হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
২৯.
রোশন আরা চিকন স্বরে বললেন,
“ঘরে চল। কথা আছে।”
হিমি জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়লো। প্লেইট তাকে রেখে রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে রোশন আরার পেছনে চললো। রোশন আরা হিমির ঘরে ঢোকে অস্থির ভঙ্গীতে খাটে বসলেন। হিমি ধীর পায়ে ঘরে ঢোকলো। রোশন আরা স্মিত গলায় বললেন,
“দরজা লাগিয়ে আয়।”
হিমি ওনার কথা মতো দরজা লাগালো। জড়সড় হয়ে রোশন আরার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“আসলে মামী খুব খিদে পেয়েছিলো। তাই! আর হবে না। তুমি প্লিজ মামানিকে বলো না কিছু। আমি এখন থেকে বাইরেই খেয়ে আসবো নয়তো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো। সত্যি বলছি।”
রোশন আরা বিরক্তি গলায় বললেন,
“তোর কোনো বিষয় নিয়ে চর্চা করতে আসি নি আমি। আমার কথার উত্তর দে।”
হিমি মাথা দুলালো। রোশন আরা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললেন,
“তোর ওই মামাতো ভাই, নিহান, ও সত্যি বলছিলো?”
হিমি রোশন আরার কথার তাৎপর্য বুঝলেও না বুঝার ভান ধরে বললো,
“কোন কথা মামী?”
“আরে ওই যে বললো না, ভালোবাসে। ওকথা সত্যি?”
হিমি ইচ্ছাকৃত অবাক হয়ে বললো,
“কাকে বলেছে?”
“আমাদের সবার সামনেই বলেছে। দুপুরে গেছিলাম ও বাড়ি। তুই ছিলি না। এখন আমার কথার উত্তর দে। ছেলেটা সত্যি বলেছে না কি,,,,”
হিমি ঠোঁট টিপে হাসি আটকে বললো,
“বলেছে যখন তখন সত্যিই হবে। অবশ্য আমাকেও বলেছে এ কথা। এসব কেনো জানতে চাইছো মামী?”
“দরকার আছে তাই। আচ্ছা, ছবিগুলোও কি নিহানের?”
হিমি ধাতস্থ হলো। ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বললো,
“নিহানকে জিজ্ঞেস করো নি তোমরা?”
রোশন আরা হ্যা সূচক মাথা দুলালেন। হিমি প্রশস্ত হেসে বললো,
“ওর উত্তর হ্যা হলে হ্যা না হলে না। আমায় জিজ্ঞেস করার কোনো কারন তো দেখছি না।”
“তোকে জিজ্ঞেস করতেও চাই নি। নেহাত দুজনকেই তুই চিনিস তাই।”
রোশন আরার ঝাঁঝ মেশানো গলায় আওয়াজে হিমির কোনো ভাবাবেগ হলো না। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বালিশ টেনে উপুর হয়ে শুয়ে পরলো সে। রোশন আরা চমকে উঠে বললেন,
“শুয়ে পরলি যে?”
ঘুমু ঘুমু গলায় হিমির জবাব,
“ঘুম পাচ্ছে মামী। তোমার তো কথা বলা শেষ। যাওয়ার সময় লাইট অফ করে দরজা ভেজিয়ে যেও। (হাই তুলে) গুট নাইট!”
রোশন আরা চোয়াল শক্ত করে তাকালেন। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। গলা কেশে বললেন,
“আমার মনে হচ্ছে তুই মিথ্যে বলছিস! মিশু যে ইয়াসিরকে ভালোবাসে সেটা কিন্তু আমি জানি হিমি। শুধু শুধু মিথ্যে বলে সব কিছু আড়াল করার চেষ্টায় বড় কোনো বিপদ ঘটাস না।”
হিমি বালিশে নাক মুখ গুঁজে রেখেই বললো,
“তাহলে মামানিকে গিয়ে বলে দেই ছবি গুলো ওনার জামাইয়ের? মিশ্মি অথৈর বরকে ভালোবেসে পাগল প্রায়?”
আঁতকে উঠা গলায় রোশন আরা বললেন,
“এসব কি বলছিস? আপা জানলে আমার মেয়েটাকে যে কি করবে কে জানে? আর অথৈ! সবে বিয়ে হয়েছে। বোনের সাথে সম্পর্ক যে একবারে শেষ হয়ে যাবে রে হিমি!”
হিমি চোখ বোজে রেখেই ক্ষীণ গলায় বললো,
“সেই জন্যই তো মিথ্যেটা বললাম। মিশ্মি যখন আগেই ইয়াসির থেকে সরে এসেছে তখন ওর স্মৃতি আর আবেগ থেকেও সরতে হবে। আর এজন্য ওকে বিয়ে করতে হবে। যাকে তাকে বিয়ে করার চাইতে ভালো তো আমাদের নিহানই। আর যাই হোক আমার এক কথায় মিশুর কথা ভেবে মিথ্যে বলতে রাজি হয়ে গেছে। ট্রাস্ট মি মামী, এই ছেলে আমাদের থুক্কু তোমার মিশুকে অনেক খুশি রাখবে। ভালোও রাখবে। ভেবে দেখতে পারো, আফসোস না হয় পরে!”
রোশন আরা হিমির কথাগুলো মনে মনে ভাবলেন। গালে গড়িয়ে পরা জ্বল হাত দিয়ে মুছে লম্বা ঘন শ্বাস টানলেন। অস্বস্তি নিয়েই বেরিয়ে গেলেন। লাইট বন্ধ করলেন না। দরজা ভেজালেন না। হিমিও উঠে নি। যেমন করে শুয়ে ছিলো তেমন করেই ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেছে।
******************
ক্রিম কালারের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো দোহা। চুল খোপায় মোড়ানো তার। কানে গলায় পাতলা অলংকার। হাতে বড় মোটা দুই বালা। বাম হাতের অনামিকা আঙুলে স্বর্ণের আঙটি। কাধের ব্যাগ টায় বই নেই। এক গাদা ইনভিটেশন কার্ড। বন্ধুদের আর পরিচিত কয়েকজনকে বিয়ের দাওয়াত দিতেই আজ এসেছে সে। সাথে এসেছে তার হবু বর আমিন। গায়ে বেগুনী রঙের শার্ট। পরনে কালো জিন্স। সু স্বাস্থ্যের অধিকারি হলেও ভুরি নেই। সুঠাম দেহীই মনে হবে দেখলে। ওরা দুজনেই রেস্টুরেন্টে ঢুকে কাঙ্খিত মানুষদের খুঁজছিলো। কর্নারের একটা টেবিলে অধীর আগ্রহে বসে ছিলো দোহার পাঁচ বন্ধু। দোহাদের দেখেই সূর্য হাত তুলে ইশারা করে উঠে দাঁড়ালো। সূর্যের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই সেদিকে দেখলো। দোহা অর আমিনকে দেখে মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়ালো সবাই। দোহা ভ্রু নাচিয়ে এগুতে এগুতে বললো,
“কেমন আছিস তোরা?”
তারা কেউ জবাব দিলো না। স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে দোহা দেখলো। চোখে মুখে তার উপচে পরা খুশি। মেঘ মৃদু গলায় বললো,
“তুই কেমন আছিস সেটা বল! এতোদিনে তবে মনে পরলো আমাদের সাথে দেখা করার কথা? তাও আবার বিয়ের দাওয়াত দিতে?”
দোহা মৃদু হাসলো। বললো,
“সরি গাইস। দরকার ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়ারও স্কোপ নেই। তাই দেখা করতে পারছি না।”
কথাটা বলে দোহা তার হবু স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো বন্ধুদের। আমিন সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। বড় এক কোম্পানিতে কাজ করছে। উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের বলা চলে। আলাপ চারিতা শেষে সবাই চেয়ার টেনে যার যার জায়গায় বসলো। অর্ডার কৃত খাবার চলে আসায় খাওয়া দাওয়ার সাথে সাথে গল্প গুজব হলো খানিক। আমিন ভীষন মিশুক টাইপ হওয়ায় সবার সাথেই অল্পতে মিশে গেছে। কথা বার্তায় শিশুসুলভ আচার আচরণ স্পষ্ট। নির্দ্বিধায় লোকটি মার্জিত স্বভাবের, ভদ্র। বেশ অনেকক্ষন কথা বার্তার পর দোহা ব্যাগ থেকে ইনভিটেশন কার্ড বের করে বন্ধুদের দিলো। বিয়ের কদিন আগেই সবাইকে যেতে অনুরোধ করলো তারা। সবাই যদিও মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়েছে তবে তারা এখনো ঠিক করে নি কিছু। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই বেরিয়ে গেলো তারা। বাকিরা বসে রইলো চেয়ারে। এখনো বিল দেয়া বাকি। সূর্য আগেই বড় গলায় বলেছে এই ট্রীট ওর তরফ থেকে। খাওয়ার বিলটাও ও একা পরিশোধ করবে। খাওয়ার শেষে বিল দেখে চক্ষু চড়কগাছ তার। মানিব্যাগে পাঁচশো টাকাও নেই তার। একটাই উপায় এখন। সবার পকেট হাতড়ে টুকটাক যা মেলে তাতেই বিল মেটাতে হবে বন্ধুদের। ইমন ঢেকুর তুলে বললো,
“আমার কাছে পাঁচশ আছে মামা। হিমি? তোর কাছে?”
হিমি হতাশ গলায় বললো,
“দুশো পঁচাত্তর!”
সোহিনী মুখ গোমরা করে দেড়শো টাকা বের করে বললো,
“আগে খেয়াল করবি না টাকা আছে কি নেই? আহাম্মক!”
সূর্য মুখ কালো না করে উল্টো ধমক দিয়ে বললো,
“চুপ কর তো। সবাই মিলেমিশে খেয়েছি তাহলে টাকাও সবাই মিলেমিশে দেবো। এতে ভালোবাসা বাড়ে। জানিস না! গাধী!”
মেঘ কিছু টাকা দিলো। সবকিছু মিলিয়েও রেস্টুরেন্টের বিল থেকে দুশো টাকা কম হলো। সবার মাথায় হাত। সোহিনী জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও ব্যাগের চেইন খুললো। হাত মুঠো করে টেবিলের উপর রাখলো কিছু। হিমি কৌতুহলী চোখে সেদিকে দেখেই বললো,
“হয়েগেছে।”
সূর্য কিঞ্চিত রাগ নিয়ে বললো,
“এই দুশো টাকা আগে কই রাখছিলি বেদ্দপ? আগেই বাইর কইরা দিলে এখন মাথা চাপড়ানো লাগতো আমাগোরে। কিপ্টা মহিলা!”
চলবে,,,,,,,,,,,,