হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৬২.
পুরো পরিবার সমেত সোহিনীর বাড়ি গিয়ে উঠেছে মেঘ। তখন সবে গালে হলুদের প্রস্তুতি চলছে। হুট করে অচেনা মানুষদের দেখে মনে কৌতুহল জাগে গ্রামের মানুষদের। সোহিনী এগিয়ে এসে মেঘের পরিচয় জানায় সবাইকে। এও বলে যে সে মেঘকেই বিয়ে করবে। গ্রামে হুলুস্থুল পরে যায়। ‘সোহিনী শহর থেকে ছেলে আনিয়েছে’ কথাটা যেনো বাতাসের ন্যায় ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। যাদের বিয়েতে আসার কথা ছিলো না তারাও এসে উপস্থিত হয়। সোহিনীর বাবা মা পরেছেন ব্যাপক অস্বস্তিতে। গ্রামের যে ছেলের সাথে সোহিনীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সে দলবল নিয়ে আসছে শুনেই কাঁপাকাঁপি শুরু হয় সোহিনীর বাড়ির সকলের। তবে মেঘ তাদের আশ্বস্ত করে। বেশ অনেকক্ষন সময় নিয়ে সোহিনীর বাবা মায়ের সাথে কথা বলে বুঝাতে সক্ষম হয় সোহিনীর সাথে তার বিয়ে হওয়াটাই উচিত। অতঃপর মেঘের বাবা মাও গ্রামের পঞ্চায়েতে অংশ নেন। কথা বার্তা, আলাপ আলোচনা সিদ্ধান্ত এটাই দাঁড়ায় যে বিয়ে হবে আজ রাতে। সন্ধ্যের আগে আগে হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হতে হবে। ততক্ষনে বর রেগে আগুন। সে কিছুতেই পিছপা হচ্ছে না। গুরুজনরা প্রচুর বুঝিয়ে শেষে কাজ না হওয়ায় পঞ্চায়েত থেকে নির্দেশ দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের। এর মধ্যেই অবশ্য নতুন কনের সন্ধান পাওয়া গেছে। আর আজ রাতেই তার বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। সোহিনী স্বস্তি পেলো। সোহিনীর বাবা মাও আশ্বস্ত। তাদের পছন্দ করা ছেলের থেকে মেঘ হাজারগুণ ভালো ভেবেই বুক থেকে বোঝা নামলো তাদের।
শুরু হলো হলুদের তোড়জোড়। মেঘের পুরো পরিবার সোহিনীর গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়িতে থাকবে বিয়ে অব্দি। বিয়ে শেষে কনে নিয়ে সোজা শহরে চলে যাবে। এতে কারো কোনো আপত্তি নেই। তাড়াহুড়ার মধ্যে হলুদের গোসল দেয়া হলো। মেঘ সময়ই পেলো না বন্ধুদের খবর দেয়ার। অথচ সন্ধ্যে হতে না হতেই দেখা পাওয়া গেলো সবার। পায়ে কাদা মাখামাখি করে চেয়ারম্যানের বাড়িতে উঠলো সূর্য। তার ঠিক পরেই দোহা আমিনের সাথে এসে উপস্থিত হলো। সোহিনী ফোন দিয়ে জানালো হিমি তাহির কনের বাড়ি পৌঁছে গেছে। বাকি ছিলো ইমন। ইমনের নাম্বার শুধু সূর্যের কাছে থাকায় সে জানিয়ে দিয়েছিলো মেঘ সোহিনীর বিয়ের কথা। চাঁদপুর থেকে ওই রাতেই সোহিনীর গ্রামে পৌঁছানো সম্ভব ছিলো না তার কাছে। ইচ্ছা সত্ত্বেও তাই আসে নি সে। তবে ফোনে খোঁজখবর নিয়েছে, বিয়ের শুভেচ্ছাও জানিয়েছে।
বন্ধুমহলের খুশি বাঁধনহারা। দুই বন্ধুর একে অপরের সাথে বিয়ে হওয়ার পর যেনো তাদের বন্ধুত্ব নতুন রুপ নিলো। ক্যাম্পাসে মেঘকে সোহিনীর বর, আর সোহিনীকে মেঘের বউ বলেই সম্বোধন করা শুরু হলো। পরীক্ষা ঝড়ের গতিতে কাছে আসছে তাদের। ইমন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। চাঁদপুর থেকে ফিরেছে সপ্তাহ দুই আগে। সুপ্তি অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় বাধ্য হয়েই তার পরিবার মেনে নিয়েছে বিয়েটা। যদিও উঠতে বসতে খোটার শেষ নেই! তবুও তারা ভালো আছে। ছোটখাটো একটা চাকরি পেয়েছে ইমন। আপাতত সেটাই করছে। বউ নিয়ে চলার মতো খরচ নিয়েই দিন কাটছে। এখানে আসার পর বন্ধুত্বে দূরত্ব কেটেছে। যখন তখন আড্ডা দিতে না পারলেও রাতে কাজ শেষে ঠিকই চায়ের দোকানে দেখা মিলছে তিন বন্ধুর। কখনো সেই আড্ডায় যোগ হচ্ছে সোহিনী। দোহা কলেজে ক্লাস করতে আসা ছাড়া আর কোথাও যাচ্ছে না। কলেজ ক্যান্টিনেই বন্ধুদের সাথে ফ্রী টাইমে আড্ডা দেয় সে। হিমি এখন প্রায় রোজই চলে আসে তাদের সাথে দেখা করতে। আধঘন্টা মতো বসে চা খাওয়ার ফাঁকে জম্পেশ গল্প করে। অতীতে হাতড়ে বেরায়।
সবকিছুই ঠিক ছিলো। এরমধ্যেই একদিন পাতলা গড়নের উনিশ বিশ বছর বয়সী এক মেয়ে এসে দাঁড়ায় তাহিরের বাড়ির দরজায়। তাহির সেদিন ডিউটির চাপে অস্থির। নাইট ডিউটি শেষ করে ভোরে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়েই ছুটেছে হাসপাতালে। হাসপাতালে এমার্জেন্সি হলে এমনটাই হয়, বলা নেই কওয়া নেই যেকোনো সময় ছুট লাগাতে হয়। তাহিরও তাই করে। এদিকে মেয়েটি এসেই খোঁজ করে তাহিরের। মায়মুনা দীর্ঘক্ষণ মেয়েটিকে দেখে বুঝতে পারলেন তিনি মেয়েটিকে এর আগে কখনো দেখেন নি। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগছে। মেয়েটির চেহারা ওনার চেনা পরিচিত কারো সাথে মিলে যাচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে সেই চেনা পরিচিত মানুষটা কে তা খুঁজতে গিয়ে। মেয়েটিকে দেখে অত্যন্ত ভয়ার্ত মনে হচ্ছিলো মায়মুনার। জিজ্ঞেস করেন কে সে? তাহিরের সাথে কি দরকার? প্যাশেন্ট কি না? বাড়িতেই কেনো এলো? তাহিরের চেম্বারে কেনো গেলো না হেন তেন। মেয়েটি একটা কথারও জবাব দিলো না। শুধু বললো,
‘ওনাকে ডেকে দিন না। উনি আমায় চেনেন।’
মায়মুনা হাল ছাড়লেন। তাকে ঘরে বসতে দিয়ে ফোন লাগান তাহিরকে। বললেন কোনো এক মেয়ে তাকে খুঁজছে। নাম, ধাম কিচ্ছু বলছেনা। তাহির হয়তো বুঝে গেলো কে হতে পারে। তাই কোনো প্রকার প্রশ্ন না করে বললো,
‘আমি আসছি। ওকে অপেক্ষা করতে বলো।’
মায়মুনা জামান চমকালেন। কি হলো ব্যাপারটা? তাহির একবারও জানতে চাইলো না কেনো কে এই মেয়ে? তাহিরের সাথে কি পরিচয় তার? ভাবনাগুলো থামছে না তার। মেয়েটিকে যে আরো কিছু প্রশ্ন করবেন তারও উপায় নেই। ভয়ে বা লজ্জায় জড়সড় হয়ে আছে সে। মায়মুনা জামান লেবুর শরবত দিলেন। সে খেলো না। চুপটি করে মাথা নুইয়ে বসে রইলো। প্রায় মিনিট পঁচিশ এভাবে বসে থেকে বললো,
‘ওয়াশরুম ইউজ করতে পারি?’
মায়মুনা সায় জানালেন। ফুলকে ডেকে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বললেন। হৃদি তুমুল কৌতুহল নিয়ে বললো,
‘ফুপি, এ কে গো? ভাইয়ার বান্ধবী?’
বিরক্ত চোখে তাকালেন মায়মুনা। বললেন,
‘দেখে মনে হয় এই মেয়ে তাহিরের বান্ধবী? বেশি হলে মেয়েটায় বয়স উনিশ হবে। আর তাহির ত্রিশ। এগারো বছরের পার্থক্য।’
হৃদি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হঠাৎ বললো,
‘ভাবির বান্ধবী?’
‘তাও তো মনে হচ্ছে না। আর মেয়ে তো হিমির নাম একবারও উচ্চারণ করলো না। এসে থেকেই ‘তাহির ভাই, তাহির ভাই’ করছে।’
হৃদি সন্দিহান গলায় বললো,
‘ভাইয়ার বোন! মানে কোনোভাবে ভাইয়ার বাবার বাড়ির সম্পর্কের আত্মীয় নয় তো?’
ধাতস্থ হলেন মায়মুনা। হতে পারে। ও বাড়ির সাথে মায়মুনার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তাহিরের ছিলো। মাঝে মাঝেই তাহিরকে তাদের সাথে ফোনে কথা বলতে শুনেছেন মায়মুনা। আটকান নি। তিনি চান নি তাহির তার দাদা দাদু, বা জ্যাঠাদের সাথে সম্পর্ক চ্যুত করে। মনে মনে ভাবলেন এই মেয়েটি কার মেয়ে হতে পারে। ক্যালকুলেট করে যা পেলেন তা হলো তাহিরের এক কাকুর তখন সদ্য বিয়ে হয়েছিলো। এই মেয়েটি নিশ্চয় ওনার? তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন। মেয়েটি ওয়াশরুম থেকে ফিরে আবারও বললো,
‘তাহির ভাই আসেন নি?’
মায়মুনা মাথা নাড়লেন। বললেন,
‘চলে আসবে। বসো।’
মেয়েটি বসলো। মায়মুনা মেয়েটি পর্যবেক্ষন করে বললেন,
‘তোমার বাবার নাম জামাল?’
মেয়েটি স্বাভাবিক ভাবেই মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো। মায়মুনা মনে করে করে আরো কয়েকজনের নাম বললেন। প্রত্যেক বারই মেয়েটি না জানালো। ক্লান্ত বোধ করলেন মায়মুনা। সদর দরজা খোলা দেখে হিমির কিছুটা কৌতুহল জাগলো। ঘরের ভেতর উঁকি ঝুকি মেরে তবেই ঢুকলো সে। মায়মুনা হিমিকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে বললেন,
‘সময়ের খোঁজ রাখা লাগে না? কখন বেরিয়েছিলে আর কখন ফিরেছো? লাঞ্চ করে এসেছো না কি করো নি?’
হিমি জবাব দিলো না। তার দৃষ্টি তখন সোফায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে। মেয়েটিও লক্ষ করলো হিমিকে। হিমি মায়মুনাকে পাশ কাটিয়ে মেয়েটির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। শুকনো হেসে বললো,
‘তুমি? কেমন আছো?’
মেয়েটি হাসলো। হাসি মুখে বললো,
‘ভালো আছি ভাবি।’
‘কখন এলে?’
‘একটু আগেই।’
মায়মুনা চমকালেন। হৃদি মুখ হা করে হিমি আর মেয়েটির কথোপকথন শুনলো। তারপর উৎসাহ নিয়ে বললো,
‘ভাবি? তুমি চেনো একে?’
হিমি জবাবে বললো,
‘হ্যা চিনি। বাচ্চা ডাক্তার পরিচয় করিয়েছিলেন।’
মায়মুনা হটকারিতা করে বললেন,
‘পরিচয় করিয়েছিলো কেনো? কি সম্পর্ক ওর সাথে? আমায় তো কখনো বলে নি ওর কথা।’
হিমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সরে দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে বললো,
‘আপনাকে বলতেই বোধ হয় আজ ও এখানে এসেছে।’
‘তাহির তোমায় আসতে বলেছিলো?’
মেয়েটি উঠে দাঁড়ালো। ভয়ার্ত গলায় বললো,
‘না। আমি নিজে থেকেই এসেছি। তাহির ভাই বলেছিলেন এসে ওনার খোঁজ করলেই হবে।’
মায়মুনা মেয়েটির কথার আগামাথা বুঝলেন না। তিক্ত গলায় বললেন,
‘এই মেয়ে? কি নাম তোমার? ঝটপট সত্যি বলো। নাহলে এক মুহুর্তও এখানে থাকা যাবে না। বলো কি নাম?’
‘ওর নাম মৃত্তিকা।’
মেয়েটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হিমি বলে দিলো। মায়মুনা অবাক হলেন। মৃত্তিকা। নামটা শুনা শুনা লাগছে। কোথায় শুনেছেন ভাবতে গিয়েই মনে পরলো। তিনি সেটা মানতে পারছেন না। মনে প্রাণে চাইছেন যেনো ওনার ভাবনা ভুল হয়। যেনো এই মৃত্তিকা সেই মৃত্তিকা না হয়। বিধিবাম। তাহির আসতেই খোলসা হয়ে গেলো পুরো বিষয়। তাহির শীতল গলায় জানালো মায়মুনা যা ভাবছেন একদম ঠিক ভাবছেন। এই মৃত্তিকাই মিতার মেয়ে। তৌসিফ মাহমুদ আর মিতার মেয়ে। মায়মুনার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পরলো। তাহির এই মেয়েটিকে কবে থেকে চেনে? কি করে পরিচয় হলো? এই মেয়ে এ বাড়ি কেনো এসেছে? হাজারটা প্রশ্ন মাথায় গোলমাল পাকাচ্ছে। অথচ ওনার গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। শান্ত চোখে তাহিরকে দেখে তিনি নিজের শোবার ঘরে চলে গেলেন। দরজা ভেজিয়ে রেখে রুম অন্ধকার করে খাটে শুয়ে পরলেন।
চলবে,,,,,,,,,,,
[আজ এইটুকুই লিখতে সক্ষম হলাম। দুঃখিত দেরি হওয়ার জন্য। ঈদের আগের দিনে ব্যস্ততা কারো অজানা নয়😪। যাই হোক, ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
সবাইকে অগ্রীম ঈদ মোবারক। ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো।]