হিমি পর্ব-৫৯

0
839

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৫৯.

মোজাম্মেল সাহেবের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছে তাহির। সাড়ে চার বছরের বাচ্চা মেয়ের মাথায় বিশ্রী কথাটা ঢোকাতে সামান্য বাধে নি মহিলার? ‌ওনার একটা কথায় হিমির মনে কি প্রভাব ফেলেছে তাও কি তিনি দেখেন নি? অবাক হয় তাহির। এদের সাথেই কি এতোগুলো বছর কাটিয়েছে হিমি। কি করে পারলো? দমবন্ধ লাগে নি?

“আচ্ছা তুমি সত্যিই বুঝো নি হিমির ভালোবাসা?”

মোজাম্মেল সাহেবের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো তাহির। কি বলবে ভাবতে লাগলো সে। কিছুক্ষন থম মেরে থেকে পরে বললো,

“কিছুটা হয়তো বুঝেছি।”

শব্দ করে হেসে উঠলেন মোজাম্মেল সাহেব। ওনার হাসির শব্দে চমকালো তাহির। ভয়‌ও পেলো বেশ। মোজাম্মেল সাহেব হাসি থামিয়ে গলা ক্ষীণ করলেন। বললেন,

“মনের ডাক্তার হয়ে মনের কথা বুঝো না তা তো হতে পারে না। তোমার কাজ‌ই হলো মানুষের মন বুঝা। প্যাশেন্টের চোখ দেখে তার ভেতরে কি চলছে সেটা ঠাহর করা। অথচ এক‌ই ছাদের নিচে থাকা মানুষের মন বুঝতে পারলে না? অবিশ্বাস্য! তাহলে আমি ধরে নিচ্ছি তুমি ইচ্ছে করে বুঝতে চাও নি। এড়িয়ে গেছো।”

“আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমি এড়িয়ে যাই নি কিছুই। যতোটা দেখেছি উপলব্ধি করেছি তাতে বুঝতে পেরেছি হিমির মনে আমার জন্য একটা জায়গা আছে। হিমি আমার কাছে অনেক কিছু আশা করেন। তবে যেহেতু নিজ থেকে বলেন নি সেহেতু আমি‌ও না বুঝার ভান করি। ভুল করি?”

মৃদু হাসলেন মোজাম্মেল সাহেব।

“না। ভালোই করো। কিন্তু এসবের মধ্যে নিজের মন বুঝার সময় পাও না? সময় পেলে একবার বুঝার চেষ্টা করো। আশা করি বুঝবে। যে কথাটা হিমি বলে নি সে কথা তুমি বলতে পারবে না তেমন কোনো নিয়ম নেই। চাইলে তুমি‌ই বলতে পারো।”

“বুঝলাম না।”

“আমি জানি তোমার মন বুঝার ক্ষমতা অন্যের থেকে বেশি। এরপর‌ও যখন বুঝছো না তখন সহজ করে বলি। যার সাথে তোমার বিয়ে হ‌ওয়ার কথা ছিলো সেই মেয়েটা পালিয়ে যাওয়ার পর তোমার রেগে থাকার কথা ছিলো, অপমানিত বোধ করার কথা ছিলো। কিন্তু তুমি খুশি হয়েছিলে। আবার যখন হিমির সাথে তোমার বিয়ের কথা হচ্ছিলো তখন হিমি যতোটা মানা করছিলো তুমি ততোটাই সায় দিচ্ছিলে। আমি তখন‌ই বুঝে গেছি। উইকেট পরে গেছে। তুমি ভালো অভিনয় জানো মনের ডাক্তার। এমন একটা ভাব করলে যেনো বেয়ানের কথা ভেবে বিয়েটা করেছো। সত্যিটা তো হলো তুমি অনেক আগে থেকেই হিমিকে ভালোবাসতে। হয়তো প্রথম আলাপ থেকেই!”

নিঃশব্দে হাসলো তাহির। হাসিটা লজ্জার। আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললো,

“আপনি সাইকোলোজি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন?”

“চুরি ধরেছি তবে?”

“ঠিক তা নয়। উইকেট কখন পরেছে তা বলতে পারছি না। তবে বিয়ের কয়েকদিন আগেই উপলব্ধি করতে পারছিলাম হিমি ছাড়া চলবে না। হয়তো কথা বলার তাগিদেই ওনাকে চেয়েছিলাম।”

“কক্ষনো না। কথা বলা তো বাহানা ছিলো। মূখ্য তো ছিলো একে অপরের কাছে থাকা।”

“উহুম ব্যাপারটা ভিন্ন। আপনি গোলমাল করে ফেলছেন।”

“তোমরা যে তালগোল করেছো তারমধ্যে এসব কিছুই না।”

আবার‌ও হাসলো তাহির। প্যান্টের পকেটে হাত পুরে ব্যালকনির দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“হিমি ঘুমাচ্ছেন। আর বেশি কথা বলা যাবে না। ঘুম ভেঙে যাবে নাহলে।”

“আই লাইট ইট! ‌দিছ ইজ কল কেয়ার ফর ওয়াইফ। ঠিক আছে রাখছি আমি। আর বিরক্ত করবো না।”

তাহির ফোন কেটে দিতে নিলে বলে উঠলেন মোজাম্মেল সাহেব,

“ওহ হ্যা! আরেকটা কথা। আমি সাইকোলোজি নিয়ে পড়াশোনা করি নি। প্রেম নিয়ে পড়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুরা আমাকে প্রেম বিশেষজ্ঞ বলে সম্বোধন করতো। সবার প্রেমের সমস্যার সমাধান দিতাম আমি। তোমার এই বিষয়ে কোনো হেল্প চাইলে আমায় জানাতে পারো। আই অ্যাম অলোয়েজ দেয়ার ফর লাভ বার্ডস!”

কথাটা বলেই হাসলেন তিনি। আমিনা বেগম খাটে আধশোয়া হয়ে গরম চোখে তাকালেন। খ্যাট খ্যাটে গলায় বললেন,

“এই লোকটার জন্য মাঝরাতেও শান্তি নেই। খালি খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। এই তোমার ঘুম না পেলে বাইরে যাও তো। এভাবে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে আমার ঘুম নষ্ট করছো কেনো?”

মোজাম্মেল সাহেব গলা পরিষ্কার করে বললেন,

“আমার প্রেমিকা ক্ষেপে গেছে বুঝলে! এখন রাখি।”

তাহির ফোন কেটে আপন মনেই হাসলো। ঘরে যেতে গিয়েও ফিরে এসে রেলিংএ ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। বুক ধরফর করছে তার। তলপেটে শির শির অনুভব হচ্ছে। নির্জনে কিছুসময় পার করে নিজেকে স্বাভাবিক করে তারপর ঘরে ঢোকলো সে। নিজের জায়গায় শুয়ে পাশ ফিরে হিমির দিকে তাকালো। ঘুমন্ত হিমির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ লেগেছে সে খেয়াল ছিলো না তার। ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হতে থাকা তাহিরের স্বপ্নে হিমির বিচরণ তার ঠোঁটে হাসি ফুটাচ্ছে। সকালের মিহি রোদ যখন ব্যালকনি পেরিয়ে শোবার ঘরের খাটে হামাগুড়ি দিচ্ছে তখন চোখ খোলে হিমিকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভড়কে যায় তাহির। ঝটপট করে উঠে বসতেই দেখলো হিমি নিজেও বেশ লজ্জায় পরে গেছে। এবং সেই লজ্জা থেকে বাঁচতে ফ্রেশ না হয়েই দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে গেলো।

___________________

দুপুরের রান্না শেষ করে সবে গোসলে ঢোকেছে মিশ্মি। এর মধ্যেই বাড়ি ফিরেছে নিহান। এসেই শুরু করেছে মিশ্মিকে ডাকাডাকি। রাদিবা হাতের কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন ছেলের ঘরে। আলমারি থেকে কাপড় বের করে দিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখলেন। বিয়ে হয়েছে দু মাস, এর মধ্যেই ব‌উয়ের আঁচল ধরা শিখে গেছে। দিন নেই রাত নেই খালি ব‌উ আর ব‌উ। নতুন কাজে জয়ন হয়েও দুপুরে ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে কি করে নিহান? ভেবে পান না তিনি। বিশেষ কিছু বলাও যায় না। একবার বলেছিলেন, ‘দুপুর বেলা কাজ ফেলে বাড়ি ফিরিস কেনো তুই? তোর ব‌উ কি পালিয়ে যাচ্ছে?’ জবাবে নিহান বলেছিলো, ‘পালাবে কেনো? ও আমার ব‌উ। আমার কাছে থাকবে। আমি ওর সাথে সময় কাটাতে আসি। বাবা আর তোমার বিয়ের পর বাবা এমন করে নি? জ্যাঠুমনি তো বলেছিলো বাবা না কি কাজেই যেতে চাইতো না।’ ছেলের এমন বেফাঁস কথা শুনে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো রাদিবার। কিছু বলার জো ছিলো না। ছোট হলে বলতেন। মারতেন‌ও হয়তো। কিন্তু এখন তো আর সে ছোট নয়। বড় হয়েছে। বিয়ে করেছে। এখন তাকে মারা যাচ্ছে না। মিশ্মি ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই মুখ ঝামটা দিলেন রাদিবা। বললেন,

“স্বামীর কাজের ক্ষতি হচ্ছে কি না সেটা ভাবার দরকার নেই? ও এলেই আদিখ্যেতা করতে লেগে পরো কেনো তুমি? বলতে পারো না যেনো অসময়ে বাড়ি না আসে? চক্ষুলজ্জা বলতেও তো একটা ব্যাপার আছে!”

মিশ্মি প্রত্যুত্তরে মাথা নিচু করলো। নিহান কিছু বলতে নিলে ঘর থেকে প্রস্থান করলেন রাদিবা। মিশ্মি কিছুটা শক্ত গলায় বললো,

“এই সময়ে কেনো বাড়ি আসেন বলুন তো আপনি? নাইন টু ফাইভ জব আপনার। হুটহাট ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবেন না। আমার এসব ভালো লাগে না। আপনার জন্য আমার‌ও কথা শুনতে হয়।”

নিহান এগিয়ে এলো। মুখ ছোট করে বললো,

“রোজ তো আসি না মিশ! মাঝে মাঝে,,,”

“সেটাই বা কেনো করবেন? আপনার বস কিছু বলে না? তাহলে বস হয়েছে কেনো ওই লোক? এম্প্লোয়ি যখন তখন কাজ রেখে বাড়ি চলে যায় আর লোকটা আটকায় অব্দি না!”

“কাজ থাকে না বলেই তো আসি। নাহলে কি বস আসতে দিতো বলো? আর কাজ থাকলে তো আমি তোমার ফোনটাও রিসিভ করি না। দেখো না?”

“খুব দেখি! আমি শেষবারের মতো বলছি কাল থেকে অফিস আওয়ারে আপনি বাড়ি আসবেন না। যদি আসেন তাহলে আমি বাপের চলে যাবো। আর কক্ষনো ফিরবো না।”

নিহান মিশ্মির হাত মুঠোয় পুরে কাছে টানলো। মিশ্মি হাত মুচড়ে ছুটানোর চেষ্টা করছে। তাতে ঘোর বিরোধীতা করে বুকের মধ্যে মিশ্মির হাত পিষ্ট করে কোমর জড়িয়ে ধরলো নিহান। বাঁকা হেসে বললো,

“গিয়ে দেখাও একবার। তোমার কি হাল করি দেখবে তখন!”

“এ্যাহ, আপনি আমার কি হাল করবেন? মারবেন? হাহ,,,আমিও পুলিশ কম্প্লেইন করবো। বধূ নির্যাতনের কেইস করবো।”

হাসলো নিহান। বললো,

“ধূর বোকা। আমি তোমায় মারবো কেনো? ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসাতেই তোমার হাল বেহাল করবো। বাপের বাড়ি তো দূরের কথা প্রতি সেকেন্ডে চোখে হারাবে আমায়!”

মিশ্মি সরু চোখে তাকালো। সাথে সাথেই টুপ করে কপালে চুমু খেলো নিহান। দুষ্টু হেসে বললো,

“আমার চরিত্র খারাপ হয়ে যাচ্ছে মিশ। দরজা খোলা রেখে ব‌উয়ের সাথে রোমান্স করছি। কেউ দেখে ফেললে,,,, ছিহ,,,,,!”

মিশ্মি হেসে ফেললো। নিহানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,

“এসেই যখন পরেছেন যান ফ্রেশ হয়ে নিন। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে।”

নিহান মাথা নেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়ে আবার‌ও চুমু খেলো মিশ্মির গালে। মিশ্মি আলতো হাতে নিহানের বাহুতে চড় লাগালো। সরে এসে অগোছালো বিছানা ঠিক করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। নিহানকে এখনো ভালোবাসতে পারে নি মিশ্মি। তবে শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে। স্বামী হিসেবে নিহানকে ভালোবাসতে চায়। তার মনে ইয়াসিরের জন্য যে জায়গা ছিলো তা ফাঁকা হয়েছে তাদের হলুদের সন্ধ্যায়। যখন ইয়াসির মিশ্মিকে হলুদ লাগাতে গিয়ে কয়েকটা কথা বলেছিলো। সেই কথাগুলোই মিশ্মি ইয়াসিরকে চিরকুটে লিখেছিলো। ইয়াসিরের হাসি, কথা বলার ধরন, ভাবভঙ্গী আর মিশ্মির লিখা কয়েকটা লাইন শুনেই মিশ্মি বুঝে গেছিলো ইয়াসিরের নিষ্ঠুরতা।

ইয়াসির জানতো মিশ্মিই সেই মেয়ে যে তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। রোদ বৃষ্টির মধ্যে যে মেয়ে তাকে ফলো করে। লুকিয়ে ছবি তুলে। চিরকুট লিখে ভালোবাসা জানায়। তবুও সে অবজ্ঞা করে গেছে মিশ্মিকে। সব জেনে শুনে মিশ্মির‌ বোনকেই বিয়ে করেছে সে। শুধুই কি মিশ্মির ভালোবাসার অপমান করতে? হয়তো! মিশ্মি সেদিন থমকে গেছিলো। ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। প্রবল অপমানে চোখে নোনা জল জমেছিলো। সে শক্ত হয়েছে। নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। কারো অনুভুতির অপমান করার মতো বিশ্রী অপরাধ পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না (নৌশিন আহমেদ রোদেলা)। ইয়াসির এই অপরাধ জেনে বুঝে করেছে। মিশ্মির মন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। যার ব্যক্তিত্বের মায়ায় আটকে গেছিলো, সে মানুষটা যে কতোটা নিকৃষ্ট তা বুঝতে পেরেই মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো মিশ্মির। কখনো আবার ইয়াসিরকে খুন করে ফেলতে মন চাইছিলো। শেষমেষ নিহানকে আপন করে জীবনে এগিয়ে যাওয়াটাকে গ্রহণ করে নিয়েছে মিশ্মি। নিহানের সাথে সুখে থেকে ইয়াসিরকে ভুলতে পারার মতো প্রতিশোধ আর হতে পারে না ইয়াসিরের অপমানের। মিশ্মি চোখ বোজে ঠোঁটে হাসি ফুটায়। বন্ধ চোখ জোড়া খোলে নিহানকে দেখে সে। ভেজা চুলে হাত ডুবিয়ে ভ্রু নাচায় নিহান। মিশ্মি হঠাৎ‌ই কি ভেবে কাছে আসে নিহানে। নিজ হাতে নিহানের চুল মুছে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। নিহান অবাক হয়। এই দুই মাসে মিশ্মি কখনোই নিজ থেকে কাছে আসে নি তার। জড়িয়ে ধরার প্রশ্ন‌ই উঠে না। নিহানকে অবাক হ‌ওয়ার আরো একটা সুযোগ করে দেয় মিশ্মি। নিহানকে ছেড়ে তার ঠোঁটের কাছে ছোট্ট চুমু দিয়ে মিষ্টি করে হাসে মিশ্মি। কোনো প্রকার তাড়াহুড়া না করে ধীর পা ফেলে ঘরের বাইরে পা রাখে। নিহানের বিস্ময় এখনো কাটে নি। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলো সে। ভাবলো মিশ্মির ভেতর কোনো আত্মার প্রবেশ হয় নি তো!

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here