হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:০১

0
3178

উপন্যাস:হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:০১

বৈশাখের প্রায় শেষ ভাগ।সেই দুপুরের পর থেকে আকাশের মুখ ভার ছিলো। অবশেষে আচমকা কেঁদে কুটে অবিরাম গতিতে ঝড়,বৃষ্টি শুরু হলো।তাও চলছে প্রায় তিন ঘন্টা যাবত।একেই বুঝি বলে আকাশ ফুটো হয়ে যাওয়া।আপাতত কমেছে একটু। সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষা কোন একটা গ্রাম।লোনা জলের খালের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে কাঁকড় যুক্ত লালমাটির মেঠোপথ। বর্ষার জলের অবদানে সে লাল মাটি গলে দইয়ের মতো হয়েছে ।যেখানে পা পড়ছে সেখানকার মাটি যেন আহ্লাদে গলে খসে আটখানা হয়ে পরছে। বনের মধ্যকার কাঠ,মধু,মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদি সংগ্রহ ও বিক্রয় করে চলে এখানকার মানুষের জীবন জীবিকা।কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের দল ব্যাস্তশন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে চলেছে কোথাও, গন্তব্য বনের প্রায় মধ্যভাগে নবনির্মিত অস্থায়ী বনদেবীর মন্দির।যেখানে আগামী কালই ঘটা করে অনুষ্ঠিত হবে বনমাতার উদ্দেশ্যে ধ্বনি নামক বনদেবীর পূজা।জঙ্গলে যারা বিভিন্ন কাজ করে জিবিকা নির্বাহ করেন তাঁরাই মূলত মহা ভক্তি শ্রদ্ধা ভরে পূজাটি সম্পন্ন করে থাকেন।দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন আসে এই “ধ্বনি” দেখতে।আসল কথা এই দু’ চার দিন বনবিভাগের কড়া নির্দেশনা একটু শিথিল করা হয় সবার জন্য। এখানকার মানুষের বদ্ধমূল ধারণা এই পূজা করলে তাদের কল্যান হয়।বনদেবী তুষ্ট হলে তাদের বিপদাপদের আশঙ্কা কম।যাইহোক,চরম রোষে তারা ধাবিত হচ্ছে সেই পবিত্র মন্দিরের দিকে সেখানে নাকি কেউ ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়েছে এতে যে কি পরিমান অশুভ, অমঙ্গল নেমে আসবে বনের আশে পাশে বসবাস রত মানুষের জনজীবনে সে ভাবনা ভাবলেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মুরুব্বি স্থানীয় ব্যক্তিদের।

বছর চব্বিশ কি পঁচিশের ছেলেটাকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে মন্দিরের খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত গেওয়া গাছটির সঙ্গে। পরনের দামী পোশাক ধুলায় মলিন হয়েছে তার। কয়েক ঘা যে পরেছে শরীরে সেটা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। ছেলেটার উল্টো দিকে হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি চাচেড় উপর বসে ভীত হরিণীর মতো কাঁপছে মেয়েটা।যেন কোন মৃগ শাবক বাঘের মুখে পরেছে।দেখেই যে কেউ বুঝে যাবে এহেন তান্ডব লীলার মুখমুখি এর আগে কখনো হয়নি সে।
বন্দী ছেলেটার ভালো মন্দ কোন কথাই আমলে নিলো না স্থানীয়রা। তাদের একটাই কথা ঝড় বৃষ্টির মধ্যে একটা পুরুষ ছেলে আর একটা কিশোরী মেয়ে এই নির্জন বন বাদাড়ে নিশ্চই কোন সদুদ্দেশ্যে আসেনি?তারা মায়ের মন্দির অপবিত্র করেছে।শাস্তি তো পেতেই হবে।কি করেছে কোন অবস্থায় কে তাদের প্রথম দেখেছে সে উল্লেখ হলোই না।ভীড়ের মধ্য থেকে একজন অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় বলে উঠলো,এই টুকু ছেমরি এত বড়ো পুলাডার লগে ফষ্টি নষ্টি করতেআছো পরাণে ভয়ডর নাই?বাপে মায়ের মুখোত চুনকালি লাগাইবা মনু?মে লোকটা উক্তি টি করলো তার কোমরের কাছে লুঙ্গির ভাঁজ উল্টালে এখনো হয়তো গাঁজার পুরিয়াটা পাওয়া যাবে।বনদেবীর বন্দনায় নয় এ সুখটানের আশায়ই তো পাঁচজনে এসেছিলো এই জঙ্গলে।এসেই বিপত্তি বাধালো।
কেউ বললো হেগো ফরেস্টার আফিসে লইয়া যাওয়া হউক, হেরা যেইডা ভালো বুঝে হরবো(করবে)
আরেকজন বললো,হেইয়া হইবো না।যা হরার (করার)মোগোই (আমাদের)করতে হইবে বুঝলা ব্যাডা।
অবশেষে পাপের বোঝা পাতলা করতে ব্যাভিচারের দায়ে তেরো বছরের কিশোরীর শরীরের কম্পন অগ্রাহ্য করে অতি নির্দয় ভাবে অতি মাত্রায় আধুনিক ধাঁচের এক চব্বিশ বছর বয়সী যুবকের বিবাহের সিদ্ধান্ত নিলেন জঙ্গলের আশে পাশে বসবাসকারী কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক বর্বর জনগোষ্ঠী। তা না হলে এখন যেখানে গ্রাম প্রধানের ডান হাত বা হাত উপস্থিত রয়েছে একটু পরে সেখানে স্বয়ং গ্রামপ্রধান হাজির হবেন । কিন্তু সেটা যে ছেলে, মেয়ে কারো পক্ষেই ভালো হবেনা সেটা বন্দী ছেলেটার বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্কে ভীষণ ভাবে ঢুকে গিয়েছে।তার এখন একটাই চিন্তা,যা হয় হোক, কিন্তু যে করেই হোক এখান থেকে মুক্তি পেতে হবে অতি সত্ত্বর।না হলে এইসব বনদেবীর জংলী চেলাচামুন্ডাদের শিকার হতে দেরী হবেনা ঐ বাচ্চা মেয়েটির। অবশেষে ছেলেটার হাতের অনামিকায় জলজল করা আংটিটা মেয়েটির আঙুলে পরিয়ে দিয়ে আশির্বাদ কর্ম সম্পন্ন হলো।আঙটি টা দু আঙ্গুলে পরলেই পারফেক্ট হতো। দেবীর মূর্তির সামনে আরেক স্তব্ধ মূর্তির অকাল বিসর্জন হলো।না হলো সাত পাক আর না হলো মালা বদল। তবুও সম্পূর্ণ নাম গোত্র পরিচয় বিহীন একটা যুবকের হাতের সিঁদুরে রাঙা হলো এক অনূঢ়া কিশোরীর সিঁথি।প্রস্তুরীভূত মেয়েটির হাতটা যখন ছেলেটির হাতে তুলে দেওয়া হলো তখন সমস্ত ভয়, দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে ছেলেটির সারা দেহে এক অজানা শিহরণ বয়ে গেলো।এমন মোলায়েম হাত আগে কখনো ছোঁয়নি সে।এ শিরহন ভালো লাগার নাকি খারাপ লাগার জ্ঞাতব্য হলোনা ছেলেটির কিন্তু মেয়েটি তখনো ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি।ভেবেই চলেছে একি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে।ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?
সন্ধ্যার আঁধার নামতে চলেছে।ঘটনা ঘটিয়ে যে যার মতো এক পা দুপা করে কেটেও পরেছে।ফরেস্ট অফিসের আলোটা লক্ষ্য করে হেঁটে চলেছে হতবিহ্বল দুই অসম বয়সের নব বিবাহিত দম্পতি। মেয়েটার রেশম কোমল হাতটা তখনো ছেলেটির শক্ত সামর্থ্য হাতের মুঠোয়,ছাড়তেই ভূলে গিয়েছে বোধহয়। সেখানে পুরোহিত যে বৃদ্ধ মানুষটি ছিলেন তিনি যাওয়ার সময় ছেলেটির কাছে এসে অতি স্নেহের স্বরে বললেন,যা হইলো অন্যায় হইলো ব্যাডা। কিন্তু বনমাতার কৃপায় যেডা পাইলা বাইন্দা রাইখো বাপ।এমন জোড়া আর পাইবা না।এই বিয়া অস্বীকার কইরো না।
লোকালয়ের কর্দমাক্ত রাস্তায় এসে ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো মেয়েটিকে, খুকি তোমার নামটা কিন্তু জানা হলো না।একই প্রশ্ন কয়েকবার জিজ্ঞেস করতে নরম মিহি কন্ঠে জবাব আসে,বনলতা।
নামটা সত্য নাকি মিথ্যা বুঝলো না ছেলেটা তথাপি মনে হলো এমন মধুর কন্ঠ ঝংকার বুঝি আর জীবনে শোনেনি সে।

*****
উপরে উল্লেখিত ঘটনার দুই বছর পরে,

নড়াইলের মথুরাপুর (কাল্পনিক) গ্রামের বিত্তবান প্রভাবশালী প্রভাকর রায় চৌধুরীর বিলাসবহুল বাড়িটিতে আলোয় আলোয় ঝলমল করছে।এত এত বাহারী রংয়ের আলোর রোশনাই চারিদিকে তবুও অন্ত পুরে সবার মনের মধ্যে আমাবশ্যার নিকষ কালো অন্ধকার বিরাজমান।প্রভাকর রায় চৌধুরীর একমাত্র ছেলে বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরীর আজ নতুন বৌয়ের হাতে ভাত কাপড়ের থালা তুলে দিয়ে সারাজীবনের দায়দ্বায়ীত্ব নেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সে ছেলে বাপের নাক কেটে, নব বিবাহিতা নারীর সব স্বপ্ন আশা ভঙ্গ করে কয়েক লাইনের এক চিঠি নাকি সান্তনা পত্র প্রিয় বন্ধু মারফত নববধূর হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে সুদূর প্যারিসে। তার একমাত্র স্বপ্ন দেশের একজন স্বনাম ধন্য ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়া।আর সেটা সম্ভব হবে শুধু মাত্র বিদেশ থেকে কয়েক বছরের বিনিময়ে একটা ডিগ্রী অর্জন করলেই।তাইতো নিজের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে কতগুলো আপন মানুষদের স্বপ্ন আশার জলাঞ্জলি দিতে পিছুপা হয়নি বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী।যে, মা বাবার আদরের খোকা আর বন্ধু বান্ধবীদের অতিপ্রিয় রূপ নামে খ্যাতো।পড়াশোনাটা যেমন ফ্যাশন ডিজাইনের উপর সাজসজ্জার দিকেও তেমন হাল ফ্যাশনে চলা ছেলে সে।একটা পনেরো বছর বয়সী মেয়ের আঁচলের তলায় গৃহী হয়ে থাকাটা তার জন্য হাস্যকর আর বোগাস ছাড়া আর কিছুই নয়।যে মেয়ে এখনো স্কুলের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ সেই মেয়েটাকে কি করে মাস্টার্স কমপ্লিট করা বিরূপাক্ষ সহধর্মিণী হিসেবে মেনে নেবে? ভাবতেই মনটা অবসাদে ভরে যাচ্ছে বিরূপাক্ষের ।মা বাবা তার ভালোমানুষীর এই সুযোগ নিলো? অভিমান জমলো খুব তাঁদের প্রতি। পাঁচ বছরেও আর দেশে ফিরছে না সে। ততদিনে বেচারী মেয়েটার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে বাচ্চা কাচ্চা হয়ে গেলেই পাপবোধ থেকে মুক্তি পাবে বিরূপাক্ষ।সে তো আর অমানুষ নয়।একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে সে কখনোই চায়নি। কিন্তু উপায় ছিলোনা। বাবার প্রতি তার ভীষণ অভিমান। তিনি যে পথে হাঁটতে নির্দেশ দেন বিরূপাক্ষ সে রাস্তার আশে পাশে ও ঘেঁষে না। পরিবেশ সব সময় সবার অনুকূলে থাকে না কিনা।তা না হলে বাবা ক্যানো তাঁর মৃত বাবার কথা রাখতে উঠে পরে লাগবে?আর সম্পূর্ণ অচেনা অজানা এক গ্রাম্য কিশোরীকে তার মতো শহুরে সভ্যতায় গড়ে ওঠা এক টগবগে যুবকের সহিত বিবাহ করাবে?তার কপালে কি কিশোরী ভাগ্যের প্রাদুর্ভাব বেশি?প্লেনের মধ্যে নিজের জায়গায় গা এলিয়ে বসে কথাগুলো ভআবছিলো বিরূপাক্ষ ওরফে রূপ।

প্রভাকর রায় চৌধুরীর অন্দরমহলে খুব কড়া নিয়ম চালু আছে। তাঁর কথার অমান্য কেউ করবে তেমন বুকের পাটা ঘড়ে ক্যানো ঘড়ের বাইরে পুরো গ্রামে এমনকি নিজের থানাতেও কারো নেই। বাড়িতে কাজের লোক আছে তিন জন কিন্তু হাতা,খুন্তি, হাঁড়ি, কড়াইয়ে অধিকার শুধু বাড়ির গিন্নিদের।কাজের মানুষের হাতের রান্না রায় চৌধুরী বাড়ির কেউই কোনো দিন খায়নি,এখনো সে নিয়মই ধরে রেখেছেন প্রভাকর চৌধুরী।যিনি এখন এই বাড়ির সর্বময় কর্তা। বাস্তু ভিটে থেকে বেরোলেই যতদূর চোখ যায় শুধু রায় চৌধুরীদের জমিই দৃষ্টিগোচর হয়। একদাগে একশো বিঘা জমি তাঁর।সমস্ত গ্রাম যেখানে প্রভাকর নামক বড়োকর্তার কথায় উঠা বসা করে সেখানে বড়োকর্তার একফোঁটা ছেলেটা বাপের মাথা খেতে ব্যস্ত‌। ছোট বেলায় অত্যন্ত দূরন্ত এবং চঞ্চল হওয়ায় নিজের এবং স্ত্রীর বুকে পাথর বেঁধে একমাত্র ছেলেকে মানুষ করার প্রয়াসে মাত্র বারো বছর বয়সেই কাছ ছাড়া করেছিলেন তিনি।বাক্স প্যাট্রা বেঁধে ছেলের অনিচ্ছা সত্ত্বেও রেখে এসেছিলেন ঢাকায় নিজের বিলাসবহুল দোতলা বাড়িতে যেখানে আগে থেকেই বসবাস করতেন প্রভাকর চৌধুরীর নিসন্তান শ্যালোক এবং তাঁর স্ত্রী।ঢাকা থেকে নিজ শহরের দূরত্ব বেশী না হলেও ঘন ঘন ছেলের আসা যাওয়া নিষেধ ছিলো গ্রামের বাড়িতে। রূপের মা অন্নপূর্ণা দেবী বুকে পাষান বেঁধে স্বামীর সাথে অভিমানে কাটিয়ে দিলেন এতগুলো বছর।এবার তো মানিক ঘড়ে ফিরবে? কিন্তু কি হতে কি হয়ে গেলো।

গ্রামের চঞ্চল ছেলেটা দিনে দিনে শহুরে জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠলো।পড়াশোনায় সব প্রসংশনীয় সাফল্য পেরোতে লাগলো ধাপে ধাপে আর পিতার বুক গর্বে গর্বিত হতে লাগলো।কিন্তু প্রভাকর রায় চৌধুরীর হার্ট এটাকের জোগাড় হলো তখনি,যখন শুনলেন সাইন্স নিয়ে পড়ে এইস.এস.সি তে স্ট্যান্ড করা ছেলে তাঁর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ভর্তি হয়েছে গিয়ে (এন.আই.এফ.টি) মানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজি নামক প্রতিষ্ঠানে।ছেলে ডক্টর হলে গ্রামে একটা ক্লিনিক স্থাপনের যে শুভচিন্তা আগেই করে রেখেছিলেন প্রভাকর রায় চৌধুরী তা সমূলে নির্মূল করে তবে ক্ষান্ত হলো বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী।সবার অলক্ষ্যে নিজের কপালে কড়াঘাত করতে লাগলেন তিনি,এত এত সম্পত্তির মালিক সে আর ছেলে কিনা লেখাপড়া শিখে অন্যের জামা কাপড় বানাবে?সবই কপাল।
একে একে অনার্স,মাস্টার্স কমপ্লিট করে তবে ফিরলো মায়ের কোলে। কিন্তু এতেও ক্ষান্ত হয়নি বিরূপাক্ষ, যেখানে ফ্যাশন ডিজাইনিং এর জন্ম সেখান থেকেই একটা কিছু করা চাই তার।তাইতো অনেক চেষ্টা চরিত্র করে সুযোগ হলো প্যারিসের ই.এস . ইন্টারন্যাশনাল . এ।

ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার পর বিরূপাক্ষ যখন বাড়িতে ফিরলো মাস দুই আগে তখন প্রভাকর রায় চৌধুরী কিডনীর ব্যাথায় মর মর অবস্থা প্রায়। হাসপাতালে ভর্তি হলেন। মৃত্যু ভয় যখন জেঁকে বসেছে মনের মধ্যে তখনই স্বর্গবাসী পিতাকে দেওয়া কথাটা ভীষণভাবে নাড়া দেয় মনের মধ্যে। প্রভাকর রায় চৌধুরীর পিতা ছিলেন প্রবোধ রায় চৌধুরী। স্বর্গীয় প্রবোধ রায় চৌধুরীর গলায় গলায় ভাব ছিলো পাশের গ্রামের শশীশেখর হালদারের সঙ্গে। প্রাচীন যারা আছেন তাঁদের মুখে এখনো শোনা যায় তাদের অটুট বন্ধুত্বের গল্প‌।প্রবোধ রায় চৌধুরীর এত বিশাল বিত্ত বৈভব তখন ছিলো না। কিন্তু বন্ধু শশীশেখর হালদার নিজের পৈত্রিক জমির কিছু অংশ বিক্রি করে অনেক গুলো নগদ টাকা তুলে দেন প্রবোধ রায় চৌধুরীর হাতে।সেই টাকা দিয়ে তিনি ব্যাবসা শুরু করেন। পাটের ব্যবসায় ধন-লক্ষীর কৃপায় দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি পেতে থাকলো। লোহার সিন্দুকে টাকার ভীড় যেমন বাড়তে লাগলো তেমনি সদ্য কেনা নতুন জমির দলিলে ভরতে লাগলো আলমারির দেরাজ গুলো।প্রবোধ রায় চৌধুরী নিজের অসময়ের বন্ধুর কথা কিন্তু সুসময়েও বিস্মৃত হননি। অনেকবার বন্ধুর দেওয়া টাকা গুলো বহুগুনে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন কিন্তু শশীশেখরের অবস্থাও তেমন খারাপ ছিলো না কখনোই। তিনি মধুর হেসে বন্ধুকে বলতেন,
প্রবোধ ছেলের বিয়ে দিয়েছো কিন্তু বুদ্ধি তোমার বাচ্চাটিই রয়ে গেলো। তুমি কি শুধু বন্ধু আমার?অন্তত আমি সেইটে মনে করিনে। নিজের সহোদরের থেকেও আপন ভাবি তোমায়। নিজের একটা ভাই থাকলে তাকে কি সম্পত্তির ভাগ দিতাম না।যা দিয়েছি ওটা তোমার।
প্রবোধ বন্ধুকে গভীর আবেগে আলিঙ্গন করে বলতেন, কিন্তু আমার যে বড্ড ঋণ তোমার কাছে।তার বেলায়?

তুমি বড়লোক মানুষ হয়েও যে এই গরীব বন্ধুর অবদান বিস্মৃত হওনি এটাই কি কম আমার কাছে?শাশ্রু নয়নে বন্ধুকে প্রতিত্তোর করে শশীশেখর হালদার।
জীবনের অন্তিম লগ্নে এসেও তাঁদের এমন বন্ধুত্বে অনেকে সুখবোধ করতো আবার কেউ কেউ ঈর্ষায় জ্বলত। সেভাবেই বছর গড়াতে লাগলো ।প্রবোধ রায় চৌধুরীর ব্যাবসার হাল ধরলেন একমাত্র ছেলে প্রভাকর রায় চৌধুরী।ঘড় আলো করে এলো এক পুত্র সন্তান।তার বেশ কয়েক বছর পরে যখন শশীশেখরের ছেলের ঘড় আলো করে কন্যা রত্নটির জন্ম হলো তখন প্রবোধ রায় চৌধুরী আরেকবার বন্ধুর ঋণ শোধের কথা মনে করে হাতে পায়ে ধরে তাঁর নাতনীটিকে চাইলেন।এবার আর শশিশেখর না করলেন না। নিজের একমাত্র নাতনী ত্ররিতি হালদার এর সাথে প্রবোধ রায় চৌধুরীর একমাত্র বংশপ্রদীপ বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরীর বিবাহের কথা পাকা করে ফেললেন তবে সেটা নিজেদের ছাড়া বাহিরে প্রকাশ করলেন না।পরের প্রজন্ম যদি এই দুই বৃদ্ধের ইচ্ছার মূল্য না দেয় তাহলে আর দুঃখের সীমা থাকবে না ভেবেই।প্রবোধ রায় চৌধুরী মৃত্যু শয্যায় ছেলে প্রভাকর রায় চৌধুরীর হাত দুটো ধরে অনুনয় করেন তাঁর অবর্তমানে যেন তাঁর বন্ধুকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার খেলাপ না হয়।তখন প্রভাকর রায় চৌধুরী পিতার কথাকে শিরোধার্য করলেও পিতার মৃত্যুর পরে কথাটাকে বেমালুম এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকমাস আগে যখন নিজের অসুস্থতায় কুলগুরু মহানন্দ মহেশ্বরের শরণাপন্ন হয়ে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করার কথা বললেন তখন তিনিই সেই পুরোনো কথাটা পাড়লেন। নিজের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে অতি মোলায়েম কন্ঠে পুরোনো কথাটা স্মরণ করিয়ে দিলেন,বাবা, তোমার স্বর্গীয় পিতা তোমার পুত্রের সাথে যে কন্যা কুষ্ঠি মিলিয়েছিলেন সেটা ছিলো রাজযোটক।অমন জুরি আর পাবেনা পুত্রের জন্য।সে কন্যা নিশ্চই তোমার অচেনা নয়।এই মুহূর্তে তাকে ক্যানো ভাবছো না?ভুলে যেওনা তোমার পুত্রের অকাল মৃত্যু যোগ সবাই খন্ডাতে পারবে না।
গুরুদেবের কথা শুনে বসার ঘরে উপস্থিত সবাই আতকে উঠে। এই কথাটা তো মনে ছিলো না ‌।অন্নপূর্ণা দেবী ছেলের বিপদাশংখায় উতলা হয়ে ওঠেন।
প্রভাকর রায় চৌধুরীর ছেলের আচার আচরণে ক্ষোভ থাকলেও পিতৃধর্মের বাইরে যাননি কখনো।ছেলেই যে তার একমাত্র বংশ প্রদীপ।
বিরূপাক্ষ বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকেই ক্যামন থমথমে পরিবেশ দেখে অবাক হয়।কি হলো এদের?
কুলগুরুকে দেখেই এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করে , দাদুর সাথে অনেক বার গিয়েছে ওনার আশ্রমে।দাদু বলেই সম্বোধন করে সবসময়।তাই রসিকতা করে বললো,দাদু হাতখানা দেখে দাও তো।আজকাল বড্ড ফাঁড়া যাচ্ছে।
রূপের সাথে গুরুদেব ও হাসেন।সবার উদ্দেশ্যে বলেন,আমি দাদু ভাইয়ের সাথে একান্তে কথা বলতে চাই।
মিনিট অতিক্রম হওয়ার আগেই ঘড়খানা ফাঁকা হয়ে যায়। রূপের ডান হাতটা টেনে নিয়ে একচিত্তে দেখতে থাকেন এবং ধীরে ধীরে তার চোখ মুখের ভঙ্গি পাল্টাতে দেখে রূপ চিন্তিত হয়।গুরুদেব দেখছেন ওনার গণণা ই ঠিক। কারন বেশ কয়েক বছর আগে রূপের হাত দেখে তিনি বলেছিলেন চব্বিশ বছর বয়সে এ ছেলের বিবাহ যোগ আছে। এখন তো ছাব্বিশ চলে।তিনি মৃদু হাসলেন। রূপের আগ্রহী দৃষ্টি দেখে বললেন,দাদু ভাই তোমার যে জুরি তার কোনো তুলনা নেই।সে হবে অতুলনীয়া তোমার সর্বসের্বা। তোমার সমস্ত দেহ মনে থাকবে তার প্রচন্ড আধিপত্য।যা পেয়েছো দাদুভাই তার যত্ন করো।হেলায় হারিও না যেনো।
বুদ্ধিদীপ্ত রূপের বুঝতে বাকী রইল না গুরুদেবের কথার মর্মার্থ।
সে বিস্মিত, সামনে বসা মহাপুরুষের কথায়।যে কথাটা এই দুটি বছর ঘুনাক্ষরেও কাউকে জানতে দেয়নি সে সেই কথাটা কত অবলীলায় বুঝে গেলেন মানুষটি।সাধেই কি আর দাদুর মতো বিচক্ষণ জ্ঞানী মানুষ তাঁকে গুরু মেনে ছিলেন?

চলবে,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।
ক্যমন হলো বলতে ভুলবেন না যেনো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here