“হালাল প্রেম” পর্ব-৮

“হালাল প্রেম”
পর্ব-৮
(নূর নাফিসা)
.
.
আশরাফ স্যারের নিজস্ব কোচিং সেন্টার আছে। এইচএসসি এক্সাম শেষ হওয়ার পরপরই স্যার শারমায়াকে বলেছিলেন কোচিং-এ যেতে। কিন্তু গতদিন গুলোতে বেশিমাত্রায় পড়াশোনা করার কারণে কিছুদিন অব্যহতি নিতে চেয়েছে শারমায়া। তাছাড়া স্যার নতুন করে সম্পর্কিত হতে চলেছেন তাই লজ্জার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারছে না আর না পারছে স্যারের কোচিং সেন্টার ছেড়ে অন্যটাতে ভর্তি হতে!
পরদিন শারমায়া কোচিং-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সেন্টার তার চেনা কিন্তু সে একা যাবে না। বারবার বলে বাবাকে সাথে যেতে বাধ্য করলো। সাখাওয়াত বদরুদ্দোজা তার চেম্বার থেকে চলে এসেছেন মেয়েকে সেন্টারে পৌছে দেওয়ার জন্য। অতপর লজ্জা ও বিরক্তি নিয়ে সে বাবার সাথে রওনা হলো। লজ্জার কারণ স্যার তার হবু শ্বশুর। আর বিরক্তির কারণ, কোনো প্রতিষ্ঠানেরই ঈদেরছুটি শেষ হয়নি। আর এই প্রতিষ্ঠান ঈদের চতুর্থদিন থেকে চালু! বেচারা শিক্ষার্থীদের একটু নিশ্বাস ফেলার সময় দিলো না। তা-ও তো শারমায়া আগে আসেনি বিধায় তার শান্তি। রমজান মাসে পড়াশোনা থেকে দূরে থেকেছিলো সে। এখন আবার শুরু হলো। আর তারা এক্সাম শেষ হওয়ার পরপরই ভর্তি হয়েছে কোচিং-এ।
সাখাওয়াত বদরুদ্দোজা শারমায়াকে সেন্টারে দিয়ে আশরাফ স্যারের সাথে কথা বলে আবার চলে গেছেন। শারমায়া ক্লাসে চলে এসেছে। দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দুই শিফটে কোচিং চলে। প্রথম শিফটে মেয়েরা, দ্বিতীয় শিফটে ছেলেরা৷ কারণ এখানে ক্লাস করা শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই অন্যত্র চাকরি করে। আশরাফ স্যার দুপুর ১টায় কলেজের ক্লাস শেষ করে কোচিং-এ আসেন।
শারমায়া ক্লাস তো করলো কিন্তু কিছুই বুঝলো না। কারণ সকলেই অনেক এগিয়ে। যার ফলে তাদের সাথে পাল্লা দেওয়া তার জন্য কষ্টকর হয়ে উঠেছে! তারা সবাই স্যারদের সাথে সাথে রেসপন্স করছে আর সে হা করে শুধু এদিক সেদিক তাকাচ্ছিলো। এখন মনে হচ্ছে শুরু থেকেই আসা উচিত ছিলো! কেনো যে রেস্ট নিতে গেলো!
মেয়েদের শিফট শেষ হলে আশরাফ স্যার তাকে ডেকে দুজন সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শারমায়া সালাম দিয়ে শুধু প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিলো। অতঃপর স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। রিকশায় বসে ভাবছে আর নিজের উপর বিরক্তবোধ করছে। কেননা আজ সারাটাদিন কেমন নিরামিষ কাটলো। সকাল থেকে কোচিং-এর চিন্তা করতে করতে সাফওয়ানার সাথে তার দুষ্টুমিও চললো না। আর কোচিং-এ আসার পর থেকে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা প্রাণী মনে হচ্ছিলো! পুরো পৃথিবী চতুর, কেবল সে-ই বোকা! আগে তো কখনো এমন হয়নি! এই বিয়ে নামক শব্দটাই কি তাকে বোকা বানিয়ে দিচ্ছে? যখন তখন এতো লজ্জা কেন চলে আসে! তাহলে তো সাফওয়ানার কথামতো সে ললিপপই হয়ে যাবে! ধ্যাৎ! এমন লাইফ কি এনজয় করতে ভালো লাগে! সর্বদা মন হওয়া চাই চাঙ্গা। তাই রাস্তায় চলতে চলতেই ঠিক করে নিলো বাসায় ফিরে সাফওয়ানার সাথে তুমুল ঝগড়া করবে। এতে যদি মনটা একটু ফুরফুরে হয়!
যেই ভাবা সেই কাজ। বাড়িতে ফিরেই শুরু হলো ঝগড়া,
“সাফু, তুই আমার ব্রেসলেট ছিড়েছিস কেন?”
“ব্রেসলেট! কোন ব্রেসলেট?”
“ওই যে, পিংক এন্ড হোয়াইট পার্পলের কম্বিনেশনে যেটা কিনেছিলাম।”
“ওইটা? ওইটা তো ঈদেরদিনই ছিড়ে ফেলেছি। বকাও তো দিলা ইচ্ছেমতো। আজ কেন তুলছো আবার?”
“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই তুলেছি! আমার ব্রেসলেট দে এখন।”
সাফওয়ানা রহস্যজনকভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“সত্যি করে বলোতো তুমি কার কাছ থেকে ব্রেসলেট চুরি করেছো?”
“মানে!”
“মানে, আমি নিশ্চিত তুমি কারো কাছ থেকে চুরি করেছো। আর নয়তো তোমার কোনো ফ্রেন্ড তোমাকে রাখতে দিয়েছিলো তুমি তারটা ব্যবহার করা শুরু করেছো। আর আজ নিশ্চয়ই সে চেয়েছে তোমার কাছ থেকে আর তুমি ফেঁসে গেছো। আর এখন ফেঁসে যাওয়ায় আমার গলায় ছুরি ধরছো।”
“আমি তোর গলায় ছুরি ধরেছি?”
“তা নয়তো কি? পরতে গেছি, ছিড়ে গেছে। বকা দিছো, অনেক কষ্টে হজম করে নিয়েছি। এখন আবার সন্ধ্যা বেলায় সকালের রোদ চাইছো, আমি কোথা থেকে এনে দিবো! রাস্তায় কোন পাগলের সাথে জানি ধাক্কা খেয়ে আসছে, এখন আমার উপর ঝাল তুলে!”
“আমি পাগলের সাথে ধাক্কা খাইছি? তুই একটা পাগল। মহা মহিলা পাগল। পৃথিবীতে একমাত্র তোর সাথেই আমার ধাক্কা লাগে।”
“আমি সারাদিন বাসায় ছিলাম। তুমি দেশান্তর ঘুরে আসছো আর পাগলের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে এসেছো। ছি! পাগলের গন্ধ বের হইছে, গোসল করো গিয়া পাগল ছাগল।”
“তুই এক মিনিট দাঁড়া, তোকে পাগলের রূপ দেখাচ্ছি।”
কথাটা বলে শারমায়া রুমে এসে ব্যাগ রেখে বোরকা ও হিজাব খুললো। অতপর চলে গেলো কিচেনে। শারমিন তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“ক্লাস কেমন করলি?”
“মা, ক্লাস আজ জঘন্য ছিলো যা তোমার মেয়ের মাথা স্পর্শ করতে পারলেও মগজ স্পর্শ করতে পারেনি।”
“মানে?”
“এখন কোনো প্রশ্ন করো না। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পরে দিবো। আগে ওই বান্দুরীকে শায়েস্তা করে আসি।”
বলতে বলতে শারমায়া ছুরি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। শারমিন পেছন থেকে ডেকে সাবধান করে দিলেন যাতে কোনো ঝগড়াঝাটির সৃষ্টি না করে। তাহলে আজ দুইটাকেই মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবে। শারমায়া সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা চলে এলো ড্রয়িংরুমে।
“আমি পাগল, তাই না? আমি তোর গলায় ছুরি ধরেছি? এইবার বুঝবি ছুরি ধরার মজা।”
বলতে বলতে শারমায়া সাফওয়ানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতে ছুরি দেখে সাফওয়ানা চিৎকার করে সোফায় উঠে গেলো। শারমায়া কাছে আসতেই সে লাফিয়ে অন্য পাশ দিয়ে নেমে দৌড়ে চলে গেলো নিজেদের বেডরুমে। পিছু পিছু ছুটলো শারমায়া।
“পালাস কেন এখন? আয় সাহস থাকলে। আমি পাগল, না? তুই পাগল। আস্ত একটা অভদ্র মহিলা পাগল। আমি, আব্বু, আম্মু বাদে তোর চৌদ্দগুষ্টি পাগল।”
বলতে বলতে দুজনই কখনো খাটের উপর, কখনো মেঝেতে দৌড়াদৌড়ি, কখনো কাথা বালিশ ছুড়াছুঁড়ি, কখনো বা চেয়ার ঠেলে ধাক্কাধাক্কি! এরইমাঝে হাতে খুন্তি নিয়ে মায়ের আগমন। তা দেখে দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে একজন বাথরুমে পালিয়েছে আরেকজন খাটের কোণে গায়ে কাথা এঁটে! শারমিন রাগান্বিত গলায় বললো,
“ফাজিলের বাচ্চারা, শুরু করেছিস কি এসব? বাইরে থেকে এসেছিস, হাতমুখ ধুয়ে কিছু মুখে দিবি তা না করে সারাদিন খোঁচাখুঁচি! ফোনটা যে কখন থেকে বেজে যাচ্ছে, কানে ঢুকে না?”
কথা বলে তিনিই ফোন রিসিভ করার জন্য বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। কল আসায় আজ তাদের রক্ষা, নতুবা খুন্তির আঘাত পড়তো নিশ্চিত! সেই ভেবে দুজনেই দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো। সাফওয়ানা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে শারমায়া ছুরি রেখে বাথরুমে গেলো হাতমুখ ধোয়ার জন্য। ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই দেখলো ফোনে কথা বলতে বলতে মা প্রবেশ করছে। মায়ের এই এক স্বভাব, সবসময় ফোন লাউডস্পিকারে রেখে কথা বলে। কানের কাছে নিলে নাকি ব্রেইনের ক্ষতি হবে!
“এইতো কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে।”
“ওহ্, আচ্ছা। কি করছে এখন?”
“আর বলো না, দুইজন একসাথে থাকলে সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটি। বাসায় ফিরেই কি নিয়ে যেনো লেগে গেছে খোচাখুচি।”
“বোন থাকলে এমন হয়ই আন্টি। আজ একা বলে সেই মজা গুলো খুব মিস করি। শারমায়ার সাথে কথা বলা যাবে?”
” হ্যাঁ, দিচ্ছি। নাও, কথা বলো। শারমায়া, জেভা কল করেছে।”
শারমায়া তোয়ালে রেখে মায়ের হাত থেকে ফোন নিলো। শারমিন চলে গেলো, সাফওয়ানা এলোমেলো সামগ্রী নির্ধারিত জায়গায় গুছিয়ে রাখছে। শারমায়া হালকা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলো অতপর সালাম দিলে মনে হলো ওপাশ থেকে সালামের জবাবে পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো। কিন্তু মা তো বলে গেলো জেভা। এতোক্ষণ চেচামেচি করার কারণে বোধহয় কানে জ্যাম লেগেছে তাই সে দ্বিতীয় উক্তিতে বললো,
“কেমন আছেন, আপু?”
তার প্রশ্ন শুনে এদিকে সাফওয়ানা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আর ওপাশ থেকে তিন-চার সেকেন্ড পর জবাব এলো,
“শারমায়া, আমার কণ্ঠ কি মেয়েদের মতো শুনতে? সিরিয়াসলি আজ প্রথম মনে হচ্ছে আপুর কণ্ঠের সাথে আমার কণ্ঠের মিল রয়েছে।”
শারমায়া দাঁতে দাঁত চেপে ই… করে আছে। এইমুহূর্তে তার অবস্থা “দম আটকে আটকে যায়, তবুও শ্বাস চলে!” আর ওদিকে সাফওয়ানা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here