“হালাল প্রেম” পর্ব- ৬৩

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৬৩
(নূর নাফিসা)
.
.
সাফওয়ানার বিয়ের চারদিন পূর্বে সুষনা আপু দেশে ফিরেছে। তাদের সকলের আনন্দটা যেন আরও বেড়ে গেলো। সুষনারও আফসোস হচ্ছিলো, না জানি সাফওয়ানার বিয়েতে তার আসা হবে না। এবার সকলের আফসোস মিটে গেলো। শারমায়া সেদিন সকালেই তার পিত্রালয় এসেছে এবং দুপুরের পর জোভান তাদের নিয়ে শপিংয়ে গেছে। শপিংয়ে যাওয়ার পর ইফাজ যুক্ত হয়েছে তাদের সাথে। এটা সাফওয়ানার জন্য সারপ্রাইজই ছিলো বটে। সে জানতো না, ইফাজও আসবে। কেবল জোভান জানতো। আর ইফাজ নাকি অফিস থেকে এসেছে। বরপক্ষের শপিং আরও আগেই শেষ। জোভানও গিয়েছিলো তাদের সাথে।
অতঃপর চারজন ঘুরেফিরে শপিং করে একেবারে ডিনার করে এসেছে। ইফাজ নিজ বাসায় চলে গিয়েছে আর তারা ধানমন্ডিতে। শ্বশুরের সাথে বিয়ে বাড়ির কাজকর্ম সম্পাদন করতে জোভানের আর অফিস যাওয়া হয়নি ঠিকমতো। জরুরি কাজ থাকলে কিছু সময়ের জন্য গিয়েছে আবার কাজ শেষ হতেই চলে এসেছে।
গায়ে হলুদে বিয়ে বাড়ি গমগম করছে মানুষে। শহরের বাড়িঘর বলতে গেলে চার দেয়ালের চৌবাচ্চা। সকল মেহমানের ভীড়ে এখানে চলাচলে একজনের সাথে অন্যজনের ধাক্কা খাওয়ার অবস্থা প্রায়। আর কোলাহল সৃষ্টি করতে মামাতো, খালাতো, চাচাতো ভাইবোনের বাচ্চাকাচ্চা তো আছেই। স্টেজ করা হয়েছে ছাদে। সন্ধ্যা হতেই তারা কাজিনরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতেছে বেশ। আর বড়রা সব নিচে ফ্ল্যাটে গল্পগুজব ও কাজকর্মে ব্যস্ত। যদিও আয়োজন কমিউনিটি সেন্টারে হবে, তবুও যেন কাজের শেষ নেই। তাদের হৈচৈ এর কারণে মাঝে মাঝে বড়দের মধ্যে কেউ কেউ ছাদে এসে বারবার সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছে, হৈচৈ কম করার জন্য। আশেপাশের লোকজনের সমস্যা হবে। কে শোনে কার কথা! যখন বলে যায়, তখন একটু নিরব হয়। পরক্ষণেই আবার শুরু হয়। তাদের আনন্দে একটাই ঘাটতি রয়ে গেছে, লগন যাওয়া হয়নি। তাদের কাজিনদের প্রায় কারো বিয়েতেই এই জিনিসটা হতে দেয় না মুরুব্বীরা। এই বিষয়টি তাদের অপছন্দের। গান বাজনাও অপছন্দের, কিন্তু ছেলেমেয়েরা একটু বেশিই জেদি। তাই এদিকটা ছাড় পাওয়া গেছে।
সন্ধ্যার দিকে সাদাত, মিরাজসহ তাদের কয়েকজন বন্ধু এসে ঘুরে গেছে। শ্বশুরবাড়িতে তাদের আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেনি জোভান। শারমায়ার শ্বশুর বাড়ির লোকজন দশটা পর্যন্ত থেকে চলে গেছে। কেবল জুথিকাকে রেখে দিতে পেরেছে শারমায়া।
উপস্থিত সকলের আবদারে প্রোগ্রামে জোভান দুইটা বাংলা গান গেয়েছে। “তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ের সুখের দোলা…” এটা গেয়েছে শারমায়ার জন্য। কেননা এটা শারমায়ার বেশ পছন্দের একটি গান। “যদি বউ সাজো গো…” এটা গেয়েছে সাফওয়ানার জন্য। সাথে সুর দিয়েছে সাফওয়ানা। সাফওয়ানার ফ্রেন্ড এবং কাজিনরা নেচেছেও। সাফওয়ানাও বসে থাকেনি। তাদের টানে সেও চলে গেছে নাচ মঞ্চে। তবে শারমায়াকে নিতে পারেনি কোনোভাবেই। জোভানকেও টেনেছিলো, কিন্তু জোভান তার বিনিময়েই গান গেয়েছে। নাচতে রাজি নয়। নিজের বিয়েতে সাফওয়ানার এতো আনন্দ শারমায়ার কাছে প্রায় অবিশ্বাস্যই লাগছিলো। তার সাফুটা এখনো পিচ্চিটাই রয়ে গেছে। ছেলে কাজিন গুলো তো তাদের বউ নিয়েই নাচে মেতে গেছে!
হৈ-হুল্লোড়ে ক্লান্ত হয়ে তাদের আসরেই এক পর্যায়ে খাওয়াদাওয়া হলো সবার। অতঃপর হাসিঠাট্টা সহিত চললো হাতে মেহেদী লাগানোর পর্ব। বারোটা বাজতে চলেছে, বিকেল থেকে এ পর্যন্ত পানি ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি জোভানের। শারমায়া তাকে টেনে ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলো। রুমে এসে জোর করেই বাথরুমে পাঠিয়ে দিলো হাতমুখ ধোয়ার জন্য। আর সে চলে গেলো কিচেনে। সালাত হাতে রুমে এসে দেখলো জোভান তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে নিচ্ছে। শারমায়া বললো,
“মাথা ভিজিয়েছো কেন?”
“নিজেকে ফ্রেশ করার জন্য।”
“মাথা ব্যাথা করছে না তো?”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো তাই।”
“তোমাকে আমি চিনি না? একটা মিনিট রেস্ট নেওয়ার কথা ভাবে না। যেন সব কাজ উনার একার। এখন খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমাবে। প্রয়োজন পড়লে আমি ডেকে দিবো।”
বলতে বলতে শারমায়া ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে বিরিয়ানির বক্স নিলো। রান্নার পরপরই তার জন্য বিরিয়ানি আলাদা করে রেখেছিলো। কেননা, বিরিয়ানি জোভানের বেশ পছন্দের। কখন না কখন খাবে, ভাগ্যে জুটবে কি না বলা মুশকিল। মুখে এক পিস শসা দিয়ে চিবাতে চিবাতে জোভান বললো,
“এটা কি?”
জবাব না দিয়ে ঢাকনা খুলে দেখালো শারমায়া। জোভান কিছুটা অবাক হয়ে হাসলো এবং বললো,
“ড্রেসিং টেবিলে বিরিয়ানি!”
শারমায়া মুচকি হেসে বক্স থেকে বিরিয়ানি প্লেটে নিতে নিতে বললো,
“এটা আম্মুর বুদ্ধি। তুমি যে খাওয়ার সময় সবার পেছনে পড়বে, সেটা সবাই জানে। বুঝেছো? ফ্রিজে রাখলে তো ঠান্ডা হয়ে যেতো। তাই আম্মু বললো ড্রয়ারে রেখে দিতে।”
“মা খেয়েছে?”
“হুম।”
“আমি খায়িয়ে দিবো নাকি তুমি খায়িয়ে দিবে?”
“নিজ হাতে খান, মিস্টার। আমার দ্বারা পসিবল হবে না। আমি বসছি এখানে।”
“ওকে। বসো।”
শারমায়া দরজা চাপিয়ে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে এক পিস লেবু নিয়ে খেতে লাগলো। জোভান খাটে বসে প্লেট হাতে নিলো এবং প্রথম লোকমা শারমায়ার মুখের দিকে এগিয়ে দিতেই শারমায়া পিছু হেলে গিয়ে বললো,
“উহুম। কিছুক্ষণ আগে আমি ভাত খেয়েছি। তুমি খাও।”
“ভাত কেন?”
“গন্ধেই প্রচুর খারাপ লাগছিলো তাই।”
“ওকে, ফাইন। এখন আমার সাথে আবার খাও।”
“সম্ভব না।”
“কোনো কথা না।”
“যতটুকু খেয়েছি, তা-ও কিন্তু বেরিয়ে আসবে।”
“আসুক। পরেরটা পরে বুঝবো।”
কথা বলতে বলতে শারমায়াকেও কয়েক লোকমা খায়িয়ে দিলো। বক্সে থাকা অবশিষ্ট বিরিয়ানি শারমায়া আবার ড্রয়ারেই রেখে দিলো। খাওয়া শেষ করে জোভান ফোন হাতে নিয়ে দেখলো বারোটা পনেরো বেজে গেছে! সে বিস্মিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“ওহ্! শীট!”
শারমায়া পিছু ফিরে বললো,
“কি হয়েছে?”
জোভান তার জবাব না দিয়ে খাটের ড্রয়ার খুলে ড্রয়ারে হাত বুলালো। অতঃপর একটা সাদা গোলাপ বের করে ড্রয়ার লাগিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং এগিয়ে গেলো শারমায়ার কাছে। গোলাপের ডাটা দুই ঠোঁটে আঁকড়ে ধরে শারমায়ার খোপা থেকে লাল গোলাপটা ছুটিয়ে নিলো। দু’হাতের ভার শারমায়ার দুই কাধে রেখে লাল গোলাপসহ হাত দুটো মাথার পেছনে রাখলো জোভান। অতঃপর ঠোঁটে আটকে থাকা সাদা গোলাপ ছুঁয়ে দিলো শারমায়ার কোমল গালে। শারমায়া চোখ বন্ধ করে নিয়েছে, মুখে বিদ্যমান হাসি আর চেহারায় ঝলমল করছে লজ্জা৷ জোভান সাদা গোলাপটাও হাতে নিয়ে লাল ও সাদা গোলাপ একত্রিত করে শারমায়া কপাল থেকে নিচে নামিয়ে থুতনি পর্যন্ত ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
“মাই লাভ, উইশিং ইউ দ্যা ডে অফ আওয়ার হালাল রিলেশনশিপ। হ্যাপি এনিভার্সারি, মাই লাইফ।”
শারমায়া চোখ খুলে তাকিয়ে মুচকি হেসে গোলাপ দুটো হাতে নিলো। চোখে তার চিকচিক করছে অশ্রু। সে জোভানের বুকে মাথা রেখে বললো,
“আই ক্যান্ট স্যা, হোয়াট ইউ আর ইন মাই লাইফ! হ্যাপি ম্যারেজ এনিভার্সারি মাই হার্ট, মাই বেস্ট হিরো এন্ড পার্টনার।”
জোভান পকেট থেকে ছোট্ট একটা গিফট বক্স বের করলো। বক্সটা অনেকটা রিং বক্সের মতো। শারমায়া ভেবেছিলো রিং আছে ভেতরে। কিন্তু বক্সটা খুলতেই দেখলো এটা আসলে কোনো বক্স নয়। বক্স সিস্টেমের একটা শোপিচ, যেটা খুলতেই লাইটের আলোয় কিছু লেখা জ্বেলে উঠলো, “মম ইজ সুইট, ডেড ইজ ন্যটি।”
অদ্ভুত জিনিসটা দেখে শারমায়া অবাক হয়ে তাকাতেই জোভান বললো,
“ইট’স ফর টুকটুকি এন্ড শিকু’স মাম।”
শারমায়া হেসে উঠলো এবং বললো,
“রেইলি, দ্যায়ার্স ডেড ইজ ন্যটি?”
“ইয়াহ! জানো, ফুল বাসায় নিয়ে আসার পরই আলাদা করে ড্রয়ারে তিনটা লাল গোলাপ রেখেছিলাম। সন্ধ্যায় সাদা গোলাপটা এনে দেখি কে যেনো সেগুলোও নিয়ে গেছে। তাই তোমার খোপা থেকেই নিয়ে নিলাম।”
শারমায়া তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি রেখেছো এগুলো! আমি তো আরও মালিক খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই নিয়ে গেছি খোপায় পরার জন্য। ওদিকে আপুদের ফুল ছিলো না খোপায় দেওয়ার জন্য। একটা আমি নিয়েছি, দুইটা তাদের দিয়ে দিলাম।”
“ভালোই তো বন্টনকারী।”
শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“কে জানতো, তুমি এনে লুকিয়ে রেখেছো!”
.
রাত দুটো বেজে গেলে শারমায়ার মামারা ধমকে তাদের প্রোগ্রাম বন্ধ করে দিয়ে ঘুমানোর জন্য পাঠিয়ে দিলো। শারমায়াদের এবং চাচীদের ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ বুকিং তাদের মেহমান দ্বারা। যে যেখানে ফাঁকা পেয়েছে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেরা সব বউ বাচ্চা এখানে রেখে খালামনির বাসায় চলে গেছে। এখানে জায়গা হবে না তাই খালামনিই পাঠিয়ে দিয়েছে। সুষনাও চলে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু যেতে দেয়নি শারমায়া। আরিফ ভাইয়া, সুষনা, শারমায়া ও জোভান ফাঁকা ছাদে বসে গল্প করতে করতে কাটিয়েছে অনেকটা সময়। ফ্ল্যাটে মা, মামী, খালামনিরাও গল্পগুজবে জমেছে, ঘুম নেই তাদের চোখে।
সাফওয়ানা নিজের রুমে তার ফ্রেন্ডস ও কাজিনদের সাথেও শুয়েছে। তিনটার দিকে ফোনে কল এলো ইফাজের। সে চাপাচাপি থেকে কোনোমতে উঠে জানালার ধারে এসে রিসিভ করলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। জেগে ছিলে নাকি ঘুমিয়ে?”
“ঘুমাতে যাচ্ছিলাম।”
“যাক, তাহলে ঘুমের ডিস্টার্ব করিনি। কার রুমে আছো?”
“আমার রুমে।”
“ভাবির রুমে আসা সম্ভব হবে?”
“আপুর রুমে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“এসেই দেখো। নয়তো আংকেল আন্টির রুমে এসো।”
“উহুম, আব্বু আর মামা ঘুমাচ্ছে। আপুর রুমে আসছি।”
“ওকে, বারান্দায় এসো।”
শারমায়ার রুমে ভাবি, আপুরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘুমাচ্ছ। মেঝেতেও বিছানা করে নিয়েছে। সাফওয়ানা ড্রিম লাইটের আলোতে একপাশ দিয়ে এসে সাবধানে বারান্দার দরজাটা একটুখানি খুলে বারান্দায় চলে এলো। তার মন বলছিলো ইফাজ এসেছে রাস্তায়, তাই ফোন করে এখানে আসতে বলেছে। কিন্তু এতো বড় একটা সারপ্রাইজ রেখেছে, সেটা ভাবেনি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here