হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৬৩.
গভীর রাত। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে মুখরিত সব। মায়মুনা জামান সেই দুপুর থেকেই শোবার ঘরে বসে আছেন। এক মুহুর্তের জন্যও বের হন নি। কেউ বার করতেও পারে নি। তাহির এসেছিলো সবকিছু বলতে, বুঝাতে। তিনি শুনেন নি। তাহিরকে দেখে চোখ বোজে উল্টো ঘুরে কাত হয়ে ঘুমানোর ভং ধরেছিলেন। মায়মুনার যখনই ভয়াবহ রাগ হয় তিনি চুপ করে যান। একদম শান্ত নদীর মতো থাকেন। তাহির হয়তো ওনার এই গুণটাই পেয়েছে। গুণ নয় যদিও, দোষ। তবে তাহির রেগে থাকলেও কথা বলে এমন ভাব করে যেনো কিছুই হয় নি। আর মায়মুনা কারো সাথে চোখও মেলান না। তিনি যে রেগে আছেন সেটা ওনার চুপ করে থাকা দেখেই বুঝে যায়। নিজেকে সবার আড়ালে রেখে মনে রাগ পুষতে থাকেন।
সারাটা বিকেল এভাবেই কেটে যায়। সবাই ভাবে রাগ ঠান্ডা হলে মায়মুনা নিজ ইচ্ছাতেই বাইরে আসবেন। কিন্তু আসেন নি। হয়তো রাগ ঠান্ডা হয় নি ওনার। সন্ধ্যার দিকে হৃদি, ফুল এসেছিলো তাদেকে গম্ভীর কন্ঠে বেরিয়ে যেতে বলেছেন। ওনার মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো নেই বলেই ওরা বেরিয়ে গেছে। তাহির তখন হাসপাতালে ছিলো। রাতে বাড়ি ফিরে জেনেছে মা এখনো ঘর থেকে বের হন নি। ফর্মাল পোশাক না পাল্টেই সে মাকে ডাকতে গেছে। বিনিময়ে তিনি আবারও শুয়ে পরার অভিনয় করেছেন। দুপুর থেকেই কেউ কিছু খায় নি। মায়মুনা খাচ্ছেন না বলেই হয়তো কেউ খেতে পারছে না। মৃত্তিকাকেও খাওয়ানো যায় নি। বেচারি মায়মুনার এমন ব্যবহার দেখে চলে যেতে চেয়েছিলো। তাহির আটকে দিয়েছে। ডিনার টাইমে জোর করে একটা পাউরুটি খাওয়ানো হয়েছে তাকে। বাকিরা উপোস। হিমি এবার দায়ভার কাঁধে নিলো। সে জানে তার কথা মায়মুনা শুনবেন না। বরং রাগ বেড়ে যাবে ওনার। তবুও চেষ্টা করতে হবে তাকে। বহু ভেবে চিন্তেই হিমি ওনার ঘরে ঢোকে। মায়মুনার ঘর নিকষ অন্ধকারে নিমজ্জিত। হিমি হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে ঘর আলোকিত করে। মুহুর্তেই চোখ মুখ কুঁচকে হঠাৎ জ্বলে ওঠা বাল্বের দিকে তাকান। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আলো আড়াল করার চেষ্টা করেন। চোখে আলো সয়ে যেতেই দরজার দিকে তীক্ষ্ণ নজর দেন তিনি। সাথে সাথেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠে। হিমি তার আগের পোশাকে আছে। গায়ে অফ হুয়াইট শার্ট আর পরনে কালো জিন্স। এইটুকুই যথেষ্ট মায়মুনার রাগ বেড়ে যাওয়ার। হিমি শিওর ছিলো ওকে এই বেশে দেখে মায়মুনা গর্জে উঠবেন। অথচ মায়মুনা টু শব্দও করলেন না। মুখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন। হিমি প্যান্টের পকেটে হাত গুজে ধীর পা ফেলে মায়মুনার খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো। গলা পরিষ্কার করে বললো,
“শাশুড়ি মা? খুব রাত হয়ে গেছে তো। খাবেন কখন?”
মায়মুনা জামানের শান্ত গলার উত্তর,
“খাবো না আমি।”
“আচ্ছা। তাহলে ঘুমাবেন কখন?”
“যখন ঘুম পাবে তখন ঘুমাবো। যাও তুমি।”
হিমি নড়লো না। কৌতুহলী গলায় বললো,
“তারমানে আপনার ঘুম পায় নি?”
মায়মুনা জবাব দিলেন না। আড়চোখে হিমিকে দেখে মনে মনে গালমন্দ করলেন। হিমি হাত পা নাচিয়ে নাচিয়ে জানালা খোলে দিলো। বাতাসের সাথে সাথে বৃষ্টির পানির ঝাপটা ঘরে প্রবেশ করতে শুরু করে। মায়মুনা জামান উঠে দাঁড়ালেন। গর্জন করে বললেন,
“জানালা খুলেছো কেনো? দেখছো না বৃষ্টি হচ্ছে? বন্ধ করো জলদি।”
হিমি জানালা বন্ধ করলো না। বরঞ্চ পর্দা সরিয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে খনিক সময় পার করলো। তারপর ফিরে এলো মায়মুনার কাছাকাছি। ওনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনার বৃষ্টি ভালো লাগে না?”
“না।”
“কেনো?”
“কেনোর কোনো উত্তর নেই। আমার মাথা গরম এখন। আর গরম করিও না। যাও এখান থেকে।”
হিমি মায়মুনার কথায় পাত্তা না দিয়ে খাটে এসে বসলো। হাত দুটো কোমরের দু পাশে রেখে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। বললো,
“শাশুড়ি মা? মৃত্তিকা সকাল থেকে কিছু খায় নি। পেট ব্যথা করছে তার।”
মৃত্তিকার নাম শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন মায়মুনা। কর্কশ গলায় বললেন,
“আমি বলেছি না খেয়ে থাকতে? খাচ্ছে না কেনো? ওর তাহির ভাই আছে না! ওর তাহির ভাইকে বলো খাওয়াতে। যাকে তাকে যখন ঘরে তুলতে পেরেছে তখন খাওয়াতে বাধা কিসের?”
হিমি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো,
“বাচ্চা ডাক্তার ওতো খায় নি। আমিও খাই নি। হৃদিও খায় নি। ওহ হ্যা, ফুলও খায় নি।”
“না খেলে না খাবে। আমার এতো নাটক করার সময় নেই। এই মেয়ে? বেরোও তো। ঘুমাবো আমি। রাগ বাড়িও না বলে দিচ্ছি।”
হিমি উঠে দাঁড়ালো ঠিক তবে গেলো না। মুখ ফুলিয়ে বললো,
“শাশুড়ি মা বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। যাই?”
“শখের কমতি নেই দেখছি। একদিন খালি ঘরের বাইরে বেরোই নি আর তাতেই বেশ ভুষা পাল্টে ফেলেছো। এখন আবার মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইছো। তুমি আমার মেয়ে হলে দেখতে। সেই কবেই ঠিক করে দিতাম। লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছো। কোনটা বাপের বাড়ি কোনটা শ্বশুরবাড়ি সেই জ্ঞানও নেই। অসহ্যকর।”
“আমার মা বেঁচে থাকলে আমি ঠিক থাকতাম। উনি নেই বলেই আজ আমার এই হাল। তাই না?”
মায়মুনা জামানের মুখটা ছোট হয়ে গেলো। রাগ কিছুটা পরলো বলে বোধ হলো। হিমি তাৎক্ষনিক বলে উঠলো,
“মৃত্তিকারও মা নেই।”
মায়মুনা শুনেও শুনলেন না। হিমি নিজ থেকেই বলতে লাগলো,
“বাচ্চা ডাক্তারের বাবা শুধু আপনাকে আর বাচ্চা ডাক্তারকে ফেলে যান নি। মৃত্তিকা আর তার মাকেও ফেলে গেছেন। আপনি যে কষ্টটা পাচ্ছেন সে কষ্টটা মৃত্তিকার মাও পেয়েছেন এক সময়। ওনার মেয়ের কি দোষ শাশুড়ি মা?”
“যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলো না হিমি।”
“আপনি তো বুঝেন। তাহলে কেনো কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন। মৃত্তিকার বাবা মায়ের দোষটা ওর ঘাড়ে না চাপালেই নয়?”
“ওরা যা করেছে তা দোষ নয়। পাপ। গুনাহ। ওদের পাপের ফল ওই মেয়ে। অবৈধ মেয়ে। যেখানে ওই মেয়ের সাথে কোনো সম্পর্কই আমি রাখতে চাই নি সেখানে তোমার স্বামী তাকে ঘরে নিয়ে এসেছে। তার সাথে এতগুলো বছর যোগাযোগ রেখেছে। সেটা কি দোষের নয়?”
“আমার তো তা মনে হয় না। এখানে দোষের কি? আঙ্কেল আন্টির দোষ বা আপনার কথায় পাপ ও কেনো বয়ে বেড়াবে? আঙ্কেল আন্টির সম্পর্ক অবৈধ ছিলো সন্তান নয়। সন্তান কখনো অবৈধ হয় না। আর তাছাড়া বাচ্চা হওয়ার আগেই ওনারা বিয়ে করেছেন। সেক্ষেত্রে বাচ্চা বৈধ হয়েছে। মৃত্তিকাকে অবৈধ বলে তাকে আর কষ্ট দেবেন না।”
“চুপ। আর কথা না। আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।”
“না বললে কি করে হবে? এভাবে রাগ পুষে রেখে তো কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে বরং রাগ ঝেড়ে ফেলুন। যা যা মনে আসছে বলুন। চিৎকার করুন, ধমকান, বকা দিন। দরকার পরলে আপনার ছেলেকে দু চারটা থাপ্পড়ও দিন। দোষ তো উনিই করেছেন। একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়েকে দেখে বড়দের বিদ্বেষ, ভুল, পাপ ভুলে গেছেন। মেয়েটাকে আদর করেছেন, ভালোবেসেছেন। মেয়েটির মা মারা যাওয়ার পর তাকে দেখভাল করার জন্য যখন কেউ ছিলো না তখন মেয়েটিকে অনাথ আশ্রমে দেখতে যেতেন। লুকিয়ে লুকিয়ে তার জন্য চকোলেট কিনতেন, পুতুল কিনতেন। প্রতি মাসে মেয়েটির সাথে দেখা করতে যেতেন। ওই বাচ্চা মেয়েটাতো জানতো না বাচ্চা ডাক্তার তার কি লাগে। বাচ্চা ডাক্তারই তাকে বুঝিয়েছেন তিনি তার ভাই। বছরের পর বছর তাকে বোনের মতো স্নেহ করে গেছেন। আগলে রেখেছেন। সমস্ত দোষ তো ওনার। চলুন, ওনাকে থাপ্পড় মারবেন চলুন।”
কথাটা বলেই মায়মুনা জামানের এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় হিমি। মায়মুনা জামান হাত ছাড়িয়ে নেন। খাটে বসে গমগমে গলায় বলেন,
“এসবের দরকার নেই। আমি কে ওর? আমায় কিছু বলা, জানানো প্রয়োজন বোধ করে না কি? তার উপর বিয়ে হয়েছে বউ আছে। এখন তো তুমিই সব। ওই মেয়ের কথা আমি জানি না তুমি জানো। এর চেয়ে বড় অপমান আর কি আছে?”
“উনি আপনাকে সব বলে দিলে আপনি মেনে নিতেন? যোগাযোগ রাখতে দিতেন মৃত্তিকার সাথে?”
“দিতাম না। কিছুতেই না। যতোই ওর বাবা মা বিয়ে করুক ওদের সম্পর্ক বৈধ ছিলো না। পরকীয়ায় জন্ম ওই মেয়ের। ছি!”
হিমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
“তাতে ওর কি দোষ শাশুড়ি মা? ওর জন্ম তো ওর হাতে ছিলো না। ওর বাবা মা চেয়েছেন বলেই জন্ম হয়েছে ওর। এখানে তার গায়ে অবৈধের ট্যাগ লাগানো কি যুক্তিযুক্ত? আচ্ছা, আঙ্কেল কেনো পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন?”
জবাব দিলেন না মায়মুনা। শ্বাস প্রশ্বাস তুমুল গতিতে উঠানামা করছে ওনার। হাত পা কাঁপছে মৃদু। কপালে ঘাম জমেছে।
“পরকীয়া পাপ। আঙ্কেল পাপ করেছেন। সেই পাপের দায়ভার আঙ্কেল আর মিতা আন্টির উপরই বর্তায়। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না আপনিও কিছুটা অংশীদার এতে?”
মায়মুনা এবারও চুপ করে রইলেন। হিমি মায়মুনার সামনে হাটু গেড়ে বসে বলে,
“মৃত্তিকা কিন্তু এখনো জানে না ওর বাবা কে। এটাও জানে না ওর মা আর বাচ্চা ডাক্তারের মা আলাদা।”
মায়মুনা গোল গোল চোখে তাকালেন। হিমি শীতল গলায় বললো,
“মৃত্তিকার বয়স এক বছর হতেই ওর মা মারা যান। তারপর থেকে অনাথ আশ্রমে থেকে বড় হয়েছে। বাচ্চা ডাক্তার ওকে বলেছেন পারিবারিক সমস্যার কারনে ওকে ওখানে থাকতে হবে।”
“এতো বছর যখন ওখানে থেকেছে তাহলে এখন কেনো থাকতে পারছে না?”
রাগান্বিত গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন মায়মুনা। হিমির শান্ত গলার জবাব,
“মৃত্তিকার বয়স আঠারো হয়েগেছে কয়েক মাস আগেই। আঠারো বছর হলে অনাথ আশ্রমে থাকা যায় না। অনেকে তো আগেই পরিবার পেয়ে যায়। যারা পায় না তারাই থাকে। মৃত্তিকা পেয়েছিলো বাচ্চা ডাক্তার তাকে অন্য কারো সাথে দিতে চান নি। অনাথ আশ্রমে মাসে মাসে একটা পর্যাপ্ত এমাউন্ট দান করতেন। তাই অথোরিটি ওনার কথা রাখতো। কয়েক মাস আগেই যখন মৃত্তিকা ওখান থেকে বের হয় তখন বাচ্চা ডাক্তার তাকে অন্যত্র থাকার জায়গা দিয়েছিলেন। এবাড়ির ঠিকানাও দিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন সমস্যা হলে যেনো সোজা বাড়ি এসে উঠে। আমার তখনই মৃত্তিকার আসে আলাপ হয়। আজ নিতান্তই বাধ্য হয়ে বাড়ি এসেছে মৃত্তিকা। আর সব থেকে বড় কথা ও জানে এই বাড়িটা ওর। বাচ্চা ডাক্তারের মা ওর মা। আপনি যখন কাউকে কিছু না বলে ঘরে চলে এসেছিলেন তখন থেকেই ঘাবড়ে আছে মৃত্তিকা। ও তখনই জেনেছিলো আপনি বাচ্চা ডাক্তারের মা। অর্থাৎ ওর মাও।”
কটমটে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হিমির দিকে তাকালেন মায়মুনা। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“আমি ওর মা নই।”
“সেটা আপনি জানেন। বাচ্চা ডাক্তারও জানেন। মৃত্তিকা জানে না।”
“তাহলে জানাও। ওকে বলো ওর মা আমার ছেলের বাবাকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। ওকে বলো ওর মায়ের জন্য আমার ছেলের মাথার উপর থেকে বাবার ছায়া সরে গেছে। জানিয়ে দাও সত্যিটা।”
“বাচ্চা ডাক্তার এগারো বছর অব্দি বাবার আদর, ভালোবাসা, স্নেহ পেয়েছেন। মৃত্তিকা এক সেকেন্ডের জন্যও পায় নি। আপনি আপনার ছেলেকে আজীবন কাছে রেখেছেন মৃত্তিকা সবে এক বছর মায়ের সংস্পর্শে ছিলো। আপনারা ছাড়া ওর কেউ নেই শাশুড়ি মা।”
কঠিন গলায় মায়মুনা প্রত্যুত্তর করলেন,
“আমরাও ওর কেউ না। না আমি আর না তাহির। আমি বুঝতে পারছি না তাহির কেনো ওই মেয়েকে এসব বলেছে। কেনো তাকে মিথ্যে বলে আশ্বাস দিচ্ছে। এখন তো মেয়েটা বাচ্চা নয়। বুঝতে শিখেছে। তাহিরকে বলো বুঝাতে। তাহিরের সব কথা মানতে পারলে এ কথাটাও অনায়াসে মানবে।”
হিমি বাঁকা হেসে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“আপনিই বলুন আপনার ছেলেকে। আমার কথা উনি শুনেন না। আপনি বললে ঠিক শুনবেন। পাঠাবো?”
মায়মুনা মুখ ভার করে চোখ সরালেন। হিমিকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্তির সুর তুলে বললেন,
“ওকে বলো আসতে। আর তুমি পোশাক বদল করো। যাচ্ছে তাই পরে ঘুর ঘুর করবে না বলে দিচ্ছি। চুল আঁচড়ে বিনুনি করো যাও।”
চলবে,,,,,,,