“হালাল প্রেম” পর্ব- ৫৬

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৫৬
(নূর নাফিসা)
.
.
দুদিন পর বাসায় ফিরে চেঞ্জও করেনি, প্রথমে আলমারি খুলে শারমায়ার ফোন হাতে দিয়ে জোভান বললো,
“একদমই মনে ছিলো না ফোনটা তোমাকে দেওয়ার কথা। ওবাড়িতে যাওয়ার পর তোমার সেই ফোন দেখে মনে পড়েছে।”
“প্রয়োজনও তো ছিলো না।”
“কি? আমার গিফট এর?”
“উহুম, গত দিনগুলোতে ফোনের প্রয়োজন হয়নি সেই কথা বলেছি। এটা সেই ফোনটা?”
“উহুম। আগেরটা আমি ইউজ করছি। এতোদিন পড়ে থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে না! তাই আমারটায় সমস্যা হওয়ার পর তোমারটা আমি নিয়েছি। তুমি আসার পর এটা কিনেছি। মেমোরি কার্ড ট্রান্সফার করা আছে। সিম এক্টিভ করে নাও। পছন্দ হয়েছে?”
শারমায়া জোভানকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“গিফট ডোনারই তো শ্রেষ্ঠ পছন্দের। তবে গিফট কেন নয়?”
“এতো পছন্দের, তাহলে আমার সাথে আসতে আবার কান্না কেন করলে?”
“সেটা তুমি বুঝবে না। তুমি যদি তোমার বাবা-মাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে তাহলে বুঝতে।”
“তাই নাকি? তাহলে চলো, বাবা-মাকে ছেড়ে আমার শ্বশুর বাড়ি চলে যাই। কান্নার কারণটা বুঝার জন্য হলেও ঘরজামাই যাওয়া প্রয়োজন।”
শারমায়া তার ব্লেজার আঁকড়ে ধরে হেসে উঠলো। পরবর্তী সপ্তাহে তারা বেড়াতে গিয়েছে। চারদিন ভ্রমণের পর গত রাতে তারা নীড়ে ফিরেছে। সাথে গিয়েছিলো সাফওয়ানা, ছোট চাচ্চুর পরিবার ও আহনাফ। জেভাকে বলা হয়েছিলো কিন্তু নোভা মেয়েটার জন্য সে যায়নি। তবে পরবর্তী সময়ে আবার তারা যাবে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই সাফওয়ানা বাসায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে। জোভান পরিষ্কার বলে দিয়েছে মিনিমাম তিনদিন তাকে থাকতে হবে। আজ সন্ধ্যায় তার বন্ধুবান্ধবরা আসবে এবং নিজেরা বারবিকিউ পার্টি এরেঞ্জ করবে। বেশ কয়েকদিন যাবত অফিস যাওয়া হয় না। সকালে একত্রে নাস্তা করে জোভান অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। শারমায়া তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দিচ্ছে। জোভান বললো,
“ভার্সিটি থেকে তোমার জব নোটিশ এসেছে বাবার কাছে। ভার্সিটিতে জব করার ইচ্ছে আছে, নাকি মেডিক্যালে ট্রাই করবে?”
“তুমি কি বলো?”
“তোমার মতামত কি?”
“সত্য বলতে চাকরি নিয়ে আমার তেমন ইন্টারেস্ট নেই। একজন আদর্শ মেয়ে, আদর্শ বউ, আদর্শ মা হয়ে নিজের পরিবারের সাথে সময় কাটানো আমার বেশ পছন্দের।”
“আমাদের বাচ্চার বয়স কত?”
শারমায়া বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তুমি সবসময় এমন করো! কথাই বলবো না তোমার সাথে।”
জোভান হেসে তাকে দু’হাতের বন্ধনে বেঁধে বললো,
“তুমিই তো বললে আদর্শ মা হয়ে থাকা বেশ পছন্দের।”
“জাস্ট শাট আপ। আমি কি বলেছি আমি আদর্শ মা হয়ে থাকছি? নিজের মাকে তো দেখেছি, আশপাশের দু’একটা পরিবার তো স্বচক্ষে দেখা। পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি থাকতে ভালো লাগে সেটা বুঝাতে চেয়েছি। একজন মানুষের আয়ু কতদিন? এরমধ্যে পাঁচ-ছয় বছর মাত্র কাটে খেলাধুলা আনন্দে, সতেরো আঠারো বছর পাড় করে দিতে হয় পড়াশোনার পেছনে, তারপর মৃত্যু পর্যন্ত ছুটে বেড়াও চাকরির পেছনে। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে কর্মস্থলে সারাদিন কাটিয়ে আবার সংসার সামলাতে বিরক্তিকর অবস্থার সৃষ্টি! সবটাই যেন বাধ্যগত কাজ হয়ে দাঁড়ায়। লাইফটা এনজয় করার সুযোগই রইলো কোথায়? সেই প্রেক্ষিতে বলেছি। আপুকেই দেখো, মাঝেমধ্যে সারাদিন কাটিয়ে দেয় হসপিটালে অন্যের সেবায়। নিজের সন্তানদেরও অবহেলার মাঝে ফেলে দেয় কখনো কখনো। আবার চাচীমাকে দেখো, এতো যোগ্যতা থাকতেও তিনি পাক্কা গৃহিণী কেবল পরিবারকে সময় দেওয়া ও চাহিদা পূরণের জন্য।”
“তাহলে জব ক্যান্সেল?”
“আমি কি সেটা বলেছি? উপার্জন তো সবার ক্ষেত্রে মূখ্য বিষয় নয়। অন্যের সেবায় নিয়োজিত হতে পারলেও তো কিছুটা প্রশান্তি আসে মনে যে, জীবনে হয়তো কিছু করতে পেরেছি। এসব ভাবতে গেলে আমার মাথায় আরও নানান ভাবনা এসে ভীড় জমায়। তাই বলছি তুমি সাজেস্ট করো।”
“তাহলে আমি বলি, এতো প্রেশার নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি যতদিন সুস্থ সবল আছি, তোমার উপার্জনের কোনোই প্রয়োজন নেই। আর যদি জনসেবায় নিয়োজিত হতে চাও তবে দুএক বছর রেস্টে থাকো। এরপর সাংসারিক ব্যস্ততা বুঝে তুমি ডিসিশন নাও তোমার জন্য কোনটা ব্যাটার হবে। আমি এখন আসি তাহলে। কোনো প্রয়োজন হলে কল করো। ফোন যেন কখনো সুইচ অফ কিংবা সাইলেন্ট মুডে না থাকে।”
জোভান শারমায়ার কপালে কোমল স্পর্শ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তাদের সারাদিন কাটলো গল্পগুজবে। ইশারের দিকে জোভান ও তার বন্ধুরা এসেছে। শারমায়াকে সম্মান দিলেও মিরাজ সবসময়কার মতো সাফওয়ানার সাথে লেগেই থাকে।
“আরে! ফাঁসিও দেখছি এখানে!”
সাফওয়ানা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালে সে বললো,
“ওহ্ স্যরি! শিফা, কেমন আছো?”
“এতোক্ষণ ভালোই ছিলাম। এখন ডেঞ্জারাস।”
“ওহ্ নো! আমাকে সাবধান থাকতে হবে।”
ইফাজ তাকে দেখে বললো,
“আরে পিচ্চি যে!”
“পিচ্চি বললেন কেন? এবার চকলেট দিন।”
ইফাজ প্যান্টের পকেটে হাত নেড়ে বললো,
“ওফ্ফ! ঠিকই তো! পিচ্চিদের তো চকলেট দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু চকলেট যে আনিনি! দেনা রইলো।”
সাফওয়ানা হেসে বললো,
“থাকুক, লাগবে না।”
মিরাজ বললো,
“আমার লাগবে। আমিও তো পিচ্চি। আমাকে দিস কিন্তু।”
“ধুর ছাগল! দুদিন বাকি তোর ঘরে পিচ্চির আমদানি হবে আর এখন তুই চকলেট চাস!”
শারমায়া ইফাজের উদ্দেশ্যে বললো,
“ইফাজ ভাইয়া, বিয়ে করবেন কবে? সাদাত ভাইয়া আর মিরাজ ভাইয়ার বিয়ে তো খাওয়ার সুযোগ হলো না। আপনার বিয়ে খাওয়ার আশা রাখতে পারি নিশ্চয়ই?”
ওদিকে জোভান সাদাতকে কল করতে করতে শারমায়ার জবাব দিলো,
“আশা রেখে লাভ নেই। ইফাজ বিয়ে করবে না পণ করেছে।”
ইফাজ এ ব্যাপারে কিছুই বললো না, মুচকি হাসলো শুধু। জোভানের জবাবের প্রেক্ষিতে মিরাজ বললো,
“ধুর! বললেই হলো বিয়ে করবে না? এবার তাকে বিয়ে করতেই হবে। এক দেড় মাসের মতো বাকি আছে, ব্যাটা পাত্রী পছন্দ করে ঠিক করে নে। নয়তো সামনে যাকে পাবো তাকেই বিয়ে করিয়ে দিবো। হোক সে রাজরানি কিংবা বস্তিরানি। এবারের এনিভার্সারিতে তোর রক্ষা নেই।”
ইফাজ গ্লাসে পানি নিতে নিতে বললো,
“তোর যদি এক বউয়ে না পোষে তো এবার এনিভার্সারিতে আরও করে নে।”
“আমার একটাই যথেষ্ট রে ভাই।”
তানহাও তাদের দুষ্টুমিতে যোগ দিয়ে বললো,
“মিরাজের রুচি তো ভালো না দেখছি! বস্তিরানিকে তুমি রাজপুত্রের জন্য সিলেক্ট করতে পারলে!”
“কি করার চাচীমা? তাকে তো সময় দিলামই। এরমধ্যে না পারলে দৈবচয়নে যা আছে তা-ই।”
তানহা হেসে বললো,
“হ্যাঁ, ইফাজ বিয়ে করে নাও। তোমার বিয়ে খাওয়ার সৌভাগ্য আমাদেরও হোক।”
ইফাজ কোনো জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলো। জেভা বললো,
“কি শুরু করেছো তোমরা! ছেলেটা লজ্জায় ডুবে যাচ্ছে। বিয়ের জন্য এতো প্রেশার না দিয়ে মেয়ে দেখা শুরু করো না। তাহলেই তো হয়।”
মিরাজ তার কোল থেকে নোভাকে কোলে নিয়ে বললো,
“এই না হলে জেভা আপু! সবসময়ই ফাস্ট। তুমি থাকতে সেই টেনশন আমাদের করতে হয় নাকি!”
“তো সেটা বলবি তো। না বললে কিভাবে!”
জোভান বললো,
“আপু, ভাইয়া কি আসবে না?”
“উহুম। অযথা এসে নাকি লাভ নেই।”
“অযথা মানে! ভাইয়াকে ছাড়া পার্টি জমবে নাকি! আমি না বিকেলে বলে দিলাম আসার জন্য।”
“তোর ভাইয়া বুড়ো হয়ে গেছে, তার সাথে নাকি তোদের জমবে না।”
মিরাজ বললো,
“ছেলেপুলে বিয়ে না দিতেই বুড়ো হয়ে গেলো! জোভান কল দে আবার।”
জোভান আবার কল করে নিলয়কে আসার জন্য রাজি করালো। অতঃপর তারা তাদের পার্টির আয়োজন শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর নিলয়, সাদাত উভয়েই চলে এলো। চাচ্চু, আহনাফ, সোয়াদও ছিলো তাদের সাথে। কেবল আশরাফ স্যার বাদে সকল পুরুষগণের পার্টি। তবে খাওয়ার সময় বাদ রাখেনি নারীগণকেও। তাদের পার্টি শেষ করতে করতে রাত একটা বেজে গেছে প্রায়। বলেছিলো সবাইকে থাকার জন্য কিন্তু তিন বন্ধু চলে গেছে। সব গুছিয়ে রেখে শারমায়া জোভান রুমে এলো দেড়টার দিকে। শারমায়া বললো,
“প্রোগ্রামে মিরাজ ভাইয়ার ওয়াইফকে দেখলাম, সাদাত ভাইয়ার ওয়াইফ আসেনি কেন?”
“অসুস্থ।”
“কি হয়েছে?”
“সুখের অসুখ।”
“প্রেগন্যান্ট?”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“এজন্যই তো বলি তুমি বুদ্ধিমতী।”
“হুহ্! এমন হিন্স ধরিয়ে দিলে কে না হবে সেই বুদ্ধিমতী। সাদাত ভাইয়ার ওয়াইফকে দেখার খুব ইচ্ছে। ছবি আছে তোমার কাছে?”
“তাদের বিয়ের ছবি আছে।”
“ভিডিও কলে কথা বলবো একদিন। আচ্ছা, বিয়ে তোমরা একই তারিখে করলে, কারণ কি?”
“একটা ইচ্ছে ছিলো, সবার এনিভার্সারি একই দিনে আসবে। তাই একই তারিখে বিয়ে করবো। প্রথমে আমি করলাম, সেই দিনকে অনুসরণে রেখে দ্বিতীয় বছর মিরাজ করে ফেললো, তৃতীয় বছর সাদাত করলো, চতুর্থ বছর ইফাজকে কত বললাম, সে করলোই না।”
“আহারে! ইফাজ ভাইয়া বিয়ে করে ফেললে পঞ্চম বছরে সবার এনিভার্সারিত চলে আসতো। ইফাজ ভাইয়া কি সত্যিই বিয়ে করবে না?”
“কি জানি! আংকেল আন্টি তো আরও আগে থেকেই চাইছেন সে বিয়ে করুক। শুনছেই না। একটা কথা তোমাকে বলার ছিলো।”
“কি?”
“আন্টি সাফওয়ানার কথা বলেছিলেন ইফাজের জন্য। আমি বললাম, আমাদের প্রোগ্রাম শেষ হোক তারপর কথা বলবো বাবা মায়ের সাথে। বাবা মা কি এখন বিয়ে দিবে তাকে?”
“বলে দেখতে বাবা মায়ের সাথে কথা।”
“তোমার সাথে কথা না বলে আমি বাবা মাকে বলি কিভাবে!”
“আমি নিজেও তো জানি না বাবা মা এখন বিয়ে দিবে কি না তাকে। দেখি, মায়ের সাথে কথা বলে। আর ইফাজ ভাইয়া তো বিয়েই করবে না। কি কথা বলবো!”
“বিয়ে তাকে এবার করাবোই দেখে নিয়ো। মিরাজ বলেছে না বস্তিরানির কথা, প্রয়োজনে বস্তিরানিই খুঁজে নিবো।”
শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। জোভান বললো,
“আমাদের আরও একটা ইচ্ছে ছিলো, নিজেদের মতো বাচ্চাদের মাঝেও বন্ধুত্ব তৈরি করে দিবো এবং একই স্কুলে একই ক্লাসে ভর্তি করে দিবো। পরে আবার ভাবলাম ব্যাপারটা অযৌক্তিক। কারণ বাচ্চা তো আর একত্রে আসবে না সবার ঘরে। চাইলেই তো আর সবাই পায় না। আল্লাহ না চাইলে কিভাবে! তাই সেই প্ল্যান ক্যান্সেল। ছোট বড় হোক, বিয়ে দেওয়া যাবে।”
শারমায়া হেসে বললো,
“তোমাদের যত্তসব আজগুবি চিন্তাভাবনা। অগ্রিম চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ঘুমাও।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here