হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:২

0
1233

উপন্যাস:হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:০২

পিতার মৃত্যুর পর তাঁর প্রাণাধিক বন্ধু শশীশেখরের সাথে ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণে সম্পর্কের অবনতি ঘঠে প্রভাকর রায় চৌধুরীর।শশীশেখর হালদার বন্ধু পুত্রকে নিজের পুত্রের মতো দেখলেও সে ছেলে রাজনীতিতে জড়িয়ে পরার পর তার বিভিন্ন কার্যকলাপ দেখে শশীশেখর হালদার নিজেই গুটিয়ে গিয়েছিলেন ঐ সম্পর্ক থেকে।প্রভাকর রায় চৌধুরী ও তেমন একটা গ্রাহ্য করতেন না। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবী শশুর মহাশয় বেঁচে থাকতে তাঁর বন্ধুকে যে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন সেটাই বহাল রেখেছেন। বিভিন্ন পালা-পার্বণে নিজে গিয়ে প্রণাম করে আসেন বৃদ্ধ মানুষটিকে। ছোট্ট ত্ররিতিকে নিজের সন্তানস্নেহ দিতে ভূলতেন না কখনো।ত্ররিতিও বড়মা নামক মানুষটিকে পেলে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দিতো। বয়স কম হলে কি হবে দাদুর মুখে শুনে শুনে ওবাড়ির সাথে নিজের ভাবী সম্পর্কটা বুঝতে পেরে মনে মনে লজ্জায় পরে সে।আগে তবুও স্কুল থেকে ফেরার পথে বা বিভিন্ন পূজায় যেতো ও বাড়িতে কিন্তু এখন যেতে লজ্জা লাগে যদি ঐ মানুষটির সাথে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায়?যার একটা ফটো এখনো অতি যত্নে লুকানো আছে রিতির আলমারিতে।
চৌধুরী বাড়িতে আরো একজন নারী আছে যার সাথে রিতির খুব ভাব।বৌদিদি বলে ডাকে রিতি কিন্তু বয়সের ফারাক বেশি হলেও সমবয়সী সখীর মতো গল্প করে দু’জনে।প্রভাকর চৌধুরীর একমাত্র বোন অল্পবয়সে বিধবা হয়ে যখন বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন তখন তাঁর ছেলে রঘুনাথের বয়স ছিলো আট বছর। অল্পদিনের মধ্যেই স্বামীর শোকে আত্ম হননের পথ বেছে নেন রঘুনাথ এর মা। রূপের তখনো জন্ম হয়নি। অন্নপূর্ণা দেবী একমাত্র ননদের সদ্য মাতৃহারা ছেলেকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন।সেই থেকে রঘুনাথ মামাবাড়িতে নিজের বাড়ির ছেলের মতো মানুষ হয়েছে।জয়া রঘুনাথের স্ত্রী।
সেদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে প্রভাকর রায় চৌধুরী ভাগ্নে রঘুনাথ কে দিয়ে ডাকালেন শশীশেখর হালদার কে। নিজের বন্ধুপুত্রের শরীর খারাপ শুনে তিনি ছুটে যান হাসপাতালে। এতদিন বাদে রূপকে দেখে না চিনলেও রূপ ঠিকই চিনে নিয়েছিলো দাদুকে।তাইতো স্থান কাল ভূলে টুপ করে প্রণাম করে বসে।শশীশেখর অচেনার দৃষ্টিতে তাকায়।হাসছে রূপ। রঘুনাথ জটলা খোলে,দাদু চিনলে না তো?আমাদের ছোট সাহেব গো।কত কোলে কাঁধে নিয়েছো এখন চিনছো না?
শশীশেখর অবাক হয়ে তাকায়, এতদিন কতকিছুই না শুনেছে মানুষের মুখে । কিন্তু শশীশেখরের বিশ্বাস ছিলো এমন ভক্তি পরায়ণ মায়ের ছেলে কখনো বখে যেতে পারেনা তা সে যতই শহুরে সভ্যতায় গড়ে উঠুক। মুখে হাসি টেনে বললেন, বেঁচে থাক দাদু।ঠিক বলেছো রঘু দাদু ভাই সাহেবই বটে তোমার ছোট ভাইটি।রূপ হেসে আলিঙ্গন করে দাদুকে। বৃদ্ধ মানুষটির বুক থেকে একটা ভার নেমে যায় তৎক্ষণাৎ।

কেবিনে ঢুকতেই প্রভাকর রায় চৌধুরী প্রণাম তো করতে পারলেন না কাকা বাবুকে।হাত ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন নিজের ব্যবহারের জন্য।ছেলে,পুত্রবধু হারা শশীশেখরের বুকের ভেতরে আত্মাভিমানে যে দ্বার রুদ্ধ হয়েছিল সেটা উন্মুক্ত হতে সময় লাগলো না।পুত্র স্নেহে অশ্রু সিক্ত হলো কোঠর গত নয়ন দুটি।

পদার্থ বিজ্ঞান বইটা টেনে পড়ছিলো রিতি।গ্রামে রাত নয়টা মানে অনেক রাত মনে হতো যখন সেখানে বিদ্যুৎ লাইন চালু হয়নি।সৌর বিদ্যুৎ এর আলোয় ঝলমল করছে রিতির ঘড়টা।কি যেনো মনে পড়াতে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো রিতি,পিসি,,,ও পিসি গো,,,পিসি,,,,
আটপৌরে ঘিয়ে রঙের সুতি শাড়ির আঁচল টা মাটিতে টানতে টানতে ছুটে আসেন বছর পঞ্চাশ বা পঞ্চান্নেরএক বিধবা মহিলা।
কি হলো মা এমনে ডাকতিছিস ক্যান?

হাসছে রিতি,পিসি তুমি এইভাবে দৌড়ে আসলে ক্যানো?আমি তো ভাবলাম টিভি দেখতে দেখতে চেয়ারেই ঘুমিয়ে গেছো।

পিসি কপট রাগ দেখিয়ে বলে,আমি ভাবলাম শরীলডা আবার খারাপ হইলো কিনা।একি এখনো দুধটুকু খাওনাই মা?শরীল সারবো ক্যামনে কও তো?খাও খাও।
দুধ ভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে তাড়া লাগায় সুমিতা দেবী।

রিতি আহ্লাদ করে বলে,ওরে আমার পিসিমনি এই উঁচু উঁচু একগ্লাস দুধ আমি খাইতে পারিবো না। তুমি অর্ধেক টা খেয়ে আমাকে দাও।
সুমিতা দেবী চোখ পাকায়, ফাঁকিবাজ মাইয়া কোথাকার,গ্লাসে উঁচা উঁচা কইরে দুধ রাহোন যায়?খালি হাবিজাবি কথা।
রিতি খিল খিল করে হেসে ওঠে,পিসি তুমি খেলে খাও না হলে তোমার দুধের গ্লাস নিয়ে যাও।
বিপাকে পড়েছেন সুমিতা দেবী,এই দ্যাকো আমার এঁটো খাইবা ক্যান মা,তুমি খাও ,পরে আমি খায়া নেবো।

আমার এঁটো তুমি খাবে আর তোমারটা খেলে কি আমি তোমার মতো কালো আর মোটা হয়ে যাবো পিসি?

সুমিতা দেবী রিতির রসিকতা বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালেন না।এই মেয়ের মাথায় গন্ডগোল আছে কি কি সব বলে।একছুটে রান্না ঘড়ে গিয়ে আরেকটা গ্লাস নিয়ে আসেন।
রিতি নাক কুঁচকে দুগ্ধ পান করে মনে মনে মজা পায় পিসিকে জব্দ করতে পেরে।
মূলত সুমিতা দেবীর গায়ের রং এমনই ফর্সা যেটা সাংসারিক , মানসিক দুশ্চিন্তা এবং বৈধ্বব্য দশাও ম্লান করতে পারেনি আর মোটা সে মোটেই নয়।রোগা পাতলা টিং টিংয়ে দৈহিক গঠন তাঁর।

দুধ শেষ করে গ্লাসটা রাখতেই শশীশেখর হালদার গলা খাঁকারি দিয়ে রিতির ঘড়ে ঢোকেন।রিতির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সুমিতা দেবী জ্যাঠা মহাশয়কে দেখে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ায়।রিতির পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলে শশীশেখর বাবু,দিদি ভাই অতবড়ো অসুখ থেকে উঠলি সবে, এখনি এত রাত জেগে পড়তে হবেনা তোকে।

রিতি আকাশ থেকে পরে,কি বলছো দাদুভাই?দেড়মাস পরে আজই স্কুলে গেলাম। পরীক্ষা তো এসেই গেলো এখন না পড়লে খাতায় বড়ো সড়ো কয়টা গোল্লা পাবো বুঝলে?শেষে লোকে বলবে,মা,বাবা ছিলেন হাইস্কুলের টিচার আর তাদের মেয়ে দেখো পড়াশুনার গুষ্টি চটকে খেয়ে ফেলেছে। পরীক্ষার খাতায় হাঁস মুরগির ডিমের বিজনেস শুরু করবো দাদু।
শশিশেখর নাতনীর কথায় বড়োই সন্তুষ্ট হন। মেয়েটার লেখাপড়ার আগ্রহটা পেয়েছে ঠিক বাবার মতো।
কিন্তু দিদি ভাই সব হবে।আগে নিজে তো সুস্থ হও।

হ্যা পড়াশোনা ছেড়ে শুয়ে বসে থেকে সব ভুলে যাই আরকি।শেষে বর যদি বিদ্বান হয় দেখা গেলো বাসর রাতে খাট থেকে লাত্থি মেরে নিচে ফেলে দিয়ে বলবে,স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি এমন মেয়ের জায়গা আমার খাটে হবেনা।এরকম অশিক্ষিত,গন্ডমূর্খ বউ চাইনা আমি।ছেলে মেয়ে গুলো সব ব-কলম হবে।

শশিশেখর হা হয়ে আছেন।নাতনী তাহার বড় হয়ে উঠেছে।সুমিতা দেবী রিতির কথার ধরন দেখে মানে মানে আগেই কেটে পড়েছিলেন।মেয়েটার মাথায় সত্যিই গন্ডগোল হয়েছে।

সবুজ শ্যামলে ঘেরা চন্ডীনগর গ্রামটি ।পাশ ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে ঘোলাটে জলের চিত্রা নদী (কাল্পনিক নাম)প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বসবাস গ্রামে। গ্রামের দক্ষিণ দিকেই নদী ।নদীর এপাড়ে চন্ডীনগর ওপাড়ে মথুরাপুর। আধুনিকতার ছোঁয়া এবং স্কুল কলেজ যাবতীয় সবকিছু ওপাড়েই মানে মথুরা পুরে।সেখানে বিদ্যুৎ লাইন চালু হয়েছে বছর কয়েক হলো। আশেপাশে চার পাঁচ গ্রামের ছেলে মেয়েরা মথুরাপুরে স্কুল কলেজে যায়।আগে দুটো স্কুল ছিলো একটা গার্লস স্কুল এবং অন্যটা হাইস্কুল। গার্লস স্কুলে ছেলেরা পড়তে পারে পঞ্চমশ্রেণী পর্যন্ত। কয়েকবছর হলো প্রভাকর রায় চৌধুরী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে অবতীর্ণ হয়ে সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় কলেজ প্রতিষ্ঠা করিয়েছেন।এক জায়গাতেই মথুরাপুর স্কুল এন্ড কলেজ।

বৈশাখের মধ্যভাগ।আকাশে গনগনে কাঠ ফাটা রোদ্দুর।আবাদি জমির মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে মথুরাপুর গ্রামের মেইন রাস্তাটি।পিচঢালা চওড়া রাস্তায় রোদের তেজ পরে আগুনের তাওয়ার মতো তাপ উঠছে। দুই পাশে সমতল ভূমি থেকে রাস্তার উচ্চতা প্রায় পনেরো ফিট।এত রোদের মধ্যেও রাস্তার দুই পাশে অবারিত পাঠক্ষেত গুলো সবুজের খেলায় মেতেছে যেনো।সে দৃশ্য অবশ্যই মনোমুগ্ধকর।যত দূর চোখ যায় শুধু সবুজের দোল আর দোল। রাস্তার দু’পাশে বেশ দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশমনি এবং ছাল, চামড়াহীন অর্জুন বৃক্ষগুলো।এখন যেখানে অগ্নিকুন্ডের তাপ পরন্ত বিকেলের ম্লান সূর্যালোক সেখানে এক মোহময় স্বর্গপুরীতে পরিনত হয়।এই ভরদুপুরে রাস্তার দক্ষিণ সীমানায় দুটো রংচঙে ছাতা এগিয়ে আসছে। ছাতার নিচে মালিক দু’জনের পোশাক দেখে বোঝাই যায় তারা স্কুল থেকে ফিরছিল।যেখানে খালের সাথে নদী মিশিয়ে দেওয়ার জন্য কালভার্ট তৈরী হয়েছে সেখানে আসতেই ছাতার নিচে মেয়ে দুটোকে ডাকলো কেউ কালভার্ট এর নিচ থেকে,এই খুকী একটু দাঁড়াও। এমনিতেই গরমে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় দুজনের তার উপর এই অনাকাঙ্ক্ষিত আহ্বান মোটেও ভালো লাগলো না ওদের।স্যান্ডেলের রবার ভেদ করে পিচের থিম যেনো সমস্ত শরীরময় নৃত্য করছে। অগত্যা
মেয়ে দুটি থেমে গিয়ে দেখলো খালের পাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে আসছে কেউ একজন।আগন্তুকের চেহারাটা স্পষ্ট হতেই বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ শুরু হয়েছে রিতির,
এই রোদের মধ্যে মানুষটা করছেটা কি?পরনে কালো কাপড়ের হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট,গায়ে ছাই রঙের গোল গলার টি শার্ট টা ঘামে ভিজে আটো সাটো হয়ে মিশে আছে।ফর্সা মুখটা গরমের তেজে লাল রংয়ে পরিনত হয়েছে। এলোমেলো কয়েক গোছা চুল কপালে ঘামের সাথে লেপ্টে আছে।
রাস্তার উপরে উঠে হাফাচ্ছে সে।যা রোদ পরেছে। হাঁফাতে হাঁফাতেই বললো সে,
সরি তোমাদের দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য।বাই দা ওয়ে , তোমাদের ব্যাগে খাওয়ার জল হবে? আমাদের জল শেষ বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।
রিতি এবং সুমি তো অবাক।জল খাওয়ার জন্য এভাবে ছুটে এসেছে?হ্যা এই রোদে হেঁটে হেঁটে পানীয় জলের সার্ভিস দিচ্ছি (মনে মনে বললো রিতি)
কিন্তু ওখানে কি অত মহামূল্যবান কাজ করছে? নিচে উঁকি দিয়ে দেখলো প্রদীপদা বরশি দিয়ে এই ভরদুপুরে মাছ ধরছে।প্রদীপদা তো আবার মানুষটার লেংটা কালের প্রাণের বন্ধু। একেবারে মানিক জোড় যাকে বলে। ব্যপারটা বুঝলো রিতি, ভাগ্যিস আজ টিফিন পিরিয়ডে চলে আসছে না হলে জলের বোতলটা ফাঁকা হয়ে যেতো।জল পানে ব্যস্ত রূপ ।প্রদীপ ততক্ষনে নিজেদের মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে আকাশ মনি গাছের ছায়ায়।
কিরে রিতি এই চুন্নিটার সাথে মিশে স্কুল পালিয়েছিস?সুমিকে ইঙ্গিত করে বললো প্রদীপ।সুমি রাগত চোখে তাকায়।
রিতি সে কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো,
দেখি কি শোল, বোয়াল ধরেছো?নিজেই প্রদীপের হাতে থাকা প্লাষ্টিকের ব্যাগটা ফাঁক করে উঁকি দিলো।
প্রদীপের মুখটা চুপসে যায় কারন সকাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র দুটো কই মাছের বাচ্চা পেয়েছে।

এই মাছের জন্য রোদের মধ্যে ভাজা ভাজা হচ্ছো? মাছের এত আকাল পরেছে ? বিরক্ত প্রকাশ পায় রিতির স্বরে।

প্রদীপ কিছু বলার আগে রূপ খালি বোতলটা এগিয়ে দেয় রিতির দিকে,ধন্যবাদ খুকী,জলের জন্য।

আমি রিতি ।খুকী নই ।ধীর স্বরে উচ্চারণ করে রিতি।রূপ থমকায় কিছুক্ষণের জন্য।কোথাও কি শুনেছে এই শ্রুতিমধুর কন্ঠঝংকার?খুব চেনা চেনা লাগছে স্বরটা।

দিন দুয়েক পরে, সন্ধ্যা উতরেছে সবে চৌধুরী মহলে বসার ঘড়ে বৈঠক চলছে।ঘড়োয়া বৈঠক বললে ভুল হবে না। বৈঠকের মূল কেন্দ্রবিন্দু রূপ আর বিষয়বস্তু হলো রূপের শুভ বিবাহ।
দুপুরের দিকে এমন একটা ছোট মিটিং চলছিলো চন্ডীনগরে হালদার বাড়িতে।আজ বহুদিন পর প্রভাকর রায় চৌধুরী ওবাড়িতে পা রেখেছিলেন।শশীশেখর হালদার এর কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং মৃত পিতার অন্তিম ইচ্ছার কথাটা যাতে বাস্তবে রুপ নেয় তার জন্য বিনীত অনুরোধ করলেন।শশীশেখর ও এতদিন অন্তর্দহনে দগ্ধ হচ্ছিলেন এটা ভেবে যে, প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেওয়া কথাটা বোধ হয় রাখতে পারলেন না।প্রভাকরের কথায় মনের কোণে আশার সঞ্চার হলো। তবুও তিনি বললেন,দেখো বাবা,এই মুহূর্তে দিদিভাইয়ের বিয়ের বয়সটাও হয়নি। রূপ দাদুভাই সবে পড়াটা শেষ করলো।এত তাড়াহুড়া ক্যানো তবে?
কাকা বাবু, আমার শরীরটা তেমন ভালো নয়,তাতো আপনি জানেন।খোকার ও যথেষ্ট বয়স হয়েছে তাই আমি চাই আপনার সামনে বাবার ইচ্ছে টা যেনো পূরণ হয়।
তোমার ছেলের সাথে কথা বলেছো এই ব্যাপারে?
এখনো বলিনি।তবে ওর অমত হবে না।দাদুকে ও ভীষণ ভালোবাসতো।

আবেগের বশে ভুল করোনা প্রভাকর ।ছেলে তোমার শহুরে সভ্যতায় মানুষ। নিজের পছন্দ অপছন্দ থাকতে পারে।শেষে বিরম্বনার শেষ থাকবেনা। আমার দিদি ভাইয়ের সুখের চেয়ে কোনো কিছুই দামী নয় আমার কাছে।

নাতনীর ভবিষ্যতের ভাবনায় মনে মনে দ্বিধান্বিত হলেও মৃত বন্ধুর কথাটা স্মরণ করে অবশেষে মত দিয়ে দিলেন প্রভাকরের কথায়।

বাবার মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে রূপ বিস্মিত।কি প্রতিক্রিয়া এই মুহূর্তে দেখানো উচিত বুঝে উঠতে পারলো না।তথাপি খুব শীতল গলায় বললো,বাবা এই মুহূর্তে বিয়ে শাদীতে জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রভাকর রায় চৌধুরী হুংকার ছাড়লেন, সম্ভব অসম্ভব তোমার কাছে জানতে চাইলো কে?
আমিতো শুধু কথাটা তোমাকে জানালাম।আজ পনেরোই বৈশাখ ,আগামী বাইশে বৈশাখ তোমার আর ত্ররিতির বিয়ে । সেভাবে তৈরী হও।বন্ধু বান্ধব দের ডেকে নাও।
রূপের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো এবার। উচ্চ স্বরে বলে,আমি পারবোনা এই বিয়ে করতে।আমাকে কি খেলার পুতুল মনে হয় তোমাদের? একটা চৌদ্দ পনের বছরের বাচ্চা মেয়েকে আমার বিয়ে করতে হবে?এটাও সম্ভব? একরত্তি একটা মেয়েকে তোমরা আমায় গছিয়ে দিচ্ছো।ওই মেয়ে কখনো খাপ খায় আমার সাথে। বন্ধুদের কাছে মান সম্মান থাকবে এই মেয়েকে বিয়ে করলে?লোকেই বা কি বলবে ? বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী অবশেষে বাল্য বিবাহ করলো?
রঘুনাথ ও তার স্ত্রী জয়া এগিয়ে যায় রূপের দিকে। থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আজ তো অনেক দিনের রাগ ক্ষোভ ঝাড়তে চায় রূপ।

পড়া শেষে চুল গুলো আঁচড়ে নিচ্ছিলো রিতি।মাস তিনেক আগে টাইফয়েড হয়ে চুল পড়ছিলো খুব। তখন পিসিমা মাথাটা ন্যাড়া করে দিলো।ঘন কালো চুলে মাথাটা ভরে উঠেছে ঠিকই কিন্তু সেই জ্বরে চেহারার যে লাবণ্যটুকু হারিয়েছে সেটা এখনো ফেরত আসেনি।
দাদু ঘড়ে ঢুকতেই ফিরে তাকায় রিতি। তিনি বিছানায় বসে কাছে ডাকেন রিতিকে। ধীরে সুস্থে দুপুরের কথাটা তোলেন।রিতি হঠাৎ আনমনা হয়ে পরে।হতে পারে সে সবে মাত্র কৈশরে পদার্পন করেছে। না ফোঁটা কুড়ি কিন্তু সেই রুদ্ধ কুঁড়ির সমস্ত টা জুড়ে রয়েছে ঐ মানুষ টা।রিতি হয়তো প্রেম বুঝেনা কিন্তু কারনে অকারণে যে, আজকাল মানুষটিকে ভেবে শিহরিত হয় সেটা তবে কি?

কি হলো দিদিভাই,আমি কি তবে কথা দিয়ে ভুল করলাম?

দাদু ভাই,অনেকবছর পরে আজ সামনে থেকে দেখেছি উনাকে। অত সুন্দর মানুষটার পাশে আমাকে মানায় না। কত পড়াশোনা করেছেন,সেখানে সব শিক্ষিত,সুন্দরী মেয়েদের চলাফেরা ,তাঁর যদি কারো প্রতি মন লেগে থাকে? তখন কি হবে দাদু? চাঁদকে দূর থেকে দেখলে যতটা শান্তি , কাছে গেলে ততটা হবে কি?
শশীশেখর মৃদু হাসলেও নাতনীর কথার গভীরতা টুকু অনুধাবন করেন, কিন্তু এটুকু বিশ্বাস তিনি করেন তাঁর দিদি ভাইয়ের সৌন্দর্যের কাছে অন্য সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যাবে শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের শ্রেষ্ঠ চরিত্র মা যার আছে তার কি আর মতামত বলতে কিছু থাকে? সেদিন বাড়ির সবার সম্মুখে কোন তর্জন গর্জন ই কাজে আসেনি রূপের ।তাইতো বউ ভাতের দিনে সবার অলক্ষ্যে অবিবেচক এর মতো একটা কাজ করে বসলো সে। বিবাহের শেষে বিদায় বেলায় যখন বৃদ্ধ দাদু সজল নয়নে রিতির হাতটা। রূপের হাতে সপে দিলেন রূপ অস্ফুট স্বরে বলল,জীবনটা আমার বরবাদ করে ছাড়লো।
উপরে যিনি অদৃশ্য হয়ে বসে আছেন তিনি মুচকি হেঁসে সে কথার প্রতিউত্তরে বললেন হয়তো,বরবাদ নয় বৎসো, তোমার মনের বরবাদ জমিন আজ থেকে আবাদ করে দিলাম,,

চলবে,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
সবাই ভালো থাকবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here