“হালাল প্রেম” পর্ব- ৬০

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৬০
(নূর নাফিসা)
.
.
দুদিন পর জোভান শারমায়াকে নিয়ে গেলো পিত্রালয়। শ্বশুরবাড়িতে জোভান একদিন থেকে শারমায়াকে রেখে চলে গেছে। সাফওয়ানা যেন এবার লজ্জায় দূরে দূরেই থেকেছে। তাকে দেখলেই যেন জোভানের হাসি পায়, সাফওয়ানাও দৌড়ে পালায়! তবে শারমায়ার সামনে যেতে ও কথা বলতে লজ্জাবোধ করে না।
ষোড়শ রমজানে জোভানের পরিবারকে দাওয়াত করলো সাখাওয়াত সাহেব। ইফাজের পরিবারের সাথে যেহেতু নতুন সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে তাই তাদের পরিবারকেও দাওয়াত করলো। সেই সুবাদে ইফাজের বাবা অন্য এক প্রস্তাব করলেন। ষোড়শ রমজানে যেহেতু দাওয়াতে আসছেন, সেহেতু সেদিন সাফওয়ানা ও ইফাজের এনগেজমেন্ট সম্পাদনের ও বিয়ের দিনতারিখ পাকাপাকির প্রস্তাব রাখলেন। জোভানের বাবাও মত রাখলেন তাই সাখাওয়াত সাহেব রাজি হলেন। ছোট মেয়ের এনগেজমেন্টের আলোকে আয়োজনের আকৃতি বড় করতে চাইলেন। কিন্তু শারমায়ার খালামনি নিষেধ করলো। তাদের আত্মীয়স্বজন মোটামুটি অনেক, যদি সম্প্রতি বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয় তাহলে উনার উপর প্রেশারটা বেশি পড়বে। কেননা, বেশিদিন হয়নি বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানসূচী সম্পন্ন হয়েছে। সাংসারিক হিসেবনিকেশেরও একটা ব্যাপার আছে। আবার এখন রমজান মাস, এতোটা আয়োজন না করাই ভালো হবে। রমজান মাস হওয়ায় ইফাজের পরিবারও চাইছে বিনা আয়োজনে এনগেজমেন্ট সম্পাদন করতে। তাই আলাদাভাবে আয়োজনের ব্যাপারটা বাদ দিলো সাখাওয়াত সাহেব। তবে খালামনি খালুজি উপস্থিত ছিলেন, যদিও পুরো পরিবারকেই দাওয়াত করা হয়েছিলো কিন্তু বাকিরা আসেনি। জোভান বলার পরও শারমায়া নিজে মিরাজ ও সাদাতকে তাদের বউসহ দাওয়াত করেছে। কিন্তু কেউই বউ নিয়ে আসেনি। আখির তো প্রব্লেম, কিন্তু লিসাকে কেন নিয়ে এলো না তাই একটু রাগারাগিও করেছে। মিরাজ তুলে ধরেছে, বিয়ের পর বউ ছাড়া বেড়াতে মজা বেশি। তাই নিয়ে আসেনি।
আজ সাফওয়ানার অবস্থা ছিলো ভয়াবহ! এতো চঞ্চল প্রকৃতির মেয়েটার কাছ থেকে এতোটা লজ্জা অপ্রত্যাশিত! সে যেন লজ্জায় কারো সাথে কথাই বলতে পারছিলো না। প্রথম প্রথম স্বাভাবিক থাকারই আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো এবং চলছিলোও। কিন্তু মিরাজ ও সাদাত মুখ চেপে কেমন যেন হাসছিলো যা তাকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। সে মনে মনে ভাবছিলো জোভান আবার তাদের জানিয়ে দিয়েছে কি না সব! তবে জোভান অন্যদিনের মতো আজ হাসেনি। সে এদিক ওদিক ছুটাছুটি ও কাজে ব্যস্ত। পরিবারের বড় ছেলে বলে কথা, মেহমানদের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখতে দিবে না। নিজ দায়িত্বে জিজ্ঞাসা করে করে গুছিয়ে দিচ্ছে সব।
ড্রয়িংরুমে সবার সামনে আসার পর যে সাফওয়ানা দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়েছে, একবারের জন্যও সেই দৃষ্টি উপরে তুলেনি। জোভান বারবার জেভাকে ইশারা করছিলো আর জেভা বারবারই সাফওয়ানাকে ইজি হতে বলছিলো। কখনো ফিসফিস করে কখনো বা ধমকের সুরেই। রিং পরানোর সময় মিরাজ ফটো তুলতে গিয়ে বললো,
“একি! তেল কি জল হয়ে গেলো? নাকি মিরচি মিঠা হয়ে গেলো? আরে পিচ্চি, দেখবা তো একবার, বিয়ে কার সাথে হচ্ছে আর রিং ই বা কে পরাচ্ছে! পরে যদি ফর্সা জামাই কালো দেখো, লম্বা জামাই খাটো দেখো তবে কেমন হবে?”
উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো। সাফওয়ানাও মুখ চেপে হাসলো। মিরাজের হাস্যকর চরিত্রের সাথে উপস্থিত সবাই কমবেশি পরিচিত। সাদাত বললো,
“আরে, মুখ দেখতে হবে না। অন্তর টান আছে। তুই তোর কাজ কর।”
অতঃপর ইফাজ রিং পরিয়ে দিতেই সাফওয়ানার চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। টুপটাপ পতন হলো দু-তিন ফোঁটা অশ্রু। এটা কি স্বপ্নরাজকে পাওয়ার আনন্দ নাকি পরিবারকে খুশি দেখার আনন্দ ভেবে পাচ্ছে না সে। তবে এটা অনুভব করতে পারছে, সকলের হাসিমুখ দেখতে তার খুব ভালো লাগছে। যদি নিজের পছন্দের ব্যাপারে পিতা মাতা জানতো, তাহলে কি এতোটা খুশি হতো? কখনোই না।
রিং পরানোর পরপর সাফওয়ানাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বড়রা কথা বলছে বিয়ের দিনতারিখ নিয়ে। ইফাজ জেভাকে ড্রয়িংরুম থেকে নড়তেই দিলো না। নোভাকে কোলে নিয়ে সে উঠে এসেছে। ডেট ফিক্সড করা না পর্যন্ত যেন জেভা না বের হয়। কারণ সে জেভাকে বারবার বলে রেখেছে ডেট যেন ৯জুন হয়। আর কেউ পারুক বা না পারুক, জেভা পারবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ৯জুনের কথা বলতে। কারণ সে জানে তাদের মিশনের কথা। তাদের বন্ধুদের আড্ডা চলছিলো শারমায়ার রুমে। শারমায়া তাদের দই মিষ্টি দিচ্ছে। সাফওয়ানাকে একটা পানির জগ নিয়ে আসতে বললো শারমায়া। সাফওয়ানা মায়ের রুমে এসে সুকেচ থেকে পানির জগ নিলো এবং শারমায়ার হাতে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। সে এখানে থাকলে নিশ্চয়ই তারা বন্ধুরা বন্ধুরা হাসিঠাট্টা করবে যার জন্য সাফওয়ানা মোটেও প্রস্তুত না। ব্যাপারটা প্রকাশ করার পর থেকে অন্যরকম এক অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। নোভা তার মায়ের জন্য কাঁদছিলো বিধায় ইফাজ তাকে নিয়ে রুমের বাইরে এসে হাটছিলো। সাফওয়ানা রুমে যাওয়ার সময় তার দিকে আড়চোখে তাকিয়েছিলো, যা ইফাজের নজরে আটকেছে এবং সে মুচকি হেসেছে। নোভার চিৎকার যেন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই জোভান তাকে ডাকছিলো নোভাকে তার কাছে দেওয়ার জন্য। এদিকে শারমায়া ই বেরিয়ে এসে কোলে নিয়ে নিলো এবং ইফাজের উদ্দেশ্যে বললো,
“ভাইয়া, আপনি খেতে যান।”
“এমনিতেই পেট ফুল ফিল। এখন খাবো না।”
“আরে আসুন তো। এতো টেনশন করার প্রয়োজন নেই। জেভা আপু আছে।”
শারমায়ার মস্করায় ইফাজ হেসে বললো,
“কিসের টেনশন!”
“থাক, কিছু না। আসুন।”
“আসছি।”
এদিকে শারমায়া নিজের রুমে গেলো আর ইফাজ সেখানে না গিয়ে চাপিয়ে রাখা দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো সাফওয়ানার রুমে। সাফওয়ানা সেলফি তুলছিলো আর এমনি ইফাজের আগমনে চরম লজ্জায় পড়ে গেলো! সে বিপরীতমুখী হয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে রাখলো। কে বলবে তাকে এখন সেলফি তুলতে! আর কে ই বা জানতো সে এখন চলে আসবে! ইফাজ বললো,
“একা একাই সেলফি তুলবেন?”
সাফওয়ানা চোখ খুলে দাতে দাত চেপে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। ইফাজের দু’হাত প্যান্টের পকেটে রাখা। সে নিজের বাহু দ্বারা সাফওয়ানার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“আপনি নাকি আমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবেন না, সেই পণ করে ফেলেছেন?”
সাফওয়ানা আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। তার বুঝতে আর বাকি নেই জোভান সব জানিয়ে দিয়েছে! এ কোন লজ্জায় পড়লো সে! এই মুহূর্তে সকলের আড়ালে লুকিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কোনোভাবেই সম্ভব না। জীবনের প্রথম বোধহয় লজ্জা কি জিনিস আন্দাজ করতে পারছে! এতোক্ষণে ইফাজ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার অবস্থা দেখে সে বললো,
“তেল তো দেখছি আসলেই জলে পরিনত হয়েছে!”
সাফওয়ানা চোখ খুলে দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে নিচু স্বরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। ইফাজ বললো,
“আর কি যেনো বলেছেন? মানুষ দেখলেই চেনা যায়, তাই না? তাহলে আমি কেন চিনলাম না আপনি যে আমার হতে চলেছেন?”
“আমি কি জানি!”
“আপনি জানবেন না তো কে জানবে? এখন যে আফসোস হচ্ছে, আগে জানলে তো এতোদিন সিঙ্গেল থাকতে হতো না।”
সাফওয়ানা মুখ চেপে হাসলো। ইফাজ বললো,
“হাতটা একটু ধরবো?”
সাফওয়ানা ডান হাত বাড়িয়ে দিলে ইফাজ বাম হাতে তার হাত ধরে পকেট থেকে ডান হাত ভর্তি কিটক্যাট চকলেট বের করে সাফওয়ানার হাতে দিলো। সাফওয়ানা বিস্ময়ের সাথে তার দিকে তাকাতেই ইফাজ মুচকি হেসে বললো,
“দেনা ছিলাম যে ভুলিনি। জোভান বললো পিচ্চি নাকি বড় হয়ে গেছে। আমি তো দেখছি আগের মতো পিচ্চিই আছে।”
সাফওয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে চকলেট গুলো দুহাতে ধরলো এবং বললো,
“আমিও তো বলেছিলাম লাগবে না।”
“কিন্তু আমি যে নিজেই দেনা নিয়েছি।”
বলতে বলতে ইফাজ সাফওয়ানার ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে বাম পকেট থেকেও চকলেট বের করে তার হাতে দিলো। তবুও হাতে জায়গা হচ্ছে না। পিছলে পড়ে যাচ্ছে তাই অবশিষ্টগুলো ইফাজ টেবিলে রেখে দিলো এবং তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে তুলতে বললো,
“আজ স্পর্শ করতে অনুমতি নিয়েছি, কাল কিন্তু নিবো না। ক্যামেরায় তাকাও একটু।”
সাফওয়ানা মুচকি হেসে ক্যামেরায় তাকালে ইফাজ বললো,
“হাসি চাপা রেখেছো কেন? মন খুলে হাসো। আর আমার দিকে তাকাও।”
সাফওয়ানার বড্ড হাসি পাচ্ছে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলে ইফাজ বললো,
“লজ্জা লাগে?”
“আপনি খুব পাজি একটা লোক।”
“আচ্ছা, আজ নতুন করে চিনলে তাহলে? তুমি সবসময়ই রোজা থাকো তো? নাকি আমরা আসবো, দেখবো এবং জিজ্ঞেস করবো বলে আজ থেকেছো?”
“আপনি কি দেখানোর জন্যই রোজা থকেন?”
“স্কুল লাইফে একসময় থাকতাম বন্ধুবান্ধবদের সাথে পাল্লা ধরে, কে কার চেয়ে বেশি রাখতে পারে। লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে বলেছি সারাদিন রোজা ছিলাম। না খেয়ে তখন সারাদিন কেটে গেলেও ইফতারের জন্য তৈরি খাবার দেখলে বিকেলে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। তুমিও এমন করো না তো যে, আন্টি চপ বানাচ্ছে আর তুমি টুপ করে গিলে ফেলেছো?”
“আপনি অনেক পঁচা হয়ে গেছেন।”
“সেজন্যই কি প্রেমে পড়লে?”
“সেলফি তুলতে হবে না। মোবাইল দিন।”
“উহুম, আমি সেলফি তুলবো।”
সাফওয়ানা এবার লজ্জা নামক বস্তুটাকে ছুড়ে ফেলে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওকে, তুলুন।”
ইফাজ বললো,
“এইতো, এবার ঠিক আছে।”
সাফওয়ানা দুষ্টুমি করে হাত ভর্তি চকলেটগুলো উপরে তুলে ধরলো ক্যামেরার সামনে। ইফাজ হেসে নিজের ফোন বের করেও কিছু সেলফি তুলে নিলো। অতঃপর রুম হতে বেরিয়ে দেখলো তারা শারমায়ার রুম থেকে বেরিয়ে শারমায়ার বাবামায়ের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে জেভার সাথে কথা বলছে। জেভা তাকে দেখে মুচকি হেসে বললো,
“যা, ডেট কনফার্ম।”
বিপরীতে মুচকি হেসে ইফাজ বললো,
“জেভা আপু থাকতে কনফার্ম না হয়ে থাকতে পারে!”
“হুম…সবাই হেসেছে তোদের মিশন জেনে।”
“হাসুক, আমরা তো দেখিনি।”
এদিকে মিরাজ তাদের একত্রে বের হতে দেখে চোখজোড়া বড় করে বললো,
“কিরে! আমরা তো ভেবেছিলাম তুই বুঝি বাইরে বেরিয়েছিস! বন্ধ রুমে কি করছিলি, হুম?”
“সেলফি তুলছিলাম।”
“সিরিয়াসলি! অন্য কিছু নয় তো?”
ইফাজ তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালে মিরাজ বললো,
“আই হ্যাট মাই মাইন্ড! আই হ্যাট মাই মাইন্ড!”
জেভা মিরাজের কাধে থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“তোমার সময় তুমি ব্যাড কাজ করে এসেছো, মাইন্ড তো হ্যাট হবেই।”
“আল্লাহ! এটা বলতে পারলা আপু!”
“তুই করতে পারবি আমরা বলতে পারবো না?”
“চুপ থাকো না, বাচ্চাদের সামনে এসব বলে! মাম্মাম, দেখো তোমার আম্মু পঁচা কথা শুনায় আমাকে।”
বলতে বলতে জেভার কোলে থাকা নোভার নাক টেনে ধরলো মিরাজ। নোভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। জেভা তার হাতে মেরে দিয়ে বললো,
“সর! আমার মেয়ের নাক ছিড়ে ফেলছে!”
“চিন্তা করো না, আমার ছেলের বউ করেই নিয়ে যাবো। রহিম, রুব্বান গো…”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here