“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৬৬
(নূর নাফিসা)
.
.
পরবর্তী সপ্তাহে তারা উত্তরাঞ্চলে ঘুরতে এলো। দুবছর পূর্বে সাখাওয়াত সাহেব প্লট কিনেছেন, সেটাই দেখতে এলো শারমায়া। ঘুরাও হলো, প্লটও দেখা হয়ে গেলো। পরদিন শারমায়া শ্বশুর বাড়ি চলে এলো। সকালে তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে জোভান অফিস গেছে। নতুন সম্পর্কের প্রেক্ষিতে দুসপ্তাহ পর ইফাজের পরিবারকে দাওয়াত করলো আশরাফ আহমেদ খান। সাথে আমন্ত্রিত সাদাত ও মিরাজের একক পরিবার। এবার আখি এসেছে বাচ্চাকে নিয়ে। সেই যে হসপিটালে দেখে এসেছিলো, সরাসরি আর দেখেনি শারমায়া। আজ কোলে নিয়ে অনেক খুশি সে। বাচ্চাদের বেশ ভালো লাগে তার কাছে। নোভার দুষ্টুমি গুলোকে তো প্রতিদিনই মিস করে। তার পরদিন বিকেলের ফ্লাইটে ছোট চাচ্চুর পরিবার ইংল্যান্ড চলে গেলো।
.
প্রেগ্ন্যাসির চার মাস চলছে শারমায়ার। আজকের আবহাওয়াটা ভীষণ প্রেমময়। গোধূলি লগ্নে জোভানকে মিস করছিলো খুব। আহনাফের সুন্নাতে খাৎনা সম্পন্ন হয়েছে গতকাল। তাই দুদিন যাবত তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আপুর বাসায় আছেন। সারাটাদিন শারমায়ার একা একা কাটছে বাসায়। দুজনের জন্য টুকটাক রান্নাবান্না আর প্রিয়জনদের সাথে ফোনে গল্পগুজবেই কাটছে তার সময়। সন্ধ্যায় কিচেনে এসে ভাবলো জোভানের পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করা যাক। সকালে যাওয়ার সময় বলেছিলো সন্ধ্যায় তারাতাড়ি ফিরবে। কিন্তু সন্ধ্যায় কল করে জানালো, কোম্পানির লোক এসেছে তাই মিটিং শেষ করে ফিরতে একটু দেরি হবে। নয়টার দিকে শারমায়া রান্না শেষ করে ইশার নামাজ আদায় করে বসে আছে। আজ বউ সাজতে ইচ্ছে করছে তার। বউ সাজ জোভানের পছন্দ বলে, কখনো জোভানের ইচ্ছায় কখনোবা নিজের ইচ্ছায় প্রায়ই বউ সাজে সে। জোভান সাড়ে এগারোটায় বাসায় এসে কল দিলো শারমায়ার কাছে। শারমায়া হাসিমুখে দরজা খুলে সালাম দিলে জোভান বউ সাজে তাকে দেখে ঠোঁটের হাসি আরও প্রশস্ত করে তুললো। সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে একহাতে পেছনে দরজা ঠেলে অন্য হাতে শারমায়ার মাথাটা কাছে টেনে কপালে কোমল স্পর্শ দিয়ে বললো, “মাশাআল্লাহ।”
অতঃপর দরজা লক করতে করতে বললো,
“সুন্দর স্মেল আসছে তো! বিরিয়ানি রান্না করেছো নাকি?”
“হুম, ঝটপট হাতমুখ ধুয়ে এসো।”
“খেয়েছো তুমি?”
“না।”
জোভান হাতমুখ ধুয়ে এসে চেয়ারে বসলো। শারমায়া প্লেটে খাবার দিয়ে পাশের চেয়ারে বসলে জোভান তাকে খায়িয়ে দিচ্ছে। পরপর তিন লোকমা শারমায়ার মুখে দিয়েছে অথচ সে এক লোকমা মুখে নিয়ে চিবাচ্ছে এখনো। শারমায়া বললো,
“তুমি খাও না কেন?”
“খাচ্ছি তো।”
“ভালো হয়নি রান্না?”
“হুম, দারুণ মজা হয়েছে।”
“সেটা তো তোমার মুখভঙ্গিই বলে দিচ্ছে।”
“সিরয়াসলি মজা হয়েছে।”
“তাহলে খাচ্ছো না কেন? বাইরে থেকে খেয়ে এসেছো?”
“আসলে, কিছুক্ষণ আগে কোম্পানির লোকদের সাথে রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম। তাই এখন ধীরে ধীরে খাচ্ছি।”
কথাটা বলার পর শারমায়ার চেহারায় যেন সামান্য হতাশা দেখতে পেলো জোভান। শারমায়া বললো,
“খেতে না পারলে রেখে দাও।”
“উহুম, খাবো।”
নিজের মুখে খাবার দিয়ে পরপর আরও দুই লোকমা শারমায়াকে দিতেই শারমায়া বললো,
“আমি আর খাবো না।”
“আর অল্প খাও।”
“সম্ভব না। খারাপ লাগবে।”
“এটাই শেষ, নাও।”
শারমায়া আরেক লোকমা মুখে নিয়ে পানি পান করলো। অতঃপর বসে রইলো জোভানের খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। প্রায় দুমিনিট পরপর যেন অল্প অল্প করে মুখে তুলছে খাবার। শারমায়া বুঝতে পারছে সে জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করছে। তাই প্লেট ধরে বললো,
“আর খেতে হবে না। রেখে দাও।”
“না, খাবো।”
“জোর করে খাওয়ার প্রয়োজন নেই। খারাপ লাগবে পরে।”
“লাগবে না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে।”
জোভান প্লেট টেনে ধরে রাখায় শারমায়া ছেড়ে দিয়ে বসে রইলো। দুমিনিটের কাজে দশ মিনিট সময় নিয়ে প্লেটের খাবারটুকু শেষ করে উঠলো জোভান। শারমায়া সব গুছিয়ে রেখে রুমে এসে দেখলো জোভান বাথরুমে। তার মনে হচ্ছে সে বমি করছে। হাতমুখ ধুয়ে জোভান রুমে আসতেই শারমায়া চেহারায় সামান্য বিরক্তি এনে বললো,
“বমি করেছো তুমি?”
“কোথায়?”
“কোথায় মানে!”
“বমি করা তো টুকটুকির আম্মুর কাজ। আমি কেন করতে যাবো?”
যখন সে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে শারমায়া বুঝে যায় সে বিষয়গুলো লুকাতে চায়। বমি করার ফলে চেহারায় দুর্বলতা ভেসে উঠেছে। শারমায়ার চোখে পানি চিকচিক করছে। সে দোপাট্টা টেনে খুলতে খুলতে হনহনিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। দোপাট্টা কাচুমাচু করে টুলে রেখে নেকলেস খুলে প্রায় ঢিল মেরেই ছুড়ে ফেললো ড্রেসিং টেবিলের উপর। জোভান আর দাঁড়িয়ে না থেকে তোয়ালে খাটে ফেলে তার নিকটে এলো থামানোর চেষ্টায়। শারমায়া তার কথায় পাত্তা না দিয়ে হাতের চুড়ি গুলো খুলতে লাগলো। জোভান এক হাতে তার দু’হাত শক্ত করে ধরে অন্যহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“টুকটুকির আম্মু, লাভ ইউ। আর কখনো এমন করবো না। প্রমিজ।”
শারমায়া নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,
“ছাড়ুন! কিসের প্রমিজ? আমি নিষেধ করিনি আপনাকে খেতে? আমি রাগ করছিলাম আপনি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন বলে? কিছু বলেছিলাম আমি?”
“সুইটহার্ট, বিরিয়ানি খুব টেস্টি ছিলো। তাই খেতে ইচ্ছে করছিলো খুব।”
“আমাকে বোকা মনে হয় আপনার? কিছু বুঝি না আমি? চিনিনা আপনাকে? এতো টেস্ট ছিলোই যখন, এখন জোর করে না খেয়ে সকালে খেয়ে নিতেন। শরীরের উপর এমন প্রেশার নিলেন কেন? আপনার কন্ডিশন কি আপনার জানা ছিলো না?”
জোভান তার হাত দুটো ছেড়ে দিয়ে এক হাতে তাকে জড়িয়ে রেখেই অন্যহাতে নিজের কান ধরে বললো,
“এই যে কান, ধরছি। আর কখনো এমন করবো না। তুমি রাগলে আমি ভয় পাই তো। টুকটুকির আব্বু অনেক ভয় পাচ্ছে, একবার জড়িয়ে ধরো।”
“সরুন, এতো ঢং আমি দেখতে পারবো না।”
“আই লাভ ইউ সো মাচ।”
“ছাড়তে বলেছি আমি।”
“এমনিতেই খারাপ লাগছে আমার, এমন করে না সুইটহার্ট।”
“এখন খারাপ লাগবে কেন?”
“লাভ ইউ তো…”
অতঃপর পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে শারমায়াকে কান্নার মাঝেই কিছুটা হাসাতে পারলো। নেকলেস আর পরায়নি তবে দোপাট্টাটা তুলে তার মাথায় ঘোমটা দিয়েছে জোভান। এরপর বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকার শহরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চললো তাদের খুনশুটিময় ভালোবাসার গল্প।
.
শীতে প্রকৃতি ছেয়ে গেছে রিক্ততায়, তবে টুকটুকির আগমনে পূর্ণতার জোয়ার উঠেছে তাদের দাম্পত্য জীবনে। প্রায় ছয় বছর পর জোভানের প্রত্যাশিত গিফটটা এনে দিতে পারলো শারমায়া। সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাকে কি দেখবে, একজন মেয়ের বাবার মধ্যে ফুটে উঠা আনন্দটাই বেশি নজর কাড়ছে সবার। জোভানের মাঝে প্রকাশিত উৎফুল্লতায় আজ অন্যরকম সফলতা অনুভব করতে পারছে শারমায়া। তার এই চেহারা দেখে মহান আল্লাহর কাছে অসংখ্যবার শুকরিয়া আদায় করেছে শারমায়া। আল্লাহর রহমতে ডেলিভারিতে তাদের মা, মেয়ের কোনো সমস্যা হয়নি, সেজন্য শুকরিয়া আদায় করেছেন জোভানসহ পরিবারের সকল সদস্যগণ। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শারমায়ার কাছে কেবিনে এসে মিষ্টি হাসি মুখে সালাম দিলো জোভান,
“আসসালামু আলাইকুম, সুইটহার্ট।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। গিফট পছন্দ হয়েছে?”
“তুমি সুস্থ হয়ে উঠো, তারপর জানাচ্ছি।”
“কেন, এখন বলা যাবে না?”
“এখন তো অসুস্থ, তাহলে শাস্তি দেই কিভাবে! তোমরা আমাকে কতটা ভয় দেখিয়েছো, জানো? কড়া শাস্তি পাবে।”
শারমায়া মুচকি হাসলো। জোভান শারমায়ার পাশে টুকটুকিকে রেখে বললো,
“এতোদিন শুনেছি এবং কল্পনা করেছি। আজ সরাসরি অনুভব করতে পারছি, বাবা হওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ বোধহয় পৃথিবীতে আর কিছুই হয় না। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো আমার পৃথিবীর প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। বাতাসে ঢেউ খেলানো প্রদীপ যে স্থির অবস্থায় এসে আরও তীব্র ঝাপটায় জ্বেলে উঠে…আমি সেটার সম্মুখীন হয়েছি, জান। ইউ ক্যান্ট ইমাজিন, হোয়াটস গোয়িং অন ইনসাইড মি! ইউ হেভ গিভেন মি দ্যা বেস্ট গিফট এভার।”
গলা ধাধিয়ে আসায় কথা কয়েকবার আটকে গেছে জোভানের। শারমায়া গর্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ থেকে ঝড়ে পড়ছে অশ্রুধারা। আনন্দ নামক ব্যাথা জোভানের হৃদে, অথচ সেই প্রতিক্রিয়া শারমায়ার চোখে। জোভান ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে পাশে বেডে বসে তার চোখের ধার মুছে দিতে দিতে বললো,
“কাঁদছো কেন?”
“সুখে।”
“আচ্ছা? তো এবার গিফট চাও দেখি টুকটুকির আব্বুর কাছে।”
“টুকটুকির আব্বুকে চাই আমার। দিবে?”
“এ জীবন উৎসর্গীত কেবলই তোমার তরে।”
শারমায়া তার হাত স্পর্শ করে বললো,
“ভালোবাসি।”
জোভান তার হাতটা দু’হাতে আলতো চেপে ধরে কপালে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বললো,
“ভালোবাসি, অনেক বেশি। মাই লাভ, টুকটুকি এতো ঘুমাচ্ছে কেন?”
“টুকটুকির আব্বুর ঘুম যে হারাম হয়ে আছে সেজন্য।”
“মজা নিচ্ছো? কিছুক্ষণ আগে তো খুব বড় বড় চোখ করে তাকালো, ঠিক তোমার মতো। রেগে গেলে তুমি যেভাবে তাকাও। থেমে থেমে কাঁদলো, কিন্তু তোমার মতো নাক টানাটানি স্বভাব নেই।”
“আরও কিছু?”
“গাল দুটো তোমার মতোই গুলুমুলু।”
“কবে থেকে বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা শিখলে?”
“তোমাকে প্রথম দেখেছি যেদিন, হৃদমাঝে ঠাঁই দিয়েছি সেদিন। নয়ন জুড়ে কেবল তোমার বৈশিষ্ট্য একে নিয়েছি দিনকে দিন।”
এমনি কেবিনে জেভা এসে বললো,
“কবি মশাই, বাইরে গিয়ে কবিতা শোনান। আপনার বন্ধুগণ এসেছেন। পাঁচটার আগে কেবিনে আসা নিষেধ।”
শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। জেভা বললো,
“ইশ! হাসুনি বুড়ি! মুখে এতো হাসি, তাহলে আবার চোখে পানি কেন?”
জোভান বললো,
“বাবা-মায়েরা খেয়েছে আপু?”
“হ্যাঁ, সবাই খেয়েছে। তুইও খেয়ে নে গিয়ে।”
জোভান উঠে যেতে যেতে জেভার চোখ ফাঁকি দিয়ে টুকটুকির গালে আলতো ছুঁয়ে নাড়ানোর চেষ্টা করলো তাকে জাগানোর চেষ্টায়। শারমায়া বুঝতে পেরে চোখ রাঙালো। ধরা পড়ে জোভান মুচকি হেসে বললো,
“বাইরে থেকে কিছু খাবে?”
শারমায়ার পূর্বে জেভা জবাব দিলো,
“স্যালাইন ছাড়া আর কিছুই খাবে না। তোর খাওয়া তুই খা গিয়ে।”
জোভান ফিসফিস করে শারমায়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“ফুচকা, চটপটি, আচার এই টাইপের কিছু?”
ফিসফিস শুনে জেভা তার দিকে রেগে তাকালো। শারমায়া মুখ চেপে হেসে দু’দিকে মাথা নেড়ে জোভানকে জবাব দিলো, কিছুই খাবে না। এদিকে জেভার রিয়েকশানে জোভান মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো দ্রুত। বাইরে আসতেই বন্ধুগন তার পকেট ছিনিয়ে নিয়েছে। তবে ইফাজ ছিলো না তখন। সাফওয়ানাকে নিয়ে আসার জন্য সে বাসায় গেছে। কিছুক্ষণ পর ইফাজ ও সাফওয়ানাও চলে এলো। সাফওয়ানা এতো খুশি যে, সে এসেই ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে নিয়েছে। কথা বলছে তা-ও যেনো হাপিয়ে যাচ্ছে খুশির ঠেলায়। তার এতো এতো বকবকে টুকটুকির ঘুম ভেঙে গেছে। আর হয়েছে তাদের বিশ্রাম নেওয়া! ঘুম ভেঙেই গেছে যেহেতু আর নিষেধাজ্ঞায় রাখলো না জেভা। সবাইকেই দেখা করার ও কোলে নেওয়ার সুযোগ দিলো। তখন অন্য ডাক্তারকে দেখানোর জন্য জেভার ডেস্কে নিয়ে যাওয়ার সময়ও তাদের দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কাউকে কোলে নেওয়ার সুযোগ দেয়নি। জোভান নাছোড়বান্দা, কেবিনে ফিরে আসার সময় সে নিয়েই ছেড়েছে এবং কেবিন পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার ছলে শারমায়ার সাথেও দেখা করে গেছে।
কিছুক্ষণ পর খালামনি ও জোভানের বন্ধুবান্ধব চলে গেলো। রাত নয়টার পর সাফওয়ানাকেও চলে যেতে হচ্ছে। সাফওয়ানার কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না হসপিটাল থেকে। কিন্তু সে-ও অসুস্থ, সুখের অসুখ বাঁধিয়ে নিয়েছে। ইফাজও চাইছে না এই অসুস্থ শরীর নিয়ে সে থাকুক, শারমিনও বকেঝকে পাঠিয়ে দিলেন। এসেছেই যখন, যাওয়ার আগে ইফাজ তার চেক-আপ করিয়ে নিলো জেভার কাছে। ইফাজ তাকে থাকতে দিলো না তাই বিড়বিড় করে বকতে বকতে লিফটে নিচ তলায় চলো এলো। ইফাজ শুনেও না শোনার ভান করে বিনা রিয়েকশানে তার সাথে হেটে চলেছে। হঠাৎ ছোট সাইজের একটা ফুটবল উড়ে এলো ওয়েটিং রুমের দিক থেকে। ইফাজ লক্ষ্য করে ফেলায় একহাতে সাফওয়ানাকে হেচকা টানে পিছু হটিয়ে অন্যহাতে বল ফিরিয়ে নিলো। সময় মতো ফেরাতে না পারলে সাফওয়ানা ব্যাথা পেতো। রাগে ইফাজের ব্রু কুচকে গেলো, হসপিটালে কি বল খেলার জায়গা! একটা বাচ্চা দৌড়ে এসে বলটা হাতে তুলে নিলো। হনহনিয়ে পা ফেলে বাচ্চার মা এসে তার মাথায় মেরে বললো,
“এখানে খেলছো কেন তুমি?”
যদিও গার্ডিয়ানদের উপর প্রচুর রাগ হচ্ছিলো ইফাজের কিন্তু নুসরাতকে দেখে আর কিছু বললো না। নুসরাতও তাদের দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো। সে এগিয়ে এসে বললো,
“কেমন আছো?”
ইফাজ রাগ ঝেড়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা কেমন আছো?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তোমার ওয়াইফ?”
“হুম।”
“ভারি মিষ্টি দেখতে। স্যরি, খেয়াল করিনি বল নিয়ে বেরিয়ে গেছে। শরীরে লেগেছে?”
“না, ঠিক আছে। তোমার এক ছেলে ই?”
“না, এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে তার বাবার কোলে।”
কাউন্টারের দিক থেকে আট-দশ মাসের বাচ্চা কোলে নুসরাতের হাসব্যান্ড এগিয়ে এলে নুসরাত বললো,
“নিষেধ করেছিলাম এখন বল কিনে দিতে। যাওয়ার সময় কিনে দেওয়া গেলো না! এখনই তাদের শরীরে লাগতে যাচ্ছিলো!”
ভদ্রলোক ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আব্বু, এটা বাসায় খেলার জন্য কিনে দিয়েছি না? হসপিটালে কেউ বল খেলে?”
বাচ্চাটি মিষ্টি গলায় বললো আর খেলবে না। খেলবেই বা কিভাবে, বল তো নুসরাত নিয়েই নিয়েছে! অতঃপর নুসরাত তার হাসব্যান্ডকে পরিচয় করিয়ে দিলো ইফাজের সাথে। ইফাজ কুশলাদি বিনিময় করে সাফওয়ানার জন্য তারাতাড়ি চলে যেতে লাগলো রাত বেড়ে যাচ্ছে বলে। আর এদিকে সাফওয়ানা কথা বলার পুরোটা সময় তো তাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলোই, এখন ইফাজের হাত ধরে যেতে যেতেও বারবার পিছু ফিরে তাদের দেখছেই! ইফাজ তার ঘাড় ঘুরিয়ে সামনের দিকে ফিরিয়ে বললো,
“ওদিকে কি?”
সাফওয়ানা মিচকে হাসি দিয়ে বললো,
“বাচ্চা দুইটা কিউট না?”
ইফাজ তার মিচকে হাসির বিপরীতে ব্রু সামান্য কুচকে বললো,
“সামনের দিকে তাকিয়ে হাটো। আরেকবার পিছনে তাকালে মাইর দিবো।”
“ইশ! মাইর দিবে! আমি দিতে পারি না বুঝি?”
“আচ্ছা? বাসায় চলো, দেখি কিভাবে দাও। আর কে কাকে দেয়।”
“আচ্ছা, দেখে নিয়েন।”
অতঃপর চুপচাপ বাইরে এসে গাড়িতে উঠে সাফওয়ানা বললো,
“নুসরাত আপু কিন্তু বেশ সুখে আছে।”
ইফাজ নিজের সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে তার দিকে তাকিয়ে মুখে সামান্য হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“আর তুমি কি আমার কাছে সুখে নেই?”
“তার আগে বলো তুমি সুখে আছো কি না?”
“তোমার সুখে আমার সুখ।”
“আমি ভীষণ সুখে আছি, আলহামদুলিল্লাহ।”
ইফাজ আবার সিট বেল্ট খুলে ফেলে তার দিকে ঝুঁকে কপালে চুমু দিলো। সাফওয়ানা তার কলার মুঠোয় ধরে গালে রিপিট করতেই ইফাজ বললো,
“কি দিলে! টক লাগলো।”
“বাসায় গিয়ে মাইর দিবো, তখন মিষ্টি লাগবে।”
ইফাজ সোজা হয়ে বললো,
“চিতুই পিঠা খাবে?”
“উহুম।”
“পাঁচ রকমের শুটকির ভর্তা দিয়ে। বেশ মজা। নিয়ে আসি?”
“বাইরের খাবার খেয়েছি শুনলে আবার মা বকা দিবে।”
“কিছু হবে না, ইনশাআল্লাহ।”
“যাও, মায়ের জন্য বেশি করে নিয়ে এসো।”
“ওকে।”
.
হসপিটালে তিনদিন কাটিয়ে টুকটুকি তার দাদা বাড়ি ফিরলো। এসেই শারমায়া যত্ন করে তুলে রাখা জুতা জোড়া পরিয়ে নিলো। তার বাবাইয়ের দেওয়া উপহার বলে কথা। এই দু-তিনদিন টুকটুকির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে গোছাতেই কেটে গেছে জোভানের। সপ্তম দিনে আকিকার অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। টুকটুকির ভালো নাম রাখা হয়েছে জান্নাতুল সাইবা। জোভান ও শারমায়ার নামের সমন্বয়ে সাফওয়ানা রেখেছে জয়া। কেউ জয়া ডাকে, কেউ সাইবা ডাকে। শারমায়া ও জোভান টুকটুকি বলেই ডাকে তবে কখনো কখনো শারমায়া জান্নাত বলে ডাকে। আকিকা সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে জোভানের ঠিকমতো অফিস যাওয়া শুরু হলো।
টুকটুকির একমাস পূর্ণ হলে শারমায়া পিত্রালয় যাচ্ছে। ছুটির দিন হওয়ায় জোভান বাসায়ই আছে। দুপুরের সময়টা টুকটুকি ঘুমাচ্ছে। শারমায়া কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। জোভান গোসল করে বেরিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের উপর কাপ দেখতে পেলো। সকালে শারমায়া কফি খেয়ে কাপ এখানেই রেখে দিয়েছে। জোভান কাপ হাতে নিয়ে তার পাশে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“সুইটহার্ট…?”
“হুম?”
“এক কাপ জুতো হবে?”
শারমায়া হাতের কাপড় ভাজ করতে করতে চোখ রাঙিয়ে তাকালো তার দিকে। জোভান মুখে দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে খাটে রাখা টুকটুকির জুতো জোড়াগুলোর দিকে ইশারা করে বললো,
“দাও না? আপাতত এক কাপ হলেই হবে।”
“আযান দিবে। নামাজ পড়তে যাও।”
“আযান দিতে আরও কয়েক মিনিট বাকি। দাও না গো, শিকুর জন্য।”
বলতে বলতে জড়িয়ে ধরতেই ওদিকে টুকটুকি জেগে উঠলো। আর শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। জোভান তার কানে কামড় দিয়ে বললো,
“একটা বছর যেতে দাও। টুকটুকির সাথে খেলার জন্য শিকু কিংবা ইকুকে আনছি।”
“আবার ইকু!”
জোভান টুকটুকিকে কোলে নিতে নিতে বললো,
“এটুকুতেই ভয় পেয়ে গেলে! আরও আছে তো।”
“শাট আপ!”
“আই ডীপলি লাভ ইউর শাট আপ।”
(সমাপ্ত)
[বি.দ্রঃ “হালাল প্রেম” আকর্ষণীয় কোনো প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত নয়। বরং স্বজনপ্রীতি ও সাধারণ সম্পর্কগুলোর ব্যাখ্যা সহজ সাবলীল ভাষায় অতি সাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। হ্যাপি রিডিং… ❤]