘুম রাতটি কাটার কথা ছিলো মিষ্টিমুখরিত ভাবে। অথচ কেটে গেলো তা অপ্রত্যাশিত বিষন্নতার সাথে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here